আষাঢ়ে_প্রেম_শ্রাবণে_পরিণয় শেষপর্ব(২য় খন্ড)

0
831

#আষাঢ়ে_প্রেম_শ্রাবণে_পরিণয়
#লেখিকা_সুমাইয়া_জাহান
#শেষ_পর্ব(শেষ খন্ড)

জানালার কোণে মাথা ঠেকিয়ে আকাশের দিকে মুখকরে দাঁড়িয়ে আছে সেঁজুতি। বাহিরে পুবাল হাওয়া বইছে। নিশিথের অন্ধকার ঘাঢ় হয়ে উঠেছে চারপাশে। সেঁজুতি নির্লিপ্তিভাবে মেঘে ঢেকে যাওয়া একফালি চাঁদের দিকে চেয়ে আছে। আকাশের বুকে আজ শ্রাবণ মেঘের আনাগোনা। কখনোসখনো মেঘের ফাঁকেফাঁকে একফালি চাঁদ উঁকিঝুঁকি মেরে তার অস্তিত্ব জানান দিচ্ছে। সেঁজুতি মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে সে দৃশ্য চোখে ধারণ করছে। মাঝেমধ্যে পুবাল হাওয়া এসে তার এলোমেলো চুল আরো এলোমেলো করে দেয়। সেঁজুতি বাধা দেয় না, অবলীলায় সেগুলো তার গালের একপাশটা ঢেকে দেয়।

ধীরেধীরে অনেকটা সময় অতিবাহিত হয়। সেঁজুতি জানালার পাশ থেকে সরে এসে বিছানার এক কোণে পা গুঁজে বসে। পাশেই হামিদা আর ফরিদ হারিকেনের আলোয় বই পড়ছে। সেঁজুতি নিঃশব্দে ফরিদের মাথায় আলতো করে হাত রাখে। ফরিদ ঘাড় ফিরিয়ে সেঁজুতির দিকে তাকায়। সেঁজুতি মুচকি হেসে ফরিদকে কাছে আসতে বলে। ফরিদ কিছু না বলে সঙ্গে সঙ্গে সেঁজুতি কোল ঘেঁষে এসে বসে। সেঁজুতি ফরিদের ছোট্ট কপালে তার অধরযুগল ছুঁয়ে দিয়ে গলা নামিয়ে বলে,

“আইজ বই পড়তে ইচ্ছা করে না তাই না?”

ফরিদ মাথা ঝাঁকিয়ে ভয়ে ভয়ে না জানায়। সেঁজুতি ফরিদের ভয়ার্ত চোখের দিকে তাকিয়ে আরেকবার মৃদু হাসে তারপর চুপিচুপি বলে,

“তবে আইজ আর পইড়া কাম নাই।”

সেঁজুতি কথা কর্ণপাত হতেই ফরিদের চোখ খুশিতে চকচক করে উঠে। সে যেনো এমন কিছুর আশা করে নি। না চাইতে আকাশের চাঁদ হাতে পাওয়ার মতো ভাব করে সেঁজুতির গলা জড়িয়ে ধরে বলল,

“সত্যি আমারে আইজ আর বই পড়া লাগবো না?”

“উহু। ”

“তবে আমি কাছারিঘরে যাই?”

“যা। ”

সেঁজুতি অনুমিত পেয়ে ফরিদ আর এক মুহূর্ত দেরি করলো না ছুটে ঘর থেকে বেড়িয়ে গেলো। পাশে বসে হামিদা অবাক হয়ে সব দেখছিলো। সেঁজুতি কত স্বাভাবিক ব্যাবহার করছে মনে হচ্ছে যেনো কিছুই হয় নি অথচ সেঁজুতির পায়ের তলার মাটি কত আগেই সরে গেছে। তার ভালোবাসাকে মিথ্যে করে তার প্রিয়তম অন্যের মাঝে নিজের প্রেম ভালোবাসা খুঁজে নিয়েছে। পুরো একটা বছর সেঁজুতির বুকে বয়ে যাওয়া প্রবল ঝড় যেনো নিমিষেই শান্ত হয়ে গেছে। হামিদা অবাক হয়ে শুধু সেঁজুতির নীরবতা চেয়ে দেখে। ভালোবাসা হারানোর হাহাকার কিংবা নতুন জীবনের হাত ছানি কিছুই যেনো তাকে উৎকন্ঠিত করছে না। এই যেনো ঝড়ের পূর্বমুহূর্তের আভাস। হামিদাকে অতিমাত্রায় অবাক হতে দেখে সেঁজুতি ভ্রুকুঞ্চিত করে জিজ্ঞাস করে,

” এই ভাবে তাকায়া কি দেখস তুই। পড়া বাদ দিয়া আমারে দেখলে হইবো?”

“আপা!”

“হু,,।”

“তোমার কি হইছে?”

” কই কিছু হয় নাই তো? কি হইবো আমার আবার?”

“সত্যিই তোমার কিছু হয় নাই আর হেইডা আমারে বিশ্বাস করতে কও?”

মুহূর্তে সেঁজুতি মুখে আধার ঘনিয়ে আসে। বুকের ভিতরটা হু হু করে উঠে তবুও সে নিজেকে কঠিন রেখে কড়া ভাষায় জবাব দেয়,

” তোরে এত কথা কইতে বলছে কে? নিজের পড়া পড়। সব সময় এমন পাকা পাকা কথা কইবি না।”

“তুমি আমারে এড়ায় গেলেও নিজেরে কি এড়ায় যাইতে পারবা আপা? কাইল বাদে পরশু তোমার বিয়া। সাবেত ভাই এমন একখান কাম করলো আর তুমি এইভাবে চুপ হইয়া আছো? একটুও কষ্ট হয় না তোমার? কান্দন আহে না তোমার চোখে?”

হামিদার কথায় সেঁজুতি বুক ছিঁড়ে দীর্ঘশ্বাস বেড়িয়ে এলো। সেঁজুতি দীর্ঘশ্বাস হামিদার কানে গিয়ে ঠেকলো। এই দীর্ঘশ্বাসের গভীরতা বুঝতে হামিদার এতটুকু সময় লাগলো না। সে জানে সেঁজুতি ভিতরে এখন কি চলছে তাই সে আর কথা বাড়ালো না চুপচাপ নিজের পড়ায় মন দিলো। সেঁজুতি বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়ায়। গুটিগুটি পা ফেলে পুনরায় জানালার পাশে এসে গ্রিল ধরে দাঁড়ায়। বাহিরে পুবাল হাওয়ার সাথে ঝিরিঝিরি বৃষ্টি পড়া আরম্ভ করেছে। চারদিক অন্ধকারাবৃত। চাঁদটাও মেঘের আড়ালে গা ঢেকেছে। নিশ্চুপতা ভর করেছে চারপাশে। শুধু দূর থেকে কয়েকটা ঝিঁঝিঁপোকা আওয়াজ একত্রে ভেসে আসছে। সেঁজুতি ভিতরটা বারবার কেঁপে উঠছে। প্রলয়কারী ঘুর্ণি হাওয়া হৃদয় সমুদ্রে বিরামহীন ঝড় তুলে যাচ্ছে। কি অসহ্য যন্ত্রণা হচ্ছে বুকের বাঁ পাশটায়। কান্নারা দলা পাকিয়ে গলায় আটকে আছে। এতটুকু সুযোগ পেলেই বেড়িয়ে আসবে। সেঁজুতি জোরে জোরে কয়েকবার শ্বাস টেনে নিজেকে শান্ত করার চেষ্টা করে। ভিতরের তাণ্ডব ঝড় বাহিরে বেড়িয়ে আসুক সেটা সে চায় না। নিজেকে ধাতস্থ করার আপ্রাণ চেষ্টা চালায় সেঁজুতি আর সফলও হয় সে।

রাতের খাওয়া দাওয়া সেরে যে যার মতো শুয়ে পড়েছে। হামিদা আর ফরিদ ঘুমিয়ে পড়েছে বেশ কিছুটা সময় আগে। শুধু ঘুম নেই সেঁজুতি চোখে।
বাহিরে মুষলধারায় বৃষ্টি পড়ছে। বৃষ্টি ফোঁটা টিনের চালায় খই ফোটার মতো শব্দ করছে। সেঁজুতি হাটু ভাঁজ করে মেঝেতে বসে আছে। একটু দূরেই হারিকেনটা মিটমিট করে জ্বলছে। তার সামনে একয়েকটা খোলা চিঠি ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে আছে। সেঁজুতি সেখান থেকে একটা চিঠি কাঁপা কাঁপা হাতে তুলে নিলো। সাবেতের দেয়া দ্বিতীয় চিঠি এটা। যেটা সাবেত এমনি এক বর্ষায় বৃষ্টি ভেজা রাতে তাকে দিয়েছিলো। কত আবেগ কত শিহরন জাগানো সব অনুভুতি মিশে আছে এই চিঠির সাথে। সেঁজুতি বুকের সাথে জড়িয়ে নেয় চিঠিটা। তার ভিতরটা জ্বলে পুড়ে ছাই হয়ে যাচ্ছে। তিল তিল করে জমে ওঠা অভিমান গুলো আজ মুল্যহীন, বড্ড বেমানান। যাকে ঘিরে এত অভিমান অভিযোগ সে আজ অন্য কারো মান ভাঙানোর দায়ে ব্যাকুল।

সেঁজুতি এক এক করে চিঠি গুলোকে হাতে নিলো।
চোখের কার্ণিশে লেগে থাকা শেষ অশ্রুবিন্দু টুকুও সে মুছে নেয়। মিথ্যা আশা মিথ্যা স্বপ্ন বয়ে বেড়ানোর চেয়ে কঠিন সত্য মেনে নিয়ে যন্ত্রণা পাওয়াই শ্রেয় বলে মনে করলো সেঁজুতি। তাই সে মনে মনে ঠিক করলো সাবেতের দেয়া সকল স্মৃতির তার জীবন থেকে মুছে ফেলবে পুড়ে ছাই করে দিবে সকল মিথ্যা আশ্বাস, মিথ্যে ভালোবাসার গল্প।

হারিকেনের আলো বাড়িয়ে চিঠি গুলো সব একত্রে করে আগুনের উপর ধরলো সেঁজুতি আর ঠিক সেই সময় জানালার পাশ থেকে খটখট করে শব্দ ভেসে আসে। চমকে উঠে সেঁজুতি, চিঠি পোড়ানোর কথা ভুলে গিয়ে কান খাড়া করে শুনে সে শব্দ। বোঝার চেষ্টা করে শব্দটা ঠিক কোথায় থেকে ভেসে আসছে। বৃষ্টির শব্দ ক্রমশ বেড়ে চলেছে তার সাথে খটখট শব্দও। সেঁজুতি ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় সজাগ হয়ে উঠে সাথে মনে ভয় কাজ করে। এতরাতে এমন ঝড়বৃষ্টিতে কে তাদের জানাল বাহিরে দাঁড়িয়ে আছে? চোর নয় তো? শংকিত হয়ে উঠে সেঁজুতি। ভয়ে বুক দুরুদুরু করে। সে হাত বাড়িয়ে হারিকেনের আলো কমিয়ে আনে তারপর বুকে কিছুটা সাহস সঞ্চয় করে উঠে দাঁড়ায় মেঝে থেকে। ভয়ে ভয়ে এক পা দু পা করে এগিয়ে যায় জানালার কাছে। তারপর কান পেতে দেয় জানালার কপাটে। সঙ্গে সঙ্গে আবার খটখট শব্দ করে উঠে। সেঁজুতি ভয়ে ছিটকে সরে আসে। তার হৃদপিন্ড ক্রামাগত উঠানামা করছে। বুক ধুকধুক করছে। কাউকে বলবে কিনা ভাবতেই জানাল অপর পাশ থেকে পুরুষালী কণ্ঠস্বর ভেসে আসতে শুনে। সেঁজুতি আচমকা কারো কণ্ঠস্বর শুনে চমকে উঠে। বুকের ভিতর এইবার রীতিমতো হাতুড়ি পেটা শুরু হয়। ভয়ে তার গলা শুকিয়ে উঠে। সেঁজুতি জিহবা দিয়ে শুকনো অধরযুগল ভিজিয়ে নেয়। কি করবে ভেবে না পেয়ে হামিদাকে ডেকে তুলার সিদ্ধান্ত নেয়। সেঁজুতি ভয়ে ভয়ে জানালার পাশ থেকে সরে এসে দুই পা এগিয়ে এলে আবারো পুরুষালী কণ্ঠস্বর তার কানে এসে লাগে আর এইবার সে স্পষ্ট শুনতে পায় কেউ তার নাম ধরে ডাকছে। সেঁজুতি হামিদাকে ডাকার জন্য দ্বিতীয় পা পেলার আগে আরেকবার ভালো করে বুঝার চেষ্টা করে কে তাকে ডাকছে।

“সেঁজুতি, এই সেঁজুতি শুনছো?”

যখনি সেঁজুতি বুঝতে পারলো পুরুষালী কণ্ঠস্বর টা আর কারো নয় সাবেতের সে একমুহূর্ত দেরি না করে ফিরে জানালার কাছে দাঁড়ায়। কান পেতে আবারো বুঝার চেষ্টা করে সত্যিই কি সাবেত তাকে ডাকছে কিনা। আর ঠিক তখন সাবেত আবার চাপা স্বরে বলল,

“সেঁজুতি জানালাটা একবার খুলো প্লিজ। আমি জানি তুমি আমার কথা শুনতে পাচ্ছো।”

সাবেতের চাপা কণ্ঠস্বর ক্ষণিকের মঝে সেঁজুতি শরীরে উষ্ণ রক্তস্রোত বইয়ে দেয়। দুকান গরম হয়ে উঠে সেঁজুতির। মুহূর্তে বুঝতে পারে না সে কি করবে বা কি করা উচিৎ। তাই সে দ্বিধাদ্বন্দে পড়ে গেলো। জানালা খুলবে কি খুলবে না ভাবতে ভাবতে শেষে খুলেই ফেললো। জানালা খুলতেই সাবেতের ফর্শা চেহারাটা অন্ধকারে ভেসে উঠে। সেঁজুতি সঙ্গে সঙ্গে চোখ দুটি বুজে নেয়। এতদিন পর তার পিয়াসু নয়নযুগল প্রেমিকের মুখখানি একটিবার দেখার মতো সাহস করলো না।
সাবেত মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে সেঁজুতিকে দেখছে। এই তো তার আষাঢ়ে সদ্য ফোটা কামিনী। বর্ষার বারিধারায় স্নানকৃত নীল শালুকের অনুরুপ তার সৌন্দর্য আজও একি আছে শুধু তাতে পড়ন্ত বিলেলের নুইয়ে যাওয়া নীলোৎপলের মতো মলিন দেখাচ্ছে। অবশ্য মলিন দেখাবেই না কেনো তার আষাঢ়ে সদ্য ফোটা কামিনী যে এই এক বছরে কত বিরহবেদনা সহ্য করেছে। কত রাত্রি-দিবস কাটিয়েছে প্রতিক্ষার প্রহর গুনে। ব্যাকুল তিয়াসে তারই পিয়াসে কেঁদে মরেছে রাতভর দিনভর।

“আপনি এত রাইতে এইহানে?”

“তোমায় দেখবো বলে ছুটে এসেছি এই ঝড়বৃষ্টির রাত উপেক্ষা করে।”

সাবেতের কথা কর্ণপাত হতেই সেঁজুতির জমে থাকা অভিমানগুলো আবার মাথাচাড়া দিয়ে উঠে।
অভিমানে চোখে জল বেড়িয়ে আসে। সেঁজুতি নিজেকে সামলে নেয়। তারপর নিজেকে কঠিনরুপে সাবেতের কাছে উপস্থাপন করে বলল,

” আমাকে দেখার মতো তো কিছু নাই? ক্যান আইছেন আমার বাড়ি?”

“অভিমান লুকিয়ে রেখে নিজেকে কঠিনরুপে প্রমাণ করতে এসো না ধরা পড়ে যাচ্ছো।”

” আমি কোনো কিছু প্রমাণ করতে চাই না। ক্যান আইছেন এখানে আপনি রাতবেরাত এ? ঘরে নতুন বউ রাইখা পরনারীর লগে দেখা করতে লজ্জা লাগে না আপনার?”

সেঁজুতি কথায় সাবেত দীর্ঘশ্বাস ফেলে ক্ষণকাল মৌন হয়ে রইলো। সেঁজুতি সাবেতের প্রতিউত্তর না পেয়ে আবারো বলল,

“কাইল বাদে পরশু আমার বিয়া। আপনে এখন এইখান থেইকা যান। কেউ দেখলে কেলেঙ্কারি হইয়া যাইবো।”

“থাকার জন্য তো আসি নি চলে যেতেই এসেছি। তোমার জমে থাকা অভিমান গুলো ভাঙার ইচ্ছে ছিলো খুব। কিন্তু সেই সুযোগ বোধহয় আর হলো না।”

সাবেতের কথা গুলো সেঁজুতিকে ক্ষতবিক্ষত করে দিচ্ছে। তবুও সে অসার হয়ে সব শুনছে। এই মুহূর্তে তার আর কিছুই করার বাকি নেই। আজ দুজনের পথ দুই দিকে বেঁকে গেছে। চাইলেও হয়তো তারা আর একই পথের পথিক হতে পারবে না। সাবেত নিজে সেই পথ বন্ধ করেছে সে তো আগ বাড়িয়ে কিছু করে নি। বিয়েটাও সে করতে চায় নি প্রয়োজনে বিয়ের দিন পালিয়ে যাবে বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলো কিন্তু সাবেত কি করলো? তাকে ভুলে গিয়ে অন্য একটি মেয়েকে বিয়ে করে বাড়ি তুললো। টপ করে সেঁজুতির চোখের কার্ণিশ বেয়ে এক ফোঁটা জল গড়িয়ে সাবেতের হাতে পড়লো। সাবেত চমকে উঠলো। কি উষ্ণ সেঁজুতির চোখের জল। বুকে কতটা যন্ত্রণার আগুন সেঁজুতি বয়ে বেড়াচ্ছে সেটা বুঝতে আর বাকি রইলো না সাবেতের। নিজেকে বড্ড অপরাধী বলে মনে হচ্ছে। কিন্তু যে করেই হোক সেঁজুতির মান ভাঙানো প্রয়োজন। অনেক জানা অজানা কথা সেঁজুতিকে তার জানানোর আছে। এখানেই যে সব শেষ হতে পারে না,এক আষাঢ়ের শুরু হওয়া ভালোবাসা অন্য আষাঢ়ে শেষ হতে পারে না। মনে মনে সাবেত দৃঢ় প্রতিজ্ঞা করলো, যে করেই হোক সেঁজুতিকে সব জানাবে। সব শুনে সেঁজুতি যা রায় দেয় তাই সে মাথা পেতে নিবে।

“আপনি চইলা যান। আর আমার সামনে আসবেন না। আমি চাই না আমার কারনে আপনার সংসারে অশান্তি হোক।”

সাবেত ছোট্ট একটা নিশ্বাস ফেলে বিড়বিড় করে বলল,

“মনে যার দু-দন্ড শান্তি নেই সে সংসারে শান্তি দেবে কি রুপে।”

ঝিরিঝিরি বৃষ্টি মাথায় করে অন্ধকারে পা বাড়ালো সাবেত। অন্ধকারে সাবেতের ছায়া মিলিয়ে যাওয়ার আগ পর্যন্ত সেঁজুতি সে দিকে তাকিয়ে থাকলো। বুকের বাঁ পাশটা ভারী হয়ে আসছে সেঁজুতি। ইচ্ছে করছে আকাশ পাতালা এক করে চিৎকার করে কাঁদতে কিন্তু সে পারলো না এমন করতে। নীরব ব্যথা নীরবেই সহ্য করার চেষ্টা করলো। কি হবে আর এত অশ্রুবিসর্জন করে ভোর হলেই তো তার বিয়ের তোড়জোড় শুরু হবে। নতুন পৃথিবীর নতুন এক মানুষের হাত ধরে সারাজীবন একসাথে কাটানোর প্রতিজ্ঞায় আবদ্ধ হবে। অচেনা অজানা মানুষটা তার অর্ধস্বত্তা হয়ে উঠবে অথচ মানুষটাকে সে ভালোবাসে না এমকি দেখে নি পর্যন্ত। এ যেনো বিধাতার এক নিয়ম একজনের জন্য মনে ভালোবাসা সৃষ্টি করে অন্যজনের সাথে ঘর বাঁধতে বাধ্য করে। যদি সে ভালোবাসার মানুষটা কে নাই পাবে তবে কেনো তার জন্য মনে এত প্রেম সৃষ্টি করে? এত মায়া কেনো দেন বিধাতা সে মানুষটার প্রতি। একেমন নিয়ম পৃথিবীর। মন ভাঙা আত্ননাদ কি তিনি শুনতে পান না? তবে এই দুনিয়ায় কেনো এত মন ভাঙা-গড়ার খেলা চলে ভাবতে ভাবতে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠে সেঁজুতি। নিজেকে শান্তনা দেয়ার মতো এমন কিছুই যে তার আর অবশিষ্ট নেই।

ভোর হতেই বাড়িতে বিয়ের তোড়জোড় চলছে। আত্নীয়- স্বজন বাড়িতে গিজগিজ করছে। মিনারা বেগম সকাল থেকেই রান্নাঘরের কাজে নিযুক্ত হয়ে আছেন। কোনো দিকে তাকানো জো নেই তার। হামিদা সকাল থেকেই বাড়ি নেই কি এক কাজে তাকে বের হতে হয়েছে। মিনারা বেগম এত করে বললেন আজ বাড়ির বাহিরে না যেতে তবুও হামিদা মায়ের কথা শুনলো না বেড়িয়ে গেলো। ফরিদের আজ ঈদের দিন। বাড়িতে আত্নীয় স্বজনের মধ্যে ছোট সদস্যরা হয়ে উঠেছে তার খেলার সঙ্গী। আনন্দে উৎসবে সে মেতে উঠেছে। এই যেনো তার নিজ বাড়িতে বৈশাখী মেলা বসেছে। এমনি কলহাস্য মুখরিত সারা বাড়ি।

সেঁজুতির ঘুম ভাঙতে অনেক দেরি করলো। শেষ রাতে কাঁদতে কাঁদতে কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছে মনে নেই। সকাল হতে মিনারাও আজ তাকে ডেকে তুললো না, প্রতিদিনের মতো জোরো করলো না ঘুম থেকে তোলার জন্য। আজ এই বাড়িতে তার আদরের কন্যার শেষ দিন তাই হয় তো একটুখানি শান্তিতে ঘুমাতে দেয়া উচিৎ বলে মনে করেছেন তিনি। সেঁজুতির যখন ঘুম ভাঙলো তখন বেলা গড়িয়ে দুপুর হতে চললো। ঘুম ভাঙতে সেঁজুতির কানে সোরগোলের আওয়াজ ভেসে এলো। চোখ খুলে চারদিকে তাকিয়ে ধরপড় করে শোয়া থেকে উঠে বসে সে। এতবেলা পর্যন্ত ঘুমিয়েছে ভেবে তাড়াতাড়ি বিছানা ছেড়ে উঠে বাহিরে বেড়িয়ে আসে। সেঁজুতিকে বেড়িয়ে আসতে দেখে একজন পৌঢ়া মহিলা চেঁচিয়ে বললেন,

“ওই তো সেঁজুতি উইঠা পড়ছে। ও বউ তোমার মাইয়ারে কও তাড়াতাড়ি গোসলখানা সাইরা নিতে।”

মিনারা বেগম মহিলার কথা হেসে হাতের কাজ ফেলে সেঁজুতি কাছে এসে নতুন একটা শাড়ি আর গামছা দিয়ে বলেন,

“যা মা গোসল সাইরা লো। একটু পর হলুদ আর মেহেন্দি বাটা শুরু হইবো।”

সেঁজুতি সারা বাড়িতে সবাইকে দেখতে পেলো অথচ হামিদাকে কোথায় দেখতে পেলো না ভেবে মিনারা বেগমকে জিজ্ঞাস করে বলল,

“আম্মা হামিদা কই? সবাই আছে হামিদারে যে দেখি না।”

“কি জানি সকাল সকাল কই জানি বাহির হইয়া গেছে। এত করে কইলাম যাইছ না তাও চলে গেলো।”

সেঁজুতি আর কিছু বলল না ছোট্ট একটা নিশ্বাস ছেড়ে গোসলখানার দিকে পা বাড়ালো। হামিদা এতক্ষণে বাড়ি ফিরেছে আর ফিরেই সোজা ঘরে চলে গেলো। মিনারা বেগম পিছন থেকে কয়েকবার ডেকে কোথায় গেছে প্রশ্ন করলেও হামিদা উত্তর দিলো না নিঃশব্দে ঘরে ঢুকে দরজা লাগিয়ে দিলো।

___________________________

পড়নে হলুদ শাড়ি গায় ভর্তি গাঁদাফুল আর গোলাপের গহনা পড়ে গায়ে হলুদের সাজে হামিদার পিছুপিছু বাড়ি থেকে বেড়িয়ে এলো সেঁজুতি। কপালে আর গালের দুপাশে এখনো কাঁচা হলুদ লেপ্টে আছে। বাড়ির পিছে হিজল তলায় দাঁড়িয়ে সাবেত অধীর আগ্রহে সেঁজুতির অপেক্ষায় আছে। অন্ধকারে চুপিচাপি সেঁজুতিকে নিয়ে হামিদা বাড়ির পিছনে এসে দাঁড়াল। সেঁজুতি বুক ধুকধুক করছে। বুঝতে পারছে না হামিদা এত রাতে তাকে এখানে কেনো ডেকে এনেছে। হারিকেনের আলোয় সেঁজুতির ভয়ার্ত মুখটা দেখে খিলখিল করে হেসে ফেললো হামিদা। সেঁজুতি অবাক হয়ে দেখে হামিদাকে কিন্তু কিছুই বুঝে উঠতে পারে না। হামিদা হাসি চেপে রেখে সেঁজুতিকে উদ্দেশ্য করে বলল,

“আপা ভয় পাইলে তোমার মুখটা খুব সুন্দর দেখতে লাগে। তোমাকে গায়ে হলুদের সাজে একেবারে আসমানের পরীর মতো লাগতাছে। সাবেত ভাই তোমারে দেইখা অজ্ঞান হইয়া যাইবো।”

হামিদার মুখে সাবেতের কথা শুনে চমকে উঠে সেঁজুতি। হামিদার কথার অর্থ বুঝতে না পেরে সন্দিহান দৃষ্টিতে তাকালো সে। হামিদা সেঁজুতির অবস্থা দেখে আরেকবার হেসে ফেলল তারপর বলল,

“আমি এখানে খাড়ালাম হিজল তলায় সাবেত ভাই তোমার লাইগা অপেক্ষা করতাছে তাড়াতাড়ি যাও।”

সেঁজুতি এইবার অবাকের সপ্তম পর্যায়ে পৌঁছে গেলো। সাবেত তার জন্য অপেক্ষা করছে এটা যেনো তার নিজ কানকে বিশ্বাস করাতে পারছে না। হামিদা কি বলতে চাইছে আর কি করতে যাচ্ছে কিছুই তার অবগত নয়। হামিদা সেঁজুতিকে থম মেরে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে তাড়া দিয়ে বলল,

“আপা তাড়াতাড়ি যাও সাবেত ভাই অনেকক্ষণ হইলো হিজল তলায় খাড়ায় আছে।”

সেঁজুতি অবিশ্বাসী দৃষ্টিতে হামিদাকে দেখলো। হামিদা তাকে বারবার তাড়া দিচ্ছে যেতে তাই অগত্যা সেঁজুতি অন্ধকারে পা বাড়ালো হিজল তলার উদ্দেশ্যে।

সাবেত উৎসুক হয়ে ইতিউতি করে দেখছে। অনেকটা সময় পেরিয়ে গেছে অথচ সেঁজুতি এখনো এসে পৌঁছায় নি। চিন্তায় সাবেত দাঁত দিয়ে নখ কাঁটছে। তার দৈর্যের বাঁধ ভেঙে যাচ্ছে। হামিদা সব দিক ঠিক রেখে প্ল্যান অনুযায়ী কাজ করতে পেরেছে কে জানে। সেঁজুতিকে বুঝিয়ে বাড়ির বাহিরে আনতে পারবে কিনা ভেবে সাবেতের হাত পা ঠান্ডা হয়ে আসছে। বুক ধুক ধুক করছে। চিন্তায় মাথা কাজ করা বন্ধ করে দিয়েছে। হামিদা প্ল্যান ঠিকভাবে কাজে লাগাতে পারলো কিনা এসব ভেবে সাবেতের দম আটকে আসতে চাইছে।
অপেক্ষার প্রহর যে কতটা যন্ত্রণার তা আজ বুঝতে পারছে সাবেত। সেঁজুতি তার অপেক্ষায় কতটা যন্ত্রণা ভোগ করেছে। তার কষ্টের গভীরতা কত টুকু সেটা সাবেত তার হৃদয় দিয়ে উপলব্ধি করেছে তাই তো ছুটি পেয়ে আর একটা দিনও নষ্ট করে নি ছুটে গ্রামে এসেছে তার আষাঢ়ে সদ্য ফোটা কামিনীকে নিজের করবে বলে। কিন্তু গ্রামে এসে সে জানতে পারে সেঁজুতির বিয়ে ঠিক হয়েছে। আর পাঁচ দিন বাদে সেঁজুতি বিয়ে। সাবেত যেনো বিশ্বাস করতে পারছিলো না এই কথা। তার আষাঢ়ে সদ্য ফোটা কামিনী তার নয় অন্য কারো সহধর্মিণী হতে চলেছে। নিজেকে তখন শান্ত রাখতে পারছিলো না কষ্টে তার ছিঁড়ে যাচ্ছিলো। কি করবে উপায়ন্তর না পেয়ে টানা তিনদিন নিজেকে ঘরে আবদ্ধ করে রাখে। শেষে পরিবারের সকলে এবং তার কলিগ অনুরাধা মিলে তাকে বুঝিয়েছে যে সব এখনো শেষ হয়ে যায় নি। এখনো অনেকটা সময় বাকি আছে চাইলে সে সেঁজুতির বিয়ে আটকাতে পারে আর এইভাবে কষ্ট পেয়ে নিজেকে একটা ঘরে আবদ্ধ করে রাখলে তো আর বিয়ে ঠেকানো যাবে না। আর ঠি সে মুহূর্তে সাবেত সিদ্ধান্ত নিলো সেঁজুতি সাথে দেখা করবে। যেভাবেই হোক বিয়েটা আটকাতে হবে। তাই সে ঝুম বৃষ্টির মাঝেও মাঝরাতে ঘর থেকে বেড়িয়ে পড়ে একটা বার সেঁজুতির সাথে দেখা করবে বলে। কিন্তু সেদিন রাতে সেঁজুতির সাথে দেখা হলেও তেমন কোনো সুবিধা করে উঠতে পারে নি সাবেত। সেঁজুতি অভিমানের পাহাড় এতই বিশাল আকার ধারণ করেছিলো যে তাকে কিছু বলার সুযোগ পায় নি সে। সেঁজুতি এত অভিমানের মাঝে রাগটাও সাবেত ধরতে পেরেছিলো যখন সেঁজুতি তাকে ঘরে বউ রেখে পরনারীর সাথে দেখা করার কথা বলল।
সাবেত তখনি বুঝতে পারে সেঁজুতি ঠিক কি বলতে চাইছে আর কেনই বা তার এত রাগ হয়েছে।
গ্রামের আর আট দশজনের মতো সেঁজুতিও ভেবেছে সাবেত বিয়ে করে বউ নিয়ে গ্রামে ফিরেছে। কিন্তু সেটা তো আর সত্যি নয়। অনুরাধা তার কলিগ সেটা কেউ জানতেও চায় নি আর বুঝতেও পারে নি তাই গ্রামবাসী ধরে নিয়েছে সে বিয়ে করে বাড়িতে বউ নিয়ে এসেছে। আর বাকি থাকলো তার নিরুদ্দেশ হওয়ার গল্প। হ্যাঁ সে নিরুদ্দেশ হয়েছিলো কিন্তু সেটা ইচ্ছাকৃত ভাবে নয় বরং কাজের সুবাদে।

সেদিন রাতে সাবেত সেঁজুতির উদ্দেশ্যে চিঠি লিখতে বসে। তখন রাত প্রায় বারোটার কাছাকাছি। এমন সময় তার নামে একটি হাসপাতাল কতৃপক্ষ থেকে একটা চিঠি আসে। সেখানে তাকে জরুরি ভাবে ইন্ডিয়া পাঠানোর সিদ্ধান্ত নেয় হাসপাতাল কতৃপক্ষ। এগারো জন ডাক্তারের সাথে তারো ডাক পড়ে ইন্ডিয়ায় যাওয়ার।
এগারো জন ডাক্তারের সম্মিলিত মেডিকেল টিম সেদিন রাত দুটোর মধ্যে প্লাইট ধরে ইন্ডিয়ার উদ্দেশ্যে যাত্রা করে। সাবেত সেদিন চিঠিতে সবটা জানায় কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত চিঠিটা সে অজান্তে নিজের ঘরে ফেলে রেখে চলে যায়। সাবেতের ইচ্ছা ছিলো চিঠিটা কাজের লোকের হাতে করে সেঁজুতির কাছে পৌঁছে দেয়ার কিন্তু তাড়াহুড়ো করতে গিয়ে সে সমস্তকিছু ভুলে গেলো।
ইন্ডিয়া যাবার পর তার চিঠির কথা মনে পড়ে ততোক্ষণে আর কিছু করার ছিলো না।

ইন্ডিয়াতে অনুরাধার সাথে সাবেতের পরিচয় হয়। তারা একই হাসপাতালে সহকর্মী হিসেবে কাজ করতো। আর তখন অনুরাধা এবং সাবেতের মধ্যে বন্ধুত্বের সম্পর্ক তৈরী হয়। অনুরাধার বাংলাদেশ আসার খুব ইচ্ছে ছিলো তাই ছুটি পেয়ে সে সাবেতের সাথে এইদেশে বেড়াতে আসে। সাবেত অনুরাধাকে তার সাথে নিজের গ্রামে নিয়ে আসে। কিন্তু গ্রামের লোক সেটাকে অন্যভাবে নিলো। ভাবলো সাবেত বিয়ে করে বউ নিয়ে এসেছে আর দিকে দিকে সে খবর বাতাসের সাথে ছড়িয়ে পড়ে।

______

হারিকেন হাতে গুটিগুটি পায়ে সেঁজুতি সাবেতের সামনে এসে নতজানু হয়ে দাঁড়ায়। সেঁজুতিকে দেখে সাবেতের হৃদস্পন্দন একমুহূর্তের জন্য থেমে গেলো। হারিকেনের লাল আলোয় হলুদের সাজে দাঁড়িয়ে থাকা সেঁজুতি দেখে সাবেতের হৃদয় যেনো আবারো তার অসারত্ব অনুভব করলো। হলুদের সাজে নারীকে যে কতটা তিলোত্তমার অনুরুপ সুন্দরী লাগে সেটা সাবেতের অজানা। সেঁজুতির কাগল কালো চোখ দুটিতে ঝিলের জল টলমল করছে। ঠোঁট দুটো পদ্মফুলের শুভ্র পাপড়ির ন্যায় দেখাছে। যেনো মৃদু সমীরণে পদ্মফুল যেমন দোল খায় ঠিক তেমন সেঁজুতির ঠোঁট দুটো তিরতির করে কাঁপছে। সাবেত পলক ফেলতে পারে না সেঁজুতির উপর থেকে। নিষ্পলক চাহনিতে তাকিয়ে থাকে সেঁজুতি মুখপানে। সেঁজুতি লজ্জায় মাথা নুইয়ে ফেলে। চোখ তুলে তাকানোর সাহস পায় না। তার বুকে ধুকধুক শব্দ ক্রামাগত বেড়ে চলেছে। মনের কোণে প্রথম দিনের মতো আজও শিহরন খেলে যাচ্ছে। ঘন ঘন বুক উঠানামা করছে। নিশ্বাস ভারী হয়ে আসছে। ইচ্ছে করছে এক্ষুনি কোথাও দৌড়ে পালিয়ে যেতে। সাবেত কয়েক পা এগিয়ে সেঁজুতি কাছাকাছি এসে দাঁড়াল। সেঁজুতি ভয়ে ভয়ে একবার চোখ তুলে সাবেতকে দেখে আবার নামিয়ে ফেলে। সাবেত বাহুতে দুহাত গুঁজে হাই তোলার ভঙ্গিমা করে বলল,

“উফ অন্যের হবু বউকে এইভাবে মাঝরাতে বের করে এনে দেখার সুযোগ বোধ হয় একমাত্র সাবেত ডাক্তার ছাড়া আর কারো হবার নয়।”

সেঁজুতি আড় চোখে সাবেতকে আরো একবার দেখলো।

” হলুদের সাজে তো দেখছি অন্যের হবু বউকে দারুণ লাগছে। তা অন্যের হবু বউকে এইভাবে দেখার অপরাধে কি আমার গর্দান হারাবার আশংকা আছে?

“আপনি হামিদারে দিয়া এত কিছু করাইলেন? লজ্জা করেন না আপনার?”

“লজ্জা করলে কি এইভাবে মাঝরাতে অন্যের হবুবউকে দেখতে পেতাম?”

“আপনি ক্যান এমনটা করলেন? ক্যান এতরাইতে আমারে এখান পর্যন্ত টাইনা আনলেন?”

“হামিদা তোমায় কিছু জানায় নি?”

“না তো।”

” ওহ আচ্ছা। কোনো ব্যাপার না তাহলে আমিই জানিয়ে দিচ্ছে। আসলে আমি একটা প্লান করেছি আর সেটাতে পুরো সাহায্য করেছে তোমার বোন হামিদা। সারা সকাল থেকে দুপুর অবদি নিরলস পরিশ্রম করে অন্যের হবু বউকে নিয়ে পালানোর পরিকল্পনা করেছি।”

সাবেতের কথা শুনে অবিশ্বাসী দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে সেঁজুতি। তার মাথায় আসলে এই মুহূর্তে কিছুই ঢুকছে না। সাবেত একে একে ঘটে যাওয়া সব কিছু সেঁজুতিকে বলে। আর সকালে যে হামিদা বাড়ি থেকে বেড়িয়ে গিয়েছিলো সেটা শুধু সাবেতের কথা মতো কাজ করার জন্য। ভোর বেলায় রানী এসে হামিদাকে সব কিছু খুলে বলে। হামিদা সব শুনে অবাক হয় আর তারপর সাবেতের কথা অনুযায়ী চেয়ারম্যান বাড়িতে চলে যায়। আর ফিরে এসে পরিকল্পনা মতো সবকাজ সেরে নিয়ে সেঁজুতি ভুলবাল বুজিয়ে বাড়ি থেকে বের করে আনে।

সমস্ত কিছু শুনে সেঁজুতির মাথায় বাজ পড়ার মতো অবস্থা। এসব কিছু যেনো তার স্বপ্ন বলে মনে হচ্ছে। আনন্দে তার চোখ বেয়ে জল পড়তে শুরু করলো। সে ভাবতেও পারে নি শেষ মুহূর্তটা এমন হবে। তার ভালোবাসা যে মিথ্যে ছিলো না সেটা সত্যিই প্রমাণ হলো। এক আষাঢ়ের প্রেম শ্রাবণে পরিণয় পেলো।

সেঁজুতি ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো। তার সকল রাগ অভিমান গুলো নিমিষে উড়ে গেলো। ভালোবাসা এবং ভালোবাসার মানুষ দুটোই ফিরে পাবার আনন্দে তার দুচোখ বেয়ে অশ্রুজল গড়িয়ে পড়ছে। সাবেত কয়েক পা এগিয়ে সেঁজুতির মুখোমুখি এসে দাঁড়াল। দুহাতে আঁজলা ভরে সেঁজুতি মুখখানা তুলে ধরে বলল,

“ওগো আমার আষাঢ়ে সদ্য ফোটা কামিনী শ্রাবণে অঝোর ধারায় তুমি ধরবে কি আমার হাত? ভিজবে কি শ্রাবণের বারিধারায়? ”

সেঁজুতির লজ্জায় তার ঠোঁট দুটো প্রসারিত করে। হাত বাড়িয়ে দেয় সাবেতের দিকে। সাবেত সেই হাত শক্ত করে মুঠো করে ধরে মুখে প্রশস্ত হাসি ফুটিয়ে তুলে। অতঃপর দুজন হাত ধরে অন্ধকারে পা বাড়ায় নিরুদ্দেশের পথে।

সমাপ্ত।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here