আষাঢ়ি পূর্ণিমা পর্ব ২

0
611

#আষাঢ়ি_পূর্ণিমা
#পর্ব_২
কলমে খাদিজা আক্তার-??????? ????? (Diza)

—আ… আমি…

রাত্রির কথা গলায় আটকে যাচ্ছে। ভয়ে তার হৃৎপিণ্ডে ছন্দের পতন হচ্ছে। অস্থিরতায় ক্রমশ নিজেকে অগোছালো লাগলেও রাত্রি চাইছে আদীকে কিছু বলে শান্ত করতে। কারণ রাত্রিসহ তার পরিবারের সবাই জানে, আদী বদমেজাজী ও উগ্র এবং তার উগ্রতা দিনের পর দিন বেড়েই চলেছে।

রাত্রি ও আদী ছোটো থেকে একসাথে বড়ো হয়েছে। একই গ্রামের হাওয়া পানিতে বেড়ে উঠতে গিয়ে দুজন দুজনকে জেনেছে। কিন্তু ছয় মাস আগে রাত্রি বুঝতে পেরেছে, আদীকে নিয়ে তার জানাশোনার মাঝে যথেষ্ট কমতি আছে। আদীর ব্যাপারে সে অনেক কিছুই জানে না।

ছয় মাস আগের ঘটনা, তখন দিনের চতুর্থ প্রহর চলছে। কিন্তু গরম কমার নাম নেই বলে পাখার তলায় বালিশ পেতে রাত্রি শুয়েছিল। হঠাৎ হনহন করে আদী এসে ঘরে ঢুকে বলল,

—এক গ্লাস পানি নিয়ে এসো। গরমে খুব অস্থির লাগছে। এত রোদ পড়ে রোজ! এমন হলে ব্লাডপ্রেশার কস্মিনকালেও আমার কন্ট্রোলে থাকবে না।

কথা শেষ করে আদী বিছানায় বসে পড়ল। এরপর দ্রুত হাতে তার শার্টের প্রথম বোতাম খুলে দিলো। ঘাড় থেকে শার্টের কলার নামিয়ে দিলো যেন পাখার বাতাস সরাসরি ঘাড়ে এসে পড়ে এবং তাকে শীতল করে দেয়। রাত্রি বসেছিল আদীর ঠিক পিছনে। হঠাৎ আদীকে দেখে চমকে গিয়েছে ফলে সে চট করে কোনো উত্তর দিতে পারল না। এখনো নামার কোনো নাম নেই। রাত্রি পিছন থেকে তাকিয়ে আছে আদীর দিকে। আদীর ভেজা পিঠের দিকে এক দৃষ্টিতে অর্থহীন তাকিয়ে রইল রাত্রি; সাদা শার্ট ঘামে ঝপঝপ হয়ে পিঠের সাথে লেগে আছে। এরপর সন্তপর্ণে নেমে গিয়ে এক গ্লাস পানি এনে বলল,

—ব্লাডপ্রেসারের পেশেন্ট হয়ে ভরদুপুরে বাড়ি থেকে বের হও কেন? রোদ পড়লে বের হতে পারো। এতে তো কোনো সমস্যা নেই।

আদী কোনো উত্তর দিলো না। ঢকঢক করে পানি পান করে গ্লাস ফিরিয়ে দিলো। এখন তার অনেকটা স্বস্তি লাগছে, কিন্তু রাত্রি এখনো উত্তরের প্রতীক্ষায় গ্লাস হাতে দাঁড়িয়ে আছে। আদী ফোনে মেসেজিং করতে গিয়ে রাত্রিকে বলল,

—আম্মা পিঠা বানিয়েছেন। আমাকে দিয়ে পাঠিয়ে দিলেন। তাই নিয়ে এসেছি। ব্লাডপ্রেশারই তো হয়েছে, কিন্তু তোমাদের সকলের ভাবখানা দেখে মনে হচ্ছে আমার ব্লাড ক্যানসার হয়ে গেছে। ক্যানসার হলে অবশ্য খারাপ হতো না।

এ কথা বলে আদী হেসে ওঠল; বিষাদের হাসি। রাত্রির এতে ভীষণ রাগ হচ্ছিল। ইচ্ছে করছিল আদীকে কোনো কড়া কথা শুনিয়ে দিতে। কিন্তু সে কথা বলা তো দূর, ভাবার পূর্বেই আদী তড়াক করে দাঁড়িয়ে গেল। একদম রেগে একাকার হয়ে নিম্ন শ্রেণির এক চতুষ্পদ জন্তুর বাচ্চার সাথে তুলনা করে একটি গালি দিলো। রাত্রি অবাক চোখে তাকিয়ে দেখল, আদী ফোনে কাউকে গালি দিচ্ছে। দুই মিনিট আগেও মানুষটি শান্ত ছিল, কিন্তু হঠাৎ করে কেমন উগ্র হয়ে গেল। রাত্রির সবকিছু এলোমেলো লাগলেও সে অযাচিত চিন্তা করতে লাগল। সে ভেবে পাচ্ছে না মানুষ রেগে গেলে কেন কুকুরের কথা মনে করে আর প্রশংসা করার সময় বাঘ/ সিংহের কথা। দুটিই তো চতুষ্পদ প্রাণী আর মাংস কামড়াকামড়ি করে দিনাতিপাত করে। একটি বনে থাকে তো অন্যটি লোকালয়ে। এখন বাঘ বনে থাকে বলেই সে বাহাদুর তাই মানুষের প্রশংসা করার সময় বলে, তুমি তো বাঘের বাচ্চা। তাহলে মানুষ পাগল হয়ে যখন বনেবাদাড়ে ঘুরে বেড়ায়, তখন তাকে বাহাদুর আখ্যায়িত করা হয় না কেন?

—কই আছস তুই? স্কুল মাঠে? দাঁড়া তুই। আমি দশ মিনিটের মধ্যে আইতাছি।

আদী রেগে কথা বলে যাচ্ছে। ওপাশের মানুষটির কথা শুনে আবার বলে ওঠল,

—হ্যাঁ শালা, একাই আসমু। কোনো মায়ের পোলারে আমি ডরাই না।

অনেকে রেগে গিয়ে খুব ইংরেজি ঝারে, কিন্তু আদীর কথাবার্তা চট করে আঞ্চলিক ভাষায় নেমে আসে। আদী কল কেটে দিয়েছে। ঘামে ঝপঝপ করা শার্ট এখন কিঞ্চিৎ শুকিয়ে এসেছে। গৌর মুখে ঘামের জলরাশি এসেছিল তাও কিঞ্চিৎ মিলিয়ে গেছে। কিন্তু কপালের দিকের চুল এখনো ভিজে আছে। সে চুলে হাত চালিয়ে দ্রুত বের হওয়ার প্রস্তুত নিলো আদী। কিন্তু রাত্রি তার সম্মুখে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞাসা করল,

—হঠাৎ কী হয়েছে তোমার? এমন উত্তেজিত হয়ে কোথায় যাচ্ছ? ভরদুপুরে বের হইয়ো না। তোমার গায়ের ঘাম এখনো শুকাইনি। অসুস্থ হয়ে পড়বে। একটু…

আদী দাঁত কিড়মিড় করে বলে ওঠল,

—সামনে থেকে সরে যাও। হারামজাদার কত্ত বড়ো সাহস আমাকে তুই করে বলে। আমাকে বলে দেখে নিবে।

নোংরা একটি গালি আদী আবার বলে ওঠল,

—এর যদি আমি বিহিত না করতে পারি। তবে আমি এক বাপের পোলা না। তুমি আমার সামনে থেকে সরে যাও।

রাত্রির ভয় করলেও সে সাহস করে আদীকে শান্ত করার চেষ্টা করছে, কিন্তু তার কথা শোনার চেয়ে আদীর মাথায় স্কুল মাঠে গিয়ে কী কী করবে সে পরিকল্পনা বীজ বুনছে। রাত্রি কিছুতেই সামনে থেকে সরছে না। ফলে গর্জে উঠে আদী রাত্রিকে চড় দিতে উদ্ধত হলো। এতে রাত্রি হতভম্ব হয়ে গেল। একটি কথাও তার মুখ দিয়ে বের হলো না কেবল ছলছল নয়নে আদীর দিকে তাকিয়ে রইল। আদী চলে গেল আর তার পথপানে তাকিয়ে ঠোঁট কামড়ে কান্না সংবরণ করল রাত্রি। অজস্র অভিমান এবং দুঃখ তাকে গ্রাস করলেও সে মনে মনে প্রার্থনা করল,

—হে আল্লাহ, আদীর যেন কিছু না হয়। তুমি ওকে দেখে রেখো, দেখে রেখো।

রাত্রির কথা আল্লাহ শুনেছেন। আদীর কিছু হয়নি, কিন্তু যাকে নিজের যোগ্যতা দেখাতে আদী ছুটে গিয়েছিল, তার অবস্থা খুবই করুণ করে আদী ছেড়েছিল সেদিন। এ ঘটনার পর রাত্রি জেনেছিল, তাদের গ্রামেরই কোনো এক ছেলেকে আদি কুকুরের মতো পিটিয়ে ক্ষান্ত হয়েছিল। ও ছেলের অবস্থা এমন ভয়াবহ হয়েছিল যে তার পরিবার মনে করেছিল সে আর বাঁচবে না। ছেলেটির নাম ছিল ফুয়াদ। রাত্রি ছেলেটিকে কয়েকবার দেখেছিল ইউনিভার্সিটি যাওয়ার পথে। দেখে তেমন কিছুই মনে হয়নি, কিন্তু আদী তাকে মেরেছিল বলে ওর বড়ো মায়া হয়েছিল। ফুয়াদের পরিবার থেকে আদীর বিরুদ্ধে মামলা করার কথা ওঠেছিল। কিন্তু আদীর বাবা ফুয়াদের চিকিৎসার সমস্ত দায় মাথা পেতে নিয়েছিল এমনকি থানার বড়ো অফিসারকে পর্যাপ্ত উপহার দিয়ে মুখ বন্ধ করিয়েছে। এ ঘটনার পূর্বে রাত্রি শুনেছিল, আদী মারামারি করে। কিন্তু আদী অন্যের জীবনের মায়া না করেই মারপিট করে তা রাত্রির জানা ছিল না। তবে এ ঘটনার মাধ্যমেই সে জেনে গেছে এবং বুঝে গেছে, আদীকে তার জানা হয়নি; চেনা হয়নি।

—আমার সময় নষ্ট কইরো না, রাত্রি।

আদী দাঁতে দাঁত চেপে আবারও আঞ্চলিক ভাষায় বলছে, কিন্তু রাত্রি কিছুই যেন বলতে পারছে না। তবুও চেষ্টাচরিত্র করে বলল,

—আমাকে তুমি অবিশ্বাস করছ। আমার রাগ হচ্ছিল। তাই কল কেটে দিয়েছিলাম।

—চুপ। একটা কথাও আমি শুনতে চাই না। বুশরা এসব কইছে—এটা তুমি কইলেই আমার বিশ্বাস করা লাগবে? ওর মতো একটা ইনোসেন্ট মাইয়া যে তোমারে চিনেই না, সে তোমার ইউনিভার্সিটির খবর ক্যামনে পাইব?

—তাহলে তুমি বলতে চাইছ আমি মিথ্যা কথা বলছি?

রাত্রি বাকরুদ্ধ হয়ে গেল কারণ আদী তার কথা অবিশ্বাস করে ওই বুশরা নামক মেয়েটির কথা বিশ্বাস করছে। আদী শুধালো,

—কী কইতাছ তুমি?

রাত্রি কান্না চাপছে প্রাণপণে। কিন্তু কণ্ঠ ভিজে আসছে কথা বলতে গিয়ে,

—আমি কিছুই বলছি না। কিন্তু পুরো পৃথিবীর এত এত মানুষের মাঝে আমাকেই সবার মিথ্যাবাদী কেন মনে হয়? আমি তো কোনোদিন সজ্ঞানে মিথ্যা কথা বলি না, কারো অমঙ্গলও চাই না। তাহলে আমার সাথেই…

রাত্রিকে থামিয়ে দিয়ে আদী বলে ওঠল,

—রাতবিরেতে এমন আজাইরা কান্না আমার ভালো লাগতাছে না। তোমার যদি মনে হয় সবাই তোমারে মিথ্যাবাদী মনে করে। যদি মনে হয় তোমার কথাই ঠিক আর বুশরা ভুল। তাহলে আমার সাথে সম্পর্ক রাইখো না। তোমাকে কেউ জোর করতাছে না সম্পর্ক রাখার জন্য। ফোন রাখলাম আমি। এসব আলগা পিরীতি মার্কা কথা শোনার খায়েশ এখন আর নাই। প্রেশারের ওষুধ খেয়ে ঘুম দিতে হবে। রাখলাম।
(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here