#আষাঢ়ি_পূর্ণিমা
#পর্ব_১৩
✍️ খাদিজা আক্তার (Diza)
আদী বলেছিল সে দুই দিন আগেই বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাবে যেন কেউ সন্দেহ করতে না পারে। আর তার পরিকল্পনা অনুযায়ী রাত্রি বাসায় বলেছে সে তার বান্ধবীর বাড়ি যাচ্ছে যার আম্মা দুই দিন আগে মারা গেছে। ঘটনা পুরোপুরি মিথ্যা নয়। শর্মির আম্মা সত্যিই মারা গেছেন। তবে সেটি দুই দিন আগে নয়, পনেরো দিন আগে। হার্ট অ্যাটাক হয়েছিল আর শর্মিদের অবস্থা তেমন ভালো নয়। ফলে অকালে শর্মির আম্মা পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করেছেন।
এখন সকাল আটটা। বৃষ্টিস্নাত আকাশের দিকে এক পলক দেখে রাত্রি তাকাল আদীর দিকে। আদী গম্ভীর মুখে সিএনজির ভাড়া মিটিয়ে চলছে। ভেজা পথে দাঁড়িয়ে রাত্রি মনের মধ্যে উষ্ণ বেদনা অনুভব করল, কিন্তু এখন নির্বিকার হওয়া ছাড়া যে অন্য উপায় নেই।আদী শরীর নুইয়ে রাত্রির ব্যাগ হাতে নিলো। একটিবারও রাত্রির চোখে চোখ রাখল না। তার এমন আচরণ রাত্রির চোখে পড়লেও সে অন্য চিন্তায় এসব নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছে না।
—এসো।
এ বলে আদী হাঁটতে শুরু করল আর তার পিছু পিছু হাঁটছে রাত্রি। ঝিরিঝিরি বৃষ্টি হচ্ছে অথচ আদী তাকে ভিজিয়ে নিয়ে চলেছে। রাত্রী আজ থ্রিপিস পরে মুখ ঢেকেছে মাস্কের আড়ালে। মাথায় হিজাবও পরেছে, কিন্তু এ ঝিরিঝিরি বৃষ্টিতে সব যেন ভিজে যাচ্ছে। এদিকে আদীও ভিজে ঝপঝপ হয়ে আছে। এমন বেখেয়ালি আচরণ কেন করছে আদী? এ চিন্তা মাথায় আসতেই রাত্রির পা কোনো এক শঙ্কায় ভারী হয়ে গেল। চলার পথে আদীর সাথে দূরত্ব বেড়ে গেল। যখন প্রায় থেমে দাঁড়িয়ে রইল, তখন আদী এসে এক হাত ধরে বলল,
—বৃষ্টির মধ্যে দাঁড়িয়ে পড়লে কেন? চলো শীগগির।
এ বলে আদী টানতে টানতে রাত্রিকে নিয়ে একটি হসপিটালে ঢুকে পড়ল। কালকে রাতে যখন আদী বলেছিল, সকাল আটটায় অমুক হসপিটালে চলে আসবে। রাত্রি অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করেছিল,
—এত সকালে হসপিটালে গিয়ে কী করব?
—No question. যখন যাবে, তখন দেখতেই পাবে। আর শর্ত অনুযায়ী তুমি আমাকে কিছু জিজ্ঞাসা বা বারণ করতে পারবে না।
এরপর আর রাত্রি কোনো কথা বলেনি। এখনো চুপচাপ একটি ঘোরের মধ্যে হেঁটে চলেছে। প্রায় পাঁচ মিনিট হাঁটার পর একটি কেবিনের কাছে এসে আদী থামল। ডাকল,
—বুশরা?
নামটি শুনে রাত্রির মাথায় যেন বজ্রপাত হলো। তড়াক করে সে সাদা চাদরের তলায় অবস্থান করা মেয়েটির দিকে তাকাল। কিন্তু তেমন করে চিনতে পারল না।
—বুশরা?
মেয়েটি ঘুমিয়ে আছে। ফলে দ্বিতীয়বার ডাকল আদী। এতেই কাজ হলো। মেয়েটি চোখ পিটপিট করে একবার রাত্রিকে দেখে নিলো। এরপর আদীর দিকে তাকিয়ে কাতর স্বরে বলল,
—কখন এলে?
—এখনই। তোমার অবস্থা…
—আমার কথা বাদ দাও। লাস্ট স্টেজে আছি। তোমার কথা বলো।
—রাত্রিকে নিয়ে এসেছি। তুমি তো জানোই ওর সম্পর্কে। কিছু বলার থাকলে বলো।
মেয়েটি আদীর কথা শুনে একটু উঠে বসার চেষ্টা করল। রাত্রি এদিকে ভেবেই পাচ্ছে না এটি বুশরা না কি অন্য কেউ। এত কম সময়ে একটি মেয়ের চেহারা এভাবে খারাপ হয় কীভাবে? বুশরা হাত বাড়িয়ে রাত্রির একটি হাত ধরে কাছে টানল। বলল,
—খুব ভাগ্য না হলে আদীর মতো কাউকে জীবনে পাওয়া যায় না। আমিও ভাগ্যবতী ছিলাম। তবে ওকে বিয়ে করতে পারলে বেশি খুশি হতাম। আমি ওকে বিয়ে করার জন্য প্রস্তাবও দিয়েছিলাম। কিন্তু আমাকে মানা করে দিয়েছে। স্পষ্ট করে কী বলেছে জানো? রাত্রির মতো কাউকে না পেলে আমি বিয়ে করব না। এটি শুনে আমার এত রাগ হলো। আমি ভাবলাম হয়তো তোমাকে ভালোবাসে। তাই তো সেদিন তোমার ইউনিভার্সিটিতে গিয়েছিলাম তোমাকে কথা শোনাতে। কিন্তু সেখান থেকে ফেরার পর জানতে পারলাম অনেক আগেই না কি তোমার বিয়ে ঠিক হয়ে আছে। এরপরই আমার ভুল ভাঙল যে আদী তোমার মতো মেয়েকে ভালোবাসতে চায়, তোমাকে নয়। কিন্তু ভুল ভাঙলে গিয়ে হবে? আমার যে মরণব্যাধি হয়ে গেল।
এ বলে একটু যেন হাসতে চেষ্টা করল বুশরা। এ হাসিতে সুখ নেই তা রাত্রি বুঝতে পারছে। কিন্তু এ মুহূর্তে কিছু বলার মতো খুঁজে পাচ্ছে না।
—আমি জেনে না জেনে তোমার সাথে বাজে ব্যবহার করেছি। আমার কথায় দুঃখ পেয়ে থাকলে ক্ষমা করে দিয়ো। বাঁচব না আর বেশি দিন। পাপ তো কম করিনি জীবনে। তোমার কাছে ক্ষমা পেলে মনে হয় একটুখানি পাপের হাত থেকে পরিত্রাণ পেয়েছি।
*
সাদা মার্বেল পাথরের মেঝে আর একাধিক বাতিতে ঝলমল করছে বাথরুম। এত নামীদামী বাথরুমে এর আগে কখনো ঢোকেনি রাত্রি। ফলে অবাকের সীমা নেই তার। বুশরার সাথে দেখা করার পর আদী সোজা তাকে নিয়ে এসেছে এক বিশাল অট্টালিকায়। এটি ভাড়া করা নয়, পরিচিত কারোর বাড়ি। কারণ এ বাড়ির চাবি আদীর কাছেই ছিল আর সে নিজে মেইম ফটক খুলে রাত্রিকে নিয়ে প্রবেশ করেছে। কৌতূহলে মনে হাজার প্রশ্ন ঘুরপাক খেলেও রাত্রি চুপচাপ থেকে এসেছে।
সকাল ফুরিয়ে দিন বাড়ছে, কিন্তু বৃষ্টি কমার নাম নেই।শহরের এককোণে অবস্থিত এ বাড়িতে আসতে সিএনজি নিয়েছিল আদী। আর তাতেও বৃষ্টি উপেক্ষা করা যায়নি। ফলে ভিজে একসা হতে হয়েছে রাত্রিকে। অবশ্য বাড়িতে পা রাখার সাথে সাথেই কাপড়ের প্যাকেট দিয়ে আদী বলেছিল,
—ভিজে গিয়েছ। এটি পরে নাও।
খয়েরী রঙের একখানা শাড়ি হাতে নিয়ে অবাক চোখে তাকিয়ে ছিল রাত্রি আদীর পানে। আদী বুঝতে পেরে বলেছিল,
—আমি জানি তুমি শাড়ি অপছন্দ করো। কিন্তু আমি আমার গার্লফ্রেন্ডকে শাড়িতেই দেখতে চাই। Is it understand?
রাত্রি কোনো তর্ক করেনি। কিন্তু জীবনের এতগুলো বছর যে শাড়ি পরেনি। হুট করে শাড়ি পরার বিষয়টি তার কাছে অস্বস্তির লাগতেই পারে। আর এ অস্বস্তি নিয়ে রাত্রি চুপচাপ ওয়াশরুমে দাঁড়িয়ে আছে। ভয়ে এবং ভেজা গায়ের ঠাণ্ডায় সে বারবার কেঁপে ওঠল। তার কেবলই মনে হচ্ছে,
—তুমি কি নেশা করেছ? তোমার আচরণ আমার স্বাভাবিক ঠেকছে না আদী। আমি যেচে কোন বিপদ ডেকে আনলাম?
আচমকা বিদ্যুৎ চমকে ওঠল আর পরক্ষণেই রাত্রির চোখের তারায় সেই বিশ্রী রাতের দৃশ্য ফুটে ওঠল। খুব ঝড়বৃষ্টি সে রাতে। ঘরময় অন্ধকার ছড়িয়ে রাত্রি ফোন নিয়ে বসে ছিল। আনমনে একটি গানের সুরে বিভোর ছিল।
ওগো বৃষ্টি আমার চোখের পাতা ছুঁইয়ো না…
এ গানে হারিয়ে গিয়ে রাত্রি মুগ্ধ হয়ে মেঘের গর্জনও শুনছিল। হঠাৎ তার ফোন বেজে ওঠল। রিসিভ করে বলল,
—বলো।
—বলো মানে? এমন ভাব লইয়া আমার লগে কথা কও ক্যা? তোমার বাপেরটা খাই না পিন্দি?
—এমন করে কথা বলছ কেন? কল করলে বলে ভাবলাম হয়তো কিছু বলার জন্য কল করেছ।
—হ। বলমুই তো। আমি নেশা করছি।
এ কথা শুনে রাত্রি মন কেমন করে ওঠল, কিন্তু সে তার মনের ব্যাকুলতা গোপন করে ছোট্ট জবাব দিলো,
—ও
—ও মানে কী? বিশ্বাস হয় নাই?
—হয়েছে।
—হইলে তো হইব না। খাঁড়াও তোমারে ছবি দেই।
—লাগবে না।
এ বলতে গিয়ে রাত্রির গলার স্বর কেঁপে ওঠল।
—না লাগলেও দেখতে হইব। ইনবক্সে গিয়া দেহো ছবি দিছি। তুমি মনে হয় ভাবতাছ আমি সিগারেট খাইয়া নেশা করছি— এটা বুঝাইতাছি। আরে এ উস্টার নেশা আমি প্রত্যেক দিনই করি। আর সিগারেট খাইলে নেশা হয় না। নেশা করতে হয় অন্য চিজ দিয়া। তুমি ইনবক্সে দেহো।
—ইচ্ছে করছে।
এটি শুনে আদী গর্জে ওঠল,
—তোমার ইচ্ছে আমি উস্টা মারি। যেডা কইলাম, হেডা করো। এক কথা বারবার কইতে আমার ভাল্লাগে না।
(চলবে)