আষাঢ়ি পূর্ণিমা পর্ব ১০

0
329

#আষাঢ়ি_পূর্ণিমা
#পর্ব_১০
✍️ খাদিজা আক্তার (Diza)

বারান্দায় অন্যমনস্ক হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল রাত্রি। মুখ ফিরিয়ে দেখল, অভি তাকে ডাকছে। অথচ অন্তর যেন আদীর গলা শুনতে পেল।

—কিছু বলবি?

—সবাই তৈরি হয়ে তোমার জন্য অপেক্ষা করছে। তুমি যাবে না?

আজকে শপিং করতে যাওয়ার কথা; বিয়ের শপিং। কিন্তু বিয়ে করার ইচ্ছা যার নেই, সে কীভাবে শপিং নিয়ে মাতামাতি করবে? কিন্তু অমত থাকলেও সেটি প্রকাশ করার সাহস রাত্রির নেই। তাই নিরস গলায় জবাব দিলো,

—যাব।

—তাহলে চলো শীগগির।

—তুই যা। আমি আসছি।

—ঠিক আছে।

এ বলে অভি চলে যাওয়ার জন্য পা বাড়িয়েছে, কিন্তু হঠাৎ কিছু মনে পড়তেই বলল,

—আমি তো বলতেই ভুলে গেলাম। নীচে যাওয়ার আগে আদী ভাইয়া বলেছে একবার ছাদে যেতে।

রাত্রি অবাক হলো,

—ছাদে!

—হুঁ

—তুই যা।

—ঠিক আছে।

অভি চলে গেল। এখন সকাল ছাদে যেতে রাত্রির কোনো আপত্তি নেই। কিন্তু ছাদে গিয়ে আদীর মুখোমুখি হওয়ার কোনো ইচ্ছেও তার নেই। তবে নিজের অজান্তেই রাত্রির মনে প্রশ্ন এলো,

—জ্বর মাথায় করে তুমি আবার এ বাড়িতে কেন এলে? আমাকে সেদিন আঘাত করে আজ তোমার কী চাই?

রাত্রি ভাবল আর চট করে সিদ্ধান্ত নিলো আদীর সাথে সে দেখা করবে না। শপিং করতে যাওয়ার জন্য আগে থেকেই তৈরি ছিল রাত্রি; প্রস্তুতি অতি সাদামাটা। ফোন আর ছোট্ট একটি ব্যাগ নিয়ে নিচে নামতে শুরু করল। কিন্তু দু’টি সিঁড়ি পার হতে গিয়ে তার মন কেমন ওঠল। রাত্রি আর সামনে পা বাড়তে পারল না। উলটো দিকের সিঁড়ি দিয়ে হঠাৎ ছুটতে শুরু করল। এক ছুটে আদীর সামনে এসে দাঁড়াল। এমন পাগলের মতো ছুটোছুটি করার অভ্যাস তার নেই। কিন্তু আজ এমন আচরণ করে নিজের কাছে অবাক হচ্ছে রাত্রি।

আদী আকাশের দিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে ছিল। তাই রাত্রির ছুটে আসার বিষয়টি তার দেখা হয়নি। কিন্তু টের পেয়েছে আর এখন পাচ্ছে; রাত্রি হাঁপাচ্ছে।

—এখনো ডাকলে এমন করে ছুটে আসবে— এ আমি স্বপ্নেও ভাবিনি। এতকিছুর পরও আমাকে পর করে দিতে পারো না কেন?

কথাগুলো বলে রাত্রির দিকে মুখ করে দাঁড়ালো আদী। রাত্রির নিশ্বাস এখনোও স্বাভাবিক হয়নি। তবে তার মুখ ভর্তি রাগ আর নত দৃষ্টি আদীর চোখ এড়ায়নি।

—মনের মধ্যে এত ঘৃণা নিয়েও আমার ডাকে ছুটে এলে কেন?

রাত্রি জবাব দিলে না। আদী রেলিঙে ভর দিয়ে হাত ভাঁজ করে দাঁড়ালো। তাচ্ছিল্যের সুরে বলল,

—জ্বরে মরে যাচ্ছিলাম। দেখতে যাবে সে তো অনেক দূরের ব্যাপার। একটিবার আমাকে ফোনও করলে না। এ অসুস্থ শরীরে আমিই এলাম তবুও তুমি আমায় তাকিয়ে দেখছ না রাত্রি।

—দশ দিন পর যার বিয়ে, তার কাছ থেকে কী আশা করছ তুমি?

শান্ত গলায় প্রশ্ন করে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল রাত্রি। আদী স্মিত হেসে বলল,

—যদি বলি আস্ত তাকে আশা করি।

—স্বর্ণালির সুই””সাইডের বিষয়ের পর তোমার মাথা খারাপ হয়ে গিয়েছে নয়তো এমন উদ্ভট কথা তুমি মুখেও আনতে না। আমার বিয়ে নিয়ে যখন প্রথম কথা শুরু হয়, তখন তুমি একটি কথাও বলোনি। আজ এতগুলো মাস তুমি আমার সাথে যারপরনাই ব্যবহার করেছ যেন আমি তোমার থেকে দূরে সরে যাই। আমার নোংরা কথা শোনাতে একটুও বাকি রাখোনি। ভেবেছ আত্মসম্মানের ভয়ে হয়তো তোমাকে আমি ইগনোর করব। কিন্তু আমি সেসব কিছু করিনি বলে তুমি অন্য মেয়েদের সাথে ফূর্তি করা শুরু করলে। ভাবলে এতে হয়তো আমি রেগে গিয়ে তোমার সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করব। আমি সেসবেও কিছু করিনি। কিন্তু একের পর এক আঘাতে আমার ভেতরে পুড়ে কয়লা হয়ে গেছে। তাই মুখের কথায় বলেছি সম্পর্ক শেষ। কিন্তু আদোও কি আমি শেষ করেছিলাম?

—ইদানীং অনেক কথা শিখে গেছ। কত কথা আজকাল বলতে পারো।

হাসার চেষ্টায় কথাগুলো বলে রাত্রির মুখপানে চেয়ে রইল আদী। তার বুকের ভেতর এখন কষ্ট টগবগিয়ে ওঠছে, কিন্তু তা চেপে রাখতে হচ্ছে খুব কষ্ট।

—আমি অবাস্তব কোনো কথা নিশ্চয়ই বলছি না। বলো আমায় যে এগুলো মিথ্যে।

মাথা নামিয়ে আদী বলল,

—পুরাতন বিষয় এখন না-ই বা টানলে। আমি তো তোমায় সরি বলতে এসেছি রাত্রি।

—সরি! তুমি তাহলে সরি বলতেও শিখেছ? আর এত দিনে তোমার মনে হয়েছে যে আমাকে সরি বলা উচিত?

—রাত্রি, তুমি কিন্তু আমার মতো বিহেভ করছ। আমি বদলে গিয়েছি রাত্রি। Please, trust me.

বলেই দুই কদম এগিয়ে এলো রাত্রি আর তখনই নিচ থেকে ডাকাডাকি শুনতে পেল তারা। কেউ অনবরত রাত্রিকে ডাকছে। কিন্তু সেসব তোয়াক্কা না করে রাত্রি জবাব দিলো,

—আমৃত্যু আমি তোমায় বিশ্বাস করব, কিন্তু কখনো ক্ষমা করব না।

বলেই রাত্রি নিচে যাওয়ার জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়ে। কিন্তু আদী রাত্রির দুই বাহু শক্ত করে চেপে কাছে এনে জিজ্ঞাসা করে,

—এত অভিমান কেন আমার প্রতি?

রাত্রি শক্ত চোয়ালে বলে ওঠল,

—অভিমান নয়, আমি তোমায় ঘৃণা করি আদী।

আদী শব্দ করে হেসে ওঠল,

—তাই? আমি জানি তুমি আমায় ঘৃণা করো। কিন্তু যাকে ঘৃণা করো, তার ডাকে এমন অন্ধ হয়ে ছুটে কেন আসো?

রাত্রি কোনো উত্তর দিলো না। আদী আবার বলল,

—ঘৃণা করো আর অভিমান করো। সেটি তোমার ব্যাপার। কিন্তু আমার চাওয়া অপূর্ণ রেখে তুমি বিয়ের পিঁড়িতে বসবে? এটি কী আমায় মানতে বলছ?

আদীর হাতের আঙুল শক্ত হয়ে ওঠছে আর বাহু ব্যথায় রাত্রির চোখে পানি জমছে। সেসব পাত্তা না দিয়ে রাত্রি বলল,

—তোমার অবাস্তব চাওয়া মানতে আমি বাধ্য নই। আমায় যেতে দাও। সবাই খোঁজাখুঁজি করছে। তাছাড়া এ অবস্থায় দেখলে…

রাত্রির মুখ থেকে কথা ছিনিয়ে নিয়ে আদী বলল,

—কী ভাববে? আমরা দু’জনে পিরীতি করে মরছি।

—ছিঃ! এমন জঘন্য কথা বলতে তোমার বুকে বাঁধে না?

—আমার বুকে যে ব্যথা হয় সে খবর রাখো তুমি? আমি পাগল যাচ্ছি। আগেই ভালো ছিলাম। কোনো কিছু নিয়ে মাথা ঘামাতাম না। কিন্তু রাত্রি এখন আমার এমন কেন লাগে? আমার মনে হয় সমস্ত পৃথিবীতে কেউ আগুন জ্বালিয়ে দিয়েছে। আর সে আগুনে আমি দিবারাত্রি জ্বলেপুড়ে মরছি।

—তোমার জ্বর। তুমি ডাক্তারের কাছে যাও আর এখন আমায় যেতে দাও। Leave me.

—হুঁ, ছেড়ে দিবো। কিন্তু বলো আমার পাওনা আমায় বুঝিয়ে দিবে।

—তোমার মাথা ঠিক নেই আদী। তুমি পাগল হয়ে গিয়েছ।

রাত্রি উত্তেজিত হয়ে বললেও আদী শান্ত গলায় বলল,

—আমি শুরু থেকেই পাগল ছিলাম। এখন হয় তুমি আমার পাওনা বুঝিয়ে দিবে নয়তো তুমি নিচে গেলে আমি সবার সামনে থেকে তোমায় তুলে নিয়ে যাব৷ এটি করলে অবশ্য তেমন কিছু হবে না, কিন্তু তুলে নিয়ে যাওয়ার আগে তোমায় জড়িয়ে ধরে চিৎকার করে বলব আমি তোমার ভালোবাসি।

আদীর মুখে এমন ভয়ংকর কথা শুনে রাত্রির চোখ বড়ো বড়ো হয়ে গেল। এ কী বলছে আদী!

—তুমি এসব কী বলছ আদী? তোমার সাথে এমন কোনো সম্পর্ক আমার কখনোই ছিল না। তাহলে কেন আমার সর্বনাশ করতে চাইছ? এমনটি করলে আমি যে…

—মুখ দেখাতে পারবে না। তাই তো? I don’t have any problem. তুমি আমার পাওনা শোধ না করলে আমি এসবই করব। বিয়ের এখনো দশ দিন বাকি। কিন্তু আমি তোমাকে ভাবার জন্য দুই দিন সময় দিলাম। পরশু রাত বারোটার আগে আমাকে জানিয়ে দিয়ো৷ নয়তো বাড়ি ভর্তি লোকের সামনে আমার প্রেমিকরূপ দেখার জন্য তৈরি থেকো।
(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here