আলো-আঁধার পর্ব 5

0
362

#আলো-আঁধার?
#লেখিকা: সালসাবিল সারা

৫.
এলোমেলো পায়ে যাচ্ছে তূর্যয়।বেশ সময় যাবত সে আর রাণী এই বৃষ্টিতে ভিজেছে।কারণ এই জঙ্গলে তূর্যয় পথ খুঁজে পাচ্ছিলো না।এখনো রাণী তার কোলে।যদিও এখন বৃষ্টি নেই,তবে অতিরিক্ত মাত্রায় বৃষ্টিতে ভেজার কারণে তূর্যয়ের শরীর খারাপ হতে শুরু করলো।বারবার তার চোখ বুজে আসছে।কিন্তু সে নিজেকে যথেষ্ট ঠিক রাখার চেষ্টা করছে।হঠাৎ করে সে দেখতে পেলো, দূর থেকে একটু একটু আলো দেখা যাচ্ছে।সেই আলোকে অনুসরণ করতেই তূর্যয় দ্রুত জঙ্গল থেকে বেরিয়ে যেতে সক্ষম হলো।রাণীর কোনো হুঁশ নেই। সে নিশ্চিন্তে জ্ঞান হারিয়ে লেপ্টে আছে তূর্যয়ের সাথে।সামনে চোখ যেতেই তূর্যয় বেশ অবাক হলো।কারণ,তার সামনে থাকা বিল্ডিংটি আর অন্য কোনো বিল্ডিং নয়,বরং মায়া এতিম খানা।তবে,এই দিকটা হলো মায়া এতিম খানার পেছনের দিক।তূর্যয় কোনো ভাবেই আর রাণীকে কোলে নিতে পারছে না।তার হাতের শক্তিটা যেনো কমে আসছে।মাথাটা ঝিম ঝিম করছে তূর্যয়ের। সে এই মুহুর্তে কি করবে কিছুই ভেবে পাচ্ছে না।এই এতিম খানার বাউন্ডারি অনেক বড়।সামনের দিকে যেতে হলে তূর্যয়কে আরো অনেক পথ অতিক্রম করতে হবে। যা তূর্যয়ের পক্ষে মোটেও সম্ভব না।এইদিকে রাণীর অবস্থাও খারাপ হচ্ছে,সেটা রাণীর নীল হয়ে যাওয়া ঠোঁট দেখেই বোঝা যাচ্ছে।তাছাড়া,রাণীর হাতে একটা ক্ষত চিহ্ন দেখতে পাচ্ছে। এই ধরনের ক্ষত সাধারণত জঙ্গলের কিছু পোকার কামড়ে হয়,এটা বুঝতে দেরী হলো না তূর্যয়ের।এমন অবস্থায় আরো বেশিক্ষণ থাকলে রাণীর বড় কোনো ক্ষতি হতে পারে।তূর্যয় এইভাবে নিরপরাধ কারো ক্ষতি কখনোই করেনি।যেই তূর্যয় মুহূর্তেই যেকোনো বড় সিদ্ধান্ত নিয়ে নেয়, সেই তূর্যয় আজ এই এতিম খানায় প্রবেশ করবে নাকি করবে না,সামান্য এই সিদ্ধান্ত নিতে পারছে না ।আকাশে মেঘের শব্দ শুনতে পেয়ে রাণীর দিক থেকে তূর্যয় নজর সরিয়ে নিলো।নিজের ঝাপসা হয়ে যাওয়া চোখগুলো দুই তিনবার পলক ফেলে আবারও চোখ মেলে তাকালো তূর্যয়।নিজের বুকে পাথর বেঁধে তূর্যয় আজ তার নিজের ঘরে যাওয়ার জন্যে পা এগিয়ে দিল।অজানা কারণে তূর্যয়ের পা কাঁপছে এই ঘরে প্রবেশ করতে গিয়ে।এতিম খানার পেছনের গেইট দিয়ে এই ঘরে বহু বছর পর প্রবেশ করলো তূর্যয়। আশ্চর্য্যজনক হলেও,আজও তূর্যয় এই ঘরের কোনো অংশ ভুলেনি।যদিও এই এতিম খানা তূর্যয়ের ঘরের চেয়ে আরো বড় করা হয়েছে।তবে নিঃসন্দেহে তূর্যয় তার আগের স্মৃতি অনুসরণ করে এতিম খানার মাঝখানের অংশে চলে এলো।এতিম খানার বাচ্চারা ইতিমধ্যে চিল্লাচিল্লি শুরু করে দিয়েছে তূর্যয় আর রাণীকে দেখতে পেয়ে।তূর্যয় নিজের নিয়ন্ত্রণ হারানোর আগেই রাণীকে নিজের কোল থেকে নামিয়ে,পিলারের সাথে হেলান দিয়ে বসিয়ে দিল।তূর্যয় নিজের মাথা চেপে দাঁড়িয়ে রইলো।এই ঘরে প্রবেশের পর থেকেই তার মনে হচ্ছে,তার মায়ের কথার শব্দ যেনো তার কানে প্রবেশ করছে।এই কারণে তূর্যয়ের মাথার যন্ত্রণা যেনো আরো বেড়ে গেলো।অন্যদিকে বাচ্চাদের চিল্লানো শুনে মোল্লা সাহেব এতিম খানার মধ্যখানে চলে এলো।তূর্যয় আর তার সাথে অন্য একটি মেয়েকে দেখে মোল্লা সাহেব থমকে গেলেন।তূর্যয়কে এইখানে দেখে মোল্লা সাহবের পা যেনো আর সামনে আগাচ্ছে না।আজ কত বছর যাবত মোল্লা সাহেব তূর্যয়কে এইখানে আনতে চেয়েছেন,কিন্তু তূর্যয় কখনো এইখানের ভেতরে আসতে চায়নি।তবে,আজ তূর্যয়কে এইখানে দেখে মোল্লা সাহেব যেনো জেগে থাকা অবস্থায় স্বপ্ন দেখছেন! তূর্যয়কে ঢুলতে দেখে মোল্লা সাহেব দ্রুত গিয়ে তূর্যয়কে ধরে ফেললো।তূর্যয়ের শরীর প্রচন্ড ভেজা দেখে মোল্লা সাহেব আতকে উঠে বললেন,”বৃষ্টিতে ভিজেছিস তুই?বাচ্চাই থেকে যাবি নাকি?জানিস না,
বৃষ্টিতে অতিরিক্ত ভিজলে তোর মাথায় যন্ত্রণা হয়!তোকে দেখে তো মনে হচ্ছে ঘণ্টার পর ঘণ্টা তুই বৃষ্টিতে ভিজেছিস।এইসব কি তূর্যয়!”মোল্লা সাহেবের এমন কথায় তূর্যয়ের কোনো হেলদুল নেই।সে নিজেকে আয়ত্বে আনার চেষ্টা করছে।কিন্তু তার মাথায় অসহনীয় এক চাপের কারণে সে নিজের উপর থেকে নিয়ন্ত্রণ হারাচ্ছে।মোল্লা সাহেব তূর্যয়ের এমন অবস্থা দেখে জলদি নিজের ছেলে কাফিফ আর এতিম খানার মহিলা সহযোগী মুনাকে ডাক দিলো,”কাফিফ,মুনা জলদি আয় এইদিকে। এদেরকে চিকিৎসার কক্ষে নিয়ে আয়।”মোল্লা সাহেবের কথায় কাফিফ আর মুনা চলে এলো।মুনা আর অন্য দুইজন মেয়ে মিলে,রাণীকে তুলে নিলো।আর মোল্লা সাহেব এবং কাফিফ মিলে তূর্যয়কে চিকিৎসার রুমে নিয়ে গেলো।এটা মূলত এতিম খানার বাচ্চাদের জন্যে করা।এতিম খানার কারো যেকোনো অসুস্থতায় তাদের এইখানে এনে চিকিৎসা দেওয়া হয়।দুইজন ডাক্তার এইখানে সব সময় নিয়োজিত থাকে।এরা অবশ্য শহরের বড় হাসপাতালের ডাক্তার।তূর্যয় হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের সাথে চুক্তি করে এই দুইজন ডাক্তারকে ভাড়া করেছে এই এতিম খানার জন্যে।চিকিৎসার কক্ষে তূর্যয় আর রাণীকে নেওয়া হলে সাথে সাথেই তাদের চিকিৎসা শুরু করা হয়।একটা এন্টিবায়োটিক ট্যাবলেট খেতেই তূর্যয়ের মাথার যন্ত্রণা ধীরে ধীরে কমতে থাকে।আর তার মাথায় ধীরে ধীরে আসতে লাগলো এক এক কথা।বেশ কিছুক্ষণ পর তূর্যয়ের মাথার ভারী ভাব কমলে সে চোখ মেলে তাকায়।তার মাথায় হঠাৎ এলো রাণীর কথা।কিন্তু তার নাম জানা না থাকায়,তূর্যয় তার সামনে বসে থাকা মোল্লা সাহেবকে বলে উঠলো,”আমার সাথে একটা মেয়ে ছিল,সে কোথায়?” তূর্যয়ের কথায় মোল্লা সাহেব বলে উঠলো,”ঐযে পর্দার অপর পাশে।ইনজেকশন দেওয়া হয়েছে তাকে।একটু পরেই জ্ঞান আসবে তার।জঙ্গলের বিষাক্ত কিট কামড়িয়েছে তাকে।বৃষ্টিতে ভেজার কারণে হালকা জ্বর‌ও ছিল।কিন্তু, ইনজেকশন দেওয়ার কারণে সব কমে যাবে,এমনটাই বললো ডাক্তার।তবে,মেয়েটি কে?কখনোই তো দেখলাম না তোর সাথে।আর তুই বা এইখানে কিভাবে এসেছিস?এতো বছরে তো তোকে আমি এই বাড়িতে আনতে পারিনি।”মোল্লা সাহেবের কথায় তূর্যয় চুপ করে রইলো।তার নিজের বাড়িতে এসেছে সে,এটা ভাবতেই আবারও তার মায়ের কথা তার কানে ভেদ করছে।আবারও তূর্যয়ের মাথা ব্যাথা করতে শুরু হলো। ঐ মেয়েটা তার সাথে না থাকলে,আর তূর্যয়ের শরীর খারাপ না হলে সে কখনোই এই বাড়িতে আসতো না।কারণ এই বাড়ির দিকে দেখতেই তার অনেক স্মৃতির কথা মনে পড়ে যায়।এই স্মৃতি বড্ড পোড়ায় তূর্যয়কে।মোল্লা সাহেবকে কিছু না বলে তূর্যয় চুপ করে রইলো।হঠাৎ কাফিফ তার হাতে কাপড় নিয়ে এসে তূর্যয়ের উদ্দেশ্যে বললো,”ডাক্তার এর নির্দেশ,
ভেজা কাপড় আপনার জন্যে ভালো হবে না।আমার এই পায়জামা,পাঞ্জাবি একেবারে নতুন।সাইজে আমার বড় হওয়ায় আমি কখনোই পড়িনি।আপনার একেবারে পারফ্যাক্ট হবে এই পায়জামা,পাঞ্জাবি।” কাফিফের কথায় তূর্যয় মাথা তুলে তাকায় তার দিকে।তূর্যয় কাফিফকে হাতের ইশারায় বলতে লাগলো,”আমি এইসব পড়ি না।” কাফিফ হালকা মন খারাপ করলো তূর্যয়ের কথায়।পরক্ষণে সে আবারও তাকে বলে উঠলো,”আপনি এটা পড়ে রেস্ট নিন।আমি আপনি পড়নে কাপড় শুকানোর ব্যবস্থা করিয়ে দিচ্ছি ততক্ষণে।” কাফিফ এর এই কথাটি তূর্যয়ের বেশ ভালো লাগলো।অতঃপর তূর্যয় কাফিফ এর কথায় সায় দিলো।কাপড় চেঞ্জ করে নিজের কাপড় ধরিয়ে দিলো সে কাফিফকে।মোল্লা সাহেব আর কাফিফ,তূর্যয়কে আরাম করতে বলে নিজেরাও বেরিয়ে গেলো সেখান থেকে।তূর্যয় রুমে থাকা ছোট্ট বেডের সাথে হেলান দিয়ে বসলো।নিজের পরিহিত পাঞ্জাবির দিকে একবার তাকালো সে।চোখের রংটাও তূর্যয়ের পরিবর্তন হতে লাগলো এই পাঞ্জাবি দেখে।তার চোখে ভেসে আসছে অতীতের কিছু কথা। নিজের করা কতো আর্তনাদ ভেদ করছে তার মাথায়!যে আর্তনাদ কেউ শুনতো না।অনেক সময় শুনেও অনেকে এগিয়ে আসেনি তাকে একটু সাহায্য করতে! হাত মুঠ করে চোখ জোড়া জোরে বন্ধ করে নিজের রাগকে নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করছে তূর্যয়।তার সাথে করা অন্যায়ের বিচার তূর্যয় করবেই।তবে সে এখন শুধুমাত্র কিছু প্রমাণের অপেক্ষায় আছে।হঠাৎ করে বাতাসে পর্দা নড়ে উঠলে,তূর্যয়ের নজর সেদিকে যায়।আর তার মনে আসে রাণীর কথা।রাণীর কথা মনে আসতেই বেখেয়ালি হয়ে যায় তূর্যয়।সে বেড থেকে নেমে হাত দিয়ে পর্দার একপাশ সরিয়ে দেয়।রাণীকে দেখতে পাচ্ছে সে।কম্বল মুড়িয়ে শুয়ে আছে রাণী।মুখটা হালকা হা হয়ে আছে তার।তূর্যয়ের কাছে অদ্ভুত লাগছে রাণীর চেহারা দেখে।সেই প্রথম দিন থেকেই,এই মেয়েকে তার চেনা মনে হয়।তবে কখন কোথায় সে রাণীকে দেখেছে এটাই তার মনে আসে না।তাছাড়া রাণীর নামটাও এখনো তূর্যয়ের জানা হলো না।নামটা জানলে হয়তো কিছু মনে আসতো তার!টেবিলের উপর থাকা মোবাইল বেজে উঠলে,তূর্যয় পর্দা ঠিক করে টেবিলের দিকে যায়।ওয়াটার প্রুফ হওয়ার কারণে তূর্যয়ের মোবাইল নষ্ট হওয়া থেকে বেঁচে গেলো।মোবাইল কানে ধরতেই অপর পাশ থেকে হ্যারির কণ্ঠ শুনতে পেলো তূর্যয়,”ব্রো,আর ইউ ওকে?” হ্যারির প্রশ্নে তূর্যয় বলে উঠলো,”ইয়াহ।আ’ম ওকে।তুমি কোথায়?”
তূর্যয়ের প্রশ্নে হ্যারি হেসে উঠলো,”আ’ম গোয়িং টু মাই অ্যাপার্টমেন্ট।একটা লং শাওয়ার নিবো দেন বারে যাবো।তুমিও আসবে ওকে! বাই দা ওয়ে, ঐ মেয়েটি কই? ইজ সি অলরাইট?” হ্যারির কথায় তূর্যয় গম্ভীর কণ্ঠে বলে উঠলো,” সি ইজ স্লিপিং।আর আমি বারে আসতে একটু দেরী হবে।আমি কমিশনারের সাথে দেখা করতে যাবো প্রথমে।এরপর তোমার সাথে দেখা হবে।”
“ওকে ব্রো।” হ্যারি কথাটা বলে ফোন কেটে দিলো।তূর্যয় সেই মুহূর্তে সেখান থেকে বের হতে নিলে,ডাক্তারের নির্দেশে আবারও বেডে গিয়ে বসলো সে।যদিও তূর্যয় কখনো কারো কথা শুনে না।তবে এখন তার এমন কাজের দুইটা কারণ আছে।একটা কারণ হলো,তূর্যয়ের গাড়ি আসার অপেক্ষা; আর দুই হলো এখনো তার মাথায় হালকা চাপ অনুভব হচ্ছে।এমন চাপ নিয়ে কমিশনারের সাথে কথা বলতে তূর্যয়ের দ্বিধাবোধ হবে।তাই সে অল্প রেস্ট করতে আবারও বেডে বসলো।তবে তার এই অল্প রেস্ট অল্প সময়ের মধ্যে ঘুম পরিণত হলো।

রাণীর চোখ খুলতেই বড্ড বমি পেলো।বিছানা থেকে পা নামাতেই গলগল করে বমি করে দিলো সে।তখনই একটা মহিলা এসে রাণীর বমি পরিষ্কার করতে লাগলো।রাণী নিজের দিকে তাকিয়ে বেশ অবাক হলো।তার গায়ে কোনো ভেজা কাপড় নেই।কেমন যেনো ঢোলা প্যান্ট আর হাঁটু সমান একটা গেঞ্জি পড়নে সে।রাণীকে জাগতে দেখে একজন ডাক্তার এগিয়ে এসে তাকে বললো,
“চিন্তার কিছু নেই।আপনি এখন ঠিক আছেন।বমি হওয়া মানে পোকার বিষটা বেরিয়েছে আপনার শরীর থেকে।রেস্ট করুন আর কিছুক্ষণ।” রাণী কিছু বলতে গেলে তার কানে ভেসে এলো আযানের শব্দ।রাণী আতংকিত হয়ে ডাক্তারকে প্রশ্ন করলো,”কিসের আযান এটা?” ডাক্তার একটু অবাক হয়ে উত্তর দিল,”মাগরিবের।” রাণীর চোখজোড়া আরো বেশি গোল হয়ে গেলো।সে বেশ জোরে বলে উঠলো,”আল্লাহ্ রে!ম্যাডাম আমাকে আজ মেরেই ফেলবে।” কথাটা বলে সে দৌড় দিয়ে পর্দার অপর পাশে চলে গেলো।সেখানে বেডের উপর ঘুমন্ত তূর্যয়কে দেখে রাণীর পা থমকে গেলো।সাদা রঙের পাঞ্জাবিতে তূর্যয়কে যেনো বড্ড পবিত্র লাগছে।তূর্যয় যে এতো হিংস্র এটা এখন তাকে দেখে মোটেও মনে হচ্ছে না।রাণী তার মনে মনে বলে উঠলো,”কে বলবে এই লোক একটু আগে কতো মানুষকে খুন করেছে!কে বলবে এই লোকের মনে কোনো মায়া নেই?কে বলবে এই লোক নারী, পুরুষ কাউকেই ছাড় দেন না!উফ রাণী,এই সন্ত্রাসীর কথা বাদ দে।দৌড় লাগা তুই।আজ ম্যাডাম তোকে জিন্দা পুঁতে ফেলবে।এই সন্ত্রাসী যাক, ডোবায়।”রাণী আপনমনে কথাগুলো বলে আবারও দৌড় দিতে গিয়ে আবারও থেমে গেলো টেবিলের সাথে লেগে।এমনটা হওয়াতে টেবিলে একটু শব্দ হলো ।রাণী আবারও রুম থেকে বেরিয়ে যেতে গিয়ে থামলো নিজ ইচ্ছায়।”আচ্ছা,আমি এইখানে কিভাবে এসেছি?আমার যতটুক মনে আছে আমি জঙ্গলেই ছিলাম।আর সেখানেই হঠাৎ করে সব কিছু আঁধার হয়ে এসেছিল আমার।এরপর আর কিছু মনে নেই। এইখানে আমি আর এই সন্ত্রাসী ছাড়া তো কেউ নেই।তার মানে আমাকে এইখানে উনি নিয়ে এসেছেন?যাক,এই মানুষটা যতো খারাপ হউক,আমাকে তো সাহায্য করেছেন।যায় একটা ধন্যবাদ দিয়ে আসি।এমনিও সন্ত্রাসী লোকটা ঘুমিয়ে আছে।” কথাগুলো ভেবে রাণী এগিয়ে গেলো তূর্যয়ের দিকে। তূর্যয়ের চোখ অল্প খোলা।ঘুমের ঘোরে এমনটা হতে পারে ভেবে তূর্যয়ের মুখের উপর হাত নাড়িয়ে রাণী তূর্যয়কে বলে উঠলো,
“মানুষ খুন করে কতো আরাম করে ঘুমিয়ে আছেন উনি!ইস,আবার পাঞ্জাবিও পড়েছে।কতো নিষ্পাপ লাগছে আপনাকে, আপনি কি জানেন?উহু,জানেন না।আপনি জানবেন কিভাবে?আপনি তো হৃদয়হীন,পাথর আপনি।মানুষ খুন করা ভালো না।ভালো হয় যান,মানুষের অনেক দোয়া পাবেন।বুঝেছেন?আর হ্যাঁ,অনেকগুলো শুকরিয়া আপনাকে আমার জীবন বাঁচানোর জন্যে।কিন্তু আপনি ভালো না।খারাপ একেবারে আপনি।আপনাকে ধন্যবাদ দিতে গিয়ে আমার দেরী হয়ে গেলো।আল্লাহ্ হাফেজ, সন্ত্রাসী।” রাণী কথাগুলো বলে দৌড় লাগালো আবারও।

তূর্যয় তার অল্প খুলে রাখা চোখগুলো এইবার বড় করে খুললো।একটু আগের টেবিলের শব্দে তূর্যয়ের ঘুম ছুটে গিয়েছিল।চোখ অল্প খুলতেই সে রাণীকে দেখতে পেয়ে সেভাবেই স্থির ছিল।রাণীর বলা কথাগুলো তূর্যয়ের মনে এক অস্থিরতা সৃষ্টি করলো।রাণীর বলা সন্ত্রাসী কথাটা কেনো যেনো তার ভেতরটা নাড়া দিল।রাণীর বলা একেকটা কথায়,রাণীর মুখের ভঙ্গি যেনো তূর্যয়ের চোখেই আটকে রইলো।তবে এই খেয়াল বেশিক্ষণ টিকলো না মোবাইলের শব্দে।মোবাইলে কথা বলে সেও রুম থেকে বেরিয়ে গেলো।তূর্যয়ের গাড়ি চলে এসেছে।সে নিচে নামতেই দেখলো রাণী মোল্লা সাহেবের সাথে কথা বলছে।তাদের দেখে অজানা কারণে আড়ালে দাঁড়ালো তূর্যয়। সে স্পষ্ট মোল্লা সাহেবকে বলতে শুনছে,”তুমি তাহলে মমতা এতিম খানায় থাকো। এতো রাতে তোমাকে আমি একা ছাড়বো না।আমি এইখানের গাড়ি করে দিয়ে আসছি তোমায়। কাফিফ এইখানের খেয়াল রাখিস।তূর্যয় উঠলে তাকে খাবারের ব্যবস্থা করে দিস।চলো, মা।” মোল্লা সাহেব এর সাথে রাণী মাথা দুলিয়ে হাঁটতে লাগলো।
রাণীও এতিম ঠিক তূর্যয়ের মতো।এই কথা তূর্যয়ের মনে আসতেই রাণীর জন্যে এক ধরনের করুণার সৃষ্টি হলো।তবে,তূর্যয়ের পাথর হৃদয় সেইসব একপাশে ঠেলে দিল।সে বড় বড় পা ফেলে সামনে গিয়ে কাফিফকে বললো,
“আমার কাপড়!” কাফিফ দুর্বল কণ্ঠে বলে উঠলো,” এখনো ভেজা।পড়ার যোগ্য না।” তূর্যয় ভ্রু কুঁচকে কাফিফকে বলে উঠলো,”ওকে।তোমারটা পড়ে যাচ্ছি।মোল্লা সাহেবকে টাকা দিয়ে দিবো।আমার মানি ব্যাগ নিয়ে আসো প্যান্টের পকেট থেকে।” কথায় কাফিফ মাথা দুলিয়ে চলে গেলো।তূর্যয় স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইল।আশেপাশে একটুও তাকাচ্ছে না।তার মনে একটা জড়তা কাজ করছে এই ঘরে দাঁড়াতে।অগত্য তূর্যয় পাথরের মতো স্থির হয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে রইলো।

এতিম খানার ভেতরে গিয়ে রাণী একটা প্রশান্তির নিঃশ্বাস ফেলো।কারণ, ম্যাডাম এখনো এতিম খানায় ফিরেনি।তার রুমে যেতেই রাণীকে সবাই ঘিরে ধরলো।সিমি আর কলি রাণীকে দেখে ইতিমধ্যে কান্না শুরু করলো।রাণীর এক হাত চেপে রিয়া রাণীকে বলে উঠলো,”আর জীবনেও তুই এই এতিম খানা থেকে একা বের হবি না।কিসব কাপড় পড়েছিস তুই?আর ঐ বুড়ো আঙ্কেল কে ছিল?” রাণী কিছু বলতে নিলে তখন সিমি বললো,”আমি তো ভেবেছিলাম তুই আর ফিরে আসবি না আমাদের কাছে।” সিমির কথায় রাণী হেসে উঠলো,
” সব বলবো।আর আমি এতো জলদি তোদের থেকে আলাদা হবো না,বুঝলি?” রিয়া এসে রাণীকে জড়িয়ে ধরলো।রাণী এক এক করে সব ঘটনা বললো সবাইকে।আজকের সব অর্ডার বাকিরা মিলে ডেলিভারি দিয়ে দিয়েছে।বাড়তি মাটি হিসেবে তারা এতিম খানার উঠোন থেকে কিছু মাটি আনিয়েছে।অবশ্য রাণী থাকলে রাণী নিজেই এই মাটি ব্যবহার করতো সেই পাহাড়ের মাটির বিকল্প হিসেবে।কিন্তু রাণীর তো তাদের বানানো সব কিছু বেস্ট হওয়া চাই,তাই সে ঐ পাহাড়ের ভালো মাটির জন্যে ছুটেছিল।গোসল সেরে রুমের ব্যালকনিতে তাওয়াল শুকাতে দিতে গেলো রাণী।তার মেজাজ ভীষন গরম।কারণ,আজকে শান্তি মহল থেকে সেই ফুলের টব দেওয়ার খোঁজে ফোন এসেছিল। ঐ মহলে ডেলিভারি দেওয়ার জন্যে কেউ যাওয়ার সাহস করেনি।তাই সাবিনা ফোন করে তাদের নানা হুমকি দিলো।সাবিনা কিছুদিন এইখানে থাকবে না।তবে,যখন সে ফিরবে তখন রাণীকে মাটি নিয়ে সেইখানে যাওয়ার হুকুম দিয়েছে সাবিনা।তার সামনে বসেই নাকি রাণীকে জিনিস বানিয়ে দেখাতে হবে।অবশ্য,এর জন্যে রাণীকে ভালো টাকাও দিবে বলেছে সে।রাণীর মাথা কাজ করছে না।সাবিনা এই শহরের সবচেয়ে বিত্তশালী পরিবারের মালকিন হওয়ায় রাণী তার বিরুদ্ধে কোনো প্রতিবাদ করতে পারছে না।রাণী ব্যালকনির দেওয়ালে হেলান দিতেই দেখতে পেলো মোল্লা সাহেব আর সালেহা দুইজন হাত নাড়িয়ে কথা বলছে।তাদের দেখে মনে হচ্ছে ঝগড়া করছে দুইজন।রাণী বেশ কিছুক্ষণ সেদিকে তাকিয়ে থেকে তার ঘরে এসে শুয়ে পড়লো।পোকার কামড় দেওয়া স্থানেও ব্যাথা করছে তার।চোখ বন্ধ করতেই রাণীর চোখে ভেসে এলো তূর্যয়ের সেই ঘুমন্ত মুখ।রাণী চোখ খুলে মনে মনে বকে উঠলো,”একজন সন্ত্রাসী সারাজীবন সন্ত্রাসীই থাকে।শুধুমাত্র ভালো কাপড় পড়লে, সে কখনো ভালো মানুষ হয়ে যাবে না।” কথাগুলো ভেবে রাণী আবারও চোখ বন্ধ করলো।

হ্যারি মুখে হাত দিয়ে বসে আছে।তার কাছে তূর্যয়কে নতুন নতুন লাগছে।হ্যারির ফোন পেয়ে তূর্যয় কমিশনারের বাসা থেকে সরাসরি বারে চলে এসেছে। তূর্যয়ের বড্ড অস্বস্তি লাগছে পাঞ্জাবির জন্যে।তার উপর হ্যারি তার দিকে তাকিয়ে আছে গালে হাত দিয়ে।হ্যারি তার পাঞ্জাবির জন্যেই এমন করে তাকিয়ে আছে এটা বুঝতে অসুবিধা হচ্ছে না তূর্যয়ের।তার করার কিছুই ছিল না।কমিশনারের বাসা থেকে ফিরতে দেরী হয়ে যাওয়ার কারণে তূর্যয় আর বাসায় ফিরলো না।তাছাড়া হ্যারি বার বার ফোন করে দ্রুত তাকে বারে যেতে বলছিল।অগত্য পাঞ্জাবি পড়েই সে এইখানে চলে এসেছে।সামনে থাকা বিয়ারের গ্লাসে অল্প চুমুক দিয়ে তূর্যয় রাগী কণ্ঠে হ্যারিকে বললো,”এইভাবে তাকিয়ে আছো কেন?”
হ্যারি মুখে হাত দিয়ে বলে উঠলো,”আর ইউ ফাইন?হেলথ ঠিক আছে?” হ্যারির প্রশ্নে তূর্যয় আবারও গম্ভীর কণ্ঠে বলল,”ঠিক না থাকলে কি এইখানে থাকতাম?” কিছুক্ষণ চুপ থেকে আবারও হ্যারিকে সে বলে উঠলো,
” এইভাবে তাকিয়ে থাকা বন্ধ করবে?” তূর্যয়ের কথায় হ্যারি সোজা হয়ে বসলো।গাল থেকে হাত সরিয়ে বলতে লাগলো,” পা..পান..পাঞ্জাবি? এটাকে পাঞ্জাবি বলে তো?একদম ডিফারেন্ট লাগছে তোমাকে দেখতে ব্রো।একদম হট লাগছে।উফ,ব্রো! আমি মেয়ে হলে,তোমাকে বিয়ে করতাম।তুমি করতে না চাইলে,তোমাকে ফোর্স করে বিয়ে করতাম আমি।” তূর্যয় নিজের ঠোঁট বাঁকা করলো আর হ্যারিকে ধমকে বললো,”শাট আপ! ম্যাচিউর একটা ছেলে তুমি।আর তোমার বিহেভিয়ার একটা ছোট বাচ্চার মতো।কমিশনার বলেছে,কালকে তোমার আর আমার ব্যাংক একাউন্টে টাকা দিয়ে দিবে।” হ্যারি আরো কথা বলতে লাগলো তূর্যয়কে।তবে হ্যারি পাঞ্জাবির কথা বলাতে,তূর্যয়ের মাথায় এলো রাণীর কথা।মেয়েটি তাকে কি কি বলেছে,সবটাই তূর্যয়ের মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে।পরক্ষণে তূর্যয়ের মনে এলো,”ঐ মেয়েটি আমাকে হৃদয়হীন,সন্ত্রাসী আরো কি কি যেনো বলেছে! যা বলেছে একেবারেই ঠিক বলেছে।তবে, আমি হলাম লিগ্যাল সন্ত্রাসী।পাপকে দমন করতে নামি দামি শহরের পুলিশ,কমিশনার আমাকেই খোঁজে। ঐ মেয়েটি একদম ঠিক বলেছে আমি হার্টলেস, আমি হৃদয়হীন।যারা নিরপরাধের সাথে অপরাধ করে, আমি তাদের জন্যে হৃদয়হীন।বিভিন্ন মিশন কমপ্লিটের জন্যে মোটা অংকের টাকা পেলে,আমি সেই মিশনের জন্যে হৃদয়হীন।আমার মনে ভালোলাগা, ভালোবাসা বলে কোনো শব্দ নেই।তাছাড়া হ্যারি,মোল্লা সাহেব আর মনি ছাড়া আমার মনে কারো জন্যে মায়ার জন্ম হয়নি।কারণ আমার মনটাই পাথরের তৈরি আর আমার জীবনটা অন্ধকারে ঘেরা।যত্তসব রাবিশ মেয়ে।”
কথাগুলো মনে মনে বলে,তূর্যয় হ্যারির কথার উত্তর দিতে লাগলো।

চলবে….
কপি করা নিষেধ।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here