আলোছায়া ২২

0
372

#আলোছায়া
কলমে: লাবণ্য ইয়াসমিন
পর্ব:২২

বাইরে সময় কাটানোর জন্য রেস্টুরেন্ট ছাড়া কোথাও যাবার কথা জুনায়েদ কখনও ভাবতে পারেনা। তাছাড়া পিউর সঙ্গেও কোথাও যাওয়া হয়নি ওর। শপিং করতে গিয়েছিল দুবার। নাজেহাল করে ছেড়েছিল ওকে। টাকার দফারফা সঙ্গে শরীরের ক্লান্তি তো আছেই। এটা ছেড়ে ওটা ধরে,আবার ওটা ছেড়ে এটা ধরে। জুনায়েদ শেষবার কান ধরেছিল আর কখনও এই মেয়েটার সঙ্গে শপিং করতে আসবে না। শুভ্র বাড়িতে ফিরতে ফিরতে সন্ধ্যার হয়ে গেলো। পারভীন বেগম আত্মীয়দের আদর সমাদরের অভাব রাখলেন না। বাড়িতে আসা আত্মীয়দের সম্পর্কে শুভ্র কিছু জানে না। ও বাড়িতে এসে হন্তদন্ত হয়ে নিজের রুমে গিয়ে ঢুকলো। এই রুমটা ও নিজের হাতে সাজিয়ে গুছিয়ে রাখে। হঠাৎ অচেনা পারফিউমের গন্ধ নাকে ঢুকতে ও বুঝতে পারলো এখানে অচেনা কেউ আছে। কিন্তু কে আছে ঠিক বুঝতে পারলো না। শুভ্র একপা দুপা করে করে ভেতরে এসে আশেপাশে তাকালো কেউ নেই হঠাৎ ওর মনে হলো গন্ধটা বেলকনিতে থেকে আসছে। শুভ্র দ্রুতগতিতে সেখানে গিয়ে উঁকি দিয়ে দেখলো একটা মেয়ে পেছন ঘুরে দাঁড়িয়ে আছে। সাদামাটা থ্রি পিচ পড়নে তবে খোলা চুলগুলো হালকা বাতাসে উড়ছে। দেখতে মন্দ লাগলো না। শুভ্রর মাথায় হঠাৎ অদ্ভুত ভূত চাপলো আর ও চট করে পকেট থেকে ফোনটা নিয়ে কয়েকটা ছবি তুলে নিলো। মুখ দেখতে না পারলে কি হবে মারাত্মক লাগলো। হঠাৎ মেয়েটা পেছনে ফিরে দেখলো শুভ্র ওর দিকে ফোন তাক করে ধরে রেখেছে দেখে ও ভ্রু কুচকে ফেলল। আরিয়া এই ভদ্রলোকের সঙ্গে আজও কথা বলেনি। শুনেছিল লোকটা খুব গম্ভীর কিন্তু লোকটা এভাবে ওর দিকে ফোন কেনো ধরেছে ঠিক বুঝতে পারলো না। ওকে এভাবে তাঁকাতে দেখে শুভ্র ঠোঁটের কোনে হাসি ফুটিয়ে বলল,

> আপনাকে ঠিক চিনতে পারলাম না? এখানে কি করছেন?

শুভ্রর কথা শুনে অরিয়ার কুচকানো ভ্রু আরও কুচকে গেলো। মাথাটা ভনভন করে ঘুরছে। মনে মনে ভাবলো এই ছেলে বলে কি? যার সঙ্গে দুদিন পরে বিয়ে আর তাকে চিনতে পারছে না। এই ছিল কপালে। আরিয়াকে ভাবতে দেখে শুভ্র আবারও বলল,

> সরি আসলে আপনাকে আমি চিনতে পারছি না। আসলে আমি কাজের পেসারে থাকি তাই ভূলে যায়।

আরিয়া শুভ্রর কথা শুনে কপাল চাপড়ে বলল,

> দুদিন পরে এই হতভাগীর মেয়েটা মুখ দেখে দেখে আপনি ঘুম ভাঙবে। সেদিন আমি ঠিক বুঝেছিলাম আপনি আমাকে না দেখে রাজি হয়েছেন। কিন্তু তাই বলে একবার দেখতে পারলেন না?

শুভ্র এবার বেশ চনচল হয়ে উঠলো। মেয়েটার কাছে এসে অপরাধীর মতো গলাটা খানিক নামিয়ে বলল,

> খুব সরি আসলে আমার মাথায় ছিল না আপনি আসতে পারেন। তাছাড়া আব্বু তো দেখেছে আমার আর নতুন করে দেখার কি আছে। আপনি ভেতরে গিয়ে বসুন আমি ফ্রেস হয়ে আসছি।

আরিয়া মাথা নেড়ে সম্মতি দিলো। শুভ্র হন্তদন্ত হয়ে বাথরুমে চলে গেলো। আরিয়ার এখানে থাকতে আর ইচ্ছে হলো না। কপালে খাটাস টাইপ বর জুটেছে একে কিভাবে মানুষ করবে ভেবেই মাথা ভনভন করে ঘুরছে। ডাক্তার হয়ে শেষমেশ নিজেই রুগী না হয়ে যায়। এই ব‍্যাটা কখনও কী মানুষ হবে? আরিয়া এসব ভাবতে ভাবতে ডাইনিং রুমে গিয়ে বসলো। মোটামুটি সবাই রেডি আছে শুধু শুভ্রর জন্য অপেক্ষা করছিল। নীলু আর জুনায়েদ রুম থেকে এখনো বের হয়নি। নীলু আজ গাঢ় নীল রঙের থ্রি পিচ পড়েছে। হাতে এক গুচ্ছ নীল চুড়ি। নীলু কখনও চুড়ি আর নুপুর পড়েনা। জুনায়েদের জন্য ওকে পড়তে হলো। নীলু রেডি হয়ে এক পা ফেলতেই নুপুরের ছমছম শব্দ শুরু হয়ে গেলো। মূহুর্ত্তেই ও ফ্রিজ হয়ে গেলো। ওকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে জুনায়েদ ওকে টেনে বাইরে নিয়ে গেলো। নীলু কথায় বলতে পারছে না।

গাড়ি এসে থামলো রেস্টুরেন্টের সামনে। এখানে খাওয়া দাওয়া শেষ করে একটু ঘুরাঘুরি করে বাড়িতে ফিরবে। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে তীব্রকে নিয়ে। জুনায়েদ ওকে সহ‍্য করতে পারছে না। এমনটা হবার কারণ ওর বোধগম্য হচ্ছে না। ছেলেটা ওদেরকে সাহায্য করেছিল সেই সুবাদে ছেলেটা ওদের শত্রু না। আবার বন্ধু বলেও ধরা যায় না। জুনায়েদের ধ‍্যান ভাঙলো নীলুর ফিসফিস আওয়াজ শুনে। জুনায়েদ পাশে তাকিয়ে দেখলো নীলু ওকে কিছু বলতে চাইছে। নীলুর ওপাশে আয়ানা বসে আছে। নীলু বলল,

> আমি একটু বাইরে থেকে আসছি। গাড়িতে আমি ব‍্যাগ রেখে এসেছি।

> তুমি বসো আমি নিয়ে আসবো।

নীলু কিছুতেই জুনায়েদকে উঠতে দিলো না। একথা সেকথা বলে ওকে থামিয়ে দিয়ে উঠে গেলো। খাবারের অর্ডার দেওয়া হয়েছে। জুনায়েদের বারবার আগের ঘটনা গুলো মনে পড়ছে। নীলুকে বাইরে একা পাঠানো ঠিক হয়নি ভেবে ও দাঁড়িয়ে পড়লো। ওকে এভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে তীব্র বিদ্রুপ করে বলল,

> বাহ আপনার দেখি বউয়ের প্রতি বিশাল ভালোবাসা। বউ সামান্য বাইরে গেছে আর আপনি উতলা হয়ে যাচ্ছেন।

তীব্রর কথাগুলো জুনায়েদের গায়ে লেগেছে বেশ। ও নিজেকে সামলে নিতে পারলো না মুখটা কঠিন করে বলল,

> আপনি নিজের চরকাতে তেল দেন। আমার বউয়ের বিষয় আমি বুঝে নিবো। তাছাড়া আমি কি একবারও বলেছি আমি নীলুকে আনতে বাইরে যাচ্ছি।

জুনায়েদকে রাগ করতে দেখে তীব্র হাসলো। মনে হলো ও বেশ মজা পাচ্ছে। ওর এমন হাসি দেখে জুনায়েদের রাগ দ্বিগুণ হয়ে উঠলো। শুভ্র পাশ থেকে জুনায়েদকে ধমক দিয়ে বলল,

> তোর মেয়েদের মতো ঝগড়া করার স্বভাব আর গেলো না। ও তোর সঙ্গে মজা করছে এতো রেগে যাওয়ার কিছু হয়নি। বাইরে গিয়ে দেখ নীলু গাড়ির দরজা খুলতে পেরেছে কিনা। চাবি তো তোর কাছে গাধা।

> এটা আমাকে না বলে ওকে বলো।

জুনায়েদ উত্তরের আশা না করে গটগট করে বাইরে চলে গেলো। কিন্তু গাড়ির কাছে এসে ও নীলুকে পেলো না। মেয়েটা আশেপাশে নেই। অজানা আতঙ্কে জুনায়েদের হৃদয় কেঁপে উঠলো। মেয়েটা কোথায় যেতে পারে? নাকি আবারও কিডন‍্যাপ হলো। কথাটা ভেবে ওর ভ্রু কুচকে গেলো। ও পাগলের মতো এদিকে ওদিকে দৌড়াদৌড়ি করলো, লোকজনের কাছে শুনলো কেউ উত্তর দিতে পারলো না কিন্তু হঠাৎ ছাদের দিকে তাঁকিয়ে ও চমকে গেলো। নীলুর উড়না বাতাসে উড়ছে। ওর চিনতে ভূল হলো না। ও দ্রুতগতিতে ছাদের দিকে দৌড়ে গেলো। ছাদের গেট বাইরে থেকে বন্ধ। জুনায়েদ দ্রুত গেট খুলে ভেতরে গিয়ে দেখলো নীলু একটা ছেলের কলার ধরে দাঁড়িয়ে আছে। ছেলেটাকে উড়াধুড়া মারছে। দৃশ্যটা ওর কাছে ভয়াবহ লাগলো। এই মেয়েটার এতো সাহস কিভাবে কি ভেবে পেলোনা। জুনায়েদ দ্রুতগতিতে নীলুর পাশে গিয়ে দাড়ালো। মেয়েটা নিজের মতো কাজ করছে আশেপাশে নজর নেই। ওর হাতের মধ্যে ছেলেটার মুখ বাধা কথা বলতে পারছে না। নীলু এর মধ্যে ভয়ানক একটা কাজ করতে গেলো। নিজের সুচালু দাঁত বের করে ছেলেটার কাধের দিকে এগিয়ে গেলো। জুনায়েদেরর এবার বেশি বেশি মনে হলো। ও তাড়াতাড়ি নীলুকে নিজের দিকে ঘুরিয়ে নিলো। মেয়টার চোখমুখ হিংস্র হয়ে উঠেছে। মুখটা কেমন কঠিন আর দৃষ্টিও ঠিক নেই। জুনায়েদ ওর দুবাহু ধরে নাড়িয়ে দিলো। তখনই নীলু স্বাভাবিক হয়ে গেলো। পাশের ছেলেটা দৌড়ে পালিয়ে গেলো দেখে নীলু আবারও ছুটতে গেলো কিন্তু জুনায়েদ ওকে হুহাতে আকড়ে ধরে আটকে দিয়ে গম্ভীর কন্ঠে বলল,

> এসব কি নীলু? তুমি ভদ্রলোকের বউ হয়ে রাস্তায় মারামারি করছো? ছেলেটা কে? আর তুমি কি করছিলে? ছি তোমাকে যা ভেবেছিলাম তুমি মোটেও তা নও। তোমার পরিচয় দাও নয়তো আম্মুকে সব বলে দিব। তুমি মানুষ তো? এই এক মিনিট, নীলিমা আর তুমি এক জন ব‍্যাক্তি তাইতো?

জুনায়েদ একদমে কথাগুলো বলে থামলো। উত্তরগুলো ওর এখুনি চাই। এই মেয়েটা কি করতে চাইছে না জানলে শান্তি হচ্ছে না।নীলু ভয়ে ভয়ে ওকে জড়িয়ে ধরে বলল,

> আমাকে ভুল বুঝবেন না প্লিজ। আমি কে আর আমার পরিচয় কি এসব কিছু এখন বলতে পারবো না। তবে কথা দিচ্ছি খুব তাড়াতাড়ি বলবো। আমার হাতে সময় কম। যদি একবার মরণ ঘুমে তলিয়ে যায় তবে আর কখনও জেগে উঠতে পারবো না। আমি আপনাকে ছেড়ে থাকতে পারবো না প্লিজ কাউকে কিছুই বলবেন না।

জুনায়েদ ওকে ছাড়িয়ে দিয়ে বলল,

> তুমি আমাকে এই পযর্ন্ত কতগুলো মিথ্যা বলেছো?

নীলু মাথা নিচু করে চুপচাপ থেকে উত্তর করলো,

> আপনাকে কঠানোর মতো কিছু করিনি। অনেক ভালোবাসি আপনাকে। আপনি বললে এসব কিছুই করবো না। আমি নিজেকে বাঁচানোর চেষ্টা ছেড়ে দিতে পারি কথা দিচ্ছি।

নীলু কথাগুলো বলে ফুপিয়ে কেঁদে উঠলো। কিন্তু জুনায়েদের সাড়াশব্দ পেলো না।ও ঝটকরে মাথা তুলে দেখলো আশেপাশে কেউ নেই। মানে জুনায়েদ রেগে হন্তদন্ত হয়ে বেরিয়ে গেছে। নীলুও সময় নষ্ট করলো না। তাড়াতাড়ি নিচে নেমে আসলো। খাবার সামনে নিয়ে সবাই বসে আছে। হয়তো নীলু জন্য অপেক্ষা করছে। জুনায়েদ মুখ ফুলিয়ে বসে আছে আশেপাশে নজর নেই। নীলু ভয়ে ভয়ে ওর পাশে গিয়ে বসলো। আয়ানা জিঞ্জাসা করলো ও এতক্ষণ কোথায় ছিল। নীলু কিছু বলতে পারলো না। শুভ্রর সঙ্গে আোয়ানার টুকটাক কথা হলো সেগুলো ওরা শুনলো। খাওয়া শেষে জুনায়েদ কিছুতেই বাইরে ঘুরতে যেতে রাজি হলো না। তাই বাড়িতে ফিরে আসতে হলো। নীলু ওর সঙ্গে নানাভাবে কথা বলার চেষ্টা করলো কিন্তু ও বলল না। রুমে গিয়েও তাই হলো। জুনায়েদ সোফায় গিয়ে ঘুমালো। নীলুর চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছা করছে। এভাবে চুপচাপ থাকার মানে কি বুঝলো না। রাগ হলে মানুষ ঝগড়া করবে বকাবকি করবে দরকার পড়লে মারবে তাই বলে এভাবে চুপচাপ থাকা মানা যাচ্ছে না। নীলুর মনে আরেক ভয় কাজ করছে ছেলেটা যদি বাড়িতে এগুলো বলে তখন কি হবে? স্টোন উদ্ধার হয়নি।হাতে সময় আছে মাত্র একটা পূর্ণিম। ও হতাশ হয়ে শুয়ে পড়লো।

(চলবে)

আসুন নামাজ ও কোরআন পড়ি।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here