#আমৃত্য পর্ব ৪
লেখক: মো: শাহরিয়ার
– আরে রনি তুই এখানে গর্ত করছিস কেন?
– আরে আসিফ তুই? আয় এদিকে আয়। কেন তোকে বললাম না যে আমি বাগান করছি।
– ওহ আচ্ছা তো এখানে বাগান করবি?
– হ্যা। এর চেয়ে ভালো জায়গা আর খুজে পাই নি।
তাদের কথা বলার মাঝেই হঠাৎ মাটি থেকে কিছু কঙ্কালের হাত বের হলো এবং রনিকে ধরে তাকে টেনে নিয়ে যেতে লাগলো। আসিফ রনি বলে চিৎকার দিলো এবং…………
তার ঘুম ভেঙে গেল। খুবই জোড়ে জোড়ে নিশ্বাস নিচ্ছে সে। আজকেও সে একই সপ্ন দেখলো। এই সপ্নটি সে গত ৩ দিন ধরে দেখে আসছে। কিন্তু বুঝতে পারছে না যে এই একই ধরনের সপ্ন সে বারবার কেন দেখছে?
সকাল ১১ টা ৩২ মিনিট।
আসিফ লেকের ধারে বসে আছে। সে বুঝতে পারছে না যে রনির বিষয়টা সে কীভাবে সমাধান করবে? তার এখনো বিশ্বাস যে রনি আত্নহত্যা করে নি। কিন্তু সিসি ক্যামেরায় যা দেখলো না অবিশ্বাস করার মতো না। তাহলে আসলে কী হয়েছিল রনির সাথে? আসিফ তার পকেট থেকে মিস্টার শাহরিয়ারের দেওয়া সেই কার্ডটি বের করলো। কিছুক্ষন কার্ডটির দিকে তাকিয়ে থেকে সে তার ফোন বের করলো এবং কাউকে কল করলো।
– হ্যালো কে বলছেন?
আসিফ বলল,
– তোর জন্য একটা গুরুত্বপূর্ণ কাজ আছে। আমার সাথে লেক রোডের গলিতে দেখা কর এখনি।
– কে আপনি? আর কীসের কাজের কথা বলছেন?
– সেটা তুই এলেই জানতে পারবি। কাজটা করতে পারলে তোর জন্য উপহার আছে।
এটা বলে আসিফ কল কেটে দিল।
আসিফ ও একটি ছেলে মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আছে। ছেলেটির গায়ের রঙ শ্যামলা। বয়স ১৭-১৮ হবে। ছেলেটি আসিফকে জিজ্ঞেস করলো,
– বলুন এখানে কেন ডেকেছেন?
– নীলিমাকে তোরা অপহরণ কেন করেছিলি সেদিন?
এই কথা শুনে ছেলেটা অবাক হয়ে গেল। তার চোখে স্পষ্ট ভয় দেখা গেল।
– কোন নীলিমা? আর কীসের অপহরণের কথা বলছেন?
– দেখ নাটক করিস না। তোর চোখই বলে দিচ্ছে যে তুই মিথ্যে কথা বলছিস। আর আমার কাছে প্রমাণ আছে।
এটা বলে আসিফ নিজের পকেট থেকে ফোন বের করে একটা ভিডিও চালু করলো। ভিডিও তে দেখা যাচ্ছে রায়হান নীলিমাকে বেধে নিয়ে যাচ্ছে। তখনি রাস্তার একটি গাড়ি এসে থামলো এবং কিছু লোক সেখান থেকে বের হলো। এরপর রায়হান আর সেই লোকগুলো মিলে নীলিমাকে গাড়িতে উঠালো।
এরপর আসিফ ভিডিওটাক পজ করে সেটাকে জুম করলো। কারণ সেই গাড়ির ড্রাইভার ছিল তার সামনে থাকা সেই ছেলে।
আসলে এই ভিডিওটা রনিরদের বাড়ির সামনের। রনির মৃত্যুর দিনই আসিফের রনির মা এর উপর সন্দেহ হয়েছিল। তাই সে রনিদের বাড়ির সামনে একটি সিসি ক্যামেরা লাগিয়ে রেখে গিয়েছিল। যাতে রনিদের বাড়িতে কে কে আসে তা দেখা যায়।
ভিডিওটি দেখে আসিফের সামনে থাকা ছেলেটি পালানোর চেস্টা করলো। কিন্তু আসিফ আগেই বুঝেছিল যে ও পালাতে পারে। তাই সে ছেলেটার কলার ধরে কয়েকটা থাপ্পর মারলো। এরপর বলল,
– বল নীলিমাকে অপহরণ কেন করেছিলি?
ছেলেটি করুণ সুরে বলল,
– আমার কোনো দোষ নেই। রায়হান আমাকে সবকিছু বলেছিল। আমার কাজ ছিল গাড়িতে করে তাদের পৌছে দেওয়া। কিন্তু যখনি তারা তাদের জায়গায় পৌছালো তখনি তারা রায়হানের মাথায় আঘাত করে তাকে অজ্ঞান করে ফেলল। এটা দেখে আমি ভয়ে সেখান থেকে পালানোর চেস্টা করলাম। ওই লোকগুলোও আমাকে ধরার জন্য আমার পিছনে আসছিল। কিছুদূর যেতেই আমি একটি গর্তে পরে গেলাম। আর সেখানেই লুকিয়ে থাকলাম। আর সেই লোকগুলো আমাকে খুজে না পেয়ে সেখান থেকে চলে যায় আর আমি কোনোমতে বেঁচে ফিরি।
– তুই আমাকে ওই জায়গায় নিয়ে যেতে পারবি?
– না স্যার প্লিজ আমাকে যেতে দিন।
– তুই যদি আমাকে ওই জায়গায় না নিয়ে যাস তাহলে তোকে আমি পুলিশে দিব।
– আচ্ছা ঠিক আছে। চলুন।
এরপর ছেলেটা আসিফকে নিয়ে চলল সেই জঙ্গলে। কিছুদূর যাওয়ার পর আসিফ একটি ছোট পুরনো বাঙ্গলো দেখতে পেল। সে ছেলেটাকে বলল,
– এটাই কি ওদের আস্থানা?
– হ্যা স্যার। এটাই।
আসিফ ভিতরে প্রবেশ করলো। ভিতরে প্রবেশ করতেই সে কিছুটা ভয় পেল। কারণ ভিতরে প্রবেশ করতেই সে অনেকগুলো মানুষের কাটা মাথা দেখতে পেল। সে তৎক্ষনাৎ পুলিশকে ফোন করলো। পুলিশ আসতেই আসিফ পুলিশকে নীলিমার ব্যাপারে সব খুলে বলল আর সেই ছেলেটাকে পুলিশে ধরিয়ে দিল। কিন্তু আসিফের মনে এখন একটাই প্রশ্ন। যারা নীলিমাকে অপহরণ করেছিল তাদের কে খুন করলো? বিষয়টা আরো জটিল হয়ে যাচ্ছে। তখনি তার সেই কাগজটির কথা মনে পড়লো। সে চিন্তা করতে লাগলো যে ওই কাগজটা তাকে কে দিল আর নীলিমাকেও বা কে রক্ষা করলো এদের হাত থেকে? গত দুইদিন ধরে এত ঝামেলায় ছিল যে এই অজানা লোকটার কথা ভাবার সময়ই পায় নি। আসিফ বিলম্ব না করে সেই লেকের ধারে গেল। সেখানে সে কিছু খোজা শুরু করলো। একটু পরই কিছু একটা দেখে তার মুখে হাসি ফুটলো। আসলে আসিফ সেখানে কোনো সিসি ক্যামেরা খুজছিল। যা সে পেয়েও গেল। এরপর লেকের পাশের একটি বিল্ডিংয়ে প্রবেশ করে সেখানকার কন্ট্রল রুমে সে প্রবেশ করতে যাবে ঠিক তখনি কেউ তাকে বাধা দিল।
– কোথায় যাচ্ছেন আপনি?
– কন্ট্রল রুমে।
– দু:খিত কিন্তু আপনার সেখানে যাওয়ার অনুমতি নেই।
আসিফ মুচকি হেসে তার পকেট থেকে মিস্টার শাহরিয়ার এর দেওয়া কার্ডটি বের করে দেখালো। কার্ডটি দেখেই লোকটি আসিফের পথ ছেড়ে দিল। আসিফ কন্ট্রল রুমে প্রবেশ করে সেখানে সিসিটিভি ক্যামেরা মনিটর করার লোককে ৩ দিন আগের রাতের ফুটেজ দেখাতে বলল। আসিফ দেখলো রাত ২ টার দিকে একটি কালো অবয়ব লেকের ধারে এসেছিল। তার হাতে ছিল একটি বস্তা। এরপর অবয়বটি তার বস্তা থেকে রায়হানের কাটা মাথাটা বের করে সেখানে রেখে দেয়ে এবং সেখান থেকে চলে যায়। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে যে কালো অবয়বটার চেহারা দেখা যাচ্ছিল না। মুখে মাস্ক পড়া ছিল। আর এমনিতেও অন্ধকার ছিল। আসিফ সেই ভিডিও ক্লিপটা তার মোবাইলে ট্রান্সফার করে নেয় এবং সেখান থেকে চলে আসে।
সন্ধ্যা ৭ টা।
আসিফ রনির কবরের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। রনির কবর জিয়ারত করছে। কবর জিয়ারত শেষে সে পিছনে ঘুরেই দেখতে পেল রনি তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। আসিফ আবেগপ্রবণ কন্ঠে জিজ্ঞেস করলো,
– কেমন আছিস বন্ধু?
– ভালো নেই রে বন্ধু। আমি আত্নহত্যা করি নি। আমাকে খুন করা হয়েছে। তুই দয়া করে কিছু কর।
– আমি জানি বন্ধু তুই আত্নহত্যা করিস নি। তোর খুনিকে আমি খুব শিঘ্রয়ই শাস্তি দিব।
– কিন্তু তার সুযোগ তো তুই পাবি না।
রনির কন্ঠস্বর পরিবর্তন হঠাৎ পরিবর্তন হয়ে যাওয়ায় আসিফ কিছুটা অবাক হলো।
– মানে কি বলতে চাচ্ছিস তুই?
তখনি রনি ভয়ানকভাবে হাসতে থাকে। হাসতে হাসতে তার চোখ গুলো গলে পরছে। শরীরের মাংসগুলো ঝলসে যাচ্ছে। হাসতে হাসতে রনি বলতে লাগলো,
– তুই মরবি আসিফ। আমার মতো তুইও মরবি। তোকেও মরতে হবে।
এসব দেখে আসিফ প্রচন্ড ভয় পেয়ে গেল। সে সেখান থেকে দৌড়ে পালিয়ে গেল।
এই ঘটনার পর আসিফের প্রচন্ড জ্বর এসেছিল। এত জ্বর এর আগে আসিফের কোনোদিন হয় নি। আসিফের মা খুবই টেনশনে পরে গেল।
এক সপ্তাহ পর
রাত ১০ টা ৪৪ মিনিট।
আসিফ বিছানায় শুয়ে আছে। ঘুম নেই তার চোখে। সে এই কয়দিন ধরে শুধু তার সপ্নের কথাই ভাবছিল। কারণ একি সপ্ন সে বারবার দেখতে পাচ্ছে। এর নিশ্চয়ই কোনো কারণ আছে। ভাবতে ভাবতে হঠাৎ তার মাথায় একটা বুদ্ধি আসলো। সে তৎক্ষনাৎ বিছানা থেকে উঠে গেল।
রাত ১১ টা ৫৪ মিনিট।
আসিফ রনিদের বাসার পিছনে আছে এই মূহুর্তে। তার হাতে একটা কোদাল রয়েছে। সপ্নে সে যে জায়গায় রনিকে গর্ত করতে দেখেছিল ঠিক সেই জায়গায় সে দাঁড়িয়ে আছে। এই সময় এই শুনশান জায়গায় আসিফ পুরো একা। মনে মনে আসিফের ভয় করছে কিন্তু সে না প্রকাশ করছে না। সে দ্রুত কোদাল চালানো শুরু করলো। সপ্নের রনির মতো আসিফও একই জায়গায় গর্ত তৈরি করছে। এই নীরব মূহুর্তে তার কানে শুধু কোদাল চালানোর শব্দই বাজছে। আর প্রতিবারই সে অজানা আতঙ্কে শিউরে উঠছে। বেশ কিছুখানি গর্ত করতেই আসিফ একটি পুতুল দেখতে পেল মাটির মধ্যে। আসিফ পুতুলটা তুলে তা ভালোমত পর্যবেক্ষণ করতে লাগলো। সে বুঝতে পারলো এটা রনির আকৃতিতে তৈরি করা। তার মনে পড়লো রনিদের বাসায় সে নীলিমার আকৃতিতে তৈরি একটি পুতুলও দেখতে পেয়েছিল। কিন্তু এই পুতুলগুলো কে তৈরি করলো বা কেন তৈরি করলো? সেটাই আসিফ বুঝতে পারছিল না। তখনি তার পায়ে কিছুর স্পর্শে আসিফের হুশ ফিরলো। কিন্তু সে যা দেখলো না দেখে সে হতভম্ব হয়ে গেল। মাটি থেকে কিছু কঙ্কালের হাত বেড়িয়ে আসছে আর তা আসিফকে ধরার চেস্টা করছে। আসিফ দৌড়ে পালানোর চেস্টা করতেই সামনে কারো সাথে ধাক্কা খেল। সে দেখলো তার সামনে মিস্টার শাহরিয়ার দাঁড়িয়ে আছে। আসিফ পিছনে ফিরে দেখলো সেখানে কিছুই নেই। কিন্তু একটু আগেও কিছু কঙ্কালের হাত তাকে ধরার চেস্টা করছিল। মিস্টার শাহরিয়ার আসিফকে এত উত্তেজিত হতে দেখে জিজ্ঞেস করলো,
– কী হয়েছে আসিফ?
– স্যার আপনি এসেছেন? আমি জানি আপনি বিশ্বাস করবেন না। কিন্তু কিছু কঙ্কালের হাত আমাকে ধরার চেস্টা করছিল।
– কী বলছো এসব তুমি?
– আপনি আমার সাথে আসুন।
আসলে মিস্টার শাহরিয়ারকে আসিফই ফোন করে এখানে আসতে বলেছিল। আসিফ তাকে পুতুলটা দেখালো। পুতুলটাকে দেখে মিস্টার শাহরিয়ার কিছুটা অবাক হলো এবং বলল,
– তার মানে রনির উপর কালো যাদু করা হয়েছিল?
আসিফ শাহরিয়ারের কথা শুনে অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো,
– মানে?
– এগুলো কারোর উপর কালো যাদু করতে ব্যবহার করা হয়। আর এটা কে করেছে তাও আমি জানি। চলো আমার সাথে।
মিস্টার শাহরিয়ার যেতে যেতে আসিফকে সব খুলে বলল।
এই শহরের একদম শেষ প্রান্তে জঙ্গলের ভিতরে একটি গুহায় দেলোয়ার নামে এক লোক থাকে। যে কিনা কালো যাদু বিদ্যায় পারদর্শী। অনেকের মতে দেলোয়ার প্রায় ৫০ বছর ধরে এই বিদ্যার সাথে জড়িত।
এবার আসিফ বুঝতে পারলো যে রনির উপর কালো যাদু করে তাকে বশ করা হয়েছিল এবং তারপর রনিকে আত্নহত্যা করতে প্রলুব্ধ করা হয়েছিল। বলতে বলতে তারা সেই জায়গায় পৌছে গেল। সেই গুহা টা দেখে আসিফ ভয় পেল কারণ এখানে দিনের বেলাও কেউ আসে না। রাত তো দূরের কথা। আসিফ ও শাহরিয়ার সেই গুহায় ধীরে ধীরে প্রবেশ করলো। তারা দেখলো দেলোয়ার নামের সেই লোকটা গভীর ধ্যানে মগ্ন। তার সামনে কিছু আগুন জ্বালানো আছে। আসিফ বোঝার চেস্টা করছে যে কত বয়স হয়েছে দেলোয়ারের? মাথায় লম্বা চুল, লম্বা দাড়ি। সব ধবধবে সাদা। মাথায় লাল সিদুরের মতো দেওয়া। আসিফ বিলম্ব না করে দেলোয়ারের সামনে গিয়ে দাড়ালো আর বলল,
– তোর সকল পরিকল্পনা শেষ। এখন তুই জেলে যাবি।
এই কথা শুনে দেলোয়ার চোখ খুলল এবং আসিফকে দেখে মুচকি হেসে বলল,
– বাহ। শিকার দেখি আজকে নিজে শিকারের কাছে এসেছে।
দেলোয়ারের কথা শুনে আসিফ বলল,
– কিন্তু আমি একা আসি নি।
এরপর মিস্টার শাহরিয়ারকে উদ্দেশ্য করে বলল,
– স্যার আপনি পুলিশকে ফোন করুন।
কিন্তু আসিফ দেখলো মিস্টার শাহরিয়ার চুপ করে দাড়িয়ে আছে। আসিফ জিজ্ঞেস করলো,
– কী হলো স্যার? ফোন করুন।
তখনি শাহরিয়ার উচ্চস্বরে হাসতে লাগলো। হাসতে হাসতে বলল,
– তুমি খুব ভালোই মজা করতে পারো আসিফ।
এটা বলার সাথে সাথেই কিছুএকটা আসিফকে দ্রুত বেধে ফেলল। আসিফ মাটিতে পরে গেল। সে তার হাত পা নাড়াতে পারছে না। তখন মিস্টার শাহরিয়ার দেলোয়ারের উদ্দেশ্যে বলল,
– এই নেও। আরো একটা শিকার এনে দিলাম। এখন একে তোমার গুরুর নামে উৎসর্গ করো।
আসিফ ভয়ে কুকড়ে গেল। সে বুঝতে পারলো আজ তার শেষ দিন।
(চলবে)