#আমৃত্য পর্ব ২
লেখক: মো: শাহরিয়ার
“তোকে আমি মৃত্যুর পরও সকল বিপদ থেকে রক্ষা করবো।”
আসিফের ঘুম ভেঙে গেল। কালকে রনির বলা কথা এখনো আসিফের কানে বাজছে। আসিফ গতকাল রনির আত্নহত্যার খবর শুনে তখনি যেতে চেয়েছিল কিন্তু সাগর তাকে যেতে মানা করে। সারারাত আসিফ ঘুমাতে পারে নি। রনির কথাই বার বার তার মনে পড়েছে। কিন্তু একটা জিনিসই সে বুঝে উঠতে পারলো না। রনি আত্নহত্যা কেন করলো? যদি ওর আত্নহত্যা করার ইচ্ছাই থাকতো তাহলে ও আরো আগে আত্নহত্যা করতো। আর তাছাড়া রনি আরো অনেক ডিপ্রেশনে ভোগা মানুষদের আত্নহত্যা না করার পরামর্শ দিয়েছে। সেখানে ও নিজে কেন আত্নহত্যা করবে? বিষয়টা রহস্যজনক লাগছে আসিফের কাছে। তখন ঘড়ির দিকে তাকাতেই তার খেয়াল হলো। ৮ টা ৩৪ বাজে। আসিফ দেরী না করে দ্রুত তৈরি হয়ে চলে গেল রনিদের বাসায়। সেখানে যেতেই দেখতে পেল রনির দাফনকার্য চলছে। আসিফ তার সকল বন্ধুদেরকেও সেখানে দেখতে পেল। অথচ এরাই একসময় রনিকে খ্যাত বলে তার সাথে বন্ধুত্ব করে নি। পরে আসিফ জানতে পারলো যে রনির জানাযা হয় নি। জানাযা ছাড়াই তাকে দাফন দেওয়া হচ্ছে। তার একমাত্র অপরাধ হচ্ছে সে আত্নহত্যা করেছে। তাই তার জানাযা পড়ার জন্য কেউ এগিয়ে আসে নি। এটা শুনে আসিফ অনেক কষ্ট পেল। সে কিছুতেই মানতে পারছে না যে রনি আত্নহত্যা করেছে। নিশ্চয়ই এর পিছনে কোনো ষড়যন্ত্র আছে। দাফনকার্য শেষে আসিফ রনির রুমে প্রবেশ করলো। পুরো রুমটাকে সে পর্যবেক্ষণ করতে লাগলো। ভাবলো হয়তো গোয়েন্দাদের মতো কোনো ক্লু পেয়ে যাবে। কিন্তু না। ভাগ্য সবসময় গল্পের মতো সহায় হয় না। তাই সে কোনো কিছুই খুজে পেল না রনির রুমে। সবকিছু পরিপাটিভাবে গোছানো আছে। আসিফ রুম থেকে বের হতেই রনির সৎ মা কে দেখলো। না, বেশ হাসিখুশিই আছে। রনি মারা যাওয়ায় মনে হয় তার সুবিধাই হয়েছে। এখন রনির বোনকে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব এই বাড়ি থেকে তাড়াতে পারলেই বাচে। রনির বোনের কথা মনে পড়তেই আসিফ মনে মনে বলল, নীলিমা (রনির বোনের নাম) কোথায়?
সে নিচতালায় সব জায়গা খুজেও যখন নীলিমাকে পেল না তখন আসিফ দোতালায় উঠলো। দোতালার একটি রুমে সে নীলিমা পেল। নীলিমা রুমে বসে নীরবে কান্না করছে। তার কান্না করাটাই স্বাভাবিক ব্যাপার। কারণ এই দুনিয়ায় একমাত্র ওর ভাই ওকে সবচেয়ে বেশি ভালোবাসতো। আসিফ নীলিমার সাথে কথা বলার চেস্টা করলো কিন্তু নীলিমা কান্না করেই যাচ্ছে। তাই আসিফ আর বেশি জোর না করে সেখান থেকে চলে এল।
রাত ৯ টা
আসিফ শুয়ে শুয়ে একটা বই পড়ছিল ঠিক তখনি তার মোবাইলে কল এলো। কল রিসিভ করেই বলল,
– হ্যালো সাগর? বল কোনো সমস্যা নাকি?
– হ্যা ভাই বিরাট বড় সমস্যা হয়ে গিয়েছে। আংকেল মানে রনির বাবা এক্সিডেন্ট করেছে। তার অবস্থা খুবই আশঙ্কাজনক।
এটা শুনে আসিফ অবাকের চূড়ান্ত সীমানায়। রনির মারা যাওয়ার শোক কাটিয়ে উঠতে না উঠতেই আবার রনির বাবা এক্সিডেন্ট করলো। রনির বাবাকে কোন হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে তা জেনে নিয়ে আসিফ তাড়াতাড়ি রওনা দিল। হাসপাতালে পৌছে সে দেখতে পেল ইতিমধ্যে তার কিছু বন্ধু এবং রনির মা হাসপাতালে উপস্থিত রয়েছে। ডাক্তারের সাথে কথা বলে আসিফ জানতে পারলো রনির বাবার অবস্থা খুবই আশঙ্কাজনক। তার বাচার সম্ভাবনা অনেক কম। নেই বললেই চলে। আসিফ, তার বন্ধুরা এবং রনির মা তারা ওয়েটিং রুমে অপেক্ষা করছে। আসিফের বন্ধুরা এবং রনির মা বিভিন্ন ব্যাপার নিয়ে আলোচনা করছে কিন্তু আসিফ চুপ করে বসে বসে তাদের কথা শুনছে। আলোচনার এক পর্যায় যখন রনির বাবার সম্পত্তির কথা উঠলো তখনি রনির মা একটি কাগজ বের করে সবাইকে দেখিয়ে বলল,
– রনির বাবা আজকেই তার সকল সম্পত্তি আমার নামে লিখে দিয়েছিলেন।
এবার আসিফ আর চুপ থাকতে পারলো না। সে বলল,
– যেখানে রনির বাবার অবস্থা খুবই আশঙ্কাজনক আর সেখানে আপনি সম্পত্তি কে পাবে তা নিয়ে চিন্তা করছেন। আপনার তো এই সময় আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করা উচিত ছিল।
রনির মা তখন আসিফের দিকে ভ্রু কুচকে তাকিয়ে বলল,
– প্রার্থনা করে কি আর ভাগ্য বদলানো যাবে? ভাগ্যে যা আছে না তো হবেই। আর পরে যাতে ঝামেলা না হয় তাই আগেই তোমাদের দেখিয়ে রাখলাম।
আসিফ এরপর আর কিছু বলল না কিন্তু তার রনির মা কে সন্দেহ হতে লাগলো। যেখানে তার স্বামী আজ মৃত্যুসজ্জায় আর সেখানে তিনি সম্পত্তির দলীল নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। মানে তিনি মনে মনে নিজের স্বামীকে মৃত স্বীকার করেই নিয়েছেন।
কিছুক্ষন পর একজন ডাক্তার এসে রনির বাবাকে মৃত ঘোষনা করলো। তখনি রনির মা একটা মুচকি হাসি দিলেন। অন্যকেউ খেয়াল না করলেও আসিফ তা ঠিকই খেয়াল করেছে। সে বুঝতে পারলো এসবের পিছনে রনির সৎ মায়েরই হাত রয়েছে। তাই আসিফ দেড়ি না করে হাসপাতালের ছাদে গেল। সেখানে গিয়ে সে তার ফোন বের করে কাউকে কল করলো। কল রিসিভ করতেই আসিফ বলল,
– হ্যালো? মিস্টার শাহরিয়ার কি বাসায়া আছেন?
– জ্বি আছেন। আপনি একটু দাড়ান আমি তাকে দিচ্ছি।
…
– হ্যালো কে বলছেন?
– হ্যালো স্যার আমি আসিফ। চিনতে পেরেছেন?
– ওহ হ্যা আসিফ। কী খবর তোমার? হঠাৎ এত রাতে।
তারপর আসিফ মো: শাহরিয়ারকে সব খুলে বলল। তার পুরো নাম মো: রিজওয়ান আহমেদ শাহরিয়ার। পেশায় একজন গোয়েন্দা অফিসার। আসিফ এর কাছ থেকে সবকিছু শুনে মো: শাহরিয়ার বললেন,
– হুম বুঝতে পেরেছি। আমি আগেই কাউকে সন্দেহ করবো না। আগে আমি পুরো ঘটনাটা তদন্ত করে দেখি। যাইহোক আমি কালকে আসছি।
– আচ্ছা ঠিক আছে স্যার। অনেক ধন্যবাদ আপনাকে। আসসালামু আলাইকুম।
– ওয়ালাইকুম আসসালাম।
এরপর আসিফ বাসায় চলে আসলো। বাসায় এসেই সে সরাসরি ছাদে চলে গেল। ছাদে এসে সে তার পকেট থেকে একটি সিগারেট বের করলো। এর আগে সে কোনোদিন সিগারেট খায় নি কিন্তু আজকে কেন জানি তার সিগারেট খেতে ইচ্ছা করছে। সে সিগারেটটা ধরিয়ে মুখে দিতে যাবে ঠিক তখনি কেউ বলে উঠলো,
– তোর না এসবের নেশা ছিল না।
আসিফ পিছনে ফিরে দেখলো তার পিছনে রনি দাঁড়িয়ে আছে। রনিকে দেখে আসিফ সিগারেটটি ফেলে দিল। কিছুক্ষন সে রনির দিকে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো। তারপর বলল,
– তুই এখানে?
– তুই আমার উপকার করবি বলেছিলি মনে আছে?
– হ্যা। তার সকল ব্যবস্থা আমি করেছি।
– আমি তোকে বলেছিলাম আমার বোনকে তোর কাছে রেখে মানুষ করতে। তুই কেন আমার বোনকে একা রেখে এলি বল?
আসিফের এতক্ষণ নীলিমার কথা মনেই ছিল না। তার মনে পড়লো যে হাসপাতালেও সে নীলিমাকে দেখে নি। আসিফ জিজ্ঞেস করলো,
– নীলিমা এখন কোথায় আছে?
রনি উত্তরে বলল,
– ও এখন বিপদে আছে। প্লিজ তুই ওকে উদ্ধার কর।
একথা শুনে আসিফ দৌড়ে রনিদের বাসায় চলে গেল। কিন্তু বাসায় এসে সে দেখলো বাসা তালা দেওয়া। সে কিছু চিন্তাভাবনা না করে তালা ভাঙতে শুরু করলো। বেশ কিছুক্ষন চেষ্টার পর সে তালা ভাঙতে সফল হলো। কিন্তু পুরো বাড়িতে সে কোথাও নীলিমাকে দেখলো না। আসিফ যখন সব জায়গায় খুজতে খুজতে ক্লান্ত হয়ে গিয়েছে তখনি সে ডাইনিং টেবিলে একটি বোরকা পড়ানো পুতুল দেখতে পেল। পুতুলটাকে হাতে নিয়ে দেখতেই তার মনে পড়লো এটা তো নীলিমার বোরকার কাপড়। নীলিমাও সবসময় বোরকা পড়তো। তার পাশে আরেকটি কাগজে লাল অক্ষরে কিসব যেন লেখা আছে। তার মানে কী নীলিমা সত্যিই কোনো বড় বিপদের মধ্যে রয়েছে?
[চলবে]