আমি তারে দেখেছি পর্ব ৪

0
561

#আমি_তারে_দেখেছি
#৪র্থ_পর্ব

শান্ত মুচকি হাসলো। তারপর শুধালো,
“আমি তাহলে ব্যতিক্রম?”
“নাহ! আপনিও সবার মতো। বরং সবার থেকে বিরক্তিকর”

অকপটে কথাটা বললো নবনীতা। শান্তর হাসির মাত্রা বিস্তারিত হলো। তার শরীরে সেই হাসির দমক প্রবাহিত হলো। নবনীতা অনুভব করলো ব্যাপার টা। মানুষটি হাসলে শরীর কাঁপে। তার বড় মামার ও এই স্বভাব ছিলো। শরীর দুলিয়ে দুলিয়ে হাসা। নবনীতা রাস্তায় চোখ ঠেকিয়ে শুধালো,
“আমাকে খুঁজছিলেন কেনো?”
“আমার মনে হয় তোমার কাকতালীয় স্বপ্নটা আংশিক হলেও সত্য। নিয়ন আ/ত্ম/হ/ত্যা করে নি। তবে আমি সেটাকে খু/ন বলেও আখ্যা দিতে পারবো না”

নবনীতার মুখোভাবে পরিবর্তন হলো। তার চোখেমুখে উদ্বিগ্নতা এবং কৌতুহল পরিলক্ষিত হলো। বিস্মিত স্বরে বললো,
“মানে?”
“মানে, ওর ময়নাতদন্তে মৃত্যুর কারণ হিসেবে হার্ট ফেইলিউর বলা হয়েছে। হ্যা, হার্ট এবং ফুসফুসে পানি পাওয়া গেছে বটে। তবে মৃত্যুর কারণ সেটা নয়। ডাক্তারের ভাষ্য পানিতে পড়ার সময় ই তার মৃত্যু হয়েছে। তবে এটা খু/ন নয় বলে আমার ধারনা। তাই বললাম, আংশিক হলেও সত্য”
“পুরোপুরি সত্যি নয় কেনো?”

নবনীতা শানিত কন্ঠে প্রশ্ন ছুড়লো। শান্ত আড়চোখে তার কঠিন মুখশ্রী একবার দেখে নিলো। বাইকের গতি সামান্য কমালো, তবে তা থামালো না। তারপর সাবলীল ভঙ্গিতে বললো,
“দুটো কারণে আমার মনে হয় এটা খু/ন নয়। এক. জেলা প্রশাষকের পুত্রের অবশ্যই একটা সিকিউরিটি ইস্যু থাকবে। ধরে নেই তার সাথে সর্বক্ষণ গার্ড থাকে না। কিন্তু সে গায়েব হয়ে যাবে বারো ঘন্টার মতো অথচ কোনো সাড়া থাকবে না শহরে ব্যাপারটা মানতে পারছি না। যদি না সে ইচ্ছাকৃত ভাবে কোথাও যায়। আর দুই, লাশ পানিতে বারো ঘন্টার মতো ছিলো। অর্থাৎ তাকে পানিতে ফেলা হয়েছে গতকাল বিকেল পাঁচটা নাগাদ। বুড়িগঙ্গা ব্রীজের মোড় সর্বদাই মানুষের ভীড়ে ডুবে থাকে। তাহলে হাইপোথেটিক্যালি তোমার স্বপ্ন সত্যি হয়েও যায় এবং তাকে বেহুশ রুপে নদীতে ফেলা হয়ে থাকে তবে কেউ কেনো তাকে দেখলো না? এই দুটো প্রশ্নের উত্তর আছে নবনীতা? তাই আমার মতে এটি খু/ন নয়। এমনটা হতে পারে নিয়নের হৃদরোগ ছিলো। ময়নাতদন্তে এও জানা গেছে ওর হৃদয় দূর্বল ছিলো। সত্যি বলতে বাইশ বছরের ছেলে হার্ট ফেইলিউর অহেতুক হবে না, যদি না তার হার্টে সমস্যা থাকে। আমার মতে সে হয়তো এখানে আ/ত্মহ/ত্যা করতেই এসেছিলো। কিন্তু মৃত্যুকে শান্ত মস্তিষ্কে অনুভব করা কঠিন ই নয় বরং কষ্টের ও। ঝাপ দিবে ভেবেই ওর ভয় হচ্ছিলো। হয়তো সেই কারণে, হার্টে ব্যাথা উঠে। ধীরে ধীরে সেটা ভয়ানক আকার ধারণ করে। ফলে তার মৃত্যু ঘটে এবং ব্রীজ থেকে পড়ে যায়। যেহেতু একা ছিলো তাই কেউ হয়তো খেয়ালো করে নি। যদিও এটার প্রমাণ আমার কাছেও নেই। কিন্তু মৃত্যুটা স্বাভাবিক ”

শান্ত খুব শান্ত কন্ঠে কথাগুলো বলে। সে খুব গুছিয়ে কথা বলতে পারে। ব্যাপারটা আগেও খেয়াল করেছিলো নবনীতা। শান্ত সাইড মিররে নবনীতাকে দেখছে। মেয়েটি তার যুক্তিগুলো মেনে নিয়েছে কি না বুঝার চেষ্টা করছে। নবনীতা খুব তন্ময় হয়ে তার যুক্তিগুলো বিবেচনা করছে। তারপর হুট করেই বলে উঠলো,
“তাহলে দুটো প্রশ্ন আছে, এক, আপনি ই বলেছিলেন ওর সিকিউরিটি ইস্যুর কথা। সে গায়েব হয়ে যাবে অথচ কেউ খোঁজ করবে না তা কি করে হয়। হ্যা, যদি সে এমন কারোর সাথে সে বের হয় যাকে নিঃসন্দেহে বিশ্বাস করা হয় তখন ঘটনা আলাদা। দুই, ও যদি একাই বের হয় তবে ও কিসে করে ব্রীজ অবধি এসেছে? আমি যতদূর ওকে চিনি ও গাড়ি ছাড়া যাতায়াত করে না। ও পারে না। লোকাল বাসে কিংবা সিএনজি তে ও যাতায়াত করে না। আর একটা মানুষের নিজস্ব গাড়ি থাকতে সে কেনো উবার ব্যবহার করবে। ওর একটা R15 বাইক ও আছে। সাথে একটি গাড়িও আছে যা গত জন্মদিনে ও বাবা ওকে উপহার দিয়েছে। তাহলে ওর যানটি কোথায় গেলো? ঘটনাস্থলে কি গাড়ি বা মোটর সাইকেল পাওয়া গেছে। যতদূর ধারণা যায় নি। একজন মৃত ব্যাক্তির পক্ষে তো গাড়ি সরিয়ে দেওয়া সম্ভব নয়। তারমানে ও হয়তো একা যায় নি। এবার উত্তর দিন”

শান্তর হাসি চওড়া হলো। সে আবারোও শরীর দুলিয়ে হাসছে। তার হাসি বড্ড অবাক করলো নবনীতাকে। বিমূঢ় স্বরে শুধালো,
“পাগলের মতো হাসছেন কেনো?”
“তোমার সাথে থাকার সাইড ইফেক্ট। তোমার পাগলা ভাইরাস আমাকেও আক্রান্ত করেছে”

শান্তর রসিকতা মোটেই ভালো লাগে না নবনীতার। ভ্রুযুগল একবিন্দু করে তীক্ষ্ণ দৃষ্টির বান প্রয়োগ করলো সে। যেনো সেই বানে শান্ত হয় কুপোকাত। কিন্তু আফসোস সে সফল হলো না। শান্ত বাইকটা নিপুন ভাবে কাট করে রাস্তার সাইডে থামালো। রাতের গভীরত্ব তখন বেশী, কালো আকাশে চন্দ্রমা মেঘের আড়াল ছেড়ে নিজের রুপ বিকাশিত করতে ব্যাস্ত। শান্ত ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালো নবনীতার দিকে। তারপর চোখে চোখ রেখে সুগাঢ় কন্ঠে বলল,
“তোমার সরল, নিরীহ মুখখানার আঁড়ালের তীক্ষ্ণ মস্তিষ্কখানা আমায় ডুবালো। শোনো মেয়ে, এই প্রথম কোনো নারীর প্রতি কৌতুহল জাগলো”

শান্তর উক্তিটি বিনা অনুমতিতে নবনীতার কঠিন হৃদয়ে হাতুড়িঘাত করলো। শান্তর গভীর স্বচ্ছ নয়নে তীক্ষ্ণতা নেই। চোখের ভাষাখানা খুব ই মৃদু, কোমল। কিছুসময় সেই চোখজোড়ার দিকে ফ্যালফ্যালিয়ে তাকিয়ে রইলো নবনীতা। তার কানজোড়া নিমিষেই গরম হয়ে গেলো। হৃদস্পন্দনটা বেড়ে গেলো। অসহ্যকর মানুষের মুখ থেকে এরুপ বাক্য মোটেই কাম্য ছিলো না নবনীতার। শক্তপোক্ত করে প্রহরী দেওয়া হৃদয়টাতে অব্যক্ত অনুভূতি হচ্ছে, যা নবনীতার ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ নতুন। তড়িৎ গতিতে দৃষ্টি সরিয়ে নিলো। মরনখাঁদে আগ বাড়িয়ে আবার পা দিবে না সে। নবনীতাকে চরমভাবে বিব্রত করে পৈচাশিক আনন্দ পেলো শান্ত। মেয়েটির বিচিত্র মুখোভাব তাকে বড্ড আকৃষ্ট করছে। এক নারী তার নানা রুপ। কখনো কঠিন, কখনো সরল, কখনো ক্রোধিত তো কখনো লাজুক। এক বাক্যে যাকে বলা যায়, “সাত রঙ্গে রঙ্গিন রমনী”। অনুসন্ধিৎসু মন আরোও জানতে চায়, অনুসন্ধান করতে চায় এই রহস্যময়ী রমনীকে। আজ প্রথমবার মাদার বাংলাদেশের প্রতি কৃতজ্ঞতাবোধ করছে সে। তার কারণে এতো অদ্ভুত, রহস্যময়ীকে পাওয়া______

শান্ত সময় নষ্ট করলো না। বাইক স্টার্ট দিলো। ধীর কন্ঠে বলল,
“আমাকে ধরে বস”

নবনীতা কথা বাড়ালো না। কথা বললেই একটা ঘাড়ত্যাড়া উত্তর দিবে লোকটি। তাই আজ্ঞাকারী নারীর ন্যায় তার কাধে হাত রাখলো। পথে মনোযোগী শান্ত স্থির স্বরে বলল,
“তোমার বুদ্ধির তারিফ না করে উপায় নেই। আমি সত্যি অবাক হয়েছি তুমি এতো সারল্যের সাথে এতো ধারালো প্রশ্ন দাঁড় করাবে”
“তাহলে আমার প্রশ্নের সাথে আপনি একমত?”
“খানিকটা, এটা যে আ/ত্ম/হ/ত্যা নয় সেটা আমার প্রথমেই খটকা লেগেছিলো যখন তার সুইসাইড নোটটি পলিথিনে মোড়া পেয়েছিলাম। সাধারণত আ/ত্ম/হ/ত্যা করার মোটিভ থাকলে ব্যক্তি তার সুইসাইড নোট এমন স্থানে রাখে যেখানে সেটা খুব সহজে পাওয়া যাবে। মানে তার ঘরে। যেহেতু ঝাপ দিয়ে মরছে সে ঐ কাগজটা পকেটে রাখবে না। কারণ কাগজ পানিতে গলে যাবে এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু সে তার পকেটে রেখেছিল, তাও পলিথিনে ভালো করে প্যাকেট করে। কেন? মানুষ যখন নিজেকে শেষ করতে চায় তার মস্তিষ্ক তখন অস্বাভাবিক পর্যায়ে থাকে। অতি স্বাভাবিক কাজ ও করে অস্বাভাবিক ভাবে। কারণ সে তার মৃত্যুকে অনুভব করতে পারে। আর স্বাভাবিক মস্তিষ্কে মৃত্যু সহ্য করা যায় না। তাই সেই অস্বাভাবিক মস্তিষ্ক এতো কষ্ট একটা সুইসাইড নোটের পেছনে করবে না। সে এমন স্থানে সেটাকে রাখবে যেনো খুব সহজেই চোখে পড়ে। তাই আমার ধারণা এই পুরো কান্ডের যে মাথা সেই এমন একটি কাজ করেছে। ফলে যখন আমার হাতে ময়না তদন্তের রিপোর্ট আসে আমার সন্দেহের বান তীক্ষ্ণ হয়। এজন্যই আমি হন্যে হয়ে তোমাকে খুজতে বের হই। কারণ সুইসাইড নোটে তোমার নাম লেখা। বুঝলে ড্রিম মেশিন?”

নবনীতা উত্তর দিলো না। সে তাকিয়ে আছে কালো পিচের রাস্তার দিকে। রাস্তাটা যেনো পেছনের দিকে ছুটছে। দেখতে ভালো লাগছে_______

*******

নবনীতার বাসার কাছে পৌছাতেই কুকুরদের তীব্র চিৎকার হুংকার শোনা গেলো। অহেতুক কারণে চারটে কুকুরের মাঝে বিবাদ বেধেছে। বিবাদখানা কি নিয়ে ব্যাপারটি জানা গেলে ভালো হতো। কিন্তু আফসোস, কুকুরদের ভাষা শান্তর জানা নেই। এদিকে নবনীতাকে একটু অস্থির দেখা গেলো। সে কুকুর ভয় পাচ্ছে? নাকি তাদের চিৎকার জানা নেই। তবে মেয়েটি শান্তর শার্ট খামচে ধরে আছে। কুকুরদের ঝগড়া উপেক্ষা করে একেবারে মেইন গেটের সম্মুখে এসে থামালো বাইক। গেটের বাহিরে উদ্বিগ্ন মুখে নিশাদকে পাওয়া গেলো। শান্ত একবার ঘড়ির দিকে তাকালো, রাত নয়টার কাছাকাছি এখন সময়। ভাই হিসেবে উদ্বিগ্ন হওয়া টা অস্বাভাবিক নয়। শান্ত এবং নবনীতাকে দেখেই সে ছুটে এলো। চিন্তিত গলায় বললো,
“বুবু তোর ফোন বন্ধ কেনো? আব্বা চিন্তা করতে করতে বিপি বাড়িয়ে ফেলেছে। উপায় না পায়ে আমি বেড়িয়ে গেছি”

নিশাদের কথা উপেক্ষা করে নবনীতা এখনো অনড়ভাবে বসে আছে। শান্ত বুঝতে বাকি রইলো না কারণটা। তাই তার নরম হাতটা নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে বলল,
“ওরা এই অবধি আসবে না। ভয় নেই”

নবনীতা শান্তর কথা বিশ্বাস করলো। গুটি পায়ে নামলো। সে এখনো তটস্থ। তাই শান্ত নিশাদকে উদ্দেশ্য করে বলল,
“আংকেলের শরীর এখন কেমন?

********

জসীম সাহেব বিছানায় আধ শোয়া রুপে বসে আছে। পেছনে বালিশ। হবু শ্বশুরের সাথে চারমাস পর আজ আবার দেখা হলো। ভদ্রলোকের উচ্চতা খুব নয়। মোটাসোটা গোলগাল মানুষ। চুল একটাও কাঁচা নয়। এমন কি ঝোপের মতো ভ্রুখানায় ও পাক ধরেছে। চোখের দৃষ্টিতে অমায়িকতা থাকলেও চেহারার গড়নে তা চাঁপা পড়ে গেছে। দেখতে খুব একটা সুদর্শন নন। ফলে বোঝাই যাচ্ছে নবনীতা তার সৌন্দর্য্য এবং উচ্চতা তার থেকে পায় নি। অবশ্য শারমিন বেগম অর্থাৎ তার মা খুব সুন্দরী এবং লম্বা মহিলা। লম্বা মহিলাদের বর হবে বেটে পুরুষ, এবং লম্বা পুরুষদের বউ হবে বেটে মহিলা। এটাই পৃথিবীর নিয়ম। তবে শান্তর ক্ষেত্রে সেটা ভুল কারন সেও লম্বা এবং তার হবু বধুও। ব্যাপারটা চিন্তার। এর মাঝেই জসীম সাহেবের রাশভারী কন্ঠ কানে এলো,
“আমার মেয়েকে থানায় কেনো নেওয়া হয়েছিলো তোমার জানা আছে?”

শান্তর বুঝতে পারি রইলো না মেয়ের প্রতি বাবার ভালোবাসা। শান্ত মুখে প্লাস্টিকের হাসি ঝুলিয়ে বলল,
“আংকেল চিন্তা করবেন না, এটা আর হবে না?”
“আংকেল?”

ভ্রু উচিয়ে প্রশ্নটি করলেন জসীম সাহেব। এতে শান্ত বিপাকে পড়লো। লোকটিকে ধুম করেই বাবা বলাটা সমুচিন নয়। বিয়ের আগে শ্বশুরকে আংকেল ছাড়া আর কি বলা হয় সেটা তার জ্ঞানভান্ডারে নেই। এর মাঝেই ফোন টা বেজে উঠলো। শান্ত বিনয়ী স্বরে বলল,
“এক্সিউজ মি”

বলেই পকেট থেকে ফোনটা বের করলো। স্ক্রিনে “মাদার বাংলাদেশ” জ্বলজ্বল করছে। ফলে কেটে দেবার উপায় নেই। ফোনটা রিসিভ করতেই কাজের মেয়ে রেবার তীক্ষ্ণ কন্ঠ কানে এলো,
“ভাইজান, তাত্তাড়ি বাড়ি আইয়েন। তুফান শুরু হইছে……………

চলবে

[কপি না করার অনুরোধ রইলো। আমার লেখা প্রথম বই “তন্দ্রাবিলাসী” পেয়ে যাবেন বইফেরী এবং বুকশেলফ.কম এ]

মুশফিকা রহমান মৈথি

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here