আমি তারে দেখেছি পর্ব ৩

0
619

#আমি_তারে_দেখেছি
#৩য়_পর্ব

হঠাৎ মনে হলো নির্জন গলিতে সে একা নয়। বুকটা ধক করে উঠলো। অজানা ভয় ভালোলাগাগুলো শুষে নিলো। হাত ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে। শিরদাঁড়া বেয়ে নেমে যাচ্ছে হিমস্রোত। ভয় গাঢ় হলো যখন সরু কাঁধে কারোর স্পর্শ অনুভূত হলো। হৃদস্পন্দনের গতি বাড়লো। মস্তিষ্ক অসাড় হতে লাগলো। এই পরিস্থিতিতে ঠিক কি করা সমুচিত হবে বুঝতে পারছে না। এক সেকেন্ড চোখ ঘুরিয়ে আশপাশ দেখলো। ছুটে পালানো কিংবা চিৎকার করে লাভের লাভ হবে না। কাঁধে থাকা চটের ব্যাগে পেপার স্প্রে এবং একটি ছোট্ট চাকু থাকার কথা। কিন্তু এই মূহুর্তে তা বের করার সময় নেই। ফলে উপায়ন্তর না পেয়ে, কাঁধের ব্যাগ দ্বারা নির্মমতার সাথে প্রহার করতে লাগলো সে। গায়ের সমস্ত শক্তি সে প্রয়োগ করে সে প্রহার করছে। আহ! উহ! শব্দের সাথে এক সময় কানে এলো,
“নীতু, আমি নীলয়। আর মা’রিস না”

নিজেকে প্রহার থেকে প্রতিরক্ষার জন্য হাত দিয়ে আঁড়াল করতে করতে কথাগুলো বললো নীলয়। তার গাঢ় কন্ঠ কানে আসতেই হতচকিত কন্ঠে বলে উঠলো,
“তুই?”

নবনীতা অবশেষে ক্ষান্ত হলো। হাতখানা থামিয়ে শানিত দৃষ্টিতে তাকালো সে সম্মুখে দাঁড়ানো সৌম্য যুবকের দিকে। নীলয় তার বিশৃঙ্খল জামা ঠিক করছে। অবিন্যস্ত উশখো, খুশখো চুলগুলোকেও হাত দিয়ে ঠিক করলো সে। নবনীতার বক্ষস্থলে জমায়িত ত্রাশ ঘন ঘন নিঃশ্বাস রুপে নির্গত হতে লাগলো। শরীর এখনো ঈষৎ কাঁপছে। ভয়টা এখনো তাকে শোষণ করছে। নীলয় এখনো দুমিনিট পূর্বের ঘটনা সামলাতে পারে নি। বিমূঢ় দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। নবনীতাকে ভয় দেখানোর উদ্দেশ্য তার মোটেই ছিলো না। নবনীতাকে যে অনেকবার হাক দিয়ে ডেকেছে। কিন্তু নবনীতা শুনে নি। তাই তো ছুটে এসে কাঁধে হাত রেখেছে, উদ্দেশ্য ছিলো মেয়েটি যেনো থামে। অপরাধী স্বরে বলল,
“ভয় পেয়েছিলি? কেটেছে ভয়?”

নবনীতা উত্তর দিতে পারছে না। ভয় এখনো কাটে নি, তার হৃদস্পন্দনের বেগ এখনো ট্রেনের গতিকে হার মানানোর ক্ষমতা রাখে। একটু স্বাভাবিক হতেই মেজাজ তিরিক্ষি হয়ে উঠলো। উত্তেজিত কন্ঠে বললো,
“একটু হলেই আত্মা খাঁচা ছাড়া হতো। এখনো বুক কাঁপছে। বেহোতার কোথাকার! এভাবে কেউ পেছন থেকে হাত রাখে?”
“আরে আমার কি দোষ! তোকে তো ডেকেছি। তুই তো শুনিস নি”

নীলয় তার পূর্ব পরিচিত। নবনীতা চিনে। তাদের সম্পর্কের খুব পরিচিত নাম রয়েছে, বন্ধুত্ব। বন্ধুত্বের সম্পর্কের জন্য ই অল্পের উপর ছেড়ে দিলো নবনীতা। রাগ দমিয়ে ক্ষান্ত হলো সে। হাঁপিয়ে গেছে। জোরে জোরে নিঃশ্বাস নিতে নিতে বলল,
“এখানে কি করছিস তুই?”
“যার জন্য করে চুরি সেই বলে চোর, আর কেনো? তোমাকে খুঁজতে আসা। বাসায় গিয়েছিলাম। আন্টি জানালেন তোকে নাকি থানায় ডেকেছে। তাই তো হন্তদন্ত হয়ে আসা। আর তুই কিনা আমাকে ব্যাগ দিয়ে মে’রে আধম’রা করে দিয়েছিস”

বাহু ঘষতে ঘষতে উত্তর দিলো নীলয়। তার কন্ঠে অসহায়ত্ব। কিন্তু নবনীতার ভ্রুক্ষেপ হলো না, দয়া দেখিয়ে সরি বললো না। উলটো ক্ষেপে বললো,
“বেশ হয়েছে আরো মা’রা উচিত”
“পাষন্ড”
“জানা কথা, নতুন কিছু বল”

বলেই সামনে হাটা দিলো নবনীতা। নীলয় ও তার পিছু নিলো। কৌতুহলী স্বরে শুধালো,
“তোকে থানায় ডেকেছে কেনো এটা তো বল”

নীলয়ের প্রশ্নে খুব একটা ভাবান্তর হলো না নবনীতার। কৌতুহল মানুষের একটি বহুপরিচিত প্রবৃত্তি। এই প্রবৃত্তিকে কেউ কেউ দমাতে পারে, কেউ কেউ পারে না। নীলয় প্রথম শ্রেণীর অন্তর্ভূক্ত। ব্যাপারটা মাঝে মাঝে খুব ই বিরক্তিকর ঠেকে। কিন্তু এতো বছরে অভ্যস্ত হয়ে গেছে নবনীতার। তাই এখন আর খুব একটা বিরক্ত হয় না সে। সেই সাথে তার এটাও মতবাদ, মানুষের কৌতুহল থাকা উচিত। কৌতুহল আছে বলেই মানুষ উন্নতর জীব। এই প্রবৃত্তি তাকে অজানাকে জানাতে সহায়তা করে। যদিও নবনীতার মনে হয় কিছু জিনিস অজানা থাকাই ভালো। এতে করে ভারসাম্য বজায় থাকে। যে সময়ে যে তথ্য জানা উচিত, সেই তথ্য সেই সময় ই জানা উচিত। এতে করে গাম্ভীর্য বজায় থাকে। ভবিষ্যত আগে জানা মোটেই সুখময় না। এর জীবন্ত প্রমাণ সে নিজে। সে যদি ভবিষ্যত না জানতো তবে তার জীবনটা আরোও সুসজ্জিত হতো। বক্ষস্থলে পাথরসম অনুভূতিগুলো জমায়িত থাকতো না, নিজের অপারগতার আফসোস হতো না। সময়ের পূর্বেই তাকে দুঃখ ছুঁইতো না। এই যে আজকের ঘটনাই ধরা যাক। সে যদি স্বপ্নে নিয়নের মৃত্যু না দেখতো তবে তার হৃদয়ে ভয়ের উৎপত্তি হতো না। যখন তাকে থানায় ডাকা হতো সে আশ্চর্য্য হতো, সামান্য দুঃখ প্রকাশ করতো। কিন্তু অজানা বিপদের ভয় হতো না। পিঠে চাপড় পড়তেই নবনীতার হুশ ফিরলো। নীলয়ের ধৈর্য্যের বাধ ভাঙ্গছে। সে খানিকটা ক্ষুদ্ধ কন্ঠেই বলল,
“কি হলো বলছিস না কেনো?”
“নিয়ন মা/রা গেছে”
“কি?”

নীলয় হতচকিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে নবনীতার দিকে। তার কান বিশ্বাস করতে পারছে না যেনো। বিস্ময়ের সর্বোচ্চ স্তরে তাকে উঠিয়ে যেতো কেউ ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিয়েছে। নিজের বিশৃঙ্খল চিন্তাগুলো জড়ো করে কিছু বলার পূর্বেই একটি মোটর বাইক এসে ব্রেক করলো ঠিক তাদের সম্মুখে। এমন ঘটনায় দুজন ই চমকে উঠলো। নবনীতা কিছু বলার পূর্বেই লম্বা, দেহবান পুরুষ হেলমেট খুলে তার সম্মুখে এসে দাঁড়ালো। তার বিধ্বস্ত আখিজোড়া ক্ষতবিক্ষত করছে নবনীতাকে। নিজের সম্মুখে শান্তকে দেখে হতবিহ্বল হলো নবনীতা। আজ বোধ হয় তার বিস্ময় হবার দিন। কিছু দিন থাকে, যে দিনে মানুষ শুধু বিস্মিত হয়। আজ হয়তো তেমন ই একটি দিন। নবনীতার বিস্ময়কে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে গম্ভীর, থমথমে স্বরে শান্ত শুধালো,
“তোমার মোবাইল বন্ধ কেনো?”

প্রথমে প্রশ্নটা বুঝতে সময় লাগলো নবনীতার। মস্তিষ্ক আজকাল বড্ড অলস হয়ে গিয়েছে। সে উত্তর দেবার পূর্বেই ব্যাগ থেকে অবহেলিত ফোনটা বের করলো। ফোনটা কিছু সময়ের জন্য খাদ্যাভাবে বেহুশ হয়ে গেছে। খানিকটা বিব্রত কন্ঠে বললো,
“সকালে চার্জ দিতে পারি নি, তাই হয়তো বন্ধ হয়ে গেছে”

শান্ত কোমড়ে হাত দিয়ে গাল ফুলিয়ে বেশ কিছুসময় জোরে জোরে শ্বাস নিলো। তারপর প্রখর দৃষ্টিপাত করলো নবনীতার পাশে থাকা ছেলেটির দিকে। ছেলেটি কিছু ভয়ে আছে। তার চোখজোড়া বড় বড় হয়ে আছে। এখনই অক্ষিকোঠর থেকে বেরিয়ে আসবে যেনো। শান্ত কঠিন কন্ঠে শুধালো,
“এই মা’ল কে?”

নবনীতা একবার তাকালো নীলয়ের দিকে। তারপর স্বাভাবিক চিত্তে বলল,
“আমার বন্ধু।“
“কোথায় কুড়িয়ে পেলে?”
“কুড়িয়ে পাই নি, রাস্তায় দেখা হয়েছে”
“দেখেতো আস্তো চোর লাগছে”
“ও দেখতে চোরা টাইপ হলেও ভালো ছেলে”

দুজনের কথোপকথনে নিজের প্রশংসা হজম হলো না নীলয়ের। সে বিস্মিত কন্ঠে শুধালো,
“এই যে আপনি? আপনি কে শুনি? আমাকে চোর বলছেন কেনো?

নীলয়ের প্রশ্নকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে শান্ত নবনীতাকে বলল,
“বাইকে উঠো”
“কেনো?”
“বুড়িগঙ্গাতে ফেলে আসবো। যতসব”

নবনীতা কিছুসময় অগ্নিদৃষ্টি প্রয়োগ করলো শান্তর দিকে। দৃষ্টি দিয়ে বধ করতে চাইলো এই মদনকুমার তর্কালংকারকে। কিন্তু সে ব্যর্থ হলো। ফলে বুক চিরে দীর্ঘশ্বাস বের হলো। নীলয়ের দিকে ফিরে বলল,
“নীলয়, তুই বাড়ি যা”
“মানে কি? আর এই লোক কে? অজানা মানুষের বাইকে কেনো উঠবি তুই? দেখে তো ডাকাতের সর্দার কালুয়ার মতো লাগছে”
“দেখতে ডাকাত সর্দার লাগলেও সে পেশায় পুলিশ। আর সম্পর্কে………আমার ফিয়ান্সে”

একটু বিরতি নিয়েই “আমার ফিয়ান্সে” কথাটা বললো নবনীতা। কিন্তু শব্দ দুটো নীলয়ের মুখোভাব পরিবর্তন করে দিলো। মুখশ্রীর যখন উত্তেজনা, কৌতুহল শুষে ফুটে উঠলো সূক্ষ্ণ বিষাদের ছাপ। অবশ্য সেই বিষাদ দেখার চোখ সবার নেই। নবনীতা বাইকে উঠলো। শান্ত বাইক স্টার্ট দিলো। নীলয় নিভু স্বরে বললো,
“বাসায় যেয়ে ফোন দিস নীতু, আমি চিন্তায় থাকবো”

কথাটি অত্যন্ত সাবলীল। একজন বন্ধু আরেকজনের জন্য চিন্তিত হতেই পারে। কিন্তু কথাটা মোটেই ভালো লাগলো না শান্তর। সে নবনীতাকে কথা বলার সুযোগ না দিয়ে বাতাসের বেগে বাইক ছোটালো। নীলয় এখনো দাঁড়িয়ে রইলো। তার চোখজোড়া তাকিয়ে রইলো নবনীতার যাবার পানে______

*******

বাইকের চাকা পিচের রাস্তা চিরে চলছে গন্তব্যে। নবনীতার অবাধ্য চুল উড়ছে বাতাসের তালে। তার হাত শান্তর কাঁধে। চোখ মুখে খিঁচে রয়েছে সে। দুদিন পর হতে যাওয়া স্বামী তাকে বিরক্ত করছে। এতো কিসের তাড়া বুঝতে পারলো না সে। কিন্তু তাকে কিছু জিজ্ঞেস করবে না সে। শান্ত বাইকের ফ্রন্ট মিররে বারবার নবনীতার ক্ষিপ্র মুখখানা দেখছে। ফলে নীরবতা সেই ভাঙ্গলো,
“তোমার ড্রিম মেশিনের কথা ছেলেটা জানে?”
“কোন ছেলে?”
“ওই চোরা ছেলেটা”
“ওর একটা নাম আছে। ওর নাম নীলয়। তাই ওকে সেই নামেই ডাকুন। আর আমি সবাইকে বলে বেড়াই না”

শান্ত মুচকি হাসলো। তারপর শুধালো,
“আমি তাহলে ব্যতিক্রম?”
“নাহ! আপনিও সবার মতো। বরং সবার থেকে বিরক্তিকর”

অকপটে কথাটা বললো নবনীতা। শান্তর হাসির মাত্রা বিস্তারিত হলো। তার শরীরে সেই হাসির দমক প্রবাহিত হলো। নবনীতা অনুভব করলো ব্যাপার টা। মানুষটি হাসলে শরীর কাঁপে। তার বড় মামার ও এই স্বভাব ছিলো। শরীর দুলিয়ে দুলিয়ে হাসা। নবনীতা রাস্তায় চোখ ঠেকিয়ে শুধালো,
“আমাকে খুঁজছিলেন কেনো?”
“আমার মনে হয় তোমার কাকতালীয় স্বপ্নটা আংশিক হলেও সত্য। নিয়ন আ/ত্ম/হ/ত্যা করে নি…………………

চলবে

[পরীক্ষা এবং শবে ব রাত সংক্রান্ত কারণে কথা থাকলেও গল্প দেই নি। ক্ষমাপ্রার্থী সেই কারণে। আমারলেখা প্রথম বই “তন্দ্রাবিলাসী” পেয়ে যাবেন বইফেরী এবং বুকশেলফ.কম এ]

মুশফিকা রহমান মৈথি

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here