#আমায়_ডেকো_একা_বিকেলে?
#লামিয়া_সুলতানা_সিলভী ( লেখিনীতে)
#পর্বঃ_৭ ( অন্তিম পর্ব)
হল রুমের সিঁড়ির পথে দাড়িয়ে দেখলাম আব্বু নিউজ দেখছে টিভিতে, অনেক কষ্টে ভয়ে কে জয় করে আব্বুর সামনে গিয়ে দাড়ালাম! আব্বু টিভি বন্ধ করে আমার দিকে তাকিয়ে বলল,,
রাশেদঃ কি বলবে মামুনি, এনিথিং রং?
আমি আগে কখনো এভাবে একা আব্বুর সামনে বসে নিজের কোন ইচ্ছের কথা সরাসরি জানায়নি! যখন যা প্রয়োজন হয়েছে আম্মুকে আব্বুর সামনে পাঠিয়েছি আর নয়তো সামিয়া কে! কিন্তু এই ব্যাপারে তো আমাকেই সরাসরি আলোচনা করতে হবে, একটা শেষ চেষ্টা করে দেখি! আমি আয়াশের ব্যাপারে কোন কথা আব্বুর সামনে এখন পর্যন্তও বলিনি, বিয়ে ঠিক হবার পরেও না আর আব্বু এমন বিগড়ে যাওয়াতেও না! তাহলে এখন কিভাবে বলবো? লজ্জা লাগছে, আবার ভয়ও করছে! এদিকে সাহেব আমার রেগে কথা বলা বন্ধ করেছে কুড়ি দিন হলো, এখন আমি কি করবো? আব্বু সেদিন ওদের সাফ সাফ জানিয়ে দিয়েছে,, এরকম বেয়াদব ছেলের সাথে আমাকে বিয়ে দিবে না! যতটুকুই বা দিতো ওর বেয়াদবির জন্য আরও পিছিয়ে গেছে! অনেক আকাশ পাতাল ভাবনার মাঝেই আব্বু আমার দিকে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো,,,
রাশেদঃ কি হয়েছ, এমন ভাবে তাকিয়ে আছো কেন?
আমি জোরে জোরে কয়েকটা দম টেনে আব্বুকে বললাম,,,
লামিঃ আব্বু আমি আয়াশ কে ছাড়তে পারবো না!
আব্বু কিছুক্ষন আমার দিকে চোখ লাল করে তাকিয়ে ছিলো! আব্বুর এমন দেখে সে কিছু বলার আগেই আমার চোখ থেকে টুপটাপ করে পানি গড়িয়ে পড়তে লাগলো,,,
লামিঃ আব্বু, প্লিজ এমনটা করোনা! তুমিই তো আমার বিয়ে আবার ঠিক করেছো কিন্তু তুমিই ভেবে বলো তো আব্বু সেটা কি কখনো সম্ভব? প্রথমে একবার এসে বললে আয়াশ নামের এক ছেলের সাথে তোমার বিয়ে এসেছে সব কিছু ঠিকঠাক হলে ওনারা সেদিনই আংটি পড়িয়ে যাবে! আমি তেমন কিছু বলিনি আবার এখন বলছো আয়াশকে ভুলে অন্য কাওকে বিয়ে করে নাও! আব্বু আমি ওকে ছাড়া ভালো থাকবো না, ওর দিক না হয় নাইবা ভাবলে কিন্তু আব্বু আমার কথা একবার ভাবো ! ও নাহয় একটু উত্তেজিত হয়েছিলো তাই এমন করেছে! সব মানুষই কি সমান হয় আব্বু, আমাদের হাতের আঙুলই পাঁচ রকম আর তো মানুষ! তুমি কি শিউর দিয়ে বলতে পারবে যে তুমি সব দিক দিয়ে পারফেক্ট? অথবা আমি সব দিক দিয়ে পারফেক্ট? পারবে না। (কিছুক্ষন চুপ থেকে) আব্বু আমি ওর সাথে হাসি-খুশী থাকি সব-সময়, এই দুই মাসে ও আমাকে সত্যিই অনেক ভালো রেখেছে! ও কোনদিন আমার সাথে খারাপ আচারণ করেনি বিশ্বাস করো, যদিও ওর রাগ টা একটু বেশী কিন্তু মানুষ হিসেবে আয়াশ খুব ভালো!
আব্বু একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে আমার দিকে তাকিয়ে আমার কথার প্রতিত্তরে শুধু এতটুকুই বললো,,,
রাশেদঃ আমি যা বলবো তাই হবে মা,, (মাথায় হাত দিয়ে) রনি ছেলেটা অনেক ভালো, ওর হাতেই আমি তোমাকে তুলে দিতে চাই! তোমার রণির সাথেই বিয়ে হবে, তুমি ওর সাথে সুখী হবে দেখে নিও! ও তোমাকে অনেক সুখে রাখবে! আমি কথা দিচ্ছি, যদি কখনো খারাপ কিছু হয় তখন আমাকে শাস্তি দিও, আমি মাথা পেতে নিবো সব!
লামিঃ তুমি আমাকে বুঝছো না কেন আব্বু? আমার যে খুব কষ্ট হচ্ছে, ও ছাড়া আমি কিভাবে থাকবো? আয়াশই আমার জীবনে প্রথম, যা কখনো ভুলতে পারবো বা! আব্বু প্লিজ কিছু একটা করো, রায়হান আংকেল কে ফোন দাও! ছোটবেলা থেকে কোনদিন তোমার আর আম্মুর অবাধ্য হইনি, আজকেও পারবো না! তোমরাই কিছু করো প্লিজ ( কাঁদতে কাঁদতে) তুমি রায়হান আংকেল কে কল দাও, আর না দিলে আমাকে পারমিশন দাও আমি আয়াশদের বাড়ি যাই? আব্বু আয়াশ আমার সাথে রাগ করেছে আমার সাথে কোন কথা বলছে না!
আব্বুর পায়ের কাছে বসতেই আব্বু আমাকে উঠিয়ে নিজের পাশে বসিয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে বলল,,,
রাশেদঃ দেখো মামুনি, আমি সবই বুঝছি আমি তো আর অবুঝ না তাইনা? কিন্তু এই ব্যাপারটা অনেক এলোমেলো হয়েছে তোমার সাথে আয়াশেকে আমি কিছুতেই মেনে নিতে পারছি না! ও আমার সাথে বেয়াদবি করেছে, তুমি কি চাও এমন ছেলেকে বিয়ে করতে যে তোমার আব্বুকে অপমান করে, বলো?
লামিঃ আব্বু ও রাগের মাথায় বলে ফেলেছে, ও আমাকে নিয়ে অনেক সিরিয়াস তাই এমন বলেছে! প্লিজ তুমি ওর এই কথাটা মনে রেখো না!
রাশেদঃ এই বিয়েটা শুধু তোমার আর আয়াশের হচ্ছে না লামি, হচ্ছে দুই ফ্যামিলিরও মিলবন্ধন! এই বিয়েটা হতে হলে আমাদের দুই পরিবারকে এক হতে হবে, সবাই যখন জানতে পারবে ওর ফ্যামিলির কথা তখন আমি সবাইকে কি বলবো? তুমি জানো না, আমি সমাজের মান্যগণ্য ব্যাক্তি! আর আয়াশের সাথে বিয়ে হলে তোমার সাথে আমাদের দূরত্ব টা বাড়তে থাকবে! কারন, সে বলেছে তোমাকে আমার কাছে থেকে নিয়ে নিবে আর কখনো আমাদের কাছে আসতে দিবে না এখানে! এটা কি কোন বাবা মেনে নিতে পারবে বলো? তুমি পারবে বাবাকে ভুলে যেতে?
আমি আব্বুর কথায় চুপচাপ বসে কাঁদতে লাগলাম, আমার শেষ আশাটাও এবার শেষ হয়ে গেলো, কান্না ছাড়া আর কোন উপায় খুজে পেলাম না! সামিয়া এতোক্ষন হল রুমে সিঁড়ির কাছে দাঁড়িয়ে ছিলো আর ওর পাশে ছিলো আম্মু! সামিয়া আব্বুর দিকে তাকিয়ে বললো,,,
সামিয়াঃ আব্বু আমার কিছু কথা আছে।
আব্বু ভ্রু কুঁচকে তাকালো সমিয়ার, আমার কোন গতিবেগ হলো না আমি আব্বুর বুকেই মাথা দিয়ে কাঁদছিলাম! সামিয়া আব্বুরকে বলল,,,
সামিয়াঃ আব্বু, এতদিন আমি আর আম্মু তোমার ভয়ে চুপ করে ছিলাম, কিন্তু আজ আর থাকবো না! জানো আব্বু আয়াশ ভাইয়া আপুকে নিতে চেয়েছিলো কিন্তু আপু যায়নি আপুর জায়গায় যদি অন্যকেও থাকতো তাহলে অনেক আগেই পালিয়ে যেতো! কিন্তু আপু তোমাকে কারোর কাছে ছোট করেনি কেনো জানো? কারণ আপু তোমাকে কষ্ট দিতে চায়না! এমন করলে তো তুমি কষ্ট পেতে তাইনা তাই ও নিজেকে শক্ত করেছে শুধু তোমাকে রাজী করানোর জন্য!
সামিয়ার কথায় ভরসা পেয়ে এবার আম্মু মুখ খুললো,,,
আফসানাঃ লামির আব্বু, এতোদিন তোমার জেদের কাছে হার মেনে চুপ ছিলাম কিন্তু এখন আর পারলাম না! এতোগুলো দিন মেয়েটা কষ্ট পেয়ে যাচ্ছে, তুমি কি একটা বারও দেখতে সেটা দেখতে না? মেয়েটা সারাটাদিন মন খারাপ করে থাকে কষ্ট পাচ্ছে, আয়াশ ওকে যথেষ্ট পরিমাণের ভালোবাসে আমি জানি কিন্তু ও শুধু তোমার ওপর রাগ করে লামিকে কাছে নিতে চেয়েছিলো আর তোমার মেয়ে তোমার কথা ভেবে তার কাছে যায়নি বলেই ওকে শাস্তি দিচ্ছে, ওর সাথে কথা বলা বন্ধ করেছে! আয়াশ কিন্তু প্রতিদিন আমার সাথে কথা ঠিকই বলে, জানো? শুধু আমাদের মেয়ের সাথে বলে না!
আম্মুর কথায় আমি বেশ অবাক হয়ে তাকিয়ে আছি, কই আম্মু তো একটা বারও আমাকে বললো না আয়াশের সাথে কথা হয়! আর আয়াশ? সে তো সেদিনের পর থেকে আমার সাথে কথাই বলে নি, আমি কখনো ভাবতেও পারিনি আমি কোন ছেলেকে এতোটা ভালোবেসে ফেলবো! সেদিন আব্বু ওদের অনেক অপমান করেছে তারপরও আয়াশের মা-বোন সব হজম করে আমাকে মেনে নিবে কিন্তু আয়াশ কি নিজের অপমান সহ্য করে আমাকে কাছে টেনে নিবে? হয়তো না, তাইতো যোগাযোগ বন্ধ করেছে! তবে সেও যে আমার চেয়ে দ্বিগুন কষ্ট পাচ্ছে এটা আমাকে রাইসা আর মামুনী (আয়াশের মা) আমাকে ফোন করে বলেছে! সে নাকি ঠিক মতো খায় না, কারোর সাথে কথা বলে না! আগে বন্ধু-বান্ধব নিয়ে থাকতো, এখন তো ঘরকোণে হয়ে গিয়েছে! মামুনি ওর কষ্ট মেনে না নিয়েই আমাকে রিকুয়েস্ট করেছে আব্বুকে বোঝাতে! আর তাই আমি আব্বুকে আজ বলতে এসেছি,,,
সামিয়াঃ আব্বু, তুমি ওদের এখন মেনে নিতে পারছো না কিন্তু একবার ভেবে দেখো তো এই সত্যি কথাটা যদি তুমি ওদের বিয়ের পর জানতে পারতে তাহলে কি ডিভোর্স করিয়ে নিতে আপুকে? একটা বিয়ে ভাঙার মানে কি তুমি অবশ্যই আমার চেয়ে জানো? আর এটা যদি করতেও তুমি তাহলে আপু কি করতো? তখন যদি নিজের কোন ক্ষতি করে ফেলতো তুমি কি করতে বলোতো?
সামিয়া, আম্মুরও দুজনই কাঁদছে ! আব্বু পুরো নির্বাক হয়ে গেছে, আজ সামিয়াকে এটা বলছেনা “তুমি ছোট মানুষ হয়ে এতো বড় বড় কথা কেনো বলছো”? আব্বু সামিয়ার কথায় একটু চিল্লিয়ে বলে উঠলো,,
রাশেদঃ থাম সামিয়া, আর বলিস না! আমি সহ্য করতে পারবো না ওর এমন কিছু হলে!
আফসানাঃ হ্যা, তুমি সহ্য করতে পারবে না তাহলে এমন কিছু করছো কেনো? ওকে কষ্ট দিচ্ছো কেনো? তুমি জানো না আমার মেয়েটা কতটা কষ্ট পাচ্ছে, তুমি শুধু তোমার জেদ নিয়েই বসে আছো! একটা বারও কারোর কথা ভাবছো না, না তোমার মেয়ের আর না ওই ছেলেটার!
রাশেদঃ ওর কষ্টটা আমি বুঝতে পারি লামির মা, ও তো আমারও মেয়ে! তুমি যেমন ওর মা, আমিও ওর বাবা! আয়াশ ওকে ভালবাসে আমি জানি কিন্তু কতদিন সে ভালো থাকবে, যদি খারাপ হয়? আর আয়াশকে আমার পছন্দ না, ও কিভাবে আমাকে অপমান করলো দেখলে না তুমি লামির মা? ওর বাপের দোষ আছে, সেটা যদি ওর মাঝে প্রতিফলিত হয় তখন কি হবে? ওর এখনকার কষ্ট আমি সহ্য করতেও পারলেও সারা জীবনের কষ্ট সহ্য করার ক্ষমতা নেই ! সারাজীবন আমরা থাকবো না তখন ওকে ছূড়ে ফেলে দেয় তখন কি হবে আমার মেয়েটার? তাই ভালো কোন ছেলের হাতে যদি ওকে তুলে দিতে পারি, আমি মরেও যে শান্তি পাবো তখন! (চশমা খুলে চোখ মুছে)
আম্মু তাচ্ছিল্যের হাসি মুখে ফুটিয়ে বলল,,,
আফসানাঃ একটা কথা না বললে আর চলছে না, তুমিও কিন্তু আমার বাবার সাথে কখনো ভালো ব্যাবহার করোনি! আমার বাবা আমাকে বিয়ে দিয়েছে পর থেকে প্রতিরাতে কেঁদে বালিশ ভেজাতো! কই আমার বাবা তো কখনো তোমার থেকে আমাকে আলাদা করতে চায়নি! বাবা মারা যাবার আগে আমার কাছে ক্ষমা চেয়েছিলো, তোমার মতো ছেলের সাথে আমাকে বিয়ে দিয়েছে জন্য! কারণ সে জানে তুমি আমার বাবাকেই সম্মান দিতে জানোনি আমার আর কি সম্মান দিতে? তাও আমি আমার দুই মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে সব সহ্য করে নিয়েছিলাম!
আম্মুর কথায় আব্বু চিৎকার করে উঠলো,,,
রাশেদঃ আফসানা, তুমি কি বলতে চাচ্ছো?
সামিয়াঃ আম্মু ঠিকই বলছে আব্বু, আমাদের বুঝ হবার পর থেকেই আমি আর আপু দেখেছি তুমি কখনো নানাইয়ের সাথে ভালো ব্যাবহার করোনি! নানাই আমাদের বাসায় আসলে তুমি অপমান করে তাড়িয়ে দিয়েছো! আর আয়াশ ভাইয়া তো শুধু দুটো কথা বলেছে, তাও আপুকে তুমি তার কাছে থেকে কেড়ে নিতে চেয়েছো বলে!
আফসানাঃ ঠিকই করেছে, আমার মতে আয়াশ কোন ভুল করেনি! কোন ছেলে নিজের মায়ের অপমান সহ্য করবে বলতো? সবাই কি আমার মতো বোকা? বাবা-মায়ের অপমান সহ্য করে মুখ বুঝে থাকবে? কার এতো ধৈর্যশক্তি? আয়াশের অতীতে কি হয়েছে তা তুমি ওকে কেনো দোষ দিচ্ছো, ওর মা’কে কেনো দোষ দিচ্ছো? আয়াশের মা তাও এসেছে, আমার যদি ছেলে থাকতো আর আমি যদি ছেলের হবু শ্বশুর বাড়ি থেকে এমন অপমানিত হতাম জীবনেও তো আর সে বাড়ির মুখাপেক্ষী হতাম না! আমার মেয়ের আর তার ছেলের কথা ভেবে তাও রেনুকা ভাবী রাজি হয়েছে, এতেই আমাদের ভাগ্য ভালো!
সামিয়াঃ আব্বু,,, আম্মু কিন্তু ঠিকই বলেছে! শুধু শুধু কেউ কাওকে কথা শোনায় না! এখানে তোমার দোষ পুরোপুরি ছিলো, তুমি আয়াশ ভাইয়াকে না বললে সে কখনোই তোমাকে ওগুলো বলতো না! আয়াশ ভাইয়া তোমাকে যথেষ্ট সম্মান করতো! আমরা কখনো তোমার অবাধ্য হইনি, কিন্তু প্লিজ বাবা এবার হচ্ছি! তুমি রাজি না হলে আমি আর আম্মু গিয়ে আপুকে আয়াশ ভাইয়ার হাতে তুলে দিয়ে আসবো!
আব্বু কিছুক্ষন থম মেরে বসেছিলো,, হয়তো আম্মুর আর সামিয়ার বলা কথাগুলোই ভাবছে! হঠাৎ বলে ওঠলো,,,
রাশেদঃ আমার বিরুদ্ধে তোমাদের এতো অভিযোগ? আমি এতটা খারাপ মানুষ? কখনো ভাবিনি মেয়েদের সুখের কাটা হয়ে দাঁড়াবো! লামি সোনা, আমাকে ক্ষমা করে দে মা! আমি হয়তো আয়াশ কে পুরোপুরিভাবে মেনে নিতে পারবোনা, তবে আমি চেষ্টা করবো! লামির আম্মু তুমি আয়াশকে ফোন দাও, ওদের কে আসতে বলো!
আব্বুর কথায় মনে হচ্ছে এখন আমার প্রাণ ফিরে এসেছে! আমি দৌড়ে আম্মুর রুমে গিয়ে আম্মুর ফোন নিচে এনে আয়াশের নাম্বারে ডায়েল করে আমিই কল দিলাম কারণ আমার নাম্বার সে ব্লকলিস্টে রেখেছে কিন্তু একি আয়াশের ফোন বন্ধ কেন? আবার ডায়াল করলাম এবারও বন্ধ! এবার আমার ফোন থেকে আন্টিকে দিলাম তার ফোনও বন্ধ! কোন উপায় না পেয়ে রাইসাকে ফোন দিলাম, ওর ফোনে রিং যাচ্ছে কিন্তু কেও ধরছে না! এখন আমার মনে ভয় ঢুকে গেলো, ওর কিছু হয়ে গেলো না তো? আমি আব্বুর কাছে গিয়ে বললাম,,
লামিঃ আব্বু ওর ফোন তো সুইচ অফ দেখাচ্ছে, ওর আম্মুরও এমনকি রাইসারও! তুমি পারমিশন দিলে আমি আম্মুকে নিয়ে ওর কাছে যাবো আব্বু!
রাশেদঃ আমিও যাবো তোমাদের সাথে, আমরা সবাই আজ শিকদার বাড়ি যাবো! আমি যেহেতু ভুল করেছি তাই আমিই আমার ভুল সংশোধন করবো!
তারপর আম্মু বোরখা পড়ে নিলো আর আব্বু রুমে গিয়ে পাঞ্জাবী পড়ে নিলো! আমার আর সামিয়ার জামা চেঞ্জ করতে হবে না, এটা পড়েই যাওয়া যাবে আর আমার এখন এসব ভালোও লাগছে না তাই চলে গেলাম ওমনিই! গাড়ি চলছে নিজের গতিতে কিন্তু আমি মনে শান্তি পাচ্ছি না! আমার শুধু একটাই ভয় হচ্ছে ও যদি কিছু করে বসে? আব্বু আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে কিন্তু আমার খুব ভয় লাগছে, তবুও যে এতকিছুর পর আব্বু রাজী হয়েছে এটাই অনেক! এখন আয়াশ ঠিক-ঠাক থাকলেই হলো! আর ভাবতে ভালো লাগছে না এতোসব, নিজেকে পাগল পাগল লাগছে, আম্মুর দিকে তাকিয়ে বললাম,,
লামিঃ আম্মু, ওর যদি কিছু হয়ে যায়?
আফসানাঃ ওর কিচ্ছু হবেনা আল্লাহর ওপর ভরসা রাখ, আয়াশ টিনেজার না যে এমন কিছু করে বসবে!
আব্বুর শ্যামলা বর্ণের চেহারা আরো কালো হয়ে ওঠেছে, খুব খারাপও লাগচ্ছে আব্বুর জন্য! আজকে আম্মু অনেক কিছু বলেছে আব্বু কে, হয়তো আব্বু মেনে নিতে পারেনি আম্মুর কথাগুলো! অবশেষে দেড় ঘন্টা পর আয়াশদের বাড়িতে পৌঁছে গেলাম, আমি আগেই বাড়ির ভেতরে গেলাম! মামুনি দড়জা খুলে আমাকে দেখে বেশ অবাক হলেন,,,
রেনুকাঃ তুমি?
লামিঃ মামুনি, আয়াশ? আয়াশ ঠিক আছে? (হাপাতে হাপাতে)
মামুনী আমার কথায় মিষ্টি করে হেসে বললো,,
রেনুকাঃ একা এসেছো?
লামিঃ না সবাই এসেছে!
রেনুকাঃ আয়াশ ভেতরে ওর রুমে আসে যাও, একদম লাস্টের রুমটা ওর!
আমি মামুনির কথা দৌড়ে আয়াশের রুমে গেলাম! আয়াশ আমাকে দেখে অবাক হয়েছে ঠিকই কিন্তু খুশিতে ওর চোখেও পানি এসেছে, কিন্তু ওকে দেখে আমি সন্তুষ্ট হতে পারলাম না! কেমন চেহারা হয়েছে, গোফ-দাড়ি জ্বালিয়ে এক্কেবারে বিশ্রী অবস্থা! অনেকটা শুকিয়েও গিয়েছে, ওর সাথে আজ যোগাযোগ নেই কুড়ি দিনের মতো হতে চললো,,
লামিঃ একি হাল করেছো নিজের?
আয়াশ প্রতিত্তরে শুধু হাসলো,,
লামিঃ ফোন সুইচ অফ করেছো কেন আমাকে কি মানুষ বলে মনে হয়না তোমার? কতবার ফোন করেছি? আজ কুড়িটা দিন হলো কল করে যাচ্ছি, কিন্তু ফোন প্রতিবার বন্ধ পাচ্ছি!
আয়াশঃ ফোনের সিম তো খুলে রেখেছি আর ফোন ফেলে দিয়েছি!
লামিঃ ভালো করেছো! (মন খারাপ করে)
আয়াশ হেসে আমাকে পেছন থেকে জরিয়ে ধরে হটাৎ আমার হাতের দিকে তাকিয়ে বলল,,
আয়াশঃ তোমার হাতে কি হয়েছে?
লামিঃ তুমি ফোন ধরোনি দেখে আমক ব্লেড দিয়ে ফ্যাশ দিয়েছিলাম!
এবার আয়াশ আমার থেকে সরে দাঁড়ালো, এতোক্ষনের হাসি এবার ওর মুখে বিলীন হয়ে গেলো! মনে হচ্ছে, আমি খুব অপরাধ করে ফেলেছি! আয়াশ মুখে গম্ভীরতা এনে বললো,,,
আয়াশঃ কেন? তুমি কি আমার হাতের মাইর খেতে চাও লামি? খুব সাহস বেড়েছে তোমার তাইনা? এতো সাহস কে দিয়েছে? কোন সাহসে এই কাজ করলে তুমি? ( চিল্লিয়ে)
লামিঃ সরি!
আয়াশঃ একা এসেছো?
লামিঃ না সবাই এসেছে!
আয়াশঃ তাহলে এখন সবার কাছে যাও, আমি একা থাকবো!
লামিঃ বললাম তো সরি আর কখনো এমন হবে না!
আয়াশঃ,,,,,,, ( কিছু বলে না)
লামিঃ আয়াশ প্লিজ সরি!
এই কথা বলাতেই আয়াশ আমার হাত খামচি দিয়ে ধরে দিলো দাত বসিয়ে এক কামুড়! ব্যাথায় আমার চোখ লাল হয়ে ওঠলো, আয়াশেরও সেইম লাল হয়েছে!
লামিঃ আহ!
আয়াশঃ লাগছে?
লামিঃ,,,,,,,( কিছু বললাম না)
আয়াশঃ আমারও লাগছে জানো, আমি জাস্ট আমার ব্যাথাটা অনুভব করালাম!
লামিঃ তুমি আর কখনো এমন করে আমাকে কষ্ট দিবে না তাইলে।
বলেই আয়াশকে জরিয়ে ধরলাম, আমার এতো এতো আশা এবার পূরণ হবে, কিন্তু আয়াশ আমাকে এক সেকেন্ডের জন্যও জরিয়ে ধরলো না!
লামিঃ আয়াশ তোমাকে বলেছিলাম না, আমি আমার আব্বুকে রাজি করিয়েই তোমার কাছে আসবো?
আয়াশঃ রাজি হয়েছে?
লামিঃ হুম!
আয়াশঃ আমি জানি!
অবাক হয়ে ওর দিকে তাকালাম, ও তো বাহিরে বেরই হয়নি তাহলে জানলো কি করে? আর আমাদের বাসার কথাও তো ওর জানা পসিবল না! ও কি সত্যি সত্যি ম্যাজিক জানে?
লামিঃ তুমি কিভাবে জানলে?
আয়াশঃ ( মুচকি হেসে) তোমাকে আসা দেখেই বুঝেছি, আমার বউ কামাল করেই এখানে এসেছে নাইলে শ্বশুর ফিট মারতো এতোক্ষনে!
লামিঃ চুপ ফাজিল, আমি কিছু করিনি! যা করার আম্মু আর রাইসাই করেছে!
তারপর একে একে সব ঘটনা আয়াশকে খুলে বললাম!
____________________
এদিকে ড্রয়িংরুমে,,
লামির আব্বু হাতজোড় করে বললেন,,,
রাশেদঃ ভাই আমাকে মাফ করে দিবেন, আমি আমার ইগোর জন্য ওদের আলাদা করতে চেয়েছিলাম!আসলে দোষ মূলত আমারই, আয়াশ যেটা করেছে আমিও ঠিক তাই করতাম! আর অতীত তো অতীতই, এতে কারোর হাত থাকে না! সেদিন আপনাদের অনেক কথা শুনিয়েছি, সবকিছুর জন্য সরি প্লিজ কিছু মনে করবেন না!
আয়াশের আব্বু হেসে বলল,,,
রায়হানঃ আরে ভাই কি বলছেন এসব, যা হবার হয়ে গেছে বাদ দেন! সব ঠিক হয়েছে এটাই অনেক কিছু, আমি জানতাম আপনিও ওদের ঠিক মেনে নিবেন!
রেনুকাঃ ( মিষ্টি করে হেসে) এবার আমার ছেলের মুখে হাসি ফুটবে তবে! ছেলে এতদিন অনেক কষ্ট পেয়েছে তার জন্য অনেক টেনশনে ছিলাম, এবার কিছুটা রেহাই পেলাম আমরা!
আমি আর আয়াশ ড্রয়িংরুমে যেতেই আয়াশ আব্বুর কাছে গেলেন,,,
আয়াশঃ বাবা, সরি! আসলে আমার রাগ ওঠলে আমি কিছু মানি না, তাই আপনাকে অতোগুলো কথা বলেছিলাম!
রাশেদঃ বাবা ও কথা বলে আর লজ্জা দিও না আমাকে! যা হয়েছে তার জন্য আমি সরি, আসলে ভুল সব আমারই হয়েছে! আমি আজ লামিকে দিতে এসেছি তুমি আর রেগে থেকো না ওর ওপর!
আয়াশঃ আমি আপনার কাছে অনেক ঋণি হয়ে গেলাম বাবা!
রাইসা এবার এগিয়ে এলো,,,
রাইসাঃ ভাবী তুমিও এসেছো? কি অবস্থা করেছো নিজের সাথে আমার ভাইয়েরও, হুম?
আমি হেসে রাইসাকে জরিয়ে ধরলাম, সামিয়াও আমার কাছে আসলো!
সামিয়াঃ এখন তো আপু কে আমি আর পাবো না, তোমার কাছেই আসবে!
রাইসাঃ কি হিংসে লাগে আমাকে?
আমি আর সামিয়া রাইসার কথায় হেসে ফেললাম! রাতে অনেক জোরাজুরি করে ডিনারের ব্যাবস্থা করেছে মামুনি! একটু পরেই আমরা বাসায় চলে যাবো,, তাই আমি, সামিয়া আর রাইসা ওদের বাসার ছাদে এসেছি! বিয়ের আগে শ্বশুর বাড়িতে এমন ঘুরে ঘুরে দেখার সৌভাগ্য কয়জনেরই বা হয়! আমার হয়েছে, আমরা আড্ডা দিচ্ছিলাম তিনজন মিলে! হটাৎই ঝড়ের বেগে আয়াশ আসলো, আমার পাশে রাইসা ছিলো ওকে সরিয়ে দিয়ে আমার পাশে দাঁড়ালো,,,
আয়াশঃ হেই পেত্নীর দল!
কি ফাজিল ছেলে এটা, আমাকেও ছাড়লো না! রাইসা তো মারতে লাগলো!
আয়াশঃ সামিয়া ধন্যবাদ, তুমি আর আমার শ্বাশুড়ি মা আমার জন্য অনেক করেছো!
সামিয়াঃ তেমন কিছুই করিনি, জাস্ট আব্বুকে বুঝিয়েছি !
আয়াশঃ এটাই আমার জন্য অনেক!
সামিয়াঃ ( মুচকি হেসে) থ্যাংকস দিয়ে তো শুধু পেট ভরবে না জিজু।
আয়াশঃ কি চাই শালিকার?
সামিয়াঃ কালকে ট্রিট দিবেন!
আয়াশঃ সেটা তো প্রায়ই দেই!
রাইসাঃ ( চিৎকার করে) ভাইয়া,,, তুমি আমাকে রেখে ওদের নিয়ে যাও? বোনের থেকে এখন বউ, শালিকা বড় হলো তোমার কাছে?
______________________
আমরা একটা লেকের পাড়ে বসে, বড় গাছের নিচে দুই কপত-কপতী বসে সময় কাটাচ্ছি!
আয়াশঃ অবশেষে অনেক কাঠখোড় পুরিয়ে তোমাকে জয় করলাম!
লামিঃ হুম!
আয়াশঃ তুমি আর কখনো নিজের ক্ষতি করে আমাকে কষ্ট দিবে না, মনে থাকে যেনো!
লামিঃ দিবো!
আয়াশঃ ( রাগী চোখে তাকিয়ে) তাহলে কিন্তু খুন করে করবো তোমাকে! তোমার কান্না আমি সহ্য করতে পারি না, আর কখনো কাঁদবে তো তোমার একদিন কি আমার একদিন!
লামিঃ আছা ঠিক আছে কাঁদবোনা!
কালকে আমার আর আয়াশের বিয়ের অনুষ্ঠান শুরু হবে, অবশেষে অনেক বাধা বিপত্তি পেরিয়ে কাল থেকে আমরা নতুন জীবন গড়বো! তাই আয়াশের ইচ্ছা বিয়ের আগে একবার একসাথে দুজন সময় কাটাবো! বিয়ের পরে তো বিবাহিতই হয়ে যাবো, তাই আজ দেখা করতে এসেছি,,আমার বাড়ি ভর্তি ম্যাহমান! আমার সব আত্নীয়-স্বজন রা এসেছে,, এদিকে আয়াশের ডাকে না আসলে আবার শাস্তি দিবে তাই আদিবা কে চুপ করে বলে বের হয়েছি! সাহেব আজ আমাকে গান শোনাবে তাই গিটারও সাথে নিয়ে এসেছে,,,
লামিঃ কই, তুমি নাকি গান শোনাবে?
আয়াশঃ হুম, তার আগে একটু ভালোভাবে দেখতে দাও! আজই শেষ প্রেমিকা হিসেবে দেখছি কাল থেকে তো বউ হবে,, সত্যি সত্যি বউ!
লামিঃ আজাইরা, গান শোনাও!
আয়াশঃ ওকে বাবা,, তবে আমি একা না তুমিও সাথে বলবে! এটা আমার অনেক দিনের ইচ্ছে!
লামিঃ আমি পারিনা!
আয়াশঃ তুমি পারো!
লামিঃ তুমি জানো?
আয়াশঃ হুম, সামিয়া বলেছে!
লামিঃ এই মেয়ে দেখি আমার সব গোপন তথ্য ফাশ করে দেয়!
আয়াশঃ (হেসে বললো) এর জন্য কিন্তু মাইনেও পায়!
লামিঃ মানে? ( অবাক হয়ে)
আয়াশঃ সে আর না বলি,, তুমি ওকে বকবে তাইলে! বাদ দাও, এখন গান শুরু করো! আগে তুমি তারপর আমি!
আমি একটা তৃপ্তির শ্বাস ছেড়ে গাইতে শুরু করলাম,,,
লামিঃ কিছু কথার পিঠে কথা
তুমি ছুঁয়ে দিলেই মুখরতা,
হাসি বিনিময় চোখে চোখে
মনে মনে রয় ব্যাকুলতা!
আয়াশঃ #আমায়_ডেকো_একা_বিকেলে,
কখনো কোনো ব্যথা পেলে!
লামিঃ আমায় রেখো প্রিয় প্রহরে,
যখনই মন কেমন করে!
আয়াশঃ কোনো এক রূপকথার জগতে,
তুমি তো এসেছো আমারই হতে!
লামিঃ কোনো এক রূপকথার জগতে,
আয়াশঃ তুমি চিরসাথী আমার জীবনের, এই পথে!
লামিঃ কোথা’ও ফুটেছে ফুল,
কোথাও ঝরেছে তারা!
কোথাও কিছু নেই
তোমার আমার গল্প ছাড়া!
আয়াশঃ তুমি আমার স্বপ্ন সারথি,
জীবনে তুমি সেরা সত্যি!
লামিঃ তুমি আমার স্বপ্ন সারথি,
জীবনে তুমি সেরা সত্যি!
আয়াশঃ কোনো এক রূপকথার জগতে,
তুমি তো এসেছো আমারই হতে!
লামিঃ কোনো এক রূপকথার জগতে!
আয়াশঃ তুমি চিরসাথী আমার জীবনের, এই পথে!
____________সমাপ্ত______________