আমার হিয়ার মাঝে পর্ব ২৮

0
767

#আমার_হিয়ার_মাঝে
লেখিকা: তাহসীন নাওয়ার রীতি
পর্ব:২৮

ডাইনিং টেবিলে চুপচাপ বসে আছে অধরা। মুখোমুখি বসে নাস্তা গোগ্রাসে গিলে যাচ্ছে টুসি। আশ্বিন খাওয়ার তালে ব্যস্ত একটি রিপোর্ট হাতে নিয়ে।
‘হঠাত দেখছি বাসার আবহাওয়া চুপচাপ হয়ে আছে! কি ব্যাপার টুসি? কি সমস্যা তোমার মামির?’
টুসি খাওয়া রেখে ফিরে তাকায় অধরার পানে। অধরা শান্ত, চোখ মুখে এক ফ্যাকাশে ভাব।
‘মামি কি হয়েছে তোমার?’
‘কিছুই তো হয়নি। কি হবে?’
‘কিছু না হলে তো আপনি চুপচাপ বসে থাকার মতো মেয়েই না। কি? গতকালের পরীক্ষা ভালো হয়নি?’
‘না, পরীক্ষা ভালোই হয়েছে।’
কথাটা বলে আবারো গম্ভীর হয়ে যায় অধরা। আশ্বিন বুঝতে পারছে না অধরার নিশ্চুপতার কারণ।

‘মামা আমাকে স্কুলে পৌঁছে দিয়ে আসবে? দেরি হয়ে যাচ্ছে আমার।’
‘হ্যা। চলো টুসি।’
চলে যায় দুজন। খাবারের টেবিলে একা বসে থাকে অধরা। রাফিনের সাথে তার দেখা করার বিন্দু মাত্র ইচ্ছে নেই। কিন্তু সে গতকাল রাত থেকে বারবার ফোন করে চলেছে। যদিও অধরা বারবার তাকে ইগনোর করছে। কিন্তু যদি আশ্বিন জেনে যায় আর আবারো তাকে ভুল বুঝে?
কথাটা মনে হতেই মাথা ঘুরে আসছে তার।

পড়ন্ত বিকেল। চারদিকে ধেয়ে নামছে অন্ধকার। খাটের মাঝখানে বসে টিভি দেখছে অধরা, যদিও টিভির দিকে তার খেয়াল নেই। আশ্বিন বসে আছে সোফায়, ব্যস্ত তার ফাইন পত্র নিয়ে।
‘কিছুদিনের জন্য নাহয় ময়মনসিংহ ঘুরে এসো। পরীক্ষা শেষ, চিন্তা নেই তাই সবার সাথে ভালোই সময় কাটাতে পারবে। নয়তো ইন্টানশিপ শুরু হয়ে গেলে আর কোথাও যাওয়ার সুযোগ পাবে না।’
‘হুম।’
ছোট করে উত্তর দেয় অধরা। ফিরে তাকায় না আশ্বিন।
‘কি ভাবছো এতো? এতো শান্তশিষ্ট থাকার মেয়ে তো তুমি না। সত্যি করে বলো আমাকে।’
কিছুক্ষণ চুপ থাকে অধরা। আশ্বিনের থেকে আর কথা লুকিয়ে রাখতে চাইছে না সে। তাই একটি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে উঠে,
‘রাফিন ভাইয়া ফিরে এসেছে।’
ফাইল থেকে চোখ তুলে একনজর ফিরে তাকায় সে অধরার দিকে। পরমূহুর্তে আবারও ব্যস্ত হয়ে পড়ে কাজে।
‘তুমি কীভাবে জানলে?’
‘দেখা হয়েছিলো গতকাল পরীক্ষা শেষে, বাসায় ফিরে আসার পথে।’
‘কি বললো তোমায়?’
‘দেখা করতে বলেছে। বলেছে অনেক জরুরি কথা বলার আছে।’
মাথা নাড়ল আশ্বিন। কিছুক্ষণ চুপ করে নিজের ফাইলের কাজ শেষ করে সব পাশে রেখে উঠে এসে বসলো অধরার পাশে। অধরা তাকিয়ে আছে আশ্বিনের জবাবের আশায়।

‘দেখা করার ইচ্ছে হলে দেখা করতেই পারো। ভয় নেই, যদিও আমি জানি রাফিন কি বলতে চাইছে।’
‘কি বলবে?’
‘সেটা রাফিনের মুখেই শুনতে পারবে।’
কিছুক্ষণ থম মেরে বসে থাকে অধরা। রাফিনের সাথে তার দেখা করার ইচ্ছে নেই। অতীতের কথা মনে হলে আজও ভয়ে কেঁপে উঠে সে।
‘না না। আমি যাচ্ছি না। একদম না।’
‘তোমার ইচ্ছা। তবে আমার মনে হয় একবার দেখা করা উচিত। রাফিন আর আগের মত নেই। একদম পুরোপুরি ভাবে সে সুস্থ।’
‘যাই হোক, আমি নেই। আর যদি যাই তবে আপনিও সাথে যাচ্ছেন আমার।’
‘আমার সাথে তো দেখা করতে চায়নি। তাছাড়া এখন এতো ভয় পাচ্ছে কেনো? যখন রাফিন অসুস্থ ছিলো, মাথা ঠিক ছিলো না, তখন তো ঠিকই রাফিনের সাথে ঘুরঘুর করেছো।’
কথাটা শুনে রেগে ফিরে তাকায় অধরা। মহাশয় এখন তাকে পুরনো কথা তুলে কথা শোনাচ্ছে? রাগে উঠে চলে যায় সে।
—————

একটি রেস্টুরেন্টে মুখোমুখি বসে আছে রাফিন আর অধরা। পাঁচ মিনিট চুপচাপ বসে থাকার পর মুখ খুললো রাফিন।
‘অধরা, আমি জানি তুমি আমাকে সেদিনের আচরণের জন্য ভয় পাও। পাওয়াই স্বাভাবিক, আমি কাজই করেছিলাম এমন। যদিও আমি ইচ্ছে করে কিছুই করিনি। আমি আসলে…।’
‘আমি জানি রাফিন ভাইয়া।’
একটু থেমে নেয় রাফিন। মাথায় সাজানো কথাগুলো কেমন যেন এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে তার।
‘মা বাবার এক্সিডেন্টের পর যখন আমি একা হয়ে গিয়েছিলাম তখন কেউ ছিলো না আমার পাশে দাঁড়ানোর মতো। বাবা মায়ের একমাত্র সন্তান আমি, কখনও এমন হয়নি যে আমি কিছু চেয়েছি আর বাবা এনে দেয়নি। আর সেই বাবাকে হারানোর পর বুঝেছি দুঃখ কষ্ট কি জিনিস। পৃথিবীতে কেউ তোমার আপন না, যখন তোমার তাদের সাহায্যের প্রয়োজন।
কলেজ লাইফ থেকে একটা মেয়েকে খুব ভালোবেসেছি। দুজনের পরিবারই এই বিষয় অবগত ছিলো, কথা ছিলো আমার ডাক্তারি পড়া শেষ হলে বিয়ে হবে। কিন্ত দেখো, বাবা মাকে হারানোর পর যখন আমার তার সাপোর্ট সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন ছিল। সেই সময়টায় সে আমাকে ছেড়ে অন্য কোথাও বিয়ে করে নিয়েছে। একবারও আমার কথা ভেবে দেখলো না।’
কথাগুলো শুনে অধরা চুপচাপ বসে আছে। রাফিন কখনও তাকে এই ব্যাপারে কিছুই বলেনি। তাই হঠাত এই কথা তাকে অবাক করছে।

‘ভেঙে পড়েছিলাম আমি। পুরো পৃথিবী জুরে আমিই যেন একা, নিঃসঙ্গ, একাকীত্ব। বাবা ছিলো একজন বড় ব্যবসায়ী, উনার ইচ্ছে ছিলো আমি উনার বিজনেস সামলাবো। কিন্ত আমার ছিলো ডাক্তার হওয়ার স্বপ্ন। বাবার পর সেই বিজনেস সাজানোর কেউ ছিলো না আমি ছাড়া। পড়ার পাশাপাশি এই দায়িত্ব পালন করে, দিনশেষে কোনকিছুই সামলে উঠতে পারিনি। হতাশার চরম সীমান্তে পৌঁছে যখন একের পর এক পাগলামি করেছি তখন হাসান চাচা আমাকে উনার কাছে নিয়ে আসেন। উনি আমার আপন চাচা নয়, তবুও আমাকে কখনও নিজের সন্তান থেকে কম ভাবতেন না। উনার ভালোবাসা, যত্ন এগুলোর জন্য কখনও আমি বুঝতেই পারিনি যে গভীরে আমি এতটাই অসুস্থ। পরে অবশ্য সব জানতে পেরেছি। চাচা সব বলেছেন আমায়, তোমার কথা, রোদ্দুরের কথা, আশ্বিনের কথা। আমি তোমার উপর চির কৃতজ্ঞ অধরা। তুমি আমার জন্য অনেক গুরুত্বপূর্ণ। নিঃস্বার্থ ভাবে আমার বিপদে তুমি এগিয়ে এসেছিলে, আমি কোনদিন এই কথা ভুলবো না। তোমাকে অনেক ধন্যবাদ।’

অধরা চুপচাপ শুনে যাচ্ছে রাফিনের কথা। তারপর একটি দীর্ঘশ্বাস ফেলে সে।
‘আমি যদিও চেয়েছিলাম আপনার চিকিৎসার উদ্দেশ্যে আপনার সাথে বন্ধুত্ব করতে। কিন্তু একটা সময় আপনি সত্যিই আমার খুব ভালো বন্ধু হতে পেরেছিলেন রাফিন ভাইয়া। আমি ভুলে গিয়েছিলাম আপনার অসুস্থতার খবর। কখনো আপনাকে দেখে আমার মনে হয়নি আপনি ভেতর ভেতর এতটা ভেঙে আছেন। আপনার উচিত ছিল আমাদের সবার সাথে মিশে নিজের কষ্ট ভাগ করে নেওয়ার। যাই হোক, পুরনো কথা বলে আর কি লাভ? আপনি এখন সম্পূর্ণ সুস্থ, এটাই অনেক বড় পাওয়া।’
একটা মুচকি হাসি দেয় রাফিন। অধরার কাছে কথাগুলো বলতে পেরে সে একটি দীর্ঘশ্বাস ফেলে।
‘রাফিন ভাইয়া, আপনাকে একটি প্রশ্ন করার ছিলো।’
‘আমি জানি তুমি কি বলবে। সেই ভুল ঔষধের কথা, তাই না?’
‘জি।’
‘অধরা, এটা সম্পূর্ণ আমার বোকামির ফল। আমি না জেনে না বুঝে সেই ঔষধগুলো নিয়মিত খেয়েছি, যদি আমার বিন্দু মাত্র ধারণা হতো যে আমি কতো বড় ভুল করতে যাচ্ছি….।’
কথাগুলো শুনে অবাক হয় অধরা। মানে রাফিন নিজেই ভুল ক্রমে সেই ঔষধ খেয়েছে যার ফলে এতো সব কিছু..!
‘অধরা, আমি দেশ থেকে চলে যাওয়ার আগে আশ্বিনের কাছি রোদ্দুরের কাছে ক্ষমা চেয়েছি। তোমার কাছে ক্ষমা চাওয়া বাকি ছিলো।’
‘না রাফিন ভাইয়া, কি বলছেন এসব? আপনার দোষ ছিলো না এতে, যা হয়েছে সবটাই একটা দূর্ঘটনা। একে ভুলে যাওয়াই ভালো।’
‘হুম। আশ্বিন খুব রেগে ছিলো সেদিন। হাসান চাচার উপর সবটার দ্বায়ে অনেক রাগ দেখিয়েছে। কেনো তোমাকে উনি এমন একটা কাজে ব্যবহার করলেন? তোমার জন্য সেদিন আমার উপর থেকে কেইস অফ করে দিয়েছিলো। যেন তুমি কোনভাবে এখানে জড়িয়ে না পরো, যেন তোমার লাইফ নষ্ট না হয়। তোমার জন্য সেদিন তার আচরণ চোখে পড়ার মতো ছিলো, সেদিন আমি বুঝেছিলাম আশ্বিন তোমাকে কতোটা ভালোবাসে।’
হতভম্ব অধরা। সে তো কখনও এমন কোন কথা জানতে পারেনি। আশ্বিন তার জন্য…?
কথাগুলো মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে তার।

‘আশ্বিন আমার জন্য কেইস অফ করেছিলো?’
‘হুম। কারণ হাসান চাচার বয়ান অনুযায়ী আমার সব ঔষধের দায়িত্ব ছিলো তোমার উপর। যা তুমি স্বীকার করেছিলে। যেহেতু তুমি তখন কেবল ফাস্ট ইয়ারে ছিলে, তাই ভুল ঔষধ দেওয়া তোমার কাজ হিসেবে সবাই ধরে নিয়েছিলো। যদি এমনটা হতো তবে তোমাকে মেডিকেল থেকে তারা বরখাস্ত করতে পারতো। আলহামদুলিল্লাহ সময় মতো আশ্বিন সবটা সামলে নিয়েছে।’
মাথার উপর যেন আকাশ ভেঙে পড়ে অধরার। এতগুলো বছর সে এই কথাগুলো জানতেই না। অথচ সে এই কারণে আশ্বিনকে কতো কথাই বলেছিলো।

–চলবে
((আসসালামু আলাইকুম। কেমন আছেন সবাই? সবার প্রথমে আমি দুঃখিত গল্প দেরিতে দেওয়ার জন্য। হঠাত আমার ফোনটা নষ্ট হয়ে যাওয়ায় নিয়মিত গল্প দিতে পারছি না। ইনশাআল্লাহ আগামীকাল গল্পের শেষ পর্ব দেওয়া হবে।))

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here