আমার হিয়ার মাঝে পর্ব ২৭

0
718

#আমার_হিয়ার_মাঝে
লেখিকা: তাহসীন নাওয়ার রীতি
পর্ব:২৭

কিছুটা দমে যায় অধরা। তবে তা প্রকাশ করে না সে। চোখ এপাশ ওপাশ করে মুহূর্তেই কিছু ভেবে ফেলে।
‘আমি হলাম..’
আর বলা হয়নি তার। আশ্বিনের ফোন বেজে উঠায় তার ধ্যান চলে যায় সেদিকে। মুখ ভেংচি কাটে অধরা। কিন্তু পর মূহুর্তে আশ্বিনের মুখের ভাবভঙ্গি দেখে সন্দেহ হয়। তাই লুকিয়ে ফোনের দিকে একটা উঁকি দিতেই চোখ মুখের রঙ পাল্টে যায়।
‘বাহ, ভালোই। তাহলে এখনো কথা হয় আপনাদের!’
ভ্রু কুঁচকে ফিরে তাকায় আশ্বিন। মারিয়ার এই আকস্মিক কল তাকে নিতান্তই অবাক করেছে, তবে অধরার কথায় সে আরো হতভম্ব।

‘কথা হয় মানে কি? তোমার কি মনে হয় আমি মারিয়ার সাথে গল্প করে বেড়াই? হাসপাতালে আমার দম ফেলারও সময় থাকে না।’
কিছুটা দমে যায় অধরা। হাতে থাকা কাপে একটা চুমুক দিয়ে আবারও তেড়ে উঠে।
‘এক মিনিট, এর মানে আপনার সময় নেই বলে আপনি মারিয়ার সাথে কথা বলেন না। সময় থাকলে ঠিকই বলতেন, তাই না?’
হতভম্ব আশ্বিন। কি বোঝাতে গিয়ে কি বুঝলো এই মেয়ে!
‘আমি এমনটা কখন বোঝালাম?’
‘সব কথা বলে বোঝাতে হয়না। আমি সব বুঝতে পেরেছি নিজেই।’
‘খুব ভালো করেছো।’
কঠোরভাবে কথাটা বলেই চলে যায় আশ্বিন। এর মাঝে মারিয়ার আবারো কল আসায় রেগে ফোন অফ করে দেয় সে।
চোখ ছোট ছোট করে আশ্বিনের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে বিস্কুট খেয়ে নেয় অধরা।
————–

সন্ধ্যার পর থেকেই আকাশের অবস্থা ভালো নেই। মহাশয় কিছুক্ষণ আগেই হাসপাতাল থেকে ফিরে এসেছেন। অধরা একবার রুমে উকি দিয়ে দেখে আশ্বিন ওয়াশরুমে ফ্রেশ হচ্ছেন। সকাল থেকে আজ মহাশয় মুখ ফুলিয়ে বসে আছেন, কোন কথাই বলছেন না। আশ্বিনের এভাবে গম্ভীরতা তার সহ্য হচ্ছে না। আসলে সে নিজেও কথা না বলে থাকতে পারছে না।
তাই রান্নাঘরে এসে আশ্বিনের জন্য কফি বানাতে শুরু করে।

এদিকে,

আশ্বিন ফ্রেশ হয়ে এসে বারান্দায় টাওয়াল রেখে রুমে এসেই দেখে অধরা কফির মগ হাতে নিয়ে হাজির।
‘কি চাই?’
‘আপনাকে ছাড়া আমি আর কি চেয়েছি জীবনে?’
অধরার কথায় একটা তাচ্ছিল্যের হাসি দেয় আশ্বিন। অধরা ততক্ষনে চলে এসেছে আশ্বিনের পাশে।
‘মনে হলো বিশ্বাস করলেন না আমার কথাটা!’
‘আরে না, অবিশ্বাস করবো কেনো? দাও আমার কফি।’
ঘাপটি মেরে বসে থাকে অধরা। মহাশয় কি সাবলীল ভাবে বসে নিজের ফাইল দেখতে দেখতে কফি খাচ্ছেন।
রাগে দুঃখে গিয়ে পড়ার টেবিলে বসে পড়তে শুরু করে সে।

রাত ঘনিয়ে আসার সাথে সাথে আকাশ যেন আরো বেশি মেঘলা হয়ে উঠছে। বাতাসের বেগ বেশি, যেন বড় ঝড়ের পূর্বাভাস।
বই খাতা গুছিয়ে রেখে অধরা একবার নজর দেয় খাটে আয়েশ করে বসে থাকা আশ্বিনের দিকে। মহাশয় সারাদিন ব্যস্ত থাকবে হাসপাতালে, আর রাতে ব্যস্ত থাকবে ফাইল পত্র নিয়ে। বাহ, কি সুখি মানুষ!
বড় বড় পা ফেলে অধরা রুম থেকে বেরিয়ে যেতে নিতেই কারেন্ট চলে যায়। মূহুর্তেই চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে আধার।
‘বাহ! খুবই ভালো..।’
‘অধরা, অন্ধকারের মাঝে কোথাও যেও না। নাহয় হোঁচট খাবে।’
আশ্বিন কথাটা বলে নিজের ফোনের লাইট অন করে।
বাহিরে ঝড়ের সাথে শুরু হলো বৃষ্টি। মাঝে মাঝে মৃদু মেঘের ডাক।
আশ্বিনের ফোনের আলোয় অধরা এসে খাটের একপাশে বসে জানালা দিয়ে বৃষ্টি দেখতে শুরু করে।
খানিক বাদে ঘরে মোম নিয়ে এসে তার পাশে বসে আশ্বিন। অভিমানে মুখ ঘুরিয়ে নেয় অধরা।

‘তোমার জন্য একটা গিফট নিয়ে এসেছিলাম। কিন্তু তুমি তো দেখছি রেগে আছো, তাহলে এখন গিফটের কি হবে?’
‘কিসের গিফট?’
গম্ভীর হয়ে কথাটা বলতেই চোখের সামনে একটা গাজরা ফুলের মালা দেখতে পায় সে। অবাক হয় অধরা। কলেজে থাকাকালীন আশ্বিন মাঝে মাঝেই তার জন্য গাজরা ফুলের মালা নিয়ে আসতো। কথাটা মনে হতেই মহাশয়ের দিক ফিরে তাকায়।
‘হঠাত?’
‘শুনেছি বউ রেগে থাকলে নাকি উপহার দিতে হয়? তাই নিয়ে এসেছি তোমার জন্য।’
একটা লাজুক হাসি দিয়ে হাত সামনে বাড়িয়ে দেয় অধরা। আশ্বিন কথা না বাড়িয়ে অধরাকে গাজরা পড়িয়ে দেয়।
‘তুমি জানো, এই গাজরা তোমার হাতে কতটা মানায়?’
‘হুম, আজ সুন্দরী না বলে…।’
থমকে ফিরে দেখে আশ্বিন।
‘কি? সুন্দরী না মানে? এই মেয়ে! তুমি শুধু অধরা না, আমার বাঁকা পাজরের হাঁড়। আমি যেহেতু এতো সুন্দর হ্যান্ডসাম, তাহলে আমার হাড্ডি হয়ে তুমি কি কম সুন্দরী হবে নাকি?’
আহাম্মক হয়ে হা হয়ে তাকিয়ে আছে অধরা। এভাবে তো কখনো ভেবে দেখেনি সে। সত্যি বলেছে, মহাশয় অনেক হ্যান্ডসাম! কথাটা মনে হতেই একরাশ লাজুকতা ভর করে তার মনে।

হঠাত আশ্বিন অধরার কপালে পরে থাকা চুলগুলো সরিয়ে কানের পিঠে গুজে দেয়। অধরা একধ্যানে তাকিয়ে থাকে তার দিকে। মোমবাতির মৃদু আলোয় তার ভালোবাসার মানুষ। অনেক বিরহ কষ্ট যন্ত্রণা সহ্য করে তাকে পেয়েছে সে, যদিও অনাকাঙ্খিত পাওয়া। তবুও তো তারই একান্ত ব্যক্তিগত।
কথাগুলোর মাঝে হঠাত একটি বড় বজ্রপাত হতেই অধরা চমকে উঠে আশ্বিনের টিশার্ট খামচে ধরে। হেসে উঠে আশ্বিন। অধরার ভীত চোখ মুখ আর কাঁপা ঠোঁট তাকে আকৃষ্ট করতে চাইছে। একধ্যানে কিছুক্ষণ সেদিকে তাকিয়ে চোখ ফিরিয়ে নেয় সে। এমনিতেই অধরা এখনও তাকে আর তার বিয়েকে মানতে পারছে না, এর মাঝে একটি ভুল কাজ তার অধরাকে চিরতরে না হারাতে হয়।

‘আশ্বিন…এইভাবে বিদ্যুত পড়ে আমাকে হার্টের রোগী বানাতে চাইছে নাকি?’
‘বিদ্যুতের কথা রাখো। আগে আমার টিশার্ট ছাড়ো। যেভাবে আমাকে বন্দি করে রেখেছো, কখন যেন খাপছাড়া হয়ে কন্ট্রোল হারিয়ে ফেলি। তখন করো না কোন আফসোস।’
আশ্বিনের কথায় চুপসে যায় সে। কিছুটা দূরে সরে গিয়ে মিনমিন কণ্ঠে,
‘আফসোস কেনো করবো? আফসোস করার কি আছে? আপনি তো আমার..।’
আর কিছু বলার সুযোগ হয়নি তার। মুহূর্তেই ওষ্ঠেদ্বয় দখল হয়ে যায় তার। বুজে আসে চোখজোড়া।
————

আজ অধরার ফাইনাল ইয়ারের শেষ পরীক্ষা। পরীক্ষা শেষে বন্ধু মহল মিলে অনেক্ষণ ধরে হৈচৈ করে পুরো কলেজ মাথায় তুলে অবশেষে রওনা হচ্ছে বাসায় যাওয়ার উদ্দেশ্যে।
‘অনিক আর সাদমান, তোরা সত্যি করে বলবি যে কবে বিয়ে করবি? দেখ জারিফ আর ইশাও বিয়ে করে নিলো?’
‘আমাদের বিয়ে নিয়ে তুই এতো উতলা হচ্ছিস কেনো অধরা?’
‘কারণ, আমি কিছুদিন আগেই একটা নতুন ড্রেস কিনেছি, কিন্তু পড়ার মতো অনুষ্ঠান পাচ্ছি না।’
হেসে উঠে জারিফ আর ইশা। এদিকে তেলে বেগুনে জ্বলে যাচ্ছে অনিক আর সাদমান।
‘দাওয়াত দিবো না তোকে বিয়েতে। আর তাছাড়া আগে সাদমান বিয়ে করুক, তারপর আমি।’
‘জি না মামা, আগে তুই বিয়ে করবি।’
কথায় কথায় দুজনের মাঝে লেগে যায় ঝগড়া। শেষে সাদমান দৌড়ে পালিয়ে যায় আর অনিক যায় তার পিছু। দুজন চলে যেতেই,
‘এই অধরা, ভুলে যাস না আবার আজ কিন্তু আমাদের বাসায় পার্টি আছে। সময়মত চলে আসিস।’
‘ঠিক আছে, টেনশন নট!’
হেসে চলে যায় ইশা আর জারিফ। সবাই চলে যেতে একাই অধরা গেইট দিয়ে যেতে শুরু করে।
আজ মহাশয়ের জরুরি ওটি আছে। তাই একাই ফিরে যাচ্ছে সে।

হঠাত,
‘অধরা!’
কারো ডাক শুনে পিছনে ফিরে তাকায় সে। কিন্তু সেখানে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষকে দেখে সে থমকে যায়!
‘রাফিন ভাইয়া!’
হতভম্ব সে। আজ এতো বছর পর রাফিনকে সামনে দেখতেই অতীতের কথাগুলো মনে পড়ে যায় তার। চোখের সামনে ভেসে ওঠে রাফিনের হিং/স্র রূপ।
সেদিনের পর আর রাফিনের সাথে দেখা হয়নি তার। আর আজ এভাবে হুট করেই?
‘কেমন আছো অধরা? অনেক সময় পর..।’
কথা বলার ভাষা নেই তার। যেন কণ্ঠ আটকে গিয়েছে।
‘আপনি দেশে ফিরে এসেছেন?’
‘গতকাল এসেছি, ভাবলাম পুরনো কলেজটা একবার ঘুরে আসি। তোমার সাথে দেখা করারও খুব ইচ্ছে ছিল, শুনেছি আশ্বিনকে বিয়ে করেছো?’
‘জি।’
‘ভালো, তোমার সাথে আমার জরুরী কথা আছে অধরা। যদি তোমার সময় হতো..।’
আর কোন কথা বলছে না অধরা। গতবার অনেক কিছুই হয়েছে রাফিনের জন্য। তাই এবার সব বুঝে উত্তর দিতে হবে তার।

–চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here