#আমার_হিয়ার_মাঝে
লেখিকা: তাহসীন নাওয়ার রীতি
পর্ব:২৬
রান্নাঘরে দাঁড়িয়ে রুটি বানানোর চেষ্টায় আছে অধরা। কিন্তু কোনভাবেই সে পারছে না গোল করে রুটি বানাতে। তবে এতে তার কোন আফসোস নেই, রুটি একরকম হলেই হলো। খাওয়া হলেই কথা।
এদিকে
অধরার কর্মকান্ড দেখতে লুকিয়ে রান্নাঘরে প্রবেশ করে আশ্বিন। পানি খাওয়ার নাম করে অধরার পাশে দাঁড়িয়ে আড়চোখে তাকে পর্যবেক্ষণ করতে থাকে।
‘পৃথিবীতে যতো ধরনের আকৃতি আছে, সব আকৃতির রুটি তো বানিয়ে ফেললে। শুধু গোল করে বানানোটা এখন বাকি আছে।’
আশ্বিনের কথায় বিরক্ত হয় অধরা। কিন্তু তা আর প্রকাশ করে না সে।
‘কি চাই আপনার?’
‘তোমাকে কিছু বলতে চাই..।’
রুটি বানানো বন্ধ করে ফিরে তাকায় অধরা। আশ্বিনের পা থেকে মাথা পর্যন্ত একবার চোখ বুলিয়ে নেয় সে।
‘এমন ভাবে কথাটা বলছেন যেন আমাকে কোন রোমান্টিক লং ড্রাইভে নিয়ে যেতে এসেছেন। সোজাসুজি বলুন কি বলতে এসছেন।’
অধরার কথায় ভ্রু যুগল কুঁচকে ফেলে আশ্বিন। এই মেয়ের স্বভাব হলো সব বিষয়ে খুটা দিয়ে কথা বলা।
‘তোমার আজ সকালে হাসপাতালে ডিউটি ছিলো না?’
‘হ্যা।’
‘তাহলে কখন যাবে তুমি? নয়টা বাজতে আর বিশ মিনিট বাকি।’
ভড়কে যায় অধরা। দ্রুত ঘড়ির দিকে তাকাতেই চোখ বড় হয়ে যায় তার। তাই তাড়াহুড়ো করে হাতে থাকা রুটি ভাজতে শুরু করে সে।
‘কি করছো এসব?’
‘দেখতে পারছেন না আপনি? নাস্তা না বানালে কি খেয়ে যাবো আমি? আপনার কথা জানি না, তবে আমি মোটেও না খেয়ে থাকতে পারবো না।’
একটি দীর্ঘশ্বাস ফেলে আশ্বিন। এই মেয়েকে আর কিছুই বলার নেই তার। তাই একটি দীর্ঘশ্বাস ফেলে চলে যায় সে।
হাসপাতালের সামনে আশ্বিন অধরাকে পৌঁছে দিয়ে চলে যায়। আজ মহাশয়ের অফ ডে। তাই অধরার কথা মতো উনাকেই দুপুরের খাবারের ব্যবস্থা করতে হবে। এই কথা শোনার পর আশ্বিনের মুখের অবস্থা মনে হতেই বারবার হাসি আসছে অধরার।
‘অবশেষে তোর দেখা পেলাম আমরা।’
‘হুম, কিরে ইশা! মনে হচ্ছে মোটা হয়ে গিয়েছিস! ব্যাপার কি? হ্যা?’
অধরার কথায় ঘাবড়ে যায় ইশা। ওজন নিয়ে সে দারুণ সচেতন মেয়ে। তাই অধরার কথা শুনে দৌড়ে গিয়ে একনজর নিজেকে আয়নায় দেখে নেয় সে। অতঃপর জারিফকে গিয়ে জিজ্ঞেস করে।
এদিকে ইশার কাজে হেসে যাচ্ছে বাকি সবাই।
‘কথাবার্তায় তো মনে হচ্ছে আমরা আমাদের আগের অধরাকে ফিরে পেতে যাচ্ছি।’
‘অধরা কখনো পরিবর্তন হয়নি অনিক। শুধু কোন এক বিশেষ কারণে নিশ্চুপ ছিলো এতদিন।’
মৃদু হাসি দেয় অনিক। এতোক্ষণে চলে এসেছে বাকি সবাই। তাই বাকি সবার সাথে ওয়ার্ডে রাউন্ড দিতে চলে আসে সবাই।
——————-
এদিকে,
বাসায় বসে বসে আরশির সাথে ফোনে কথা বলছে আশ্বিন। তার মাথায় আসছে না যে হুট করেই অধরা একাই কেনো চলে এসেছে ঢাকা? কি এমন জরুরি ছিলো যে এভাবে সবাইকে কিছু না জানিয়ে চলে আসার? অধরাকে সে অবশ্য অনেক বার জিজ্ঞেস করেছে, কিন্তু সে কোন উত্তর দেয়নি।
‘ভাই বিশ্বাস করো, ভাবির রাত থেকে মন খারাপ ছিলো। রাতের খাবার না খেয়েই ঘুমিয়ে পড়েছিলো। তারপর সকালে উঠে দেখি বাসায় নেই। সবাই খুব টেনশনে ছিলাম।’
কোন কথা না বলে মাথা চুলকে নেয় আশ্বিন। এতোক্ষণ ধরে সে ভাবছিলো হয়তো আরশির কাছে সে কিছু জানতে পারবে কিন্তু না, আরশি তো নিজেই কিছু জানে না।
‘আচ্ছা বাদ দে এসব কথা। মাকে বলিস টেনশন না করতে।’
‘হুম। আচ্ছা ভাই শোনো, রাশেদা খালা আর টুসি কদিন পর ঢাকা আসবেন। মা বলেছে তাদের কিছুদিন তার কাছেই থাকতে।’
‘ঠিক আছে।’
‘হুম। এটাই কিন্তু তোমার সুযোগ ভাইয়া..।’
অবাক হয় আশ্বিন। কিসের কথা বলছে আরশি?
‘কিসের সুযোগ?’
চোখ মুখে বিরক্ত ফুটে ওঠে আরশির। এমন একটা হাবা বড় ভাই তার কপালেই কেনো জুটলো? মাঝে মাঝে খুব মায়া হয় তার অধরার জন্য।
‘কিসের সুযোগ মানে? তোমার বাবা ডাক শোনার সুযোগ। বাপ হওয়ার ইচ্ছে আছে নাকি নাই?’
‘বেয়াদব মেয়ে। বড় ভাই আমি তোর। কথা বার্তা বুঝে বল।’
মুখ ভেংচি দেয় আরশি। আসছে বড় ভাই। জানা আছে তার লাজুক ভাইকে তার।
‘তোমার ভালোর জন্যই তো বলেছি। কথাটা মাথায় রেখো। রাখছি।’
ফোন কেটে দেয় সে। রেগে ফোনটা খাটের একপাশে রাখে আশ্বিন। দুইদিনের পিচ্চি কিনা তাকে উপদেশ দিতে এসেছে। কথাটা মনে হতেই রেগে রুম থেকে বেরিয়ে খাবারের আয়োজন করতে চলে আসে সে।
ঝিরঝির বৃষ্টিতে পরিবেশ মুখরিত। মাঝে মাঝে শোনা যাচ্ছে মৃদু মেঘের ডাক। এই অসময়ে বৃষ্টিতে অধরা পড়েছে বিপাকে।
হাসপাতাল থেকে আজ একা যাওয়ার কথা ছিল তার। কিন্তু হুট করেই এই বৃষ্টি যেন রাস্তার সব রিকশাকে শূন্য করে দিয়েছে। তাই বৃষ্টি কমে আসলে ফিরে যাওয়ার অপেক্ষা করছে সে।
‘আশ্বিন ভাই আসেনি তোকে নিতে?’
‘না, আজ আমার একা যাওয়ার কথা ছিল।’ ‘কোন সমস্যা নেই, আমি পৌঁছে দিবো তোকে। বাইক সাথে আছে আমার সাথে।’
‘আচ্ছা, বৃষ্টি একটু কমে আসুক তারপর নাহয় যাবো।’
জারিফ মাথা নেড়ে অধরাকে নিয়ে হাসপাতালের ক্যান্টিনে এসে বসে। টিনের চালে বৃষ্টির পানির ধুপধাপ শব্দ হচ্ছে।
‘জারিফ, তোকে একটা প্রশ্ন করার ছিলো?’
‘বল’
‘হাসান স্যার কি তোকে নিজ থেকে রাফিন ভাইয়ার রিপোর্ট গুলো দেখিয়েছিলো?’
‘না। আসলে কথায় কথায় স্যার রিপোর্ট দেখিয়েছেন আমাদের।’
‘কিন্তু এই রিপোর্ট কখন করেছেন?’
‘যখন রোদ ভাইয়ের এক্সিডেন্ট হয়েছিলো আর পুলিশ রাফিন ভাইকে ধরে নিয়েছিলো তখন স্যারের কথায় আইনি ভাবে এই রিপোর্ট করা হয়েছিলো।…’
কথাগুলো খুব মনোযোগ দিয়ে শুনতে থাকে অধরা। তার মাথায় অনেক প্রশ্ন এসে জমাট বেঁধে যাচ্ছে।
‘তার মানে আশ্বিন ভাইয়া এই রিপোর্ট দেখেই কেইস তুলে নিয়েছিলো?’
‘সম্ভবত।’
‘তাহলে ভুল ঔষধ দেওয়ার বিষয়টি? এটা কেউ লক্ষ্য করেনি? এমন তো হতে পারে রাফিন ভাইয়াকে কেউ ইচ্ছে করে ঔষধ গুলো দিতো।’
‘এমন কিছু না। এই ঔষধের বিষয়ে স্যার কিছুই বলেননি। তাছাড়া, একবার ভেবে দেখ যদি আশ্বিন ভাইয়া কেইস অফ না করতো তবে হয়তো ভুল ঔষধের দেওয়ার দায়ে আমারা শাস্তি পেতাম।’
চুপ হয়ে যায় অধরা। জারিফ সত্য বলছে। রাফিন ভাইয়া উনার ঔষধের খবর জানেন না, তারা সবাই গোপনে তাকে এইসব ঔষধ খাইয়ে দিতো। মানে যদি কেইস অফ না হতো তবে তাদের পক্ষে কোন প্রমাণ থাকতো না। অনেক বড় বিপদ থেকে আল্লাহ্ রক্ষা করেছেন তাদের।
—————–
ফ্ল্যাটে প্রবেশ করতেই খিচুড়ি আর মাংসের গন্ধ পায় অধরা। মহাশয় তাহলে বৃষ্টির দিন উপলক্ষে ভালোই আয়োজন করেছেন। চুপিচুপি রান্নাঘরে এসে উকি দেয় সে। আশ্বিন ব্যস্ত রান্নার কাজে।
‘কি রান্না হচ্ছে আজ?’
‘তুমি চলে এসেছো? তোমার না আরো পর ডিউটি শেষ হবে?’
‘আগে আগেই চলে এসেছি..।’
‘এই বৃষ্টির মাঝে একাই? আমাকে কল করতে পারতে।’
‘জারিফ পৌঁছে দিয়েছে।’
‘ওহ আচ্ছা।’
কথাটা বলে চুলা অফ করে আশ্বিন। অধরার দিকে একনজর তাকিয়ে মুচকি হেসে চলে যায় সে ফ্রেশ হতে।
আশ্বিনের যাওয়ার পথে নিরবে তাকিয়ে থাকে অধরা। আশ্বিনকে অনেকগুলো প্রশ্ন করার আছে। তবুও কোন কথাই বলতে ইচ্ছে হচ্ছে না তার।
তবে একটি ব্যাপারে সে নিশ্চিত যে আশ্বিন ইচ্ছে করে রাফিনের কেইস বন্ধ করেছে শুধু মাত্র তার জন্য। যেনো সে কোনভাবে এখানে ফেঁসে না যায়। মনে মনে একটি দীর্ঘশ্বাস ফেলে অধরা।
বারান্দায় চায়ের কাপ হাতে একা বসে পুরনো কথাগুলো আর একবার মনে করছে অধরা। রাফিন সেদিনের ঘটনার পর অনেক পাল্টে গিয়েছিলেন। হুটহাট সেই ঘটনা উনার মস্তিষ্কে আরো বেশি আঘাত করে। যার ফল স্বরূপ সেই বছরই তাকে নিয়ে যাওয়া হয় চিকিৎসার জন্য দেশের বাইরে। সেই থেকে তাদের সাথে আর কোন যোগাযোগ হয়নি কারো। হাসান স্যারও হুট করেই রিটায়ার্ড নিয়ে নেন।
লোক মুখে শুনেছিলো রাফিন এখন সম্পূর্ণ সুস্থ আর তারা স্থায়ি ভাবে সেখানেই থাকছেন।
‘কি ভাবছো একা বসে?’
পাশে ফিরে তাকায় সে। আশ্বিন ভাবলিসভাবে চায়ের কাপে চুমুক দিচ্ছেন। মাথায় দুষ্টু বুদ্ধি এসে চাপে তার। অনেক দিন হলো মহাশয়কে বিরক্ত করা হয়না।
‘আপনার কথাই ভাবছিলাম। জানেন তো, একজন আদর্শ বউয়ের কাজ হলো শয়নে স্বপনে সর্বক্ষণে তার স্বামীর কথাই স্মরণ করা।’
তাজ্জব লাগা চোখে ফিরে তাকায় আশ্বিন। অধরার কথাগুলো যেন হজম হচ্ছে না তার।
‘এটতাও স্বামী ভক্ত হওয়ার মানুষ তো তুমি না। কি ব্যাপার?’
‘আপনি কি জানেন আমি কেমন মানুষ?’
‘না। তুমিই বলো তুমি কেমন মানুষ?’
কিছুটা দমে যায় অধরা। তবে তা প্রকাশ করে না সে। চোখ এপাশ ওপাশ করে মুহূর্তেই কিছু ভেবে ফেলে।
‘আমি হলাম..’
–চলবে