#আমার_হিয়ার_মাঝে
লেখিকা: তাহসীন নাওয়ার রীতি
পর্ব:২৫
মাটিতে পড়ে থাকা রোদ্দুরের দিকে বিস্ময়ের নয়নে তাকিয়ে আছে অধরা। চারপাশে হৈচৈ, হট্টগোল! কয়েকজন ছেলে এসে রাফিনকে চেপে ধরে আছে। হিং/স্র পশুর ন্যায় বিলাপ করছে সে।
অধরার বিশ্বাস হচ্ছে না কোন কিছুই। একটু আগেও তো সবটা স্বাভাবিক ছিলো, হুট করেই সব কিভাবে পাল্টে গেলো? স্তব্ধ সে! মস্তিষ্কের কার্যকর ক্ষমতা যেন আজ হারিয়ে গিয়েছে তার। সে ভুলে গিয়েছে কোথায় আছে সে, কি হচ্ছে এখানে।
এদিকে সবার হৈচৈ আরো বেশি উন্মাদ করে তুলছে রাফিনকে। বারবার হেলুসিনেশন হচ্ছে তার। চোখ বারবার যাচ্ছে রোদ্দুরের পাশে বসে থাকা অধরার দিকে। সে ভুলে গিয়েছে কে এই মেয়ে। এই মুহূর্তে তাকে বিষের ন্যায় মনে হচ্ছে তার। তাই সবার থেকে কোনরকম নিজেকে সরিয়ে হাতে থাকা লাঠি নিয়ে এসে যেই না আঘাত করতে যাবে অধরাকে ঠিক তখনই অধরা জ্ঞান হারিয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। শুধু মনে আছে আবছা আবছা চোখে সে সামনে আশ্বিনকে দেখেছিলো। আর কিছু মনে নেই তার।
পুরো কলেজ জুড়ে উক্ত ঘটনা বাতাসের মতো বয়ে যাচ্ছে। কেউ কেউ আবার কথার প্রসঙ্গে আরো চারটা কথা মিশিয়ে বলে বেড়াচ্ছে। তবে তাদের মূল কথাটা হলো অধরার জন্য রাফিন আর রোদ্দুরের মাঝে এই ঝামেলা লেগেছে।
আজ পাঁচদিন হলো রোদ্দুরের জ্ঞান নেই, হাসপাতালে ইমাজেন্সি ওয়ার্ডে তাকে রাখা হয়েছে। তার পরিবারের সবার অবস্থা শোচনীয়। একমাত্র সন্তান হিসেবে রোদ্দুরের বাবা মায়ের এই কষ্ট সহ্য হচ্ছে না আশ্বিনের। তার বারবার মনে হচ্ছে রোদ্দুরের এই অবস্থার জন্য সে নিজে দ্বায়ি।
‘এভাবে ভেঙে পড়ো না আশ্বিন, রোদ্দুর খুব শীঘ্রই ঠিক হয়ে যাবে।’
‘ইনশাআল্লাহ। মারিয়া, রোদ যদি সুস্থ না হয় তাহলে আমি নিজেকে কখনও ক্ষমা করতে পারবো না।’
‘এখানে তোমার কি দোষ আশ্বিন? সব দোষ তো রাফিনের আর অধরার। এই শান্তশিষ্ট ভোলা ভালা মেয়ে, অধরা একসাথে তোমাদের দুজনের মনেই নিজের জন্য জায়গা করে নিয়েছে। দুজনকেই সে শুধু ব্যাবহার করেছে।’
‘কি বলছো এসব? বাজে কথা বলবে না, এমনিতেই মন ভালো নেই আমার।’
‘বাজে কথা বলছি না আমি। সত্য বলছি। এতদিন ওই মেয়ে তোমাকে সহজ সরল পেয়ে তোমার পিছু পিছু ঘুরঘুর করেছে সে। তারপর যেই না কলেজে একজন হ্যান্ডসাম ছেলে আসলো তখনই তোমাকে ফেলে সে হন্যে হয়ে লেগেছে তাকে ইমপ্রেস করতে। আর দেখো কীভাবে সফলও হয়েছেন উনি।’
‘থামো মারিয়া।’
‘না, আশ্বিন বোঝার চেষ্টা করো তুমি। যেখানে রাফিনের জন্য সব মেয়েরা পাগল, সেই রাফিন কিনা পছন্দ করলো এমন একটা কালো কুৎসিত মনের মেয়েকে। আর সেও এই লোভ সামলাতে না পেরে কিভাবে রাজি হয়ে একমাস ঘুরঘুর করলো দুজন। তুমি তো নিজ চোখেই দেখেছো সব।’
উত্তর দেয়না আশ্বিন। অধরার বিপক্ষে কোনো কথাই শুনতে ইচ্ছে হচ্ছে না তার। তবুও আজ সে নিশ্চুপ।
‘অধরা যদি এতোই ভালো হতো, তবে এতকিছুর পরেও সে বলতো না রাফিন ইচ্ছে করে রোদ্দুরের এমনটা করেনি। আস্ত ড্রামা কুইন একটা।’
কথাগুলো বলে মুখ ভেংচি কাটে মারিয়া।
এদিকে,
হোস্টেলে মন বসছে না অধরার। সে কোনমতে মানতে পারছে না তার খামখেয়ালীর জন্য রোদ্দুরের এই অবস্থা।
সকালে রাফিন আর হাসান স্যারকে পুলিশ নিয়ে গিয়েছেন জিজ্ঞাসাবাদের জন্য। মাথা ঠিক নেই কারোর।
অধরা নিজেকে সামলাতে না পেরে ইশাকে নিয়ে দ্রুত চলে এসেছে হাসপাতালে।
তখন আশ্বিন আর মারিয়া বসে ছিলো পাশাপাশি।
‘রোদ্দুর ভাইয়া এখন কেমন আছেন আশ্বিন ভাইয়া?’
নিশ্চুপ আশ্বিন। মাথা নত করে নীরবে বসে আছে সে। পাশে থাকা মারিয়ার চোখ মুখে বিরক্তির ছাপ স্পষ্ট।
‘কেনো এসেছো তুমি এখানে?’
‘রোদ্দুর ভাইয়াকে দেখতে এসেছি। আর কেন কারণে আসবো, মারিয়া আপু?’
‘অবশ্যই! দেখতে এসেছো যে রোদ্দুর এখনো বেঁচে আছে কিনা। খুব দ্বিধায় আছো নিশ্চয়ই, যে এখনো বেঁচে আছে রোদ্দুর।’
‘এসব কি বলছো আপু? রোদ্দুর ভাইয়া কি আমার শত্রু? এমন সব কথা আমি কখনো কল্পনাও করিনি।’
‘তাহলে কি কল্পনা করেছো তুমি? রোদ্দুরকেও ফাঁসানোর কথা কল্পনা করেছিলে নাকি?’
‘মারিয়া আপু!’
চেঁচিয়ে ওঠে অধরা। নূন্যতম মানবতা বেঁচে নেই এই মেয়ের মাঝে। আশ্বিনের কাছে ভালো সাজার জন্য সে এমন পরিস্থিতিতেও বাজে বকে যাচ্ছে।
মারিয়ার সাথে কথা বলে লাভ নেই। তাই অধরা ধীরে ধীরে এগিয়ে গিয়ে আশ্বিনের সামনে হাটু গেড়ে বসে পড়ে। মুখ তুলে তাকায় আশ্বিন। অধরার চোখে অনুশোচনা, কষ্টের ছাপ।
‘আপনি ভেঙে পড়বেন না আশ্বিন ভাইয়া। রোদ্দুর ভাইয়া সুস্থ হয়ে উঠবেন ইনশাআল্লাহ।’
জবাব না দিয়ে অধরার মুখ পানে চেয়ে আছে আশ্বিন। মেয়েটি এই কদিন ঠিকমতো ঘুমায়নি, চোখের নিচে কালি পরে গিয়েছে তার। মায়া হচ্ছে তার অনেক বেশি।
‘শুনেছো নিশ্চয়ই রাফিনকে পুলিশ নিয়ে গিয়েছে?’
‘হুম।’
ছোট করে উত্তর দেয় অধরা। মাথা নেড়ে পরিস্থিতি বোঝার চেষ্টা করে আশ্বিন।
‘তার কাজের শাস্তি পাচ্ছে সে। আর রোদ্দুরের যদি কিছু হয়ে যায় তাকে আমি একদম ছাড়বো না।’
‘রাফিন ভাইয়া অসুস্থ, আশ্বিন ভাইয়া। উনার এখন চিকিৎসার প্রয়োজন।’
‘রাফিনের চিকিৎসার ব্যবস্থাই তো করেছি অধরা।’
আশ্বিনের শান্ত কণ্ঠে বলা কথাটার উত্তর দিতে পারে না অধরা। নিরবে চোখ বেয়ে গড়িয়ে পড়ে অশ্রু। কেউ বুঝতে চাইছে না তার কথা।
‘কার জন্য কাঁদছো তুমি? রোদ্দুরের জন্য নাকি রাফিনের জন্য? তুমি কি চাও না রাফিনের শাস্তি হোক? রোদ্দুরের অবস্থা দেখেও তোমার মনে হচ্ছে না রাফিন শাস্তি পাওয়ার যোগ্য?’
উত্তর দেয়না সে। তার যে আর কিছুই বলার নেই। দূরে দাঁড়িয়ে মাথা নিচু করে আছে ইশা। অধরা নিজ থেকে সত্য না স্বীকার করলে, সে কিছুই বলতে পারবে না।
এদিকে অধরার নিরবতায় অবাক হয় আশ্বিন। এতোটা রাফিনের প্রতি ভক্ত হয়েছে সে?
‘চলে যাও এখান থেকে…।’
কঠোর কণ্ঠ শুনে সামনে তাকায় অধরা। আশ্বিনের চোখ মুখে কঠোরতা।
‘আশ্বিন..।’
‘আমি বলেছি চলে যাও এখান থেকে। তোমাকে আমি আর দেখতে চাই না। তোমার মুখ দেখলেই আমার ভুলের কথা মনে পড়ছে। তোমার সাথে পরিচিত হওয়াই আমার ভুল ছিলো। মুখ দেখতে চাই না তোমার, শুনতে পেরেছো তুমি অধরা? চলে যাও তোমার রাফিনের কাছে। আর কখনো আমার সামনে আসবে না তুমি।’
একদমে কথাগুলো বলে চলে যায় আশ্বিন। মারিয়ার মুখে বিজয়ের হাসি, সেও চলে আসে সেখান থেকে। একা বসে থাকে অধরা। আশ্বিনের প্রতিটি কথা তার কানে এসে বাঁজছে। এখন পর্যন্ত যতটুকু সাহস মনে ছিলো, এখন সম্পূর্ণ ভাবে ভেঙে পড়েছে সে। ইশা এসে সামলে নেয় তাকে। প্রিয় বান্ধবীর কান্নায় বারবার চোখ ভিজে আসছে তার নিজেরও। হাসপাতালের বারান্দায় নীরবে বসে থাকে দুজন।
————–
বর্তমানে,
‘মামি, ধ্যান কোথায় তোমার? মামা কখন থেকে তোমাকে ফোন করছে। ফোন রিসিভ করো না তুমি।’
টুসির কথায় অতীতের ঘোর কেটে যায় তার। অজান্তেই চোখ বেয়ে পানি গড়িয়ে পড়ছে, রাতের অন্ধকারে আড়াল পরে যাচ্ছে এই কান্না।
‘তুমি যাও টুসি, আমি ফোন করছি মামাকে।’
‘আচ্ছা।’
চলে যায় টুসি। একটি দীর্ঘশ্বাস ফেলে ফোন হাতে তুলে নেয় সে। স্ক্রিনে আশ্বিনের অনেক গুলো ফোন আর ম্যাসেজ। পাশে রেখে দেয় সে ফোন। ভালো লাগছে না তার, ইচ্ছে নেই তার কথা বলার। অন্ধকার ঘরে ঢুকে খাটে শুয়ে পড়ে সে। মুহূর্তেই তলিয়ে যায় গভীর ঘুমে।
সকালে,
গতকাল রাত করে ডিউটি শেষে বাসায় ফিরে ঘুমিয়ে আজ সকালে আর চোখ খুলছে না আশ্বিনের। বেলা বাজে এগারোটা। তবুও আজ ঘুম যাওয়ার নাম নেই মহাশয়ের। বহু কষ্টে আড়মোড়া ভেঙে উঠে বসে সে। পিটপিট করে চোখ মেলতেই অধরাকে কফি হাতে দেখে চমকে উঠে।
‘অধরা? তুমি কখন এসেছো? কিভাবে এসেছো? আমাকে ডাক দাওনি কেনো?’
‘সকালেই এসেছি, একা এসেছি বাস দিয়ে। আর এসেই আপনাকে ডেকেছি কিন্তু আপনি উঠেননি।’
কথাগুলো বলে আশ্বিনের পাশে বসে পড়ে অধরা। আশ্বিন নির্লিপ্ত ভাবে তাকিয়ে আছে অধরার দিকে।
‘কি? এভাবে কি দেখছেন?’
‘চোখ ফোলা কেনো তোমার? কি কারণে এতো কেঁদেছিলে তুমি? কেউ কিছু বলেছে তোমাকে?’
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে অধরা। কিভাবে বলবে সে মহাশয়কে যে সে তার অতীতের কথায় কেঁদে উঠেছিলো। অতীতকে যে সে আর মনে করতেই চাইছে না। তাই হাতের মগটা আশ্বিনের দিকে এগিয়ে দেয়।
‘স্বামীকে রেখে এতো দূরে আমার মন বসছিলো না। তাই দৌড়ে আপনার কাছে চলে এসেছি।’
সবে মাত্র কফিতে চুমুক দিচ্ছিল আশ্বিন। অধরার কথায় সে আঁতকে উঠে ড্যাবড্যাব করে শুধু তাকিয়ে থাকে তার দিকে।
অধরার চোখে মুখে চাঞ্চল্য, একটা রহস্যের হাসি দিয়ে চলে যায় সে রুম থেকে।
–চলবে।