#আমার_হিয়ার_মাঝে
লেখিকা: তাহসীন নাওয়ার রীতি
পর্ব:২৩
গোল হয়ে সবাই বসে আছে রেস্টুরেন্টে। অধরা জুস খেতে খেতে একনজর সবার দিকে তাকিয়ে দেখে নেয়। সবাই রাগী ভাবে তাকিয়ে আছে তার দিকে। ইশা এতোক্ষণ চুপচাপ বসে শুনছিলো।
‘সব তো বুঝলাম। কিন্তু রাফিন ভাইয়া আর হাসান স্যার এই কথাগুলো তোকে কেনো বললো?’
‘কারণ স্যার চাইছেন এই বছরটা কোনরকম পার করে সামনের বছর রাফিন ভাইয়াকে নিয়ে বাহিরের দেশে যাবেন উনার চিকিৎসার জন্য।’
অনিক তেড়ে উঠে অধরার কথায়,
‘সামনের বছর আবার কেনো? সমস্যা বেড়ে যাওয়ার আগেই তো চিকিৎসা প্রয়োজন উনার। এই বছর কেনো যাবেন না?’
‘কারণ স্যার ব্যাপারটা গোপন রাখতে চাইছেন। রাফিন ভাইয়া ফাইনাল ইয়ারে আছেন, এখন এই মুহূর্তে যদি ব্যাপারটা জানাজানি হয়ে যায় যে, উনি মানসিক ভাবে অসুস্থ তাহলে হয়তো উনার মেডিকেলে পড়ার এখানেই সমাপ্তি হবে।’
চুপ হয়ে যায় সবাই। ছোট থেকে স্বপ্ন দেখে মেডিকেলে পড়তে পারার সৌভাগ্য সবার হয়না। অনেক সংগ্রাম, পরিশ্রম আর ত্যাগ স্বীকার করে উনি হয়তো এতদূর এসেছেন। আর লক্ষ্যের এতোটা কাছে এসে কিনা ভাগ্য এভাবে মোড় নিলো!
‘কিন্তু অধরা, জানি ব্যাপারটা কষ্ট জনক। তবে, একজন ডাক্তারের কাজ হলো রোগীর সেবা করা। উনি নিজেই যদি অসুস্থ হয় তাহলে কিভাবে অন্য একজন রোগীর চিকিৎসা করবেন? এই ব্যাপারটা গোপন রেখে সবাই অনেক ভুল করছে।’
ইশার কথায় চুপ হয়ে বসে থাকে অধরা। বাকিরাও সম্মতি জানিয়েছে ইশাকে। কিন্তু অধরা যেন এই কথা শুনতে নারাজ।
‘তোরা বুঝতে চাইছিস না কেনো? বছর শেষ হতে আর মাত্র কয়েক মাস বাকি, এর পর তো উনারা চলেই যাচ্ছেন চিকিৎসার জন্য বাহিরে। ইনশাআল্লাহ তখন পুরোপুরি সুস্থ হয়ে উঠবেন, আর বাকি দশজন ডাক্তারদের মতোই উনিও মানুষের সেবা করবেন।
কিন্তু এই ভাঙা বছরটা আমরা তো সাহায্য করতেই পারি। আর, বেশি কিছু তো করতে হচ্ছে না আমাদের, শুধু বন্ধু হয়ে উনার আশেপাশে থেকে উনার সব ঔষধের হিসাব ঠিকঠাক ভাবে রাখবো। এইটুকুই।’
অধরার কথার প্রতিউত্তর দেয় না কেউ। কেনো জানি কারো কাছেই ব্যাপারটা ভালো লাগছে না। কেউ এই দায়িত্ব নিতে চাইছে না। সবার হাবভাব দেখে অধরার আর বুঝতে বাকি নেই তাদের উত্তর কি হতে পারে।
‘মানে, তোরা কেউ আমাকে সাহায্য করবি না?’
উত্তর দেয় না কেউ। সবাই চাইছে অধরা এই ঝামেলা থেকে সরে আসুক। তাই জারিফ একটু জোর গলায় বললো,
‘দেখ অধরা, রাফিন ভাইয়ের মানসিক অবস্থা ঠিক নেই, হঠাত কখন কি করে বসে তার কোন নিশ্চয়তা নেই। বাই চান্স যদি কোনো খারাপ কিছু হয়ে যায়, তাহলে সব দোষ এসে পড়বে আমাদের উপর। যদি ব্যাপারটা গোপন রাখা না হতো, তবে উনাদের সাহায্য করা যেতো।’
‘জারিফ ঠিক বলছে অধরা। এখন আর জেদ করিস না। ভালো হবে এই বিষয় থেকে তুই দূরে থাক।’
অনিক আর জারিফের কথায় মাথায় হাত রেখে চুপচাপ বসে আছে অধরা। এখন কি করা উচিত তার?
‘কিন্তু আমি তো হাসান স্যারকে কথা দিয়ে এসেছি।’
‘এটাই হলো আমার আসল প্রশ্ন..।’
এতোক্ষণ ধরে চুপচাপ সবার কথা শুনতে থাকা সাদমানের কথায় সবাই ফিরে তাকায় তার দিকে।
‘কি বলতে চাইছিস তুই?’
‘এটাই যে, আমাদের সম্মানিত হাসান স্যার উনাদের ব্যাক্তিগত এতো বড় ঝামেলা সামলানোর দায়িত্ব তোকেই কেনো দিলেন! না মানে, কলেজে তো এমন অনেকেই আছেন যাদের এই দায়িত্ব দেওয়া যেতো, কিন্তু তুই কেনো? এমন তো না যে স্যার তোর উপর বা তোর কাজে খুব ইমপ্রেসড! আরে যে ব্যক্তি মাসে অন্তত দুইবার হলেও তোকে শান্তি আর বহিষ্কারের ওয়ার্নিং দিয়েছেন, এখন তোকেই দিয়ে দিলেন এতো বড় কাজ?’
চুপসে যায় অধরা। সাদমানের কথায় বাকিরাও সন্দেহের দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তার দিকে।
‘কিহহ? এখন উত্তর দে আমাদের।’
‘ইয়ে..। আসলে…আমি সেদিন…’
‘কি সেদিন?’
‘সেদিন বিকেলে বাহির থেকে হোটেলে ফিরে যাওয়ার পথে স্যারের সাথে দেখা হয়েছিল আমার। স্যারের একটা মিটিং ছিলো কিন্তু মাঝপথে উনার গাড়ি নষ্ট হয়ে গিয়েছিল। তাই আমি আমার স্কুটি করে স্যারকে পৌঁছে দিয়েছিলাম। স্যার অনেক খুশি হয়েছিলেন, তাই আমিও ভেবেছিলাম আরো দুচারটা কথা বলে ভালো সেজে ফেলি।’
‘কি এমন কথা বলেছিলি তুই?’
‘বেশি কিছু না শুধু বলেছিলাম স্যার আমি তো আপনার মেয়ের মতোই, হয়তো একটু বেশি দুষ্টুমি করে ফেলি। তবুও কখনো কোন প্রয়োজন হলে আমাকে বলবেন, আমি সর্বোচ্চ চেষ্টা করবো সাহায্য করার।’
‘আর তোর এই কথায় স্যার খুশি হয়ে তোকে এতো বড় দায়িত্ব দিয়ে দিলেন?’
উপর নিচ মাথা নেড়ে হ্যা বোঝায় অধরা। সবাই পারছে না অধরাকে শুধু ধোলাই দিতে। রাগে এক একজনের মুখ লাল হয়ে আছে।
‘তুই নিজেই খাল কেটে কুমির নিয়ে এসেছিস গাধী, এখন আমাদের বলিস কুমির সরা..!’ ‘আমরা নেই তোর সাথে।’
রেগে গিয়ে চলে যায় সবাই অধরাকে একা ফেলে। হতভম্ব হয়ে বসে আছে সে একাই। এখন কি হবে? সবটা একাই সামলাতে হবে! চিন্তায় মাথা খারাপ হয়ে গেলো অধরার।
————-
ফ্ল্যাটে বসে নিজের পড়া ঠিকঠাক করছে আশ্বিন। দুই তিনবার অবশ্য আড়চোখে সে তাকিয়েছে ফোনের দিকে। সকাল থেকে অধরা একবারও কল দেয়নি আর না দিয়েছে কোনো ম্যাসেজ। এমন তো কখনও হয়নি। তাহলে কি বেশিই রেগে আছে তার উপর?
কথাগুলোর মাঝেই ফোন বেজে উঠতেই আশ্বিন দ্রুত ফোন হাতে তুলে নেয়। হয়তো অধরার ফোন। কিন্তু তার আশাকে ভুল প্রমাণ করে ইশা ফোন দিয়েছে তাকে।
‘হ্যালো আশ্বিন ভাইয়া..।’
‘হ্যা ইশা, কেমন আছো?’
‘ভালো নেই ভাইয়া। সন্ধ্যা গড়িয়ে অন্ধকার হয়ে আসছে, অধরা এখনও হোস্টেল ফিরে আসেনি। বিকেলে সবাই একসাথে বাহিরে ছিলাম, একটু ঝগড়া হয়েছে সবার সাথে তার। এরপর আর হোস্টেল ফিরে আসনি। আমার ফোনও রিসিভ করছে না, আর না বাকিদের। আপনি একটু কল দিন তাকে। আমার খুব টেনশন হচ্ছে..।’
‘আমি..আমি কল দিচ্ছি। চিন্তা করো না তুমি।’
ফোন রেখে দেয় ইশা। আশ্বিন পরে গেল চিন্তায়। এই মেয়েকে নিয়ে তার যতো সব চিন্তা। মাথা ঠিক নেই, যখন যা ইচ্ছে হয় তাই করবেন উনি।
পরপর ছয়বার ফোন করার পরেও ফোন রিসিভ না করায় আরো চিন্তায় পড়ে যায় আশ্বিন। দ্রুত অধরার জন্য রাখা তার গার্ডকে ফোন করতেই জানতে পারে অধরা কোথায় আছে। ফোন রেখে বেরিয়ে পড়ে আশ্বিন।
পার্কের বেঞ্চে বসে লেকের পানিতে ঢিল ছুঁড়ে ফেলছে অধরা। চারদিকে অন্ধকার হয়ে আসায় পার্কে মানুষ জন কমে আসছে। তবুও একা বসে থাকতে ভালো লাগছে তার।
‘পুরো পৃথিবী তোমাকে খুঁজে আমি হয়রান আর তুমি এখানে..।’
আশ্বিন কথাটা বলে পাশে বসে পড়ে তার। অধরা শান্ত, স্বাভাবিক। যেন সে জানতো আর কেউ তার খোঁজে না আসলেও মহাশয় ঠিকই আসবেন।
‘নাও তোমার জন্য হাওয়াই মিঠাই।’
চুপচাপ হাতে নিয়ে নেয় অধরা। মুখ গোমড়া হয়ে আছে তার। অন্য দিন হলে এতক্ষণে অনবরত কথা বলা শুরু হয়ে যেতো তার, কিন্তু আজ সে নিশ্চুপ।
‘এখনো রাগ করে আছো? আমি সরি, সেদিন হঠাত খবর আসে বাবা অসুস্থ। কোন প্ল্যান ছাড়াই ছুটে গিয়েছিলাম বাসায়। টেনশন আর তাড়াহুড়োয় তোমাকে জানাতে পারিনি। আমি সত্যিই সরি।’
অধরা ফিরে তাকায় আশ্বিনের দিকে।
‘এই কথা আপনি সকালে এসেও তো বলতে পারতেন। তখনও কিছু বলেননি। যাই হোক, আঙ্কেল এখন কেমন আছেন?’
‘এখন একটু ভালো। ব্লা/ড প্রেসার লো হয়ে পড়ে গিয়েছিল। এখন ভালো আছে।’
নীরবতা বিরাজ করে দুজনের মাঝে। অন্ধকার ছেয়ে গিয়েছে চারদিকে। বেঞ্চে বসে লেকের পাশে বসে আছে দুজন মানবী।
‘কি নিয়ে ঝগড়া হয়েছে সবার সাথে?’
উত্তর দেয় না অধরা। মাথা নিচু করে বসে হাতে থাকা হাওয়াই মিঠাই দেখছে সে।
‘বলো।’
‘রাফিন ভাইয়াকে নিয়ে।’
কিছুটা অবাক হয় আশ্বিন। রাফিনকে নিয়ে সবার সাথে অধরা কেনো ঝগড়া করবে?
‘রাফিনকে নিয়ে কেনো? কি করেছে সে?’
‘কিছু করেনি। রাফিন ভাইয়া আমার নতুন বন্ধু। আমি চেয়েছিলাম সবাই উনার সাথে বন্ধুত্ব করুক। কিন্তু তারা কেউ রাজি না।’
রাফিন অধরার বন্ধু কথাটা শুনে খটকা লাগে আশ্বিনের। কবে থেকে হলো তাদের বন্ধুত্ব? তার অনুপস্থিত এই একদিনের মাঝেই?
‘হয়তো তাদের রাফিনের সাথে বন্ধুত্ব না করার কোন কারণ আছে। কেউ যেহেতু মিশতে চাইছে না তাই তোমারও বন্ধুত্বের প্রয়োজন নেই।’
‘না, প্রয়োজন আছে। রাফিন ভাইয়া অনেক ভালো ছেলে। কারো না কারো তো উনার বন্ধুত্বের প্রয়োজন।’
কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে থাকে আশ্বিন। অধরার কথাগুলো বোঝার চেষ্টা করছে সে।
‘ঠিক আছে, তাহলে আমি বন্ধু বানাবো তাকে। কিন্তু এখন আর এই নিয়ে কথা নেই। রাত বেশি হচ্ছে, আর দেরি করলে হোস্টেল গেইট বন্ধ করে দিবে। চলো যাই।’
মাথা নেড়ে আশ্বিনের পাশাপাশি হাটতে শুরু করে অধরা। বাকিটা পথ আর কথা বাড়ায়নি আশ্বিন।
————–
রোদ্দুর বসে বসে ফোনে গেইম খেলছে আর আশ্বিন বই হাতে নিয়ে অন্য ধ্যানে মশগুল।
‘কি নিয়ে এতো ভাবছিস? পড়বিই যখন না তাহলে বইটা রেখে’দে।’
রোদ্দুরের কথায় বইটা পাশে রেখে দেয় আশ্বিন।
‘রোদ একটা কথা বল তো।’
‘কি?’
‘রাফিন কেমন ছেলে?’
ফোন থেকে চোখ সরিয়ে আশ্বিনের দিকে তাকায় সে।
‘হঠাত এই প্রশ্ন?’
‘উত্তর দিবি তুই?’
‘কেমন আবার হবে? ভালো ছেলে। হ্যা একটু ভাব দেখায় বেশি, কিছুটা রুড। তবে ভালো।’
‘তুই এতো নিশ্চিন্তে কিভাবে বলছিস সে ভালো ছেলে? কতদিন হলো তাকে চিনিস?’
ভড়কে যায় রোদ। আশ্বিন হুট করেই কেনো এমন হাইপার হয়ে গেলো বুঝে উঠতে পারছে না সে।
‘কি এমন বললাম আমি? রেগে যাচ্ছিস কেনো?’
কিছুটা শান্ত হয় আশ্বিন। মাথা কাজ করছে না তার। কি থেকে কি বলছে সে!
‘আচ্ছা এটা বল, রাফিন কি আমার থেকেও বেশি ভালো ছেলে?’
ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে থাকে রোদ্দুর। কি বলছে এসব আশ্বিন?
‘মাথা ঠিক আছে তোর?’
‘যেটা জিজ্ঞেস করেছি সেটা বল।’
একটা দীর্ঘশ্বাস নেয় রোদ্দুর। মাথায় দুষ্টু বুদ্ধি এসে উঁকি দিচ্ছে তার।
‘তোর থেকে তো ভালোই মনে হচ্ছে। সেদিন ক্যান্টিনে কয়েকটা মেয়েকে বলতে শুনেছি রাফিন নাকি সব মেয়েদের ক্রাশ। দেখিস না কিভাবে সবাই হুমড়ি খেয়ে তাকে দেখে? সেদিক থেকে দেখতে গেলে তোর থেকে সে বেশি হ্যান্ডসাম।’
‘বলেছে তোকে? আমি কি কম হ্যান্ডসাম নাকি?’
‘জি, আপনি কম। নাহয় তুই বল, তোর উপর কয়টা মেয়ে ক্রাশ খায়?’
‘কয়জন লাগবে না আমার। একজন হলেই হবে। তার ক্রাশ হতে পারলেই চলবে আমার।’
আশ্বিন রেগে বই বিছানায় ধপ করে রেখে রুম থেকে চলে যায়। রোদ্দুর অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে তার যাওয়ার দিকে।
–চলবে।