#আমার_হিয়ার_মাঝে
লেখিকা: তাহসীন নাওয়ার রীতি
পর্ব:২১
অধরার হাত ধরে পাশাপাশি হেঁটে যাচ্ছে আশ্বিন। একটু সামনে আসতেই লাল নীল বাতির মাঝে চেয়ার টেবিল ক্যান্ডেল দিয়ে সুন্দর করে সাজানো অবস্থায় দেখতে পায় দুজন।
আশ্বিন হতভম্ব। অধরার দিকে একনজর তাকিয়ে চিন্তায় পড়ে যায় সে। এসব কি তবে অধরা তার জন্য আয়োজন করেছে?
কিন্তু কিছুক্ষণ আগেও তো সে বন্ধুদের সাথে এখানে এসেছিলো, তখন তো এসব ডেকুরেশন ছিলো না। তবে কি করে..?
‘এসব কিছু তুমি করেছো অধরা?’
আশ্বিনের কথায় হুশ ফিরে আসে অধরার। এতোক্ষণ ধরে বিস্মিত নয়নে সে নিজেই তাকিয়ে ছিলো সামনে।
‘না মানে..। আমি কখন..?’
কথাগুলো বলতে গিয়েও থেমে যায় অধরা। আরশি তো বলেছিলো তার বন্ধু সব ঠিকঠাক করে রেখেছে। তবে কি এসব তারই কাজ? কথাগুলো মনে হতেই একনজর ফিরে তাকায় আশ্বিনের দিকে। আশ্বিন স্বাভাবিক।
‘হয়তো কোন দম্পতি আজ আমাদের মতোই ঘুরতে এসেছিলো এখানে। এসব হয়তো তাদের জন্যই ছিলো।’
কথাগুলো বলে আশ্বিন ফিরে তাকায় অধরার দিকে। বেচারি অধরা কি বলবে ভেবে না পেয়ে একটা মুচকি হাসি দেয়। আশ্বিন কথা না বাড়িয়ে পাশ কাটিয়ে চলে যেতে নিতেই হঠাত কেউ একজন পেছন থেকে তাকে ডেকে উঠে।
‘আশ্বিন কোথায় যাচ্ছিস তুই?
এত কম সময়ের মাঝে তোদের জন্য এত কষ্ট করে এতোসব আয়োজন করলাম। এখন সব ব্যার্থ যাবে না কি?’
মুহূর্তেই থেমে গিয়ে কপাল কুঁচকে ফেলে আশ্বিন। কণ্ঠস্বর তার অতি পরিচিত। কিন্তু সে এখানে কি করে আসবে?
তাই সন্দেহ দূর করতে অধরা সহ দুজন একসাথে পিছনে ফিরে তাকিয়ে অবাক হয়ে যায়।
‘রোদ! তুই?’
‘তো? আর কাকে আশা করেছিলি? আমার বেস্ট ফ্রেন্ড তুই। তোর জন্য ঢাকা থেকে এসে এই রাতেরবেলা পার্কে ডেকুরেশন করেছি এই আমি। আর তুই কিনা চলে যাচ্ছিলি?’
রোদ্দুরের কথায় হেসে উঠে আশ্বিন। ছোট থেকে সবসময় রোদ্দুর তার প্রতিটি মুহূর্তে পাশে থেকেছে। তার খুশির জন্যই সব ঝামেলা উপেক্ষা করে চলে আসতে প্রস্তুত সে।
তাই তো ছোট থেকেই আশ্বিনের কাছে রোদ্দুর তার বন্ধু কম, ভাই বেশি ছিলো।
এগিয়ে গিয়ে রোদকে জড়িয়ে ধরে আশ্বিন।
‘কখন এসেছিস? একবার বলবি তো যে ময়মনসিংহ আসছিস। বিকাল থেকে তোকে ফোন দিচ্ছি আমি, ফোন রিসিভ করিসনি।’
‘আরে শান্তি, শান্তি। ঘন্টা খানেক আগেই এসেছি। আর আসতে না আসতেই আমার মহারাণীর নির্দেশ পেয়েছি উনার ভাইয়া আর ভাবির জন্য সারপ্রাইজ ডেকুরেশন করার।’
‘আচ্ছা তো আরশির কথায় করেছিস এসব?’
একটা বাঁকা হাসি দেয় রোদ্দুর। যদিও সে নিজ থেকেই এসব করেছে। শুধু মাত্র তার জন্য হওয়া অধরা আশ্বিনের মাঝে এই ভুল বোঝাবুঝি ভেঙে দিয়ে আবারও দুজনের মিল করাতে। সে চায় না তার প্রিয় বন্ধুকে কষ্ট পেতে দেখতে। তাইতো আরশির মাধ্যমে তারই এতসব আয়োজন। তবে এই মুহূর্তে কথাগুলো স্বীকার করতে চাইছে না সে।
‘তো আর কি? ভবিষ্যত বউয়ের কথা শুনতে হবে না? নয়তো তোর জন্য আমার এতো সময় কোথায় আছে?’
একটা ভাব নিয়ে কথাগুলো বলতেই পিঠে এক চাপড় পরে রোদ্দুরের।
এদিকে,
তাদের কথাগুলো দূর থেকে শুনছে অধরা। খানিকটা এগিয়ে সামনে চলে আসে সে।
‘আমার ভাইকে মা/র/বে/ন না আশ্বিন। খবরদার।’
মুহূর্তেই ভ্রু যুগল কুঁচকে ফেললো আশ্বিন। আর হেসে উঠে রোদ্দুর।
‘এইতো, ভাইয়ের জন্য তার বোন চলে এসেছে। এখন দেখি তুই কি করিস..।
যাই হোক, অধরা এখন তুমিই সামলাও একে। আমি যাচ্ছি বাসায়, সারাদিন ডিউটি করেছি আবার এই জার্নি। এখন না ঘুমাতে গেলে মাথাই নষ্ট হয়ে যাবে আমার।’
অধরা আশ্বিনের সাথে টুকটাক আরো কথা বলে সেখান থেকে চলে যায় রোদ্দুর।
রোদ্দুর যাওয়ার পর আশ্বিন অধরার হাত ধরে এসে বসে পড়ে। টেবিলে রাখা আছে অধরার পছন্দের নুডুলস আর আইসক্রিম। অধরা তো এসব দেখেই দিক-বেদিক হারিয়ে খুশিতে খেতে শুরু করেছে। আর আশ্বিন দেখে যাচ্ছে অধরাকে। কীভাবে বাচ্চাদের মতো করে খেয়ে যাচ্ছে সে।
একটি দীর্ঘশ্বাস ফেলে আশ্বিন, এই মেয়ে হয়তো কোনদিন সিরিয়াস হবে না। তবে ভালো লাগছে তার অধরাকে আগের মতো এমন হাসি খুশি থাকতে দেখে। তাই তো কথা না বাড়িয়ে শুধু একমনে নয়ন ভরে দেখে যাচ্ছে সে অধরাকে।
শুধু চাইছে যেন এই রাত এখানেই থমকে যাক, তার অধরার হাসির মাঝে।
————
সকাল সকাল উঠেই আশ্বিন রেডি হচ্ছে ঢাকা ফিরে যাওয়ার জন্য। রুমের একপাশে থাকা সোফায় বসে অধরা ঘুমঘুম চোখে পিটপিট করে তাকিয়ে তার কান্ড দেখছে।
ঘুমে চোখ লেগে আসছে তার। সে শুধু পারছে না দৌড়ে গিয়ে খাটে শুয়ে আবার ঘুমিয়ে পড়তে। এমনিতেই গতকাল অনেকটা রাত করেই তারা ফিরে এসেছে, এখন আশ্বিনের ফিরে যাওয়ার জন্য এই ভোর বেলা উঠতে হলো তাদের।
‘আপনার আজই ফিরে যাওয়া কি খুব দরকার ছিলো আশ্বিন?’
‘হুম। ফোন করে বললো একজন ইমার্জেন্সি রোগী এসেছে। সিনিয়র ডাক্তাররা অন্য এক জটিল কেইস নিয়ে ব্যস্ত আছেন। রোদ্দুরও সেখানে নেই, এখন আমাকেই তো যেতে হবে নাকি?’
‘হুম।’
ছোট্ট করে একটি জবাব দেয় অধরা। একটা হামি তুলে উঠে দাঁড়িয়ে চুপচাপ এসে হাজির হয় আশ্বিনের পিছু। আশ্বিন তখন আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে।
‘তাহলে আমিও যাচ্ছি আপনার সাথে।’
‘প্রয়োজন নেই। তোমার সাতদিন ছুটি আছে তাই কদিন বাবা মায়ের সাথেই থাকো। তাদের ভালো লাগবে। তাছাড়া তুমি যেতে চাইলে তোমার সাথে রাশেদা খালা আর টুসিও যেতে চাইবে। এমনিতেই তারা অনেক দিন পর এখানে এসেছে, কিছুদিন থাকুক।’
‘কিন্তু আমি বলছিলাম কি, আপনি একা সেখানে কিভাবে থাকবেন? রান্না খাওয়ার তো একটা ব্যাপার আছে।’
অধরার কথায় আশ্বিন আয়নার মাঝেই অধরার দিকে ফিরে তাকায়। অধরা তখনও আশ্বিনের জবাবের অপেক্ষায়। একটা তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে আশ্বিন পেছনে ফিরে।
‘আমি রান্না করতে পারি অধরা। ব্যাচেলর লাইফে একাই থেকেছি আমি। আমার মনে হচ্ছে না কোন সমস্যা হবে।’
‘তবুও ভাবছিলাম কি..।’
‘আজকাল দেখছি আমাকে নিয়ে অনেক ভাবতে শুরু করেছো।’
ভড়কে যায় অধরা। সে কি এমন বললো যে আশ্বিন এসব বলছেন?
তাছাড়া উনার তো বোঝা উচিত, বউকে একা ফেলে উনি কিভাবে চলে যেতে চাইছেন?
‘ভাবতে পারি না নাকি? বউ আমি আপনার। আমার অধিকার আছে আপনার..।’
কথাটা বলতে গিয়েও চুপ হয়ে যায় অধরা। কেননা আশ্বিন গোল গোল চোখে এমনভাবে তাকিয়ে থাকা তাকে মুহূর্তেই অস্বস্তিতে ফেলে দিচ্ছে। কি থেকে কি বলছে তার ধারণা নেই। শুধু জানে আশ্বিনের চোখের দিকে তাকিয়ে ভুলভাল বলে যাচ্ছে সে।
আশ্বিন হয়তো বুঝতে পারছে অধরার মনের অবস্থা। তাই মনে মনে একটা হাসি দিয়ে অধরাকে একটানে কাছে নিয়ে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে তাকে।
‘আমার বউটাকে অনেক মিস করবো। কতোদিন দেখা হবে না আমাদের। কিন্তু আমি ভাবছি তুমি আমাকে ছাড়া একা থাকবে কিভাবে? এখনই যেভাবে অস্থির হয়ে যাচ্ছো যাওয়ার জন্য!’
হতভম্ব অধরা। কি বললো মহাশয়? তার নামে এতবড় মিথ্যা অপবাদ? এক ধাক্কায় দূরে সরে দাঁড়ায় সে।
‘আপনি বেশি জানেন আমি থাকতে পারবো কিনা? আপনার ভালোর জন্য একটু জিজ্ঞেস কি করেছি আপনি তো উল্টো আমাকেই দোষ দিচ্ছেন। ভালোই।’
‘তাহলে বলতে চাইছো তুমি থাকতে পারবে?’
‘অবশ্যই পারবো।’
‘ভেরি গুড। থাকো তাহলে। আমি আসছি।’
কথাটা বলতে দেরি কিন্তু আশ্বিন আর এক মুহূর্ত দেরি না করে বেরিয়ে যায় রুম থেকে। এদিকে অধরা বোকার মতো দাঁড়িয়ে আছে সেখানে। কি হলো এটা? সত্যিই রেখে চলে গেলো? কথাটা ভেবে সেও বেরিয়ে যায় রুম থেকে আশ্বিনের পিছু পিছু।
পড়ন্ত বিকেল,
ঝিরঝির বৃষ্টিতে পরিবেশ বেশ ঠান্ডা আজ। বারান্দায় বসে আকাশ দেখতে ব্যস্ত অধরা। কালো মেঘাচ্ছন্ন আকাশ সেই সাথে শেষ বিকেল! মুহূর্তটা উপভোগ করার মতো। চারদিকে বয়ে বেড়ানো মৃদু ঠান্ডা বাতাস উপভোগ করতে করতে হঠাত ফোনে কল আসে অধরার।
অধরা চরম বিরক্তি নিয়ে ফোন হাতে তুলে দেখে জারিফের ফোন।
‘হ্যালো জারিফ, কি খবর তোদের?’
‘খবরের হিসেব রাখ। আগে আসল কাহিনী শোন।’
‘কি কাহিনী?’
‘কলেজে আজ হাসান স্যার এসেছিলেন।’
‘কিহ? স্যারের রিট্রায়ার্ডের পর তো কখনো আসেননি। তাহলে হঠাত আজ?’
‘জানি না। হয়তো কোন প্রয়োজনে এসেছেন। যাই হোক, আমরা সুযোগ বুঝে কথা বলেছি স্যারের সাথে। তারপর স্যারের কথায় আমি আর অনিক স্যারের বাসায় যাই।’
‘তারপর?’
‘স্যার আমাদের রাফিন ভাইয়ার মেডিকেল রিপোর্টগুলো দেখান। রিপোর্ট দেখে তো আমরা দুজন আকাশ থেকে পড়েছি। তুই দেখলে তুইও অবাক হবি। দাঁড়া আমি তোকে ছবি পাঠিয়ে দিচ্ছি। আর চেষ্টা করিস দ্রুত ফিরে আসার। আমরা এতদিন যেটা একটা এক্সিডেন্ট ভেবে এসেছি, এখন দেখছি এর পিছনে গভীর রহস্য।’
‘এসব কি বলছিস তুই? কি হয়েছে?’
‘তুই আগে রিপোর্ট দেখ। তাহলে নিজেই বুঝতে পারবি।’
কথাগুলো বলে ফোন কেটে দেয় জারিফ। অবাক হয় অধরা। কি এমন আছে এই রিপোর্টে? তখনই তার ফোনে কতগুলো ছবি আসে। অধরা এক এক করে সেগুলো খেয়াল করে বিস্ময়ের চরম পর্যায়ে চলে যায়। নিজের চোখকে বিশ্বাস হচ্ছে না তার।
‘রাফিন ভাইয়া তাহলে এই কারণেই…।’
কথাগুলো বলতে গিয়েও কথা আটকে যাচ্ছে তার। এতোগুলো কড়া পাহারা, নজর বন্দি থাকার মাঝে কে তাকে ভুল ঔষধ খাওয়াতে পারে? কথাগুলো মনে হতেই মাথা ঘুরে উঠেছে অধরার।
–চলবে।