#আমার_হিয়ার_মাঝে
লেখিকা: তাহসীন নাওয়ার রীতি
পর্ব:০২
আশ্বিনের ঘর ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করছে অধরা। ছেলেটা আগে থেকেই গোছানো প্রকৃতির ছিলো। তার ঘরের আসবাপত্র থেকে শুরু করে পড়ার টেবিলের বই খাতাগুলোও পরিপাটি করে রাখা আছে। আজ এই মুহুর্ত থেকে আশ্বিনের অর্ধাঙ্গিনী হিসেবে এই ঘরটা এখন তার নিজেরও! কথাটা মনে হতেই পুলকিত হয় উঠলো সে।
খাট থেকে নেমে ধীর পায়ে হেঁটে বারান্দায় এসে উপস্থিত হয় অধরা। চারদিক অন্ধকার আচ্ছন্ন। আকাশের বুকে জমে আছে মেঘ, ঠিক অধরার মনে অভিমানের মতোই। হয়তো যেকোন সময় এই মেঘ বৃষ্টি হয়ে নামবে ধরার বুকে। গভীর আগ্রহ নিয়েই অধরা তাকিয়ে আছে মেঘেদের আনাগোনায়।
এর মাঝে আশ্বিন রুমে প্রবেশ করে বারান্দায় অধরার উপস্থিতি বুঝতে পেরে একটি দীর্ঘশ্বাস ফেলে। অতীতের কথাগুলো আজ বারবার কানের সামনে এসে ভেসে যাচ্ছে তার। কী করে সে বোকার মত একটি কথার জের ধরেই অধরার মনে আঘাত করেছিলো! মেয়েটি তো আর এমনি এমনি এতো কষ্ট পায়নি, তাই তো এখন তার প্রতি অধরার এই ঘৃণা যথেষ্ট যুক্তিপূর্ণ। অধরার দিকে একনজর তাকিয়ে ফ্রেশ হতে চলে যায় সে।
হঠাত রুমে কারো ফোন বেজে উঠায় অধরা রুমে এসে দেখে আশ্বিনের ফোন বেজে যাচ্ছে। আশ্বিনের অনুপস্থিতিতে তার ফোনে হাত দেওয়া কি ঠিক হবে? যদিও সে নিজেই এখন আশ্বিনের একান্ত ব্যাক্তিগত, তাই আশ্বিনের ফোন ধরার সম্পূর্ণ অধিকার তার আছে। অধরার এই ভাবনার মাঝেই ফোন কে/টে যায়। কিন্ত পুনরায় আবার ফোন বেজে উঠলে সে সাত পাঁচ ভেবে আশ্বিনের ফোন হাতে নিয়ে স্কিনে থাকা নামটা দেখে চমকে উঠে। মুহূর্তেই চোখ মুখে এসে পড়ে এক অদ্ভুত চিন্তার ছাপ। তবে কি এতদিন ধরে তার করা অনুমানই সঠিক ছিলো?
‘কে ফোন করেছে?’
আশ্বিন টাওয়াল হাতে ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে অধরার সামনে এসে দাঁড়ায়। অধরার সেদিকে খেয়াল নেই সে নিস্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে আছে ফোনের দিকেই।
‘কি হলো? কার ফোন?’
‘আপনার মারিয়ার ফোন। তাহলে এখনও যোগাযোগ আছে আপনাদের মাঝে, ভালোই।’
অধরার উত্তরে আশ্বিন বিস্মিত হয়, মুহূর্তেই কপালে প্রকাশ পায় সেই বিস্ময়ের ভাঁজ। কি বলছে অধরা? তার সাথে তো মারিয়ার…।
অধরা নির্লিপ্ত পানে আশ্বিনের দিকে চেয়ে হাতের ফোন তার দিকে এগিয়ে দেয়। সরল সহজ ভাবে প্রশ্ন করে বসে,
‘কেনো করলেন এই বিয়ে? নিশ্চয়ই বলবেন আমার মতো আপনিও বিয়ের বিষয়ে কিছু জানতেন না।’
‘বললেই কি তুমি বিশ্বাস করবে আমার কথা?’
মুখ বন্ধ হয়ে যায় অধরার। মস্তিষ্ক বারবার জানান দিচ্ছে আশ্বিনের করা অতীতের সব কর্ম। সে চাইছে বারবার কঠোর হতে কিন্তু মন এতে সায় দিচ্ছে না।
তাই এই মুহূর্তে ক্লান্ত শরীরে আর কথা বাড়াতে চাইছে না অধরা। আশ্বিনের সামনে থেকে সরে খাটের এক প্রান্তে এসে বসলো সে।
‘আপনার ফোনে কথা বলা শেষ হলে এসে ঘুমিয়ে পড়বেন। আমি অনেক ক্লান্ত। সকালে মা তার অসুস্থতার মিথ্যা বলায় আমি তড়িঘড়ি করে ঢাকা থেকে চলে এসেছি। কাল সকালে ক্লাস আছে, তাই ভোরেই আমাকে ফিরতে হবে।’
অধরা কথাগুলো বলে এক মুহূর্ত অপেক্ষা না করে একপাশ হয়ে শুয়ে পড়ে। আশ্বিন কিছুক্ষণ ঠাঁই দাঁড়িয়ে থেকে অধরার অপর পাশে এসে বসে।
‘কাল ফিরে যাওয়ার প্রয়োজন নেই। আমারও ডিউটি আছে। দুদিন পর নাহয় একসাথে যাবো। আজ বিয়ে হয়েছে, মা এমনিতেও কাল যেতে দিবে না।’
আশ্বিনের কথায় অধরার জ্ঞান ফিরে আসে। আশ্বিন তো ঠিকই বলছে, এখন এই পরিস্থিতিতে সে চাইলেও কিছু করতে পারবে না। আড়চোখে একনজর আশ্বিনের পানে চেয়ে ছোট করে শুধু বলে, ‘হুম।’
রাত, দুটো বেজে বিশ মিনিট!
খাটের দুই প্রান্তে বিপরীতমুখী হয়ে শুয়ে আছে দুজন, মাঝে বিশাল দূরত্ব। কারো চোখেই ঘুম নেই। বাইরে তুমুল বেগে ঝড়, বৃষ্টি সেই সাথে থেমে থেমে বিদ্যুত চমকানোর শব্দ। ভয়ে জড়োসড়ো হয়ে বারবার কেঁপে কেঁপে উঠছে অধরা। আশ্বিন বুঝতে পারছে অধরার ভয়ের কারণ। নিজেকে সবসময় বীর, বাহাদুর, নির্ভীক দাবি করা এই মেয়ে যে বিদ্যুতের শব্দ কতটা ভয় পায় সেই নিয়ে অতীতের ভালোই অভিজ্ঞতা আছে তার।
তাই সোজা হয়ে শুয়ে এক হাতে আলতো করে অধরার ডান হাত নিজের হাতের মুঠোয় ধরে নেয়।
চমকে উঠে অধরা! আশ্বিনের এই স্পর্শ প্রতিবার তার হৃৎস্পন্দন বাড়িয়ে দেয়। দুজনেই চুপচাপ শুয়ে আছে, ভাব প্রকাশের ভাষা নেই। নীরবতাই প্রকাশ করছে দুজনের মনের অভিমান অভিযোগ।
হঠাত দেয়ালে থাকা আশ্বিনের একটি ছবির দিকে নজর যায় অধরার। ছবিটা সেদিনের যখন প্রথমবার সে দেখেছিলো আশ্বিনকে। এক বিশাল অঘটনের মাঝেই প্রথম সাক্ষাৎ ছিলো তাদের দুজনের। সে দিনটি মনে হতেই অধরার ঠোঁটের কোণে মৃদু হাসি ফুঁটে ওঠে। চোখ বুজে সে হারিয়ে যায় সেই স্মৃতির পাতায়।
—————-
মেডিকেলে ভর্তির মাস তিন এক এর মাঝেই অধরার বন্ধুত্ব হয় অনিক, ইশা, জারিফ আর সাদমানের সাথে। বন্ধুত্বের সময়সীমা খুব কম হলেও এই অল্প সময়ের মধ্যেই তাদের বন্ধুত্ব গভীর হয়ে যায়। পাঁচজন মিলে পুরো ক্যাম্পাসে রাজত্ব করে বেড়াতো যার লিডার হলো অধরা। বরাবরই ছোট থেকে দুষ্টু প্রকৃতির সে, তাই তার দুষ্টুমি ভরা সকল কর্মকান্ড তাকে সবার চোখের মণি করে তোলে।
সেদিন কলেজ মাঠে বসে আড্ডা দিচ্ছিল সবাই। অনিক বরাবরই চুপচাপ ছেলে হলেও সেদিন মনমরা হয়ে বসে ছিলো সে। অধরা চিপস্ খেতে খেতে ইশার কানের কাছে গিয়ে,
‘অনিকের কি হয়েছে রে? তার এক্স রেণুর শোকে এখনও কাতর হয়ে আছে নাকি?’
‘তুই জানিস না? কাল রেণুর বিয়ে। বেচারা এই নিয়ে কষ্টে আছে, অনেক ভালোবাসতো মেয়েটাকে। আফসোস মেয়েটা বুঝতে পারলো না।’
অধরা ইশার দিকে তাকিয়ে কথাগুলো শুনে স্বাভাবিক ভাবেই মুখে চিপস্ পুরে নেয়। ঐ টাকার লো/ভী মেয়ে আবার ভালোবাসার কি বুঝবে? এমন একটা মেয়ের সাথে নাকি অনিক রিলেশনে করতো! যেদিন কথাটা জানতে পেরেছিলো সেদিন ইচ্ছে ছিলো অনিককে ধরে দুচারটা উত্তম মধ্যম দিয়ে দিতে। কিন্তু এখন বেচারার জন্য খারাপ লাগছে তার।
‘অনিক তোর রেণুর যে কাল বিয়ে আমাদেরকে তো দাওয়াত দিলো না। আমাদের কথা নাহয় বাদ দিলাম, তোকে তো দাওয়াত দেওয়া প্রয়োজন ছিলো। আফটার অল মাসে মাসে দশ বিশ হাজার টাকার উপহার দিয়েছিলি তুই রেণুকে। কাল এক বেলার খাবারের দাওয়াত দিলে কতই আর ক্ষতি হয়ে যেতো তাদের? নাহ, এটা ঠিক হয়নি, তুই গিয়ে আর কতটুকুই খেয়ে ফেলতি, তাই না বন্ধু?’
‘চুপ কর অধরা। ভালো লাগছে না আমার। রাগ হচ্ছে নিজের প্রতি। এমন একজন ভুল মানুষের মোহে আমি কীভাবে জড়ালাম?’
‘আমাদের কথায় তো সেদিন দাম দিলি না। তাই এখন আর এসব বলে লাভ নেই, তুই বরং চিল মুডে থাক। বাই দ্য ওয়ে, রেণুর হবু বর কি করে?’
জারিফের প্রশ্নে সবাই উৎসুক হয়ে তাকিয়ে আছে অনিকের দিকে। অনিক সবার দিকে তাকিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস নিয়ে,
‘সরকারি চাকরি করে। শুনেছি অনেক বড়লোক। তবে উনার বয়স সাতচল্লিশ প্রায়।’
অনিকের এই উত্তরে পরিবেশ নিঃশব্দ ছিলো বড়জোর দুইমিনিট। পর মুহূর্তে সবাই একসাথে হাসির মাঝে ভেঙে পড়ে। অনিক সবার হাসির দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে।
‘অনিক মামা, এ তুই কার সাথে রিলেশনে ছিলি রে ভাই?’
সাদমান আর জারিফ হাসির তালে তালে অনিকের পিঠে দুচারটা থা/বা বসিয়ে দিয়েছে। অধরা অবশ্য এই নিয়ে মোটেও অবাক নয়, বরং বিয়েটা কোন সাধারণ কারো সাথে হলেই সে অবাক হতো।
অনিকের ভালো লাগছে না সবার এমন হাসি তামাশা।
‘থামবি তোরা? ওই মেয়ে আমার ফিলিংস নিয়ে খেলা করেছে। সে না বাসুক, আমি তো তাকে সত্যিই ভালোবেসেছিলাম। কোথায় আমি নিজেকে শান্ত রাখার চেষ্টা করছি আর তোরা..। তোরাই থাক, আমি যাচ্ছি।’
অনিক রেগে উঠে দাঁড়িয়ে সেখান থেকে চলে আসতে নিতেই অধরা তাকে থামিয়ে দেয়। সে অনিককে বসতে ইশারা করে কোকের বোতলে একটা চুমুক দিয়ে,
‘তোর কি মনে হয় অনিক? অধরা তার ফ্রেন্ডের সাথে অন্যায়কারীকে এতো সহজে ছেড়ে দিবে? কোনদিনও না। রেণুর খুব শখ না বিয়ে করার? তুই নিশ্চিন্তে থাক, কাল তার বিয়ের আসল সানাই তো আমরাই বাজাতে যাচ্ছি। এমন সানাই বাজাবো যে ইতিহাস হয়ে থাকবে। নয়তো আমার নাম অধরা ওহি না। তুই শুধু সময় মতো রেডি থাকিস।’
অধরার এমন রহস্যজনক কথায় বাকি সবাই সাপোর্ট করলেও অনিক এসব মানতে নারাজ।
‘না অধরা। আমি ভালো করেই বুঝতে পারছি তোর মাথায় এখন কি ঘুরছে। কিন্তু এসব কিছুই আমরা করবো না।’
জারিফ আর সাদমান উঠে দাঁড়িয়ে অনিকের দুই কাধে দুই হাত রেখে,
‘এতো ভয় পাচ্ছিস কেনো তুই? জানিস না অধরার প্ল্যান কখনো ফ্লপ হয়না।’
‘কিন্তু কি করবি তুই অধরা?’
‘এটা তো কালই দেখতে পারবি। তবে জেনে রাখ, খেলা হবে মামা।’
অধরা এক রহস্যের হাসির দেয়, যার দিকে অনিক অসহায়ভাবে তাকিয়ে থাকে। না জানি কাল কোন অঘটন ঘটতে যাচ্ছে এই মেয়ে।
–চলবে(ইনশাআল্লাহ)
((আসসালামু আলাইকুম। ভুল ত্রুটি ক্ষমার চোখে দেখবেন। ধন্যবাদ))