আমার হিয়ার মাঝে পর্ব ১৯+২০

0
773

#আমার_হিয়ার_মাঝে
লেখিকা: তাহসীন নাওয়ার রীতি
পর্ব:১৯

অধরার প্রশ্নে হালকা হেসে উঠে বাবা। আকাশের দিকে তাকিয়ে বলে উঠে..

‘আমি ছোট থেকেই আশ্বিনকে গভীর ভাবে পর্যবেক্ষণ করেছি অধরা। যে বয়সে ছেলেমেয়েরা খেলাধুলা, দৌড়-ঝাঁপ নিয়ে ব্যস্ত! আমার আশ্বিন তখন থেকেই নিশ্চুপ, নিরীহ। বই পড়া, টিভি দেখা আর নিজের রুমে বসে একাই খেলনা দিয়ে খেলতে পছন্দ করতো সে। কোন প্রকার চাওয়া পাওয়া নেই। বাবা এটা আমাকে কিনে দিতেই হবে, এমন কোন জেদ তার নেই। সে তার দিক দিয়ে ছিল সন্তুষ্ট।
মাঝে মাঝে ছেলেকে নিয়ে আমার অনেক চিন্তা হতো। আমি চাইতাম আশ্বিন আর দুটো স্বাভাবিক বাচ্চাদের মতো একটু চঞ্চল হোক। তাই অনেক চেষ্টা করেছি তাকে চঞ্চল প্রকৃতির বাচ্চাদের সাথে বন্ধুত্ব করিয়ে দেওয়ার। লাভ হয়নি, সে তাদের সাথে মিশতে নারাজ। ওর মা-ও এতে ঘোর আপত্তি জানায়, ছেলে যেমন ভাবে থাকতে চাইছে থাক না। বাধা দিচ্ছি কেনো?
কিন্তু আমিও নাছরবান্দা। আমার বন্ধুর ছেলে রোদ্দুরের সাথে আশ্বিনের পরিচয় করিয়ে দেই। রোদ্দুর ছোট বেলায় ভারি দু/ষ্টু ছিলো। খেলার ছলে পুরো বাড়ি মাথায় তুলে রাখতো। ভাবলাম একে দিয়েই কাজ হবে। কথায় আছে না, সঙ্গ দোষ? আমিও তাই ভেবে আশ্বিনকে দিনে প্রায় চব্বিশ ঘণ্টাই রোদ্দুরের সান্নিধ্যে রাখলাম। কিন্তু আমার আশাকে সম্পূর্ণ ব্যার্থ করে দিয়ে, আশ্বিন রোদ্দুরের মতো না হলেও, রোদ্দুর ঠিকই আশ্বিনের মতো শান্তশিষ্ট বাচ্চা হয়ে গেল।’

কথাগুলো বলে থেমে যায় বাবা। মুহূর্তেই অধরা আর বাবা একসাথে হেসে উঠে। আশ্বিনের বাবার চোখ মুখে আগ্রহ। যেন অনেকদিন পর মনের কথাগুলো প্রকাশ করার সুযোগ পেয়েছেন উনি।
‘সেদিন আমার আর বুঝতে বাকি ছিল না যে আশ্বিনকে ঠিক করতে অন্য কেউ নয় বরং আমারই চেষ্টা করতে হবে। তাই তখন থেকেই আমার চেষ্টা ছিলো আশ্বিনের বাবা হওয়ার পাশাপাশি তার ভালো বন্ধু হওয়া। যাকে সে মন খুলে সব কথা বলতে পারবে।
আমার চেষ্টার কোন কমতি ছিল না, তাই দেখো আজ বাবা ছেলের সম্পর্ক অন্যরকম, সুন্দর।’

অধরা মুচকি হেসে মাথা নেড়ে সম্মতি জানায়। বাবাও মাথা নেড়ে হ্যা বোঝায়। নীরবে তাকিয়ে থাকে সিঁড়িঘরে অতি যত্ন করে রাখা ছোট্ট সাইকেলের দিকে।
‘ওই সাইকেলটা দেখছিস মা?’
‘জি বাবা। প্রথম দিন এসেই দেখেছিলাম।’

‘আশ্বিন যখন ক্লাস ফাইভে অনেক ভালো রেজাল্ট করেছিলো, সবাই তার রেজাল্ট দেখে খুশি হয়ে এটা সেটা উপহার দিচ্ছিলো। সেদিন আশ্বিন প্রথম আমার কাছে এই সাইকেল পাওয়ার জেদ করেছিলো। অনেক শখের ছিলো সাইকেলটা তার কাছে। প্রতিদিন বাহির থেকে এসেই রুমাল দিয়ে মুছে পরিষ্কার করতো, ছুটির দিনে আরশিকে সাইকেলে বসিয়ে বাগান ঘুরে আসতো।
হঠাত একদিন স্কুল থেকে ফিরে আসার পথে গাড়ির সাথে ধাক্কা লেগে ভেঙে যায় তার সাইকেল। আশা অনেক রাগ করেছিলো ছেলের উপর। আর আশ্বিন সারাদিন চুপচাপ তার রুমেই ছিলো। একবারও বলেনি যে গাড়ির সাথে লেগে শুধু তার সাইকেল ভাঙেনি, সেও আঘাত পেয়েছে। তার ছোট্ট মন ভেঙেছে। শখের বস্তু হারিয়ে যাওয়ার কষ্ট সেই বুঝতে পারে যার হারায়।’
এতোক্ষণ ধরে চুপচাপ বাবার কথাগুলো শুনছিলো অধরা। অতঃপর একনজর ফিরে তাকায় পুরনো সাইকেলটার দিকে।
‘শখের বস্তু অমূল্য হয় বাবা। শখের বস্তুকে মানুষ তার মনের গহীনে, হিয়ার মাঝে লুকিয়ে রাখে।’
মুচকি হেসে মাথা নেড়ে সম্মতি জানায় বাবা। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে আকাশের দিকে তাকিয়ে,
‘তুইও আশ্বিনের অনেক শখের, অধরা।’

থেমে যায় অধরা। বিস্মিত নয়নে ফিরে তাকায় সে বাবার দিকে। কি বুঝতে চাইছেন বাবা?
‘বুঝলাম না, বাবা।’
‘আশ্বিন আমার সাথে সব কথাই শেয়ার করে অধরা। কলেজে তোমাদের পরিচয়ের পর আশ্বিন প্রায়ই ফোনে তোমার গল্প আমায় বলতো। আমিও সেই সব গল্প শুনতে শুনতে একপ্রকার অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছিলাম। তারপর এমনও হয়েছে যে আশ্বিন ফোন করলে আমি প্রথমেই তোমার খবর জানতে চেয়েছি। আশ্বিনও খুশি মনে তোমার কথা বলতো।
হঠাত সব পাল্টে যায়। আশ্বিনকে তোমার কথা জিজ্ঞেস করলে বলতো, এখন তোমাদের মাঝে আর আগের মতো কথা হয়না। বুঝলাম তোমাদের সম্পর্কে কোন ঝামেলা এসেছে। আমি আশ্বিনের কাছে অনেকবার জানতে চেয়েছি, কিন্তু সে কিছু বলেনি।
তারপর একদিন খবর আসে রোদ্দুরের সেই এক্সিডেন্টের কথা। আমরা সবাই ছুটে যাই ঢাকা, এতো সব ঝামেলা আর ব্যস্ততার মাঝে আশ্বিনকে তোমার ব্যাপারে কিছু জিজ্ঞেস করিনি। কিছুদিন পর শুনেছি তোমাদের মাঝে অনেক বড় ধরনের ভুল বুঝাবুঝি হয়েছে, আর সেই দোষটা ছিলো আশ্বিনের।’

মুখটা কালো হয়ে আসে অধরার। এই প্রসঙ্গে কথা বলে অতীত মনে করতে চাইছে না সে। তার মনে আছে কিভাবে তার খামখেয়ালীর জন্য রাফিন আর রোদ্দুরের মাঝে ঝামেলা হয়েছিলো। তার ভুলের জন্যই তো রোদ্দুরের জীবন ম/র/ণ নিয়ে টানাটানি চলছিলো।
‘সবটা হয়েছে সেই সময়ের পরিস্থিতির জন্য। এখানে নির্দিষ্ট কারো দোষ ছিল না বাবা।’
‘জানি না আমি। তোমাদের মাঝে কি নিয়ে এই ভুল বোঝাবুঝি হয়েছিল, কেনো দুজন পুরোপুরি আলাদা হয়ে গিয়েছিলে সেসব আমি জানি না। তবে আমি এটা জানি, এখানে, এই বেঞ্চে বসেই আশ্বিন আমার সামনে তোমাকে পাওয়ার জন্য কান্না আহাজারি করেছিল। শুধু একটি কথাই বলেছিলো সে, বাবা প্লিজ অধরাকে এনে দাও।
আমি অনেক চেষ্টা করেছি আশ্বিন যেন তোমাকে ভুলে যায়, কিন্তু লাভ হয়নি। আশ্বিনের শুধু তোমাকেই চাই, তুমি তার হিয়ার মাঝে লুকিয়ে থাকা একমাত্র ব্যক্তি।
ছেলের পাগলামো আমার আর সহ্য হয়নি। তাই রোদ্দুরের থেকে খোঁজ খবর নিয়ে তোমার পরিচয় সংগ্রহ করতেই জেনেছি তুমি আশার সবচেয়ে কাছের বান্ধবীর মেয়ে। তোমার মায়ের সাথে আমাদের অনেক বছর যোগাযোগ ছিল না, তাই একদিন আমি পরিকল্পনা করেই আশাকে তোমাদের বাসায় নিয়ে যাই। যোগাযোগ আর সম্পর্ক কিছুটা উন্নতি হওয়ার পর কথায় কথায় তোমার সাথে আশ্বিনের বিয়ের ব্যাপার আসে। আশা তো অনেকটা ইমোশনাল ব্লেকমেইল করেই তোমার মাকে বিয়ের ব্যাপারে রাজি করিয়েছে। যদিও আশা তোমার আর আশ্বিনের ব্যাপারে কিছু জানে না।’

থমকে গিয়ে চুপচাপ বসে আছে অধরা। কোন কথা বলার শক্তি তার নেই। তার অজান্তেই এতো কিছু হয়ে গিয়েছে। তাদের বিয়ে! সবটাই ছিল বাবার পরিকল্পিত?
‘তাহলে হুট করে এই বিয়ের কারণ?’
‘আমি ভেবেছিলাম তুই হয়তো আশ্বিনকে দেখলে এই বিয়ে ভেঙে দিবি। তাই আমার অসুস্থতার বাহানা দেখিয়ে হুট করে একদিন তোদের ডেকে এনে ঘরোয়া ভাবে বিয়ের কাজ সম্পন্ন করি।’

চুপ হয়ে যায় অধরা। বাবা অপরাধীর ন্যায় মাথা নামিয়ে বসে আছে। হয়তো সেদিন উনি শুধু নিজের ছেলের কথাই ভেবেছেন, অধরার হয়েও একবার ভেবে দেখা উচিত ছিল উনার।
‘অধরা মা, আমি আসলে..।’
‘আপনি কোন ভুল করেননি বাবা। সেদিন যদি আপনি এমন কিছু না করতেন তাহলে আজ আমি আপনার আর মামুনির মতো ভালো মা বাবা পেতাম না, আরশিকে পেতাম না। আর সবচেয়ে বড় হলো, আশ্বিনের মতো কাউকে আমি চিরতরে হারিয়ে ফেলতাম। আপনি সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়েছেন বাবা। আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।’
আশ্বিনের বাবা হেসে উঠে। অধরার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে উঠে ছাদ থেকে চলে আসেন উনি।
—————–

নিরবে বসে একধ্যানে বাবার কথাগুলো মনে করছে অধরা। মনে হচ্ছে সেই দিনগুলো, যখন আশ্বিন তার ভুল বুঝতে পেরে বারবার ক্ষমা চাইতে এসেছিলো আর সে প্রতিবার তাকে ফিরিয়ে দিয়েছিল। অথচ আশ্বিনের দোষ ছিলো এটাই যে সে সত্য না জেনেই অধরাকে দোষ দিয়েছে।
মানুষ মাত্রই ভুল। আশ্বিন তার ভুল বুঝতে পেরেছে। শুধু তার উচিত হয়নি এতোদিন ধরে কঠোর হয়ে আশ্বিনের সাথে এভাবে দূর্ব্যবহার করা। সেও তো কষ্ট পেয়েছিল অনেক।
একটি দীর্ঘশ্বাস ফেলে হাতের পিঠ দিয়ে চোখ মুছে অধরা। অনেক হয়েছে এই ভুল বোঝাবুঝি। এখন সব রাগ অভিমান ছেড়ে আবারো সে ফিরে যাবে সেই চঞ্চল অধরা রূপে। যে অধরা নীরবে নিভৃতে ভালোবাসে আশ্বিনকে।

হঠাত ফোন বেজে ওঠে অধরার। ফোনের দিকে তাকিয়ে আশ্বিনের নাম দেখে মুচকি হাসি দেয় অধরা।
‘হ্যালো।’
‘হ্যা, অধরা। কি করছো তুমি? রাতের ঔষধ খেয়েছো তো?’
অজান্তেই চোখ বেয়ে পানি পড়ছে অধরার। নিজেকে অনেক কষ্টে সামলে নিয়ে,
‘না, খাইনি।’
‘আমি জানতাম। পৃথিবীর সব জ্ঞান তোমার আছে অথচ সময় জ্ঞানটাই নেই তোমার। এখনি গিয়ে ঔষধ খেয়ে নাও, যাও।’
‘আপনি বাসায় কখন আসবেন? কোথায় আছেন এখন?’
‘পার্কে এসেছি সবার সাথে। আড্ডা দেওয়া শেষ হলেই চলে আসবো।’
‘মানে কি? আপনি কি ভাবছেন রাত করে বন্ধুদের সাথে গল্প করে ফিরে আসবেন আর আমি চুপ থাকবো? আশ্বিন আপনি এখন সিঙ্গেল না, আপনার বাসায় একজন সুন্দরী বউ আছে।’
থতমত খেয়ে যায় আশ্বিন। অধরা কি বললো এটা?
‘আমি আসলে বন্ধুদের সাথে…।’

এদিকে ডায়লগ দিতে গিয়ে নিজের কথায় নিজেই বেকুব বনে গিয়েছে অধরা। কি বলতে গিয়ে কি বলে ফেললো সে? তবে এখন নিজের বলা ভুল স্বীকার করা যাবে না, উল্টো আরো দু চারটা লজিক দেখাতে হবে।
‘কি বন্ধুদের সাথে? আপনি কি ভুলে গিয়েছেন আমি অসুস্থ? তাছাড়া আজ সারাদিনের ব্যস্ততার জন্য এখন মাথা ব্যাথা করছে আমার। কোথায় আপনি জলদি এসে আমার সেবা যত্ন করবেন, তা না করে ফোন দিয়ে আমাকে নিজে ঔষধ খেয়ে নিতে বলছেন। ভালোই!’
‘আরে আমি কখন বললাম..।’
‘আপনি আর কি বলবেন আশ্বিন? মনে করে দেখুন আপনার যখন জ্বর হয়েছিলো এই আমি অধরা, আপনার স্ত্রী, আপনার কতো সেবা যত্ন করেছিলাম। আর আপনি? আজ এই দিন দেখানোর জন্যই কি বিয়ে করেছিলেন আমায়?’
‘হয়েছে থামো এখন। অনেক বড় বড় কথা বলেছো। আসছি আমি, দশ মিনিট।’
ফোন কেটে দেয় আশ্বিন। ফোনের দিকে একনজর তাকিয়ে মুচকি হেসে দ্রুত ছাদ থেকে নেমে যায় অধরা।

–চলবে।

#আমার_হিয়ার_মাঝে
লেখিকা: তাহসীন নাওয়ার রীতি
পর্ব:২০

আয়নার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে নিজের চুল আঁচড়ে নিচ্ছে অধরা। আরশি পাশে দাঁড়িয়ে তাকে এটা সেটা বলে যাচ্ছে। অধরা তার কথাগুলো শুনে একটি দীর্ঘশ্বাস ফেলে।
‘আরশি সব তো বুঝেছি, কিন্তু সেখানে গিয়ে যদি কোন সমস্যা হয়ে যায়?’
‘আরে কিচ্ছু হবে না ভাবি। এতো ভয় কিসের? আমি আমার কিছু ফ্রেন্ডদের আগেই বলে রেখেছি, তারা সুন্দর করে ডেকুরেশন করে রেখেছে।’
‘হুম। তোমার ভাই এতো রাতে আমার সাথে ঘুরতে যেতে রাজি হলেই হয়। মহাশয় হয়তো এখনি চলে আসবেন। বাই দ্য ওয়ে, বাসার সবাইকে কি বলে যাবো?’
‘এসব নিয়ে তুমি টেনশন করো না। আমি কিছু একটা বলে সব সামলে নিবো।’
আরশির কথায় মাথা নেড়ে সম্মতি দেয় অধরা। আয়নায় একবার নিজেকে পরখ করে নেয় সে। শ্যামবর্ণ গায়ের রঙ, টানাটানা কালো চোখ। সৌন্দর্য বলতে খুব আহামরি কিছু নেই তার, তবুও আশ্বিন বলে সে মায়াবী। কি জানি সত্য কি না?
‘কি ভাবছো ভাবি?’
‘হুম? না কিছু না। এমনি…।’
————

তাড়াহুড়ো করে আশ্বিন চলে এসেছে বাসায় কাছে। আজ দীর্ঘদিন পর অধরার বাধহীন, অনিয়ন্ত্রীত কথা শুনে কিছুটা হতভম্ব হয়েছে সে। কেননা এই কদিন অধরা প্রয়োজন ছাড়া তেমন একটা কথা বলেনি তার সাথে।
বাসার দরজার কাছে এসে কলিং বেল বাজাতেই আরশি এসে দরজা খুলে দেয়।
‘তাহলে আমার ভাইয়া বাসার পথ ভুলে যায়নি। আমি আর ভাবি তো ভেবেছিলাম তুমি হয়তো পথ হারিয়ে ফেলেছো ভাইয়া।’
‘বেশি কথা বলিস তুই। ঘুমাসনি কেনো এখনও? আমি বলেছি না পরীক্ষার আগে তোর রাত জেগে বসে থাকা নিষেধ?’
‘মাত্র তো দশটা বাজে। একটু পর ঘুমাবো।’
আর কথা বারায় না আশ্বিন। বাসায় প্রবেশ করতেই নিজের ঘর থেকে তেড়ে আসে অধরা। বিস্মিত হয়ে গোল গোল চোখে তাকিয়ে আছে আশ্বিন অধরার পানে। গাঢ় গোলাপি রঙের একটি থ্রি-পিস পরিহিত, চুল ছেড়ে দিয়ে হালকা করে সেজে আছে সে। মাথা থেকে পা পর্যন্ত একবার পরখ করে দেখে আশ্বিন।
‘কোথাও যাচ্ছো নাকি? এভাবে সেজে আছো যে?’
‘হ্যা। যাবো বলেই তো রেডি হয়ে আপনার অপেক্ষায় ছিলাম। চলুন এবার যাওয়া যাক।’
অধরা আর কথা না বলে আশ্বিনের হাত ধরে বেরিয়ে যেতে যেতে আরশিকে এক চোখের ইশারা দেয়। আরশি কথা মতো মাথা নেড়ে হ্যা বোঝায়।

রিকশায় পাশাপাশি বসে রাতের শহর ঘুরে দেখছে দুজন। মাথার উপর খোলা আকাশ, এক ফালি চাঁদ এসে উঁকি দিচ্ছে এর মাঝে। রিকশা চলার গতিতে বাতাসে চুল এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে অধরার। আশ্বিনের হাতের মুঠোয় হাত রেখে পরিবেশ উপভোগ করতে ব্যস্ত সে।
এদিকে,
আশ্বিন মুগ্ধ নয়নে শুধু দেখে চলেছে অধরাকে। হুট করেই অধরার এতো পরিবর্তনে কিছুটা বিস্মিত সে। কি এমন হলো তার? অধরা কি তার সব রাগ ভুলে গিয়েছে? নাকি কেবল তার জন্মদিন উপলক্ষে দিনটি উপভোগ করতে চাইছে? উত্তর সব অজানা। তবে আজ এর উত্তর জানতে আগ্রহী নয় সে, অধরার সান্নিধ্যে থাকতে পারাই যেন তার কাছে সবচেয়ে বড় পাওয়া।

‘তাহলে এ কারণে আমায় এভাবে জরুরি বাসায় আসতে বলেছো? একসাথে ঘুরতে যাওয়ার জন্যে?’
‘হঠাৎ আপনাকে নিয়ে রাতের শহর ঘুরে দেখার ইচ্ছে হলো।’
‘হুম, কিন্তু সেটা তো আমরা ঢাকা ফিরে পরেও ঘুরতে পারতাম। এতো তাড়া ছিল কিসের?’
ফিরে তাকায় অধরা। জবাবের আশায় অধরার মুখ পানে চেয়ে আছে আশ্বিন।
‘আপনি জানেন আশ্বিন? এই ময়মনসিংহ শহরকে মায়ার শহর বলা হয়। দূর-দুরন্ত থেকে ক্ষণিকের জন্য আসা মানুষও মায়ার জড়িয়ে যায় এই শহরের। আর আমি তো জন্মেছি এখানে। আমার শৈশব, বেড়ে ওঠা অনেক সুন্দর স্মৃতি জড়িয়ে আছে এই শহরে, তাই ভাবলাম আর একটি সুন্দর স্মৃতি রেখে যাই এখানে।’
হেসে উঠে অধরা। আশ্বিনের ঠোঁটের কোণে মুচকি হাসি। ভালোই লাগছে তার এই মুহূর্ত উপভোগ করতে। খুব ইচ্ছে করছে অধরার দিকে তাকিয়ে একটি গান গেয়ে যেতে,
-এই পথ যদি না শেষ হয়, তবে কেমন হতো তুমি বলো তো?
অধরার হাতের মুঠোয় থাকা নিজের হাত শক্ত করে আঁকড়ে ধরে নীরবে হেসে উঠে সে।

রিকশা ভাড়া মিটিয়ে অধরার হাত ধরে পার্কে হেঁটে যাচ্ছে আশ্বিন। রাতের অন্ধকারেও পার্কের চারপাশ লাল নীল হলুদ রঙের বাতিতে আলোকিত। সারাদিন জনবহুল থাকা এই পার্ক এখন কেমন নির্জন হয়ে আছে।
‘এখানেই আসতে হলো আমাদের অধরা? আমার বন্ধুরা আছে হয়তো এখানে। এক তো তোমার কথায় কোনরকম বাহানা দেখিয়ে তাদের থেকে উঠে বাসায় গিয়েছি। এখন যদি কেউ দেখে নেয় আমায়, তাহলে তো আমি শেষ।’
‘আরে ভয় নেই আশ্বিন। আপনার বউ আপনার পাশে আছে।’
ভ্রু কুঁচকে আশ্বিন ফিরে তাকায় অধরার দিকে। কলেজে থাকা কালে অধরা ঠিক এভাবেই আশ্বিনকে বলতো,
-ভয় নেই আশ্বিন ভাইয়া, যখন অধরা আছে আপনার পাশে।
কিন্তু প্রতিবারই অঘটন ঘটিয়ে সে নিজেই ভয়ে আশ্বিনের পিছন লুকিয়ে থাকতো। কথাগুলো মনে হতেই একটা তাচ্ছিল্যের হাসি দেয় সে।
‘আচ্ছা তো আমার বউ আমার পাশে আছে?’
মাথা নেড়ে সম্মতি জানায় অধরা। সে ঠিকই বুঝতে পারছে মহাশয় কলেজের সেই কথাগুলো মনে করে তাকে খোঁচা দিতে চাইছে।
‘দেখুন আশ্বিন, আপনি যদি ভেবে থাকেন আমি এখনও ভয় পেয়ে আপনার পিছু লুকিয়ে থাকবো তাহলে আপনি ভুল। এখন আমি অনেক সাহসী মেয়ে, কাউকে ভয় পাইনা আমি।’

প্রতিউত্তর দেয় না আশ্বিন। অনেক কষ্টে হাসি থামিয়ে রেখেছে সে। আশেপাশে একবার তাকিয়ে দেখে সে।
‘শুনেছি পার্কে থাকা এই গাছগুলো অনেক বছর পুরনো। দেখো কেমন বিশাল বিশাল গাছ।’
আশ্বিনের কথায় আড়চোখে একবার গাছগুলোর দিকে চোখ বুলিয়ে দেয় অধরা।
‘হুম পুরনো। তো কি হয়েছে?’
‘নাহ, কিছু হয়নি। তবে কোথায় যেন শুনেছিলাম এমন পুরনো বট গাছে নাকি জ্বিন ভূত থাকে।’
বিস্ফারিত দৃষ্টিতে ফিরে তাকায় অধরা গাছগুলোর দিকে। ছোট বেলা বাবার কাছেও একবার শুনেছিলো এই বিশাল গাছগুলোর কথা। ভয়ে গলা শুকিয়ে আসছে অধরার। আশ্বিনের কথায় মুহূর্তেই কলিজা কাঠ হয়ে গিয়েছে।
‘আরে ক..ক..কিছু ন..নেই এখানে। এসব তো রূপকথার গল্প।’
অধরার কথার ভঙ্গিতে মনে মনে হেসে উঠে আশ্বিন। কিন্তু তা প্রকাশ করে না।
‘কি জানি, হতেও তো পারে। বাই দ্য ওয়ে, তোমার তো ভূত প্রেত ভয় পাওয়ার কথা না, কেননা তুমি অনেক সাহসী। আর তাছাড়া যে কড়া লিপস্টিক লাগিয়ে এসেছো, তোমাকে ভয় দেখাতে পেত্নী এসে তো নিজেই ভয়ে পালাবে?’
‘এই কি বললেন আপনি?’
হেসে ফেলে আশ্বিন। রাগে কড়াভাবে তাকিয়ে আছে অধরা। এতো বড় অপমান? একটু নাহয় লিপস্টিক দিয়েছিলোই। তাই বলে এমন বলবে?
রাগে আশ্বিনকে ফেলেই হনহন করে ছুটে গিয়ে দূরে একটি বেঞ্চে এসে বসে সে।
তার পিছু পিছু আশ্বিন গিয়ে বসেছে তার পাশে।

‘রাগ করেছো? আমি তো মজা করে বলেছি।’
‘যা সত্যি তাই তো বলেছেন। মিথ্যে তো বলেননি।’
আশ্বিনের আর বুঝতে বাকি নেই বিবি সাহেবা রাগ করেছেন। তাই আশ্বিন অধরার দিকে একটু এগিয়ে গিয়ে অধরার কোমরে হাত রেখে এক টানে তাকে কাছে নিয়ে আসে সে। চমকে উঠে অধরা। গা ঘেঁষে বসে আছে দুজন দুজনের। অধরা হতভম্ব নয়নে তাকিয়ে আছে আশ্বিনের দিকে। আশ্বিনের চোখ মুখে চাঞ্চল্য।
‘কি করছেন? ছাড়ুন।’
‘কিভাবে ছেড়ে দিবো? এমন রোমান্টিক একটা আবহাওয়া, পাশে সুন্দরী বউ বসে, পার্কে শুধু আমি আর তুমি..।’
চোখ নামিয়ে নেয় অধরা। একরাশ লাজুক ভাব এসে ভর করছে তার চোখ মুখে। বুকের ভেতর হাতুড়ি পিটা করছে, ঠিক যেন উত্তাল সমুদ্রের ঢেউ।
‘লজ্জা পেলে তোমাকে অনেক কিউট লাগে অধরা। গাল দুটো গোলাপি হয়ে যায়, কান লাল হয়ে আসে, আর চোখ মুখে লাজুকতা এসে ভর করে তোমার। এতো মায়াবী কেনো তুমি?’
মুহূর্তেই এক শীতল হাওয়া বেয়ে যায় অধরার পুরো রম্ভে রম্ভে। আশ্বিনের থেকে চোখ সরিয়ে রেখেছে সে, তবুও অস্বস্তি ভাব যেন বেড়েই চলেছে তার।
আড়চোখে একবার তাকাতেই আশ্বিনের সাথে চোখ মিলে যেতেই উঠে যেতে নেয় অধরা। তখনই হাত ধরে আটকে নেয় আশ্বিন। ধীরে পায়ে এসে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে তাকে।

‘আকাশের ওই চাঁদ কি আমার অধরার থেকেও সুন্দর? বাগানে ফোঁটা লাল গোলাপ ফুলটি কি তোমার থেকেও সুন্দর?’
জবাব দেয় না অধরা। আশ্বিন ধ্যান ছাড়া হয়ে অধরার খোলা চুলের ঘ্রাণ নিতে থাকে। মুহূর্তেই কেঁপে উঠে অধরা। পেটের ভেতর মোচর দিয়ে উঠছে তার। আর বেশিক্ষণ এখানে থাকলে কখন যেন জ্ঞান হারায় সে।
তাই একটি দীর্ঘশ্বাস নিয়ে এক ঝাকটায় দূরে সরে যায় অধরা। ঘোর থেকে বেরিয়ে আসে আশ্বিন।
নিজেকে সামলে নিয়ে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকা দুজন।

‘সব দোকান তো বন্ধ। আপনি বলেছিলেন আমায় আইসক্রিম খাওয়াবেন।’
‘হুম, বাসার সামনের দোকান থেকে কিনে দিতে হবে।’
একটা ভেংচি কাঁটে অধরা। এই সুন্দর মুহূর্ত ফেলে মহাশয় বাসায় যাওয়ার পথে আইসক্রিম কিনবেন? হঠাত তার মনে আসে আরশির কথা। আরশি বলেছিলো সব ব্যবস্থা করা আছে এখানে।
‘চলুন। সামনে একটু হেঁটে আসি। তারপর নাহয় ফিরে যাবো।’
রাজি হয়ে অধরার পাশাপাশি যেতে থাকে আশ্বিন।

–চলবে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here