#আমার_হিয়ার_মাঝে
লেখিকা: তাহসীন নাওয়ার রীতি
পর্ব:১৫
দুপুরের খাবারের পর থেকে ঘুমিয়ে আছে আশ্বিন। হুট করেই জ্বর বেড়ে আসায় কিছুক্ষণ আগেই ঔষধ খেয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে সে।
এদিকে, আশ্বিনের পাশে পড়ার টেবিলে বসে অধরা বই খাতা নিয়ে পড়ছে। না চাইতেও অজান্তেই তার চোখ চলে যাচ্ছে ঘুমন্ত আশ্বিনের মুখ পানে। কি স্নিগ্ধ লাগছে মহাশয়কে! বাতাসে সিল্কি চুলগুলো কপালের উপর পড়ে আছে। কাপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমে আছে, হয়তো ঔষধের প্রভাবে জ্বর কমে আসছে তাই।
‘মামি, টিভি দেখবে? শাহরুখ খানের সিনেমা হচ্ছে, চলো দেখি।’
টুসির কথায় অধরা আশ্বিনের থেকে মুখ ফিরিয়ে টুসির দিকে ফিরে তাকায়। ছোট ছোট দুটো বেণী করা চুল, হাসি মাখা মায়াবী মুখশ্রী!
‘টুসি বাবু, আমার পড়াটা শেষ করে নেই, তারপর দেখবো। ঠিক আছে?’
‘আচ্ছা।’
দৌড়ে চলে যায় টুসি। খালার সাথে বসে প্রতিদিন বিকেলে সিনেমা দেখা তাদের অভ্যাস। ইদানিং অধরাকেও তাদের দলে যোগ দিতে চাইছে দুজন। ব্যাপারটা ভালো লাগে তার। মুচকি হেসে পড়ায় মনোযোগ দেয় সে।
টিভির ঘর থেকে ভেসে আসছে সিনেমার কতো সব ডায়লগ। অধরা ফিরে তাকায় আশ্বিনের দিকে। দুদিন ধরে মহাশয় হঠাত যেন প্রেমিক পুরুষ হয়ে গিয়েছেন। পুরনো আশ্বিনের সাথে উনার কোন মিল খুঁজে পাচ্ছে না অধরা। কেননা, সে যে আশ্বিন চিনতো সে আশ্বিন অত্যন্ত লাজুক প্রকৃতির ছিলো। আর এখন হয়েছে ঠোঁট কা/টা স্বভাবের। হুটহাট কি সব কথা বলে অধরাকে লজ্জায় ফেলে দেয় এই মহাশয়।
ঘুমন্ত আশ্বিনের দিকে তাকিয়ে অজান্তেই হেসে উঠে সে। পরমূহুর্তে নিজেকে সামলে নিয়ে মনোযোগ দেয় পড়ায়।
ঘড়ির কাঁটায় চারটা বিশ।
অধরা যোগ দিয়েছে খালা আর টুসির সাথে সিনেমা দেখতে। হঠাত কলিং বেল বেজে উঠায় টুসি দৌড়ে চলে যায় গেইট খুলতে। দরজার অপর প্রান্তে দাড়িয়ে আছে একজন সুন্দরী রমণী, চোখে কালো সানগ্লাস।
‘কাকে চাই?’
‘আশ্বিন বাসায় আছে? আমি আশ্বিনের সাথে দেখা করতে এসেছি।’
‘মামা অসুস্থ, এখন ঘুমায়। দেখা করা যাবে না।’
বিরক্ত বোধ করলো মেয়েটি, তার চোখ মুখে ফুটে উঠলো সেই বিরক্তির ছাপ। টুসিকে ঠেলে ঢুকে পরে বাসার ভেতর। হতভম্ব টুসি। মেয়েটির পিছু পিছু যেতে যেতে অধরাকে ডাকতে শুরু করে সে।
‘কি হয়েছে টুসি?’
অধরার কণ্ঠ শুনে মেয়েটি অবাক হয়ে তার দিকে ফিরে তাকায়। অধরার চোখেও বিস্ময়!
‘মারিয়া আপু?’
‘অধরা!’
‘আপনি এখানে? হঠাত?’
‘প্রশ্নটা কি আমার করা উচিত ছিল না? তুমি এখানে কি করছো?’
একটা তাচ্ছিল্যের হাসি দেয় অধরা। মারিয়া তাহলে এখনো জানে না তার আর আশ্বিনের বিয়ের খবর।
‘মামি এখানে থাকবে না তো কই থাকবে? মামা যেখানে মামিও সেখানে।’
ভ্রু কুঁচকে মারিয়া ফিরে তাকায় টুসির দিকে। কোমরে হাত রেখে রাগি রাগি ভাবে তাকিয়ে আছে পিচ্চি মেয়েটি।
‘হোয়াট? কি বললে তুমি?’
‘টুসির কথার অর্থ হলো, বিয়ের পর সকল স্ত্রী তাদের স্বামীর বাসায় থাকে। আমিও তাদের মতোই একজন।’
অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে মারিয়া। কি বললো এটা অধরা? তার মানে..?
‘আশ্বিনের সাথে তোমার বিয়ে হয়েছে?’
মাথা নেড়ে সম্মতি জানায় অধরা। তেলে বেগুনে জ্বলে উঠলো মারিয়া।
‘এতো কিছুর পর তুমি কিভাবে আশ্বিনকে বিয়ে করলে? আবারও ফাঁ/সি/য়ে/ছো আশ্বিনকে?’
হেসে উঠে অধরা। রাশেদা খালা আর টুসি চুপচাপ দাঁড়িয়ে তাদের কথা শুনতে ব্যস্ত।
‘ফাঁ/সা/নো কাকে বলে মারিয়া আপু? আমার নামে মিথ্যা অভিযোগ দিয়ে আমার থেকে আশ্বিনকে দূরে সরিয়ে দেওয়ার প্ল্যান কি আপনার ছিলো না? আপনি মিথ্যা দিয়ে আশ্বিনকে জয় করতে চেয়েছিলেন। ফল স্বরূপ আজ আমি উনার স্ত্রী, আপনি নয়।’
রেগে যায় মারিয়া। মুহূর্তেই অধরার উপর চিৎকার চেঁচামেচি করতে শুরু করে সে।
‘কি হয়েছে? এতো শব্দ কিসের?’
ড্রইং রুম থেকে শব্দ শুনে আশ্বিনের ঘুম ভেঙে যায়। জ্বরের জন্য এমনিতেই তার মাথা ব্যাথা, তার উপর এই শব্দ! তাই বাধ্য হয়ে উঠে আসে এ রুমে। কিন্তু এখানে এসে যে মারিয়াকে দেখবে তা স্বপ্নেও ভাবতে পারেনি আশ্বিন।
‘মারিয়া, তুমি এখানে?’
মারিয়া দৌড়ে ছুটে আসে আশ্বিনের কাছে। অধরার চাহনি স্থির, স্বাভাবিক।
‘আমি তোমার হাসপাতালে গিয়েছিলাম আশ্বিন। তোমাকে না পেয়ে রোদ্দুরকে পেয়েছি। তার কাছে শুনলাম তুমি নাকি অসুস্থ, তাই ঠিকানা নিয়ে দেখতে চলে এসেছি।’
হতভম্ব আশ্বিন। রোদ্দুর মারিয়াকে তার বাসার ঠিকানা দিয়ে দিলো? আর সেই বা কেনো তাকে খোঁজার জন্য হাসপাতালে গিয়েছে?
‘আমি ঠিক আছি মারিয়া। সামান্য একটু জ্বর। ঠিক হয়ে যাবে।’
‘দেখি তো কতো জ্বর..।’
কথাটা বলেই আশ্বিনের কপালে হাত দেয় মারিয়া। মুহূর্তেই দু’পা পিছিয়ে যায় আশ্বিন। অধরার দিকে একবার তাকিয়ে দেখে সে কড়া চাহনিতে তাকিয়ে আছে তার দিকে।
‘আশ্বিন, অধরা এখানে কি করছে? তুমি সত্যিই তাকে বিয়ে করেছো? এতকিছুর পরেও তুমি কিভাবে…?’
‘মারিয়া, তুমি জানো আমি একটা মিথ্যার ভিত্তিতে এতোদিন অধরাকে দোষারোপ করেছি। অধরা যে দোষী নয়, এটা বুঝতে আমার অনেকটা দেরি হয়েছে। তাই পুরনো কথাগুলো আমি তুলতে চাইছি না এখন।’
‘কিন্তু তুমি তো বলেছিলে তোমার বিয়ে পারিবারিক ভাবে, হুট করেই হয়েছে। তুমি এই বিষয়ে আগে কিছুই জানতে না।’
‘আমি সত্যিই জানতাম না বিয়ের কথা। অধরার সাথে যে বিয়ে হচ্ছে আমি এটাও জানতাম না। অধরা আমার মায়ের সবচেয়ে কাছের বান্ধবীর মেয়ে। দুই মায়ের ইচ্ছে অনুযায়ী হয়েছে এই বিয়ে।’
থমকে যায় মারিয়া। মাথা ঘুরছে তার। একটু হেটে গিয়ে পাশের সোফায় বসে পড়ে সে। অধরা নির্বিকার ভাবে দাঁড়িয়ে আছে সামনে। দুজনের কথা বার্তার ধরণ যেন গভীর ভাবে লক্ষ্য করে চলেছে সে।
‘এই নেন খালা, এক গ্লাস পানি খাইয়া নেন। অনেক তো কা/ই/জ্জা করছেন, গলা শুকিয়ে গেছে নিশ্চয়ই।’
আচমকা টুসি এক গ্লাস পানি এগিয়ে দেয় মারিয়ার দিকে। টুসির কথায় ফিক করে হেসে ওঠে অধরা। মুহূর্তেই রেগে উঠে মারিয়া। এক ধাক্কা দিয়ে গ্লাস ছুড়ে ফেলে বেরিয়ে যায় বাসা থেকে।
অধরা মুচকি হেসে তাকিয়ে থাকে তার যাওয়ার দিকে।
‘গ্লাসটা ভাঙলো কেন? পানিই তো দিয়েছিলাম আমি।’
অধরা উত্তর না দিয়ে টুসির মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়।
—————-
কলেজ ক্যাম্পাসের মাঠে গোল হয়ে বসে আছে অধরা আর তার বন্ধুমহল। গতকাল মারিয়ার কথা তাদের বলার পর সবাই মিলে একদফা ঝেড়ে দিচ্ছে মারিয়াকে।
‘এই মেয়ে কি আর শান্তি দিবে না তোকে? আর কতো ঝামেলা করতে চাইছে সে?’
‘জানি না ইশা। তবে এতোদিন পর যেহেতু সে জানতে পেরেছে আমাদের বিয়ের কথা, একটা কিছু তো সে করবেই।’
‘একদম চিন্তা করবি না তুই। আমরা আছি তোর পাশে। তাছাড়া এবার আমাদের আর কোন পিছুটান নেই, তাই মারিয়ার উপর কোন ভয় নেই।’
অনিকের কথায় অধরা মাথা নেড়ে হ্যা বোঝায়। সবাই যখন চুপ হয়ে যায় তখন সাদমান দৌড়ে এসে তাদের পাশে বসে পড়ে।
‘এই খবর শুনেছিস? আমাদের ফিল্ড ওয়ার্কের জন্য হাসপাতাল সিলেক্ট করা হয়েছে। আগামী রবিবার থেকে ডিউটি।’
‘কোন হাসপাতাল?’
‘কোনটা আবার? প্রতিবার যেই হাসপাতাল দেওয়া হয়, সেটাই।’
‘বাহ! মারিয়া যেই হাসপাতালে আছে এখন ওই হাসপাতালে আমরাও ডিউটি করবো। ভালোই।’
ইশা আফসোস করে তাচ্ছিল্যের সাথে কথাটা বললো। জারিফ সম্মতি দেয় তার কথায়।
‘মারিয়ার ভয়ে আমরা পিছিয়ে থাকবো নাকি? তাছাড়া পড়ালেখার মাঝে ব্যক্তিগত কোন ব্যাপার নিয়ে আসবি না। তবে যত যাই হোক, মারিয়াকে এতো সহজে ছেড়ে দিচ্ছি না আমি। এর একটা হিসাব করা এখনও বাকি আছে।’
অধরা কথাগুলো বলেই সবার সাথে তার আগামী প্ল্যানের কথা তুলে ধরে। সবাই এতে সম্মতি জানায়। অতঃপর ক্লাসের উদ্দেশ্যে চলে যায় সবাই।
এদিকে,
রোদ্দুরের পিঠা ইতিমধ্যেই দুই ঘা বসিয়ে দিয়েছে আশ্বিন। গতকাল সে যদি মারিয়াকে তার বাসার ঠিকানা না দিতো তবে এতসব ঝামেলা হতো না।
কাল অধরা তার সাথে আর কোনরূপ কথা বলেনি। সেও আর আগ বাড়িয়ে কথা বলতে যায়নি।
‘রোদ তুই আমার বন্ধু নাকি শত্রু?’
‘আরে আশ্বিন থাম এখন। কখন থেকে আমাকে দোষ দিয়ে যাচ্ছিস। বুঝিস না কেনো, আমি পরিস্থিতির চাপে পড়ে তোর ঠিকানা তাকে দিয়েছি।’
‘পরিস্থিতি তোকে আমার বাসার ঠিকানাই দিতে বাধ্য করলো? তাকে অন্য ভাবে বুঝিয়ে তো বাসায় পাঠিয়ে দিতে পারতি।’
‘চেষ্টা করেছি তো। লাভ হয়নি। মারিয়া কারো কথা কখনো শুনেছে নাকি? পাক্কা দুই ঘন্টা ধরে কানের কাছে এমনভাবে ঘেণঘেণ করেছে যে মনে হচ্ছিল, এখনই একটা ইনজেকশন দিয়ে তাকে বেহুঁশ করে দেই। আর সবচেয়ে বড় কথা হলো, তার আচরণে নুরুল স্যার ভেবেই বসেছিলো মারিয়া আমার গার্লফেন্ড! কি সাংঘাতিক ব্যাপার!’
রোদ্দুরের কথায় হেসে উঠে আশ্বিন। বুঝতে আর বাকি নেই বেচারার উপর কাল অনেক চাপ গিয়েছে।
‘ঠিকই তো ভেবেছে। ভেবে দেখ রোদ, মারিয়া তোর গার্লফেন্ড হলে কিন্তু মন্দ হয় না।’
আঁতকে উঠে রোদ্দুর। এই ভয়াবহ মেয়ে হবে তার গার্লফেন্ড? অসম্ভব।
‘মাথা কি ঠিক আছে তোর আশ্বিন? ওই মেয়ের আশেপাশেও আমি না যাই। তাছাড়া আমার ভালোবাসার মানুষ আছে। আর সে হলো..।’
‘আমার ছোট বোন আরশি। জানি আমি।’
একসাথে হেসে উঠে দুজন।
আশ্বিনের মাথা ধরে আসছে চিন্তায়। এ কি বিপদে পড়লো সে। অধরার সাথে যতোই সে সম্পর্ক ঠিকঠাক করতে চাইছে, ততো বেশি করে ঝামেলা চলে আসছে তাদের মাঝে।
‘আশ্বিন এতো ভাবিস না তো। মারিয়া এখন কিছুই করতে পারবে না। আর করলেও ভয় নেই, আমরা এখন সবটা জানি।’
‘আমার মারিয়াকে নিয়ে যত না ভয় হচ্ছে তার থেকেও বেশি হচ্ছে অধরাকে নিয়ে। এই মেয়ে চুপচাপ বসে থাকার মেয়ে না রোদ। যেহেতু গতকাল মারিয়াকে সে কিছুই বলেনি তার মানে সামনে ভয়াবহ কোন চিন্তা ভাবনা আছে তার। হয়তো এখন বসে তার হিটলার বন্ধুদের মিলে কিসব প্ল্যান করতে ব্যস্ত সে।’
রোদ্দুর হেসে উঠে। অধরার চিন্তাধারা, কর্মকান্ড সব বুঝতে পারে আশ্বিন। এই দুইজনের জুটি অনেক ভালো লাগে তার। অনেকটা টক ঝাল মিষ্টির মতোই। আনমনে হেসে উঠে রোগী দেখার জন্য চলে যায় সে।
–চলবে(ইনশাআল্লাহ)
#আমার_হিয়ার_মাঝে
লেখিকা: তাহসীন নাওয়ার রীতি
পর্ব:১৬
পড়ন্ত বিকেল!
দুপুরের দিকে সূর্যের তেজ বেশি থাকলেও সময়ের সাথে সাথে তা কমে এসেছে। তাই বারান্দায় দোলনায় বসে আপনমনে বই পড়ছে অধরা।
আশ্বিন এখনও ফিরে আসেনি। টুসি বুড়িও দুপুরের খাবারের পর ঘুমিয়ে পড়েছে। ফলে কাজ না পেয়ে কিছুক্ষণ ফোনে আরশি আর আশ্বিনের মায়ের সাথে কথা বললো সে। অতঃপর পড়ার বই নিয়ে এসে বসলো তার শখের দোলনায়।
হঠাত নিচে গাড়ির শব্দ পেয়ে অধরা দোলনা থেকে উঠে গ্রিল দিয়ে নিচে তাকিয়ে দেখে আশ্বিন চলে এসেছে, সাথে রোদ্দুর। দৌড়ে বারান্দা থেকে বেরিয়ে রুমে চলে আসে সে। ইদানিং আশ্বিনের উপস্থিতি সে বুঝতে পারে। নিজের এমন কাজে নিজেই হতবাক হয় অধরা।
আশ্বিন আর রোদ্দুর এর মাঝেই উপরে চলে এসেছে। দরজার কাছে অধরা দাঁড়িয়ে ছিল তাদের অপেক্ষায়।
‘আরে অধরা, কেমন আছো? অনেক দিন পর আমার ছোট বোনটাকে দেখলাম।’
‘আমি ভালো আছি রোদ ভাইয়া। আপনার কি খবর? একবার তো খোঁজ খবর নিতেও প্রয়োজন মনে করলেন না।’
‘নতুন নতুন জয়েন করেছি, বুঝতেই তো পারছো কেমন ব্যস্ত থাকা হয়। তবুও আমার ভুল হয়েছে তোমার খোঁজ নেওয়া উচিত ছিল।’
মুচকি হেসে অধরা তাদের পিছু পিছু ড্রইং রুমে প্রবেশ করে। আশ্বিন এতোক্ষণ ধরে চুপচাপ তাদের কথা শুনছিল, এর মাঝেই তার চোখাচোখি হয়ে যায় অধরার সাথে।
রাগে একটা ভেংচি কাটে অধরা, আশ্বিন কপাল কুঁচকে ফেলে তা দেখে।
‘রোদ তুই থাক এখানে। আমি ফ্রেশ হয়ে আসছি।’
চলে যায় আশ্বিন। অধরা বসে থাকে রোদ্দুরের মুখোমুখি। টুকটাক গল্প করতে ব্যস্ত দুজন। রাশেদা খালাও এর মাঝে রোদ্দুরের খোঁজ খবর নিয়ে তার জন্য চা নাস্তার আয়োজন করতে গিয়েছেন।
‘অধরা, শুনেছি তুমি সেদিন আমার খোঁজ করতে হাসপাতাল গিয়েছিলে? কোন দরকার ছিল কি?’
চুপসে যায় অধরা। সে যে রোদ্দুরকে খোঁজার জন্য হাসপাতাল গিয়েছিল সেই খবর কি তবে আশ্বিন জানে গিয়েছে? সে যে আশ্বিনের অগোচরে ব্যাপারটা খোলাসা করতে চেয়েছিলো।
‘কোন বিশেষ প্রয়োজনে যাইনি, এমনি একটু কথা ছিলো আপনার সাথে।’
‘ওহ! আচ্ছা এখন বলো শুনি।’
কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে অধরা। আড়চোখে একনজর ফিরে তাকায় সে রুমের দিকে। আশ্বিন হয়তো শাওয়ার নিচ্ছেন। এই সুযোগে রোদ্দুরকে প্রশ্নগুলো করা মন্দ হবে না।
‘আসলে রোদ ভাইয়া, আমি আপনার কাছে সেদিনের কথা জানতে চেয়েছিলাম। আপনার আর রাফিন ভাইয়ার মাঝে কি হয়েছিলো সেদিন?’
চুপ হয়ে যায় রোদ্দুর। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে মুচকি হেসে বলে উঠে।
‘বাদ দাও না সেদিনের কথা অধরা। শুধু শুধু অতীত মনে করতে চাইছো কেনো?’
‘কারণ আমার সত্যিটা জানা দরকার।’
নির্বিকার ভাবে বসে আছে রোদ্দুর। সেদিনের কথা বলতে চাইছে না সে। কিন্তু অধরা নাছরবান্দা, সেভাবেই হোক তাকে সত্য জানতে হবে। যেই কারণে এতোগুলো মানুষ তাকে ভুল বুঝে গেলো সেই কারণ জানতে হবে তার।
‘সেদিন আমার আর রাফিনের মাঝে কথা কাটাকাটি হয়। এক পর্যায়ে রাফিন রেগে গিয়ে আমাকে আঘাত করে। তারপর তো সবটা তুমি জানোই।’
‘কি নিয়ে ঝগড়া শুরু হয় আপনাদের?’
‘আমি রাফিনকে…তোমার কথা জিজ্ঞেস করেছিলাম অধরা। কিন্তু রাফিন আমাকে কিছুই বলতে চাইছিলো না, উল্টো আমার উপর রাগ দেখাচ্ছিল। তার এমন আচরণে আমারও রাগ উঠে যায়। কথায় কথায় ঝগড়া শুরু হয়। তারপর..। আমি তো তখন জানতাম না যে রাফিন…।’
থেমে যায় রোদ্দুর। কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে থাকে সে। তারমানে তার কথার জের ধরেই দুজনের মাঝে ঝামেলা হয়েছিলো। আর মারিয়া এই সুযোগটা কাজে লাগিয়েছে।
‘আমাকে নিয়ে কি এমন কথা জিজ্ঞেস করেছিলেন ভাইয়া?’
থেমে যায় রোদ্দুর। চুপচাপ বসে হাতে থাকা চায়ের কাপে চুমুক দেয় সে। অধরাকে সত্য বলা যাবে না। বলা যাবে না যে সে আশ্বিনের জন্যই…।
‘তেমন গুরুত্বপূর্ণ কিছু না। এমনি জিজ্ঞেস করেছিলাম তোমার কথা।’
অধরা বুঝতে পারে রোদ্দুর তাকে সত্যটা বলতে চাইছে না। তবুও সে জোর করে জানতে চাইবে ঠিক তখনই আশ্বিন প্রবেশ করে। একটা কালো টিশার্ট পরে টাওয়াল দিয়ে মাথা মুছতে মুছতে এগিয়ে আসে সে।
‘কি নিয়ে কথা হচ্ছে?’
রোদ্দুর ফিরে তাকায় অধরার দিকে। অধরা পড়ে যায় বিপাকে। এখন যদি রোদ্দুর বলে দেয় আশ্বিনে?
‘খোঁজ খবর নিচ্ছিলাম আমার বোনের। আর, এতক্ষণ লাগে তোর? অপারেশন কেইস নিয়ে আলোচনা করবো বলেই তো এসেছি, এখন তুই দেরি করলে কিভাবে কি হবে?’
‘কোথায় দেরি করলাম? একটু তো শুধু শাওয়ার নিয়েছি। যাই হোক, আমি ফাইল নিয়ে আসছি।’
চলে যায় আশ্বিন। অধরাও উঠে দাঁড়ায়। রান্নাঘরে গিয়ে রাশেদা খালাকে কাজে সাহায্য করতে শুরু করে।
——————–
রাতের খাবারের পর রোদ্দুর চলে গিয়েছে। অধরা সবটা জানতে চেয়েও কিছু জানা হলো না তার। কিছু একটা তো গোপন করছে রোদ্দুর। কিন্তু কি? খাটের এক প্রান্তে এসে বসে কথাগুলো ভাবছে অধরা।
‘কি ভাবছো?’
পাশ ফিরে আশ্বিনের দিকে ফিরে দেখে অধরা। সে যে কখন এসে এখানে বসেছে সেই খেয়াল নেই তার।
‘কিছু না।’
‘শুনেছি তোমাদের নাকি রবিবার থেকে হাসপাতালে ফিল্ড ওয়ার্ক?’
মাথা নেড়ে হ্যা বোঝায় সে। আশ্বিন একনজর অধরার দিকে তাকিয়ে ফাইলগুলো আবারও দেখতে শুরু করে। অধরা চেয়ে আছে নির্বিকার ভাবে।
‘আশ্বিন, এতো কিছুর পরেও আপনি কিভাবে মারিয়া আপুর সাথে যোগাযোগ রেখেছেন?’
থমকে গিয়ে কাজ বন্ধ করে দেয় আশ্বিন। অধরার দিকে নিঃশব্দে তাকিয়ে থাকে শুধু।
‘আমি কখনোই মারিয়াকে পছন্দ করিনি অধরা, তুমি জানো ব্যাপারটা। এখনও চাই না সে আমার সাথে আর কোন যোগাযোগ রাখুক।’
‘কিন্তু আমি তো অন্য কিছু দেখতে পারছি আশ্বিন। আপনার মনে হচ্ছে না আপনি মারিয়া আপুকে ইদানিং অনেক বেশি প্রশ্রয় দিচ্ছেন?’
বিস্মিত ভাবে তাকিয়ে আছে আশ্বিন। মারিয়া যে তাকে মেডিকেল কলেজ থেকেই পছন্দ করে তার আশেপাশে ঘুরঘুর করতো, এ কথা তো অধরা জানে। এটাও জানে যে আশ্বিনের কখনও মারিয়াকে পছন্দ নয়। তবে এসব কথা কেন বলছে সে?
‘অধরা তুমি কি বলতে চাইছো?’
‘এটাই বলতে চাইছি যে, আমাকে নিয়ে এতসব মিথ্যে বলার পরেও আপনি কিভাবে এখনও মারিয়া আপুর সাথে যোগাযোগ রাখতে পারেন?’
‘আমি চাইনি তার সাথে কোন যোগাযোগ করতে। সে নিজ থেকেই এসেছে। তাছাড়া, মারিয়া নিজেও তো না জেনে তোমার নামে কথাগুলো বলেছিলো। সে তো আর রাফিনের বিষয়টা জানতো না। এখানে তার কোন দোষ নেই, আসল দোষটা আমার ছিল। আর কেউ না হোক, আমি তো জানতাম তুমি কেমন মেয়ে। আমি কিভাবে তোমার নামে মিথ্যেগুলো সেদিন বিশ্বাস করলাম!’
কথাগুলো বলে আশ্বিন চলে যেতে নিতেই অধরার কথায় থেমে যায় সে।
‘আপনার কি সত্যিই মনে হয় মারিয়া আপু ইচ্ছে করে কোন কিছু করেনি?’
ফিরে তাকায় আশ্বিন। কি বলতে চাইছে অধরা?
‘মানে?’
‘যে মেয়ে সবার অগোচরে গোপনে আমার আর রাফিন ভাইয়ার মাঝে সকল বিষয়ের তথ্য সংগ্রহ করেছে। কোনদিন রাফিন ভাইয়ার সাথে আমি কোথায় গিয়েছি, কোন রেস্টুরেন্টে বসে কফি খেয়েছি, দুজন কবে সেইম কালার ড্রেস পড়েছি সব খবর উনার কাছে ছিলো। অথচ আপনার মনে হচ্ছে সেই মেয়ে রাফিন ভাইয়ার অসুস্থতার ব্যাপারে কিছুই জানে না?’
চুপ হয়ে থাকে আশ্বিন। মিথ্যা বলছে না অধরা। সত্যিই তো মারিয়া যেখানে সব তথ্য সংগ্রহ করতে পেরেছে সেখানে একটা ছোট বিষয়ে সে অবগত নয় সেটা বিশ্বাস করা বোকামি। অধরা উঠে দাঁড়িয়ে একনজর আশ্বিনের দিকে তাকিয়ে চলে যায়। আশ্বিন নিরবে তাকিয়ে থাকে তার যাওয়ার পানে।
—————
আজ রবিবার,
হাসপাতালের সামনে অধরাকে পৌঁছে দিতে এসেছে আশ্বিন। আজ তার প্রথম ডিউটি, তাই দিনটি যেন ভালো ভাবে সম্পন্ন হয় সেই জন্য অধরাকে শুভকামনা জানিয়েছে দু পরিবারের সবাই।
‘বেস্ট অফ লাক অধরা। জানি তুমি সব ঠিকঠাক ভাবে সামলে নিতে পারবে। তবুও কোন প্রয়োজন হলে আমাকে ফোন করো।’
‘ঠিক আছে।’
গাড়ি থেকে নেমে যায় অধরা। ধীর পায়ে হেঁটে এগিয়ে যেতে থাকে সে। মনে মনে খুব করে চাইছে আশ্বিন তাকে একবার ডাকুক। কিন্তু কেনো এমন চাইছে জানা নেই তার।
‘অধরা!’
থমকে যায় সে। নিঃশ্বাস ভারি হয়ে আসছে তার, হৃৎস্পন্দন বেড়ে চলেছে ক্রমান্বয়ে। ফিরে তাকায় সে পেছনে। আশ্বিন চলে এসেছে তার খুব কাছাকাছি। আচমকা কি জেনো হলো?
অধরা নিজেকে আবিষ্কার করলো আশ্বিনের বাহুজোরে। শক্ত করে নিজের বুকের মাঝে আকড়ে রেখেছে তাকে আশ্বিন। অধরা স্তব্ধ, হতভম্ব! এই প্রথম আশ্বিন তাকে জড়িয়ে নিয়েছে বুকে। থমকে গিয়েছে পুরো পৃথিবী।
‘আ..আশ্বিন!’
কম্পিত কণ্ঠে কথাটা বলতেই ছেড়ে দেয় সে। অধরার দুগালে হাত রেখে চোখের দিকে ফিরে তাকায়।
‘সাবধানে থেকো অধরা।’
চলে যায় আশ্বিন। আর যাওয়ার আগে রেখে যায় অধরার কপালে আলতো ঠোঁটের ছোঁয়া। পলকহীন ভাবে তাকিয়ে থাকে অধরা তার যাওয়ার পথে।
–চলবে।