#আমার_হিয়ার_মাঝে
লেখিকা: তাহসীন নাওয়ার রীতি
পর্ব:১১
অতীতে,
লাইব্রেরি রুমে বসে নিজের বইয়ে মুখ গুঁজে আছে আশ্বিন। পাশে বসে রোদ্দুর বই সামনে নিয়ে ফোনের মাঝে ব্যাস্ত। আড়চোখে দুবার রোদ্দুরের গতিবিধি লক্ষ্য করে একটি দীর্ঘশ্বাস ফেললো সে। ইদানিং কোন কাজেই কিছু ভালো লাগছে না আশ্বিনের। জ্বরের জন্য অধরা ময়মনসিংহ গিয়েছে আজ পাঁচদিন। এই কদিনের মাঝেই নিজেকে একা মনে হচ্ছে তার, যেন চারদিক বিরাজ করছে অদৃশ্য শূন্যতা।
লাইব্রেরিতে আশ্বিনের পিছনের সারিতে বসে আছে মারিয়া। আশ্বিনকে শুনিয়ে তার বান্ধবীর সাথে গল্প করতে ব্যস্ত সে। রোদ্দুর এতে চরম বিরক্ত, তবে আশ্বিনের কোন প্রতিক্রিয়া নেই।
‘এই মারিয়া মেয়েটা তোর কপালেই কেনো এসে জুটলো বল তো? আর কি ছেলে ছিলো না ক্যাম্পাসে?’
‘তাকেই জিজ্ঞেস করে আয়। আমি কি করে উত্তর দিবো?’
রাগ হলো রোদ্দুরের। আশ্বিন একে সহ্য করে কীভাবে? কেনোই বা করে? সরাসরি নিষেধ করে দিলেই তো পারে, তবে কেনো করছে না সে?
‘তুই মারিয়াকে কেনো নিষেধ করছিস না যেনো তোকে বিরক্ত না করে?’
‘তোর মনে হয়, বললেও কোন লাভ হবে? তাছাড়া, তার সাথে কথা বলার কোন ইচ্ছে আমার নেই।’
হতাশা আর বিরক্তি এসে গ্রাস করছে রোদ্দুরের। মারিয়া করার ফাঁকে বারবার এদিকে ফিরে তাকানো, মুচকি হাসি কোনটাই সহ্য হচ্ছে না তার। এ যে কোন বিপদ এসে পড়লো তার বন্ধুর!
বইয়ের মাঝে মনোযোগ দিয়ে আছে আশ্বিন। হঠাত এক অদ্ভুত অনুভূতি হয় তার। বুকের ভেতর অকারণেই ধুক করে উঠলো। চমকে উঠে আশ্বিন, হঠাত কি হলো তার!
কেমন এক পরিচিত অনুভূতি মনের কোণে এসে হানি দিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু কি?
‘অধরা এসেছে রোদ।’
‘কি বললি? অধরা..? গতকাল না সে নিজেই তোকে ফোনে বললো সুস্থ হলে রবিবার আসবে। তাহলে এখন কি বলছিস এসব?’
থেমে যায় আশ্বিন। ঠিকই বলেছে রোদ্দুর, অধরা নিজেই তাকে বলেছে তার দেরিতে ফিরে আসার খবর। তবে হঠাত এমন কেনো মনে হচ্ছে তার? নিজের অনুভূতিতে আজ নিজেই হতবাক আশ্বিন।
‘জানি না। কেনো জানি মনে হচ্ছে অধরা এসেছে ক্যাম্পাসে।’
‘আরে অধরা কীভাবে আসবে? সে তো ময়মন..।’
আর বলা হয়নি রোদ্দুরের। লাইব্রেরির দরজার দিকে তাকিয়ে থমকে যায় সে। অবাকতার শীর্ষে পৌঁছে মুখ নিজের অজান্তেই হা হয়ে গিয়েছে তার। আর আশ্বিন নির্লিপ্ত ভাবে তাকিয়ে আছে রোদ্দুরের মুখ পানে। অথচ একবারও ফিরে তাকায়ই সে।
‘আশ্বিন ভাইয়া..!’
বুকের ভেতর মোচর দিয়ে উঠে আশ্বিনের, মুহুর্তেই বেড়ে যায় হৃৎস্পন্দন। অধরা এসেছে! সে সত্যিই এসেছে, ঠিক যেমনটা তার মনে হয়েছিলো! কিন্তু এ কি করে সম্ভব?
কোন প্রতিক্রিয়া না করে মাথা নিচু করে বইয়ের দিকে ফিরে তাকায় আশ্বিন। এতক্ষণে অধরা দৌড়ে এসে বসেছে আশ্বিনের পাশ বরাবর।
‘সারপ্রাইজ..! আমি চলে এসেছি।’
খুশিতে হাসি হাসি মুখে কথাগুলো বলে সামনে ফিরে তাকায় অধরা। হতভম্ব রোদ্দুর এখনও হা করেই তাকিয়ে আছে তার পানে। আশ্বিনও বসে আছে কোন প্রতিউত্তর না করে। মুহূর্তেই হাসি মিলিয়ে যায় তার।
‘কি হয়েছে? ক্যাম্পাসে কিছু হয়েছে?’
জবাবের উদ্দেশ্যে ফিরে তাকায় সে আশ্বিনের দিকে। আশ্বিন একটা ছোট নিঃশ্বাস ফেলে অধরার গালে আলতো করে হাত রেখে,
‘ক্যাম্পাসে কিছু হয়নি, সব ঠিকঠাক আছে। তোমার জ্বর এখনও আছে, তাহলে ফিরে এসেছো কেনো?’
‘আম্মু বলেছিলো সুস্থ হয়ে আসার জন্য। কিন্তু বাসায় একা একা বিরক্তি এসে ভর করছিলো আমায়। তাই আজই সকালের বাসেই চলে এসেছি। খুশি হননি?’
আর কথা বাড়ায় না আশ্বিন। কি বলবে সে, উত্তর দেয়ার জন্য ভাষা তার জানা নেই। কিন্তু তাই বলে চুপ নেই অধরা। সে মুখ ঘুরিয়ে ফিরে তাকায় রোদ্দুরের দিকে।
‘রোদ ভাইয়া, মুখ বন্ধ করুন। কখন জানি মশা মাছি ঢুকে যায়। আর, কি দেখে এতো অবাক হয়েছেন?’
নিজেকে সামলে নেয় রোদ। প্রশ্নবিদ্ধ চোখে ফিরে তাকায় সে আশ্বিনের দিকে। আশ্বিন নতজানু হয়ে আছে, রোদ্দুরের প্রশ্নের জবাব তার নেই। সে তো নিজেই হতভম্ব!
————–
ক্লাস শেষে অধরা তার বন্ধুমহলকে বিদায় জানিয়ে চলে এসেছে আশ্বিনের সাথে দেখা করতে। আজ সকাল থেকেই আকাশ মেঘলা। ঠান্ডা বাতাস বয়ে যাচ্ছে থেমে থেমে। এমন একটি দিনেই ঘুরতে যাওয়ার অনেক ইচ্ছে অধরার।
‘আশ্বিন ভাইয়া, ঘুরতে যাবেন?’
‘কিহ? মাথা ঠিক আছে তোমার? আকাশের অবস্থা দেখেছো? যে কোন সময় বৃষ্টি শুরু হবে।’
‘তো কি হয়েছে? চলুন লেকের ধারে ওই পার্কে যাই, বেশি দূর না যেতে।’
‘অধরা..বৃষ্টি শুরু হবে। হোস্টেল ফিরে যাও।’
ভেংচি কাটে অধরা। এতো সুন্দর একটা আবহাওয়া, আর সে কিনা হোস্টেলে ফিরে যাবে? অসম্ভব। রাগে অভিমানে কোন কথা না বাড়িয়ে সে একাই যেতে শুরু করে। আশ্বিন ভ্রু কুঁচকে তাকায়।
‘কোথায় যাচ্ছো?’
অধরা নির্লিপ্ত ভাবে পিছনে ফিরে তাকিয়ে,
‘যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে, তবে একলা চলো রে।’
আবারো যেতে শুরু করে অধরা। হতভম্ব আশ্বিন! সে কি তবে একাই যাচ্ছে নাকি? এতো জেদী কেনো মেয়েটা? বাধ্য হয়ে পিছু নেয় সেও।
লেকের ধারে পার্কের একটি ছোট্ট বেঞ্চে পাশাপাশি বসে আছে দুজন। চারদিকে বাতাস খেলে যাচ্ছে, এলোমেলো করে দিচ্ছে অধরার খোলা চুল। গুণ গুণ করে গান গেয়ে যাচ্ছে সে। আশ্বিন পর্যবেক্ষণ করছে আশেপাশের পরিবেশটা। খোলামেলা, গাছপালা ঘেরা সুন্দর একটি জায়গা, আগে কখনো আসা হয়নি তার। অথচ অধরা নাকি প্রায়ই চলে আসে এখানে। থেমে থেমে শোনা যাচ্ছে মেঘেদের মৃদু গর্জন।
‘হয়েছে অনেক ঘুরাঘুরি। এখন চলো ফিরে যাই।’
বিরক্ত হয় অধরা। একটা মানুষ এতটা পানসে কীভাবে হতে পারে? এত সুন্দর একটা মুহূর্ত ফেলে উনি কি না বাড়ি ফিরে পড়তে বসবেন?
‘আপনার সমস্যা কোথায় আশ্বিন ভাইয়া?’
‘কি বললা? আমার আবার কিসের সমস্যা হবে?’
‘সমস্যা না হলে এভাবে চিংড়ি মাছের মতো লাফালাফি করছেন কেনো? শান্ত হয়ে বসে থাকুন।’
অধরার ধমক খেয়ে আশ্বিন স্তব্ধ। এই মেয়ে তাকে বকলো? পর মুহূর্তে নিজেকে সামলে নেয় আশ্বিন। এ যে বাকি সব মেয়ে নয়, অধরা।
‘বেশি কথা না বলে ভালো করে গলায় ওরনা পেঁচিয়ে নাও। নয়তো এই বাতাস আবারো গলা বসিয়ে দিবে তোমার।’
বাধ্য মেয়ের মতো অধরা গলায় ওরনা জড়িয়ে নেয়।
‘আশ্বিন ভাইয়া, একটা ছোট শ্বাস নিয়ে চোখ বন্ধ করে এই বাতাস উপভোগ করুন। ফিল করুন এই আবহাওয়াকে।’
আশ্বিন কিছুক্ষণ অধরার দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে তার কথা মতো চোখ বন্ধ করে। হিম শীতল এক ঠান্ডা বাতাস স্পর্শ করে যাচ্ছে তার শরীরে, প্রশান্তি এসে ভর করেছে তার মন। হেসে উঠে অধরা। চোখ বন্ধ করে আশ্বিন অনুভব করে অধরার খিলখিল হাসির শব্দ।
হঠাত শুরু হয় বর্ষণ। টিপ টিপ বৃষ্টি থেকে মুহূর্তেই এর বেগ বেড়ে যায়। চমকে উঠে চোখ মেলে তাকিয়ে পাশে অধরাকে দেখতে পায় সে। অধরা হাত মেলে যেন বৃষ্টিকে উপভোগ করতে ব্যস্ত।
‘আবারও জ্বর আসবে তোমার। চলো এখনই।’
গা থেকে একটানে সাদা এপ্রোন খুলে অধরার মাথার উপর ধরে তাকে নিয়ে ছুটে চলে রাস্তার ধারে। কিন্তু শেষ রক্ষা হয়নি, এর আগেই আকাশ ভেঙে শুরু হয় বৃষ্টি। শেষে বাধ্য হয়ে তাদের আশ্রয় নিতে হয় চায়ের টং দোকানটায়।
‘আরো জেদ করো, এখন তো খুব ভালো হয়েছে। আমার কথা কোনদিন শুনবে না তুমি।’
অপরাধীর মতো অধরা চোখ মুখ কালো করে দোকানের বেঞ্চে বসে পড়ে। তাকে সামলাতে গিয়ে যে নিজে ভিজে একাকার হয়েছে আশ্বিন মহাশয়। খারাপ লাগছে অধরার। আশেপাশে কোন রিকশা বা গাড়ি নেই। কীভাবে যাবে তারা? এদিকে বৃষ্টির বেগ বেড়েই চলেছে।
‘চা খাবে?’
বাধ্য মেয়ের মতো মাথা নেড়ে সম্মতি দেয় অধরা। আশ্বিন দৃষ্টি ফিরিয়ে নেয় তার থেকে। হালকা ভেজা চুলে মায়াবী লাগছে মেয়েটিকে।
‘মামা, দুটো লেবু চা..।’
নির্দেশ পেয়েই চা বানাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে চা দোকানের মামা। আজ দোকানে ভিড় নেই। মেঘলা দিন বলে হাতে গোনা দুচার জন যারা এসেছিলো, তারাও বৃষ্টি শুরুর আগে ফিরে গিয়েছে।
‘আপনেরা কি দুইজনেই ডাক্তার?’
‘জি, আমরা দুজন এখনও ডাক্তারি পড়ছি।’
‘ভালাই তো। ডাক্তার ডাক্তারে প্রেম!’
চমকে উঠে দুজন। উনি কি তাদের বাকিদের মতো কাপল মনে করছেন নাকি? অধরা তাকিয়ে আছে ভ্যাবাচ্যাকা দৃষ্টিতে। আশ্বিনের দৃষ্টি স্বাভাবিক।
আশ্চর্য ব্যাপার! মামার কথায় কোন প্রতিক্রিয়া করলো না দুজন, নীরবেই মেনে নিলো সবটা।
এর মাঝে তাদের হাতে চলে আসে গরম চায়ের কাপ। আশ্বিন মামার সাথে কথায় ব্যস্ত থেকে আনমনে চায়ের কাপে চুমুক দিচ্ছে। আর অধরা আপনমনে তাকিয়ে আছে আশ্বিনের দিকে। আচ্ছে সে এখানে আশ্বিনকে কোন নিয়ে আসলো? সে তো চাইলে ইশাকে নিয়েও আসতে পারতো। প্রশ্নটা নিদারুণ রহস্য জনক!
তখনই হঠাত বিকট শব্দে শুরু হয় বজ্রপাত। চমকে উঠে অধরা। এক লাফে গিয়ে বসে পড়ে আশ্বিনের পাশ বরাবর। হুট করে এমন কাজে ভড়কে যায় আশ্বিন। কিছু বলতে যাবে তার আগেই এক জোরে বজ্রপাতের শব্দে অধরা ভয়ে নিজের অজান্তেই আশ্বিনের হাত টেনে নিয়ে কামড়ে ধরে।
হতবাক হয়ে যায় আশ্বিন, মুহুর্তেই হাতে চিনচিন ব্যাথা অনুভব হয়।
‘আহ! অধরা হাত ছাড়ো আমার।’
কে শোনে কার কথা? অধরার থেকে নিজের হাত ছাড়াতে ব্যস্ত আশ্বিন। এ কোন রাক্ষস মেয়ে রে বাবা!
এদিকে, তাদের কাজে হেসে যাচ্ছে চা দোকানের মামা।
–চলবে(ইনশাআল্লাহ)
#আমার_হিয়ার_মাঝে
লেখিকা: তাহসীন নাওয়ার রীতি
পর্ব:১২
‘এক,দুই,তিন,চার,পাঁচ! মোট পাঁচ পাঁচটি দাঁতের ছাপ তোর হাতের উপর, তাও আবার মানুষের দাঁতের। আর তুই কিনা বলছিস এটা মশার কামড়!’
রোদ্দুরের থেকে নিজের হাত সরিয়ে আঁড়াল করে নেয় আশ্বিন। রা/ক্ষ/স মেয়ের জন্য আজ এসব কথা শুনতে হচ্ছে তার। কি দারুন লজ্জার ব্যাপার!
এদিকে, রোদ্দুর প্রশ্নের পর প্রশ্ন করেই চলেছে। রাগে দুঃখে বানিয়ে কোন মিথ্যাও বলতে পারছে না বেচারা।
‘আরে বললাম তো এটা মশার কামড়।’
‘বললেই হলো মশার কামড়? মেডিকেলে পড়ি আমি। মানুষের দাঁতের ছাপ আর মশার কামড়ে পার্থক্য চিনবো না নাকি? এতো বোকা ভেবেছিস আমাকে?’
দমে যায় আশ্বিন। অধরার কাজে এখন তাকে কীভাবে বিব্রত হতে হচ্ছে। মানছি বজ্রপাত ভয় পায়, তাই বলেই কি এমন কান্ড করতে হবে তাকে?
‘কি হলো? কথা বলিস না কেনো?’
‘না মানে..। আসলে, গতকাল টুসি হাতে কামড়ে দিয়েছে। বুঝিস তো, বাচ্চা মানুষ। কি আর করার?’
‘ওহ আচ্ছা টুসি দিয়েছে। আমি আরও ভাবলাম কি না কি..?’
হাসি চেপে রাখে রোদ্দুর। আশ্বিনের অবস্থা এখন দেখার মতো হয়ে আছে। রোদ্দুর ভালো করেই জানে আশ্বিন তাকে মিথ্যা বলছে। আঁড়ালে সে কোন কথা লুকিয়ে রেখেছে অবশ্যই।
মাঠে গোল হয়ে অধরা বসে আছে তার বন্ধুমহলের সাথে। অনেকদিন হল কোন বিনোদন করতে পারছে না তারা। হাসান স্যারের কড়া নির্দেশ আছে অধরার উপর। তাই বাধ্য হয়ে সবাই চুপচাপ আছে কিছুদিন। কিন্তু এভাবে আর কতদিন?
‘চল আশেপাশে কোথাও একটা ট্যুর দিয়ে আসি। এভাবে ভালো লাগছে না কিছুই।’
‘অনিকের কথায় আমিও একমত।’
ইশা আর অনিকের কথায় সম্মতি দেন জারিফ। কিন্তু সালমানের এতে আপত্তি রয়েছে।
‘এভাবে আমরা কয়জন মিলে আশেপাশে কোথায় আর যাবো? তারচেয়ে ভালো হবে আশ্বিন ভাই আর রোদ ভাইকে নিয়ে সবাই রাঙামাটি ঘুরে আসি। পাঁচদিনের ট্যুর হবে।’
‘ভালো বুদ্ধি।’
এতক্ষণ ধরে চুপচাপ বসে ছিল অধরা। কিন্তু এখন আর চুপ থাকতে পারলো না সে।
‘তোদের বলেছে ভালো বুদ্ধি? এই মুহূর্তে কোন ট্যুর সম্ভব না। সামনে পরীক্ষা, পড়ার প্রস্তুতি নে সবাই।’
অধরার কথায় তেলে বেগুণে জ্বলে উঠলো সবাই। এই মেয়ে সারাজীবন তাদের প্ল্যান নষ্ট করতে ব্যস্ত।
এবারেও তার উদ্দেশ্য তাই। তাই সবাই মিলে একদফা ঝাড়ি দিতে শুরু করে অধরাকে। রাগে অভিমানে অধরা নীরবে সবার থেকে উঠে গিয়ে আলাদা চলে যায়।
অধরার এভাবে চলে যাওয়ায় হতভম্ব সবাই। সে তো চুপ করে থাকার মেয়ে না। তবে কি কষ্ট পেয়েছে তাদের এরূপ আচরণে?
‘একটু বেশিই বলে ফেলেছি আমরা।’
ইশার কথার প্রতিউত্তর দেয়না কেউ। উঠে দাঁড়িয়ে অধরার খোঁজে চলে আসে সবাই।
ক্যান্টিনে একা একা বসে আছে অধরা। সামনে গরম গরম সিঙ্গারা আর চা। প্রিয় এই খাবারটিও খেতে ইচ্ছে হচ্ছে না তার। হঠাত করেই কেনো জানি মন খারাপ লাগছে। কিছুটা চিন্তিত সে। সকালের ব্যাপার নিয়ে।
‘এভাবে বসে আছো কেনো? কী হয়েছে?’
মাথা ঘুরিয়ে পিছু ফিরে তাকিয়ে আশ্বিনকে দেখতে পায় অধরা। পাশে দাঁড়িয়ে আছে রোদ্দুর।
‘কিছু হয়নি।’
আবারও সামনে ফিরে তাকায় সে। কপালে ভাঁজ পড়ে আশ্বিনের। অধরার উপস্থিতি অথচ এমন নিশ্চুপ পরিবেশ, যেনো বড় ঝড়ের পূর্বাভাস। আবারও কি কিছু করে বসলো অধরা? সর্বনাশ! হাসান স্যারকে তবে কি জবাব দিবে সে? চিন্তিত হয়ে রোদ সহ দুজন বসে পড়ে অধরার পাশে।
‘আবারো কোন অঘটন ঘটিয়ে এসেছো অধরা?’
নির্লিপ্ত ভাবে ফিরে তাকায় অধরা। এই চাহনি অন্যরকম। মুখ খানি তার মলিন।
‘কি হয়েছে বলো আমাকে?’
খানিক নিশ্চুপ ভাবে বসে থাকে অধরা। আশ্বিন তাকিয়ে আছে তার জবাবের অপেক্ষায়।
‘আশ্বিন ভাইয়া, আজ সকালে হোস্টেল থেকে কলেজ আসার সময়..।’
আর কিছু বলা হয়নি তার। বন্ধুমহল দৌড়ে এসে অধরাকে ঝাড়ি দিতে শুরু করে।
‘একটু কি কথা বলেছি, তাই বলে এভাবে রাগ দেখিয়ে চলে আসবি?’
‘আমাদের সাথেই খালি রাগ দেখাতে পারিস..।’
জারিফ সাদমান ইশা আর অনিক এসে বসে পড়ে তাদের পাশাপাশি। আশ্বিন আর রোদ্দুর কি হয়েছে জানতে চাইলে তারা অধরার অভিমানের কথা বলে। তাই তো অধরার সাথে কথা বলে ব্যাপারটা হালকা করতে চাইছে তারা।
অধরা নিশ্চুপ। মাঝে মাঝে দুচারটা প্রশ্নেরউত্তর দিচ্ছে শুধু।
আশ্বিনের কাছে কেনো যেনো মনে হচ্ছে আসল ঘটনা বন্ধুদের সাথে ট্যুর নিয়ে অভিমান নয়। সে যতদূর অধরাকে চিনতে পেরেছে, উনি এতো অল্পতেই রিয়েক্ট করার মতো কোন মেয়ে না। তবে কি হতে পারে? কেনো বললো হোস্টেল থেকে আসার পথে…?
ক্লাস শেষে লাইব্রেরি থেকে বেরিয়ে অধরা আর আশ্বিন যাচ্ছে অধরাকে হোস্টেল পর্যন্ত পৌঁছে দিতে। সকাল থেকেই অধরা আজ চুপচাপ। ব্যাপারটা ভালো লাগছে না আশ্বিনের। তাই মাঝপথেই হাঁটা থামিয়ে দেয় সে।
‘অধরা কি হয়েছে বলো তো আমায়?’
নীরব অধরা নতজানু হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তার দৃষ্টিতে স্পষ্ট ভীতির ছাপ।
‘আশ্বিন ভাইয়া, তিন দিন ধরে হোস্টেল থেকে কলেজ যাওয়ার পথে কারা যেন আমার পিছু নেয়। প্রথমে ভেবেছিলাম হয়তো আমার মনের ভুল। কিন্তু আজ আমি সরাসরি দেখেছি তাদের। আমাকে ধরতে চেয়েছিলো, কিন্তু আমি কোনরকম দৌড়ে পালিয়ে এসেছি।’
স্তব্ধ হয় আশ্বিন। কি বললো সে? মেয়েটির সাথে এতকিছু হয়ে গেলো অথচ এতক্ষণ ধরে কাউকে টু শব্দ করেও কিছু বললো না! অধরা নীরবে চোখ মুছে যাচ্ছে, ভয় পেয়েছে নিশ্চয়ই। মায়া হলো আশ্বিনের। নিজেকে যতোই বীর বাহাদুর ভাবুক না কেনো, এমন পরিস্থিতি যে কাউকে ভয় দেখাতে বাধ্য।
অধরাকে নিজের দিকে টেনে তার কাছে গিয়ে চোখ চোখ রাখে আশ্বিন। মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে শান্ত কণ্ঠস্বরে বলে উঠে,
‘কথাগুলো তোমার এতক্ষণ গোপন করা ঠিক হয়নি অধরা। যাই হোক, ভয় নেই। আমি দেখছি কি করা যায়, ইনশাআল্লাহ কাল থেকে আর কেউ তোমাকে বিরক্ত করবে না। তবুও সাবধানতার জন্য এখন থেকে ইশার সাথে কলেজে যাবে, একা বাহিরে থাকবে না। ঠিক আছে?’
মাথা নেড়ে হ্যা বোঝায় অধরা। ভীত বিড়াল ছানার ন্যায় গুটিসুটি মেরে দাঁড়িয়ে আছে সে। আশ্বিন তার ভরসার জন্য শক্ত করে তার হাত চেপে ধরে এগিয়ে যেতে থাকে।
শত প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে তার মস্তিষ্কে। অধরার পিছু করছে, কে হতে পারে? কি তার স্বার্থ? যদি অধরার ক্ষতি করার চিন্তাও করে থাকে তবে তার আর রক্ষে নেই। আশ্বিন যতোই শান্ত প্রকৃতির হোক না কেনো, অন্যায়ের প্রতিবাদ সে কঠোর ভাবেই করে, আর এই বিষয়ে তো তার অধরা জড়িত।
—————-
বর্তমানে,
অধরার ডাকে কল্পনা থেকে ফিরে আসে আশ্বিন। অনেক্ষণ ধরে দুজন বসে আছে পার্কের সেই বেঞ্চটায়। আকাশে মেঘ জমে আছে। দ্রুত বাড়ি ফিরে যাওয়া উচিত। তবুও ফিরে যাওয়ার আগে একটা কাজ না করলেই নয়।
‘চা দোকানের মামার সাথে দেখা করে যাই? অনেক দিন হলো যাওয়া হয়নি। আমাদের দেখলে খুশি হবেন উনি।’
মুচকি হেসে সম্মতি জানায় আশ্বিন। অধরার হাত ধরে হেঁটে যায় চা দোকানের দিকে।
রাত আটটা বেজে বিশ। পড়ার টেবিলে ঝিম মেরে বসে আছে অধরা। যেই উদ্দেশ্যে সে কলেজ থেকে বেরিয়ে এসেছিলো সেই আসল কাজ এখনও করা বাকি। খাটের উপর হেলান দিয়ে বসে ফাইলে কিসব দেখতে ব্যস্ত আশ্বিন। বাহিরে বৃষ্টি হচ্ছে, আবহাওয়া যেন শীত শীত অনুভূতি দিচ্ছে।
টুসি এসে এতক্ষণ অধরার সাথে গল্প গুজব করে গিয়েছে। তাই এখন একা একা লাগছে অধরার। আশ্বিনের দিকে কিছুক্ষণ এক ধ্যানে তাকিয়ে থাকে সে, বুঝে পায় না তার কপালেই কেন এই পানসে মহাশয় জুটলো? সে কি কম রোমান্টিক মেয়ে নাকি?
মাঝে মাঝে তো ভেবে বিশ্বাস হয় না, কিভাবে এই মানুষটিকে পাবার জন্য কতো সব আহাজারি করেছিল সে!
‘অধরা ছাদে যাবে?’
চমকে উঠে বই থেকে মুখ তুলে তাকালো অধরা। কানে কি ভুল শুনলো সে?
‘হ্যাঁ?’
‘চলো ছাদে যাই, বৃষ্টি বিলাস করে আসি।’
থমকে যায় অধরা। এ কিসব বলছে আশ্বিন? নিজ থেকেই বলছে তো নাকি?
‘বৃষ্টি ভিজে আপনার জ্বর আসবে না?’
‘আসবেই তো।’
‘তবে..?’
‘তখন হাসপাতাল থেকে কিছুদিন ছুটি নিয়ে বাসায় শুয়ে বসে আমার স্ত্রীর সেবা যত্ন নিবো।’
ভ্যাবাচেকা খায় অধরা? পাগল হয়ে গেলো নাকি
‘আশ্বিন, মাথা ঠিক আছে আপনার? পাগল হলেন?’
হেসে উঠে আশ্বিন। ফাইলগুলো গুছিয়ে রেখে উঠে এসে অধরার সামনে হাটু গেড়ে বসে পড়ে। অধরার হাত নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে নির্লিপ্ত ভাবে বলে উঠে।
‘আমি প্রেম নামক রোগে অসুস্থ, অধরা। এই রোগ সুস্থ স্বাভাবিক মানুষকে এক অদ্ভুত অনুভূতির মায়াজালে বেঁধে ফেলে তাদের পাগল করে দেয়। ডাক্তার এই রোগ ধরতে পারে না, তাই এর চিকিৎসা তাদের কাছে নেই। শুধুমাত্র অনুভূতি জরানো মানুষ এই রোগের চিকিৎসা পারে। জানো কীভাবে?’
উত্তর নেই অধরার। স্তব্ধ হয়ে বসে আছে সে। আশ্বিনের শীতল কণ্ঠস্বরে বলা কথা তাকে থমকে দিয়েছে। অনুভূতি খেলে যাচ্ছে তার রম্ভে রম্ভে। নির্বাক সে, হতভম্বও বটে। স্মিত হাসি দেয় আশ্বিন।
‘চলো। একদিনে বেশি কথা বললে মাথা গুলিয়ে ফেলবে তুমি। আবার আমাকে পানসে ভাবো, বোকা মেয়ে।’
–চলবে(ইনশাআল্লাহ)