#আমার_নিঠুর_মনোহর
#লেখিনীতে_জেনিফা_চৌধুরী
#পর্ব_তিন
বধূবরণের সময় চোখের সামনে নিজের স্বামীকে অন্য একটা মেয়ে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরে আছে__এমন দৃশ্য তারিনের মতো কিশোরি মনের মেয়ের পক্ষে সহ্য করা সম্ভব না। সারা শরীর একবার ঝাঁকুনি দিয়ে কেঁপে উঠল। তামজিদ একবার তারিনের দিকে আর একবার ওর বাবা মার দিকে তাকাচ্ছে। তারিনের অশ্রুসিক্ত চোখের দিকে তাকিয়ে তামজিদ উচ্চস্বরে বলে উঠল,
“দিশা! কি করছো? ছাড়ো আমাকে। এখানে বড়রা আছেন। আমার সম্মান নষ্ট করো না। ছাড়ো আমাকে।”
দিশাকে ছাড়ানোর চেষ্টা করল। কিন্তু পারলো না। দিশা কিছুতেই তামজিদকে ছাড়ছে না৷ বর্ষা বেগম এবার গর্জে উঠে বলে উঠলেন,
“তাজ, এই মেয়েকে এক্ষুনি তোর থেকে সরে আসতে বল। কী নির্লজ্জা মেয়ে!”
তার কথা শেষ হতে না হতেই আমজাদ সাহেব কঠোর কণ্ঠে বললেন,
“এই মেয়ে, যদি আমার ছেলের থেকে দূরে না আসো। তাহলে আমার থেকে খারাপ কেউ হবে না, বলে দিলাম।”
বর্ষা বেগম পুনরায় বললেন,
“ দেখছো না, তাজের পাশে ওর বিয়ে করা বউ দাঁড়িয়ে আছে? সব জেনে, বুঝে, দেখে, শুনে এতটা নির্লজ্জ হতে কি করে পারছো? পরিবার থেকে নূন্যতম শিক্ষাটুকু দেয়নি তোমাকে? এক্ষুনি সরে আসো, বলছি। আমাকে কঠিন হতে বাধ্য করো না।”
চারপাশের সবাই মিলে দিশাকে বকে যাচ্ছে। কিন্তু ওর সেদিকে কোনো ধ্যান নেই। ও তামজিদকে জড়িয়ে ধরেই বলতে লাগল,
“ছাড়বো না। কিছুতেই ছাড়বো না। আমার তাজ শুধু আমারেই থাকবে।”
বর্ষা বেগম এবার আর নিজেকে নিয়ন্ত্রণ কিরতে পারলেন না। রাগে ফোসফাস করে বললেন,
“তবে রে।”
বলেই তিনি এগিয়ে গেলেন সেদিকে। দিশাকে সরিয়ে আনার জন্য হাত বাড়াতেই কেউ একজন তার হাতটা ধরে ফেলল। বর্ষা বেগম অবাক হয়ে পাশে তাকাতেই দেখলেন তারিন তার হাতটা ধরে আছে। তারিনের মুখে আশ্চর্যজনক মিষ্টি হাসি। তা দেখে বর্ষা বেগম অবাক হলেন বটে। অবাক স্বরে জিজ্ঞেস করলেন,
“বউমা, তুমি আমার হাত ধরলে যে?”
তারিন সঙ্গে সঙ্গে হাস্যজ্বল স্বরে উত্তর দিলো,
“আম্মা, মাফ কইরেন এমনে হাত ধরলার লেইগ্যা। কিন্তু আমি থাকতে আপনে ক্যান কষ্ট করতে যাইবেন?”
উপস্থিত কেউ ওর কথা বুঝলো না। জিজ্ঞাসুক চোখে তাকিয়ে রয়েছে সবাই। তা দেখে তারিন পুনরায় বর্ষা বেগমের উদ্দেশ্য বলে উঠল,
“আম্মা, একটু সাইডে আহেন।”
বর্ষা বেগম খানিকটা সরে আসতেই তারিন গিয়ে দাঁড়াল তামজিদের মুখোমুখি। তামজিদের চোখে একবার চোখ রাখল। পরক্ষনেই দিশার হাতটা শক্ত করে ধরে ছিটকে সরিয়ে এনে, ধাক্কা মে’রে দূরে সরিয়ে দিলো। তারিনের এহেন কান্ডে সবার চক্ষু চড়ক গাছে। তামজিদের মুখ বিস্ময়ে হা হয়ে আছে। বর্ষা বেগম আর আমজাদ সাহেব চোখ বড় বড় তাকিয়ে আছে তারিনের দিকে। দিশা হঠাৎ এমন ধাক্কা সামলাতে না পেরে মুখ থুবড়ে গিয়ে আমজাদ সাহেবের পায়ের কাছে পড়ল। কিছু সেকেন্ডের ব্যবধানে ওর সাথে ঠিক কি হলো__এটা বুঝতে পারল না। দিশার মুখের অবস্থা দেখে বর্ষা বেগমের মুখে হাসি ফুটল। মনে মনে তারিনকে বেশ বাহবা দিলেন। তামজিদ দিশার দিকে এগিয়ে যাওয়ার জন্য পা বাড়াতেই তারিন হাত ধরে ফেলল। চোখের ইশারায় যেতে বারণ করল। তামজিদের গায়ের পাঞ্জাবিটা ঝাড়তে ঝাড়তে বলল,
“এখন আপনে বিবাহিত, মাস্টার মশাই। আপনের বউ আপনের সামনে দাঁড়াইয়া থাকাকালীন পরনারী আপনেরে সোহাগ কইরা ধইরা রাখব__এইডা আপনে কোনোদিন ভাইবেন না। তারিনের অধিকার তারিন খুব ভালা কইরা বুইজা লইতে পারে।”
দিশার এবার চৈতন্য কেটে গেলো। নিজেকে সামলে উঠে দাঁড়াল। তারিনের দিকে অগ্নি দৃষ্টিতে চেয়ে রাগে ফোসফাস করল কিছুসময়৷ অতঃপর এগিয়ে গেলো তারিনের দিকে। চিৎকার করে জিজ্ঞেস করল,
“আমার গায়ে হাত তোলার সাহস কে দিয়েছে তোমাকে?”
তারিন হাসল। জবাব দিলো,
“ছোড বেলার থেইকা আমার সাহসখানা বড্ড বেশি।”
দিশা আবার আগের থেকেও জোরে চেঁচিয়ে উঠে বলল,
“গাইয়া ভূত! তুমি আমার মুখে মুখে কথা বলছো? তোমাকে আমি…।”
বলেই তারিনকে থাপ্পড় দেওয়ার জন্য হাত উঠাতেই তারিন খপ করে হাতটা ধরে ফেলল। হুঁশিয়ারি বাক্যে বলে উঠল,
“আমার শরিলে হাত দেওনের মতো সাহস একদম কইরেন না, আফা।”
দিশা পুনরায় চিৎকার করে উঠল। তামজিদ চেয়ে দেখলো তারিন দিশার হাতটা মুচড়ে ধরে আছে। দিশা ব্যাথায় এবার কুঁকিয়ে উঠল। ব্যাথাতুর স্বরে বলল,
“এই মেয়ে আমার হাত ছাড়ো। আমার লাগছে।”
তারিন পাল্টা শব্দ না করে ছেড়ে দিলো। শান্ত হয়ে বলল,
“হুনেন শুহুরে আফা, বয়সে আপনে আমার থেইকা বড়। কিন্তু গায়ের জোরে না৷ আপনে আমার বড় বইলাই আজকা ছাড় পাইয়া গেলেন। নয়তো দেহাইয়া দিতাম, তারিন কি জিনিস?”
দিশা সহ প্রত্যেকে তারিনে কর্মকান্ডে ভারী অবাক। তামজিদ এতটাই বিস্মিত যে কথা বলার ভাষা খুঁজে পাচ্ছে না। তারিনকে ঠিক কি বলা উচিত এই মুহূরতেও খুঁজে পাচ্ছে না। তাই চুপ চাপ দাঁড়িয়ে থেকে তারিনকে দেখছে। বর্ষা বেগম আর আমজাদ সাহেবের মুখে তৃপ্তির হাসি। তারা যেন এমন কাউকেই এই মুহূর্তে আশা করেছিলেন৷ দিশা এবার তামজিদের কাছে গিয়ে বলে উঠল,
“তাজ, তোমার সামনে এই অশিক্ষিত, গাইয়া মেয়েটা আমাকে অপমান করছে__আর তুমি চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছো?”
তামজিদ এবার মুখ খুলল। প্রসঙ্গ এড়িয়ে শান্ত স্বরে বলতে লাগল,
“ তুমি না আমাকে ভালোবাসো? তাহলে আমাকে এমন একটা পরিস্থিতিতে ফেললে কি করে? সবার সামনে আমার সম্মান নষ্ট করলে কি করে? যেখানে তোমার আমার পাশে থাকার কথা ছিলো। আমাকে মেন্টার্লি সাপোর্ট করার কথা ছিলো। সেখানে তুমি আমার বাড়িতে এসে আমার ও আমার পরিবারের মানসম্মান ডুবিয়ে দিলে, দিশা? তোমার থেকে অন্তত আমি এমনটা আশা করেনি। যাইহোক, এসব কথা পরে হবে। আমার ঝামেলা ভালো লাগছে না আর। যদি নিজের বাকি সম্মানটুকু বাঁচাতে চাও। তাহলে এবার তুমি আসতে পারো।”
বলেই তামজিদ সেখানে আর এক মুহূর্ত দাঁড়ালো না। বড় বড় পা ফেলে ভেতরে চলে গেলো। দিশা তামজিদ পিছু ছুটে যাওয়ার জন্য পা বাড়াতেই তারিন ধরে ফেলল। বলল,
“কি কইলো হুনেন নাই? আপনে এইবার আইতে পারেন। দরজা খোলাই আছে।”
দিশা রাগে ফেটে পড়ে চিৎকার করে বলল,
“চুপ। একদম চুপ। অশিক্ষিত, গাইয়া ভূত একটা! একদম বাড়াবাড়ি করতে আসবে না আমার সাথে। ছোটলোক একটা। বড়লোকের ছেলে পেয়ে গলায় ঝুলে পড়েছো। আবার বড়বড় কথা বলতে এসেছো।”
তারিন দিশাকে থাপ্পড় মারার জন্য হাত এগিয়ে নিয়েও থেমে গেলো। দাঁতে দাঁত চেপে বলে উঠল,
“আপনি যদি আমার থেকে বয়সে অনেক বড় না হতেন, তাহলে আমার হাতের পাঁচটা আঙ্গুলের ছাপ আপনার গালে এঁটে দিতাম। কি বললেন, আমি অশিক্ষিত? হ্যাঁ, আমি অশিক্ষিত। সদ্য এস. এস.সি পাস করা মেয়ে যদি অশিক্ষিত হয়। তাহলে আমি অশিক্ষিত। অন্যের স্বামীর উপর ঢলে পড়ার মতো শিক্ষিত হতে চাইনা। আমি গ্রামের মেয়ে বলে ‘গাইয়া ভূত’ হয়ে গেলাম তাই না? ও’কে ফাইন, আমি গাইয়া ভূত। মরে যাওয়ার আগে অব্দি গাইয়া ভূতেই থাকবো। স্মার্ট মানে যদি হয় আপনার মতো নির্লজ্জ, বেহায়া। তাহলে আমি সেই স্মার্ট কোনোদিন হতে চাই না। আশা করি বুঝতে পারছেন। আপনাকে আজকে প্রথম ও শেষ বার সাবধান করে দিচ্ছি। আমার স্বামীর থেকে দূর থাকবেন। নয়তো দেখবেন তারিন কি চিজ? এখন আসতে পারেন। এমনিতেই আমি খুব টায়ার্ড। সারাদিন অনেক ধকল গেছে। আর পারছিনা। আপনি আসুন। আমাদের একটু শান্তি দিন।”
বলেই দিশার হাত ধরে দরজার বাইরে এক প্রকার ধাক্কা মে’রে ছেড়ে দরজাটা বন্ধ করে দিলো। জোরে হাঁফ ছাড়লো। মনে মনে বলল,
“তারিনের সাথে লাগতে আইলে এমন অবস্থাই হইব।”
#চলবে