আমার নিঠুর মনোহর পর্ব ২

0
55

#আমার_নিঠুর_মনোহর
#লেখিনীতে_জেনিফা_চৌধুরী
#পর্ব_দুই

“একজন শিক্ষক হইয়া নিজের ছাত্রীরে বিয়া করতে আইছেন ক্যামনে, মাস্টার মশাই? আপনের তে আমি কমপক্ষে ১৩ বছরের ছোট। আপনের কি বিবেক বুদ্ধি বলতে কিচ্ছু নাই? ক্যামনে রাজি হইলেন এই বিয়াতে? এখন সব জাইনাও আমারে এই বিয়া করার লাইগা জোর করতাছেন। তাও আমি সব মাইনা নিতাম যদি আপনের আমারে পছন্দ করতেন। কিন্তু আমি অবাক হইয়া গেলাম এইডা হুইনা যে, আপনে অন্য এক মাইয়ারে পছন্দ করেন। আবার আমারেও বিয়া করতে আইছেন। আল্লাহ গো! এক অঙ্গের কয়ডা রুপ আপনের? দুইডা মাইয়ার জীবন নষ্ট কইরা আপনে শান্তিতে থাকবেন, মাস্টার মশাই?”
তারিন পুরো দমে কথাগুলো বলে থামল। তামজিদ চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে আছে তারিনের দিকে। মেয়েটা যে বয়সের তুলনায় খুব বেশি ম্যাচুর সেটা আর তামজিদের বুঝতে বাকি রইল না। তামজিদ একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে শান্ত স্বরে বলল,
“বিশ্বাস করো, আমার কিছু করার নাই। আমি এই বিয়েটা করতে চাইনি। আমার মা ক্যান্সারের পেশেন্ট। আমার মায়ের হাতে বেশি সময় নেই, তারিন। শুধুমাত্র আমার মায়ের ইচ্ছা পূরণের জন্য এই বিয়েতে আমি রাজি হয়েছি। আমি তোমাকে বিয়ে করতে চাইনি। আমার বাবা-মায়ের তোমাকে খুব পছন্দ। আমি যেই মেয়েকে ভালোবাসি সে শহরের স্মার্ট, শিক্ষিত, হাই ক্লাস ফ্যামিলির মেয়ে। তাই তাকে আমার মায়ের পছন্দ না। এক প্রকার বাধ্য হয়ে নির্লজ্জের মতো তোমাকে বিয়ে করতে এসেছি।”
তামজিদের কথা শেষ হতেই তারিন সাথে সাথে বলল,
“আপনের মায়ের ইচ্ছা পূরণের জন্য আমি আমার জীবনডা নষ্ট করুম ক্যান, মাস্টার মশাই?”
তামজিদ আগের ন্যায় শান্ত, শীতল স্বরে শুধালো,
“তোমার জীবন নষ্ট হবে কেন?”
“আপনে অন্য মাইয়ারে ভালোবাসেন। তাইলে বিয়ের পর আপনে আমারে মাইনা নিবেন ক্যামনে?”
তামজিদ চুপ করে গেলো। এত শক্ত শক্ত প্রশ্নের জবাব ও কি করে দিবে ভেবে পাচ্ছে না। তামজিদ কে চুপ করে থাকতে দেখে, তারিন পুনরায় প্রশ্ন করল,
“আমারে ভালোবাইসা বুকে টাইনা নিতে পারবেন, মাস্টার মশাই?”
তামজিদ আগের ন্যায় চুপ। তারিন আবার বলা শুরু করল,
“আমি ভালোবাসার কাঙাল। অল্প ভালোবাসা আমার প্রাণে সয় না৷ আমার বাপ মায় আমারে বহুত আদর, সোহাগ কইরা বড় করছে। এহন যদি আপনে আমারে নিয়া দহনের জ্বালা দেন, ওই জ্বালা সইবার ক্ষমতা আমার নাই। আপনে এই বিয়াডা ভাইঙা দেন। আমি এই বিয়া করমু না।”
তামজিদ ভয়ে হাস ফাস করতে লাগল। তারিনের এসব কথা শুনে একটা কঠিন সত্য বলতে গিয়েও চে’পে গেলো। কঠিন স্বরে বলল,
“শোনো মেয়ে, আমার পক্ষে বিয়েটা ভাঙা সম্ভব না। তুমি ভয় পেও না। তোমার প্রতি স্বামী হিসেবে সব দায়িত্ব আমি পালন করব। তোমাকে কখনো অবহেলা করব না। কষ্ট ও দিবো না৷ তোমাকে আমি আমার মতো করে বড় করব। পড়ালেখা করাব। তোমার সব আবদার পূরণ করব। অতিত ভুলে সংসারে মন দেওয়ার চেষ্টা করব। তুমি যা বলবে সব মেনে নিবো। প্লিজ, এই বিয়েটা ভেঙে দিতে বলো না।”
তারিন এবার শান্ত হয়ে গেলো। কি বলবে খুঁজে পাচ্ছে না। এর মধ্যেই দরজার ওপাশ থেকে তারিনের বাবার গলা ভেসে আসলো। বাবার কণ্ঠস্বর শুনে তারিন চোখের পানিটুকু তড়িঘড়ি করে মুছে ফেলল। তামজিদ এবার বিনয়ী স্বরে বলল,
“প্লিজ, বিয়েটা বিয়ে ভেঙে দিও না।”
তামজিদ দরজা খুলে দিতেই আক্তার মিঞা বললেন,
“বাপজান, আমি একটু আমার মাইয়ার লগে কথা কইতাম।”
“জ্বি, আংকেল। বলুন। আমি বাইরে অপেক্ষা করছি।”
বলেই তামজিদ চলে গেলো। তারিন বাবাকে দেখে বাবার বুকে হামলে পড়ল। আক্তার মিঞা মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে বলতে লাগলেন,
“তুমি যহন ৬মাসে পড়লা। তহন আমার আম্মায় আমারে ছাইড়া চইলা গেলো। আমার আম্মায় মইরা যাওনের সময় আমার হাতটা ধইরা কইয়া গেছিল, ‘বাজান, আমার অভাব ভুলায় দেওনের লাইগা আল্লায় তোর কোলে আমাগো তারুরে পাডাইছে। আমি থাকুম না তো কি অইছে। আমার তারু বইনে আছে না। ওরেই তুই আম্মা কইবি। মনে করবি আল্লায় তোর এক আম্মা নিয়া গিয়া আরেক আম্মা দিয়া গেছে।’ জানো আম্মাজান, হেইদিনের পর আমি যহনি তোমার মুখের দিকে চাইতাম আমার আম্মার কথা ভুইলা যাইতাম। আমার পরানডা ঠান্ডা হইয়া যাইতো। এতিম হওয়ার দুঃখ ভুইলা যাইতাম। তুমি এক্কেরে আমার আম্মার লাহান হইছো। আল্লায় আমার ঘরে তোমারে পরির লাহান সুন্দর বানাইয়া পাডাইছে।”
তারিনের চোখ বেয়ে পানি পড়ছে। আক্তার মিঞা পুনরায় বলতে শুরু করলেন,
“আইজা আমার হেই পরির বিয়া। কত সপন দেখছি আমার আম্মার বিয়া লইয়া। আল্লায় আইজা হেই সব সপন পূরণ করব।”
বলেই তিনি একটু হাসলেন। পরক্ষণেই পরান ঠান্ডা করার মতো ডেকে উঠলেন,
“আম্মা! ও আম্মা! আমার আম্মা! আমার চান্দের টুকরা আম্মাজান।”
তারিনের বেশ কান্না পাচ্ছে এবার। আক্তার মিঞা নিজেও এবার কেঁদে উঠলেন। তার বুকটা ফেটে যাচ্ছে। নিজের প্রানের থেকেও প্রিয় মেয়েকে আজ বিদায় জানাতে হবে। অন্যের ঘরে পাঠিয়ে দিতে হবে সারাজীবনের জন্য। প্রত্যেকটা মেয়ের বিয়ের দিন বিদায় বেলা বাবাদের এভাবেই বুক ফেটে যায়। চাইলেও সব বাবা তা প্রকাশ করতে পারেন না। ‘বিদায়’ শব্দটা খুব বিষাক্ত। সেটা ক্ষনিকের হোক বা চিরতরের। আক্তার মিঞা এবার জিজ্ঞেস করলেন,
“আমার আম্মা তুমি কও, তুমি এই বিয়া করবা না? তুমি ভয় পাইও না, আম্মা। আমার কাছে তোমার থাইকা দামী আর কিছু নাই, আম্মা। কে কি কইবো ওই লইয়া আমি মাথা ঘামাই না। আমার কাছে তোমার সুখটাই দামী।”
তারিন বাবাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে কান্না করে উঠল। ভাবলো, যেই বাবা নিজের সম্মানের কথা না ভেবে ওর কথা ভাবছে৷ সেই বাবাকে ও কিছুতেই কষ্ট দিবে না। কিছুতেই গ্রামের মানুষের সামনে বাবার সম্মানহানি হতে দিবে না। কাঁদতে কাঁদতে বলে উঠল,
“আমি এই বিয়া করুম, আব্বা। আমার এই বিয়াতে কোনো অমত নাই।”
আক্তার মিয়ার মুখে হাসি ফুটল। মেয়ের কপালে চুমু এঁকে দিয়ে বলে উঠলেন,
“আমাগো মাস্টার খুব ভালা মানুষ, আম্মা। তোমারে অনেক সুখে রাখবো। তুমি চিন্তা কইরো না। লও এইবার যাই আমরা। বেলা গড়ায় যাইতাছে তো।”
তারিন আর বাঁধা দিলো না৷ বাবার সাথে চুপচাপ চলে এলো। বিয়ে শুরু হলো। আবার সবাই মিলে হাসি ঠাট্টায় মেতে উঠল। বিয়ে শেষ হতেই বিদায়ের পালা আসতেই কান্নার রোল পড়ে গেলো। তারিনের মা কান্নাকাটি করে অস্থির হয়ে পড়েছেন৷ তারিনের বাবা তারিনের হাতটা তামজিদের হাতে তুলে দিয়ে বলে উঠলেন,
“বাপজান, এত বছরে আমার চান্দের টুকরার গায়ে কোনো দাগ লাগতে দেইনাই। তুমি আমার মাইয়াডারে দেইখা রাইখো, বাপজান। ভালা রাইখো।”
তামজিদ আশ্বস্ত স্বরে বলল,
“আপনি চিন্তা করবেন না, আংকেল। আপনার মেয়ে সুখে থাকবে।”
তামজিদের কথা শেষ হতেই আমজাদ সাহেব বললেন,
“আপনার মেয়ে মানে আমারো মেয়ে বেয়াই মশাই। আপনি নিশ্চিন্তে থাকুন৷ আপনার মেয়ের গায়ে একবিন্দু আঁচ লাগবে না কখনো।”
তারিন তামজিদের সাথে এক করে এগিয়ে যাচ্ছে আর ভেতর থেকে ভয়গুলো নড়েচড়ে উঠছে। আজ থেকে তারিনের নতুন জীবন শুরু। জীবন কোন দিকে মোড় সেটা একমাত্র উপরওয়ালাই জানেন। তারিন বেশ ভালোভাবে বুঝতে পারছে ওর জীবনে স্বামী সুখ এত সহজে হবে না। অনেক কাঠখড় পোড়াতে হবে। তারিন মনে মনে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়ে বলল,
“আমি হার মানুম না। আমি সংসার ও করুম। স্বামীর ভালোবাসা ও পামু। নিজের পায়ে ও দাঁড়ামু। আমিও তারিন। হেরে যাওয়ার মাইয়া আমি না।”



শুশুড় বাড়ির চৌকাঠে এসে পা রাখতেই বাড়ির আত্মীয়-স্বজন সকলে ভীড় জমালো বউ দেখার জন্য। তারিন আর তামজিদকে বরন করা শেষ হতেই তামজিদের মা বর্ষা বেগম বললেন,
“বাবা, আমার বউমা রে কোলে তুলে ঘরে নিয়ে আসো।”
মায়ের এহেতুক আবদারের উপর তামজিদ বারণ করতে পারলো না। তারিনকে কোলে তুলে নেওয়ার জন্য হাত বাড়াতেই কোথা থেকে একটা মেয়ে এসে সবার সামনে তামজিদকে জড়িয়ে ধরল। তামজিদ ঠাঁয় দাঁড়ানো। ভয় আর অস্বস্তিতে সাথে সাথে মেয়েটাকে সরানোর চেষ্টা করল। কিন্তু মেয়েটা সরল না। বরং আরো শক্ত করে জড়িয়ে ধরল। আমজাদ সাহেব, বর্ষা বেগম দুজনেই বিস্ময়ে চোখের পাতা ফেলতে ভুলে গেলেন। তারিন যেন আকাশ থেকে পড়ল। কয়েকপা পিছিয়ে গেলো। জীবন কোন কাঠগড়ায় এনে দাঁড় করালো তারিনকে…?

#চলবে

[এটা একটা সামাজিক গল্প। প্যাঁচ থাকবে না বেশি। সাধাসিধে প্রেম ও বিয়ের বন্ধন নিয়ে গল্পটা হবে। ভুলত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here