#আপনিময়_বিরহ (০৭)
#বোরহানা_আক্তার_রেশমী
_________________
রাস্তার পাশে মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আছে প্রিয়তা আর শিশির। দুজনের মুখেই কোনো কথা নেই। প্রিয়ম তাদের থেকে কিছুটা দুরত্ব নিয়ে দাঁড়িয়েছে। শিশিরকে দেখে প্রথমে রাগ লাগলেও পরে সব হজম করে সে একটু দুরে গিয়ে কানে হেডফোন লাগিয়ে চিল মুডে গান শুনতেছে। শিশির যত যায় বলুক সে আর প্রিয়তাকে কখনোই শিশিরের লাইফে ফিরতে দেবে না। তার জন্য যা করতে হয় করবে। প্রিয়তা প্রিয়মের দিকে তাকিয়ে আবার মাথা নিচু করে দাঁড়াচ্ছে। শিশির কাতর কন্ঠে প্রথমেই শুধায়,
‘তুমি সত্যি সত্যি আমাকে ছেড়ে বিয়ে করে নিলে প্রিয়ু? একটা বার আমার কথা মনে পড়লো না তোমার? আমাকে ভুল বুঝে তুমি বিয়ে করে নিলে!’
প্রিয়তা অবাকের সপ্তম পর্যায়ে। সে কি আগে বিয়ে করছে? না তো। এমনিতে তো সে বিয়েই করেনি এখনো তবুও তাকে কি সব দোষ দিচ্ছে শিশির! প্রিয়তা কিছু বলতে যাবে তার আগেই শিশির বলে,
‘কেনো অনিমাকে বিয়ে করলাম তা যদি একটাবার জিজ্ঞেস করতে তাহলে হয়তো ভুল বুঝতে না। সেদিন তোমার ব্যাাপারে মা’কে বলতেই মা সরাসরি মানা করে দিলো। আমি অবাক হলাম। মা’কে জিজ্ঞেস করলাম কেনো সে তোমাকে বিয়ে করাবে না। কারণ হিসেবে সে বললো, ‘প্রিয়তা উড়নচণ্ডী একটা মেয়ে। ওসব মেয়ের ঘর সংসার হয় না বুঝেছিস। আর তাছাড়া তোর বউ হিসেবে আমার অনিমাকে পছন্দ। ওকেই বিয়ে করবি তুই।’ আমি আরেকদফা অবাক হলাম। তুমি শুধুমাত্র চঞ্চল স্বভাবের বলে মা তোমাকে পছন্দ করে না। মায়ের চাপে পড়ে তোমার সাথে দুরত্ব বাড়ালাম। এরপর মায়ের কসমের জন্য অনিমাকে বিয়ে করতে বাধ্য হলাম। কিন্তু অনুষ্ঠান করে বিয়ে করলে তুমি ঝামেলা করবে ভেবে মা আমাকে জোড় করে অনিমার কাছে পাঠায়। অনিমা আমাকে বিয়ে করবে না সাফ সাফ জানিয়ে দেয়। এরপর অনেক রকম কথা বলে, তোমার নামে ব্ল্যাকমেইল করে বিয়ে করলাম। আমি তখনও জানতাম না এসবের পেছনে আসলে কে কে আছে! বিয়ের পর জানতে পারি অনিমা আমাকে ভালোবাসতো তাই ওর বাবা মা আর আমার মা মিলে দুজনের বিয়ের এরকম প্ল্যান করেছে। আমি সেদিনও চাপে পড়ে অনিমাকে বিয়ে করেছি ওকে ভালোবেসে নয়। আমি আজো ভীষণ ভালোবাসি তোমাকে। তুমি আমাকে ভুল বুঝে ওই ছেলেকে কেন বিয়ে করলে?’
প্রিয়তা বাকরুদ্ধ হয়ে শিশিরের দিকে তাকিয়ে রইলো। আপন মানুষগুলো এভাবে তাকে ঠকিয়েছে! অনিমাও ভালোবাসে শিশিরকে! কিছুক্ষণ সেভাবেই তাকিয়ে রইলো শিশিরের মুখের দিকে। তারপর হুট করেই শব্দ করে হেঁসে উঠলো। শিশির বুঝলো না প্রিয়তা হাসছে কেনো? সে কি হাসার মতো একটাও কথা বলেছে? প্রিয়তা কিছুক্ষণ ওভাবেই হাসতে থাকলো। ইসস বিষাদের হাসিটুকুও আজ কত সুন্দর। চোখ ভর্তি পানি জমা হয়ে গেছে আর ঠোঁটের কোণে হাসি লেগে রয়েছে। প্রিয়ম প্রিয়তার দিকে তাকাতেই এভাবে পাাগলের মতো হাসতে দেখে দ্রুত এগিয়ে আসে। ল্যাম্পপোষ্টের আলোয় স্পষ্ট দেখতে পায় চোখের জল। প্রিয়ম প্রিয়তার বাহু ধরে বলে,
‘এমন পাগলের মতো হাসছিস কেন? কি হয়ছে প্রিয়?’
প্রিয়তা যেনো হুশ জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছে। তাই প্রিয়মের ‘প্রিয়’ ডাকটাও খেয়াল করেনি। শিশির শুধু প্রিয়মের অস্থিরতা খেয়াল করলো। প্রিয়ম রক্তচক্ষু নিয়ে শিশিরের দিকে তাকিয়ে বললো, ‘কি বলেছিস তুই? ও এমন করছে কেন? ওর কিছু হলে তোকে আস্ত পুঁ’তে ফেলবো আমি।’
প্রিয়তাকে আগলে নেয় প্রিয়ম। প্রিয়তা হাসি থামিয়ে প্রিয়মের থেকে খানিকটা সরে এসে সজোড়ে থা’প্পড় বসায় শিশিরের গালে। হতভম্ব শিশির এবং প্রিয়ম। দুজনের কেউই ভাবেনি প্রিয়তা এমন কিছু করতে পারে। এতটুকুতেই ক্ষ্যান্ত হয়নি প্রিয়তা। রাগে হিতাহিত জ্ঞানশূণ্য হয়ে গেছে। চিৎকার করে বলতে লাগলো,
‘ভালোবাসা! আপনি আমাকে ভালোবাসেন? আরে লজ্জা লাগে না কথাটা বলতে! আপনি আমাকে হাজারটা স্বপ্ন দেখিয়ে বিয়ে করেছেন কাকে? অনু আপুকে। আমার হৃদয়ের খুব কাছের একটা মানুষকে। আপনার মায়ের আমাকে পছন্দ না কারণ কি? আমি চঞ্চল, উড়নচণ্ডী। আরে আমাদের মতো হাজারটা মেয়ে আছে যারা সুন্দর ভাবে সংসার করে। আর কি বললেন আপনি বাধ্য হয়ে বিয়ে করেছেন! বিয়ে করার আগে একটা বার আমাকে বলেছেন কিছু? আপনি আসলে আমাকে কখনোই ভালোবাসেননি। ভালোবাসলে অন্তত এত নিচু একটা কাজ করতেন না। এত নিচে নামার আগে একটা বার আমার সাথে কথা বলতেন। দুজনে মিলে সমাধান করতাম। আন্টি আজ মানতো না কাল মানতো। কাল না হয় পরশু। কিন্তু আপনি তো চেয়েছিলেন অন্য কাউকে বিয়ে করতে তাই আপনি একটা বার আমাকে কিছু জানানোর প্রয়োজন মনে করেননি। আমাকে বলেননি কিছু্। আর এখন আপনি যখন শুনেছেন আমার বিয়ে হয়ে গেছে তখন আমাকে দোষ দিচ্ছেন? বিয়েটা আপনি করেছেন আর সব দোষ আমার। আমি কেন ভুল বুঝলাম? আপনাকে আমার দুইটা চোখে সহ্য হচ্ছে না। আপনার মতো কিছু লোক থাকে জানেন যারা নিজেরা দোষ করে সব দোষ চাপায় অন্যের ঘাড়ে। আপনি আমার সামনে থেকে যান। আপানকে দেখলেই আমার গা ঘিনঘিন করতেছে।’
প্রিয়তার এতো ঘৃণা শিশিরের সহ্য হলো না। চুপচাপ চলে গেলো। প্রিয়তা ওখানেই বসে পড়লো কাঁদতে কাঁদতে। প্রিয়ম নিজেই কিছু বলার মতো ভাষা পেলো না। মানুষ এতো নিচ মনের হয় কিভাবে? প্রিয়ম নিজেও নিচে বসে প্রিয়তাকে নিজের বাহুতে আবদ্ধ করে। ভরসার বুক পেয়ে প্রিয়তা হাউমাউ করে কাঁদতে কাঁদতে প্রিয়মের বুক ভাসায়। প্রিয়ম বুকের বাম পাশে চিনচিনে ব্যাথা অনুভব করে। প্রিয়তার মাথায় হাত বুলাতে থাকে। প্রিয়তা অনেকটা সময় কাঁদতে কাঁদতেই জ্ঞান হারিয়ে প্রিয়মের বুকে লুটিয়ে পড়ে। প্রিয়ম আতঙ্কিত স্বরে প্রিয়তাকে ডাকতে থাকে। প্রিয়তার সাড়া না পেয়ে দ্রুত কোলে উঠিয়ে বাড়ির দিকে হাঁটা দেয়। ভয়ে প্রিয়মের প্রাণপাখি উড়ে যাওয়ার মতো অবস্থা। বলতে দ্বিধা নেই এই মেয়েটি তার মনের অনেকটা জুড়ে বাস করছে। কিছু কিছু মানুষ আমাদের জিবনে অনেক বেশি জায়গা নিয়ে থাকে। প্রিয়তাকে বাড়ি নিয়ে ঢুকেই ‘মামনি’ বলে চেঁচাতে থাকে। তাঁরা বেগম প্রিয়মের এমন অস্থির ডাক শুনে দ্রুত নিচে নেমে আসে। উদয়, তনিমা আর পলক সাহেবও আসে। প্রিয়তাকে চুপচাপ সোফায় শুয়ানো দেখেই বুঝে যায় কিছু হয়েছে। সবাাই ব্যস্ত হয়ে পড়ে প্রিয়তাকে নিয়ে।
ডক্টর এসে প্রিয়তাকে জ্ঞান ফিরার সাথে সাথে ঘুমের ইনজেকশন দেয়। প্রিয়তা সাথে সাথেই ঘুমিয়ে পড়ে। মেয়েটার ওপর অনেক কিছু গেছে এখন একটু ঘুম দরকার। প্রিয়তা ঘুমাতেই প্রিয়মকে সবাই চেপে ধরে কি হয়ছে তা নিয়ে। প্রিয়ম শুধু প্রিয়তার বলা কথা গুলোই ক্লিয়ার করে বলে। শিশির কি বলেছে তা সে জানে না। সবাই চিন্তিত হয়ে পড়ে প্রিয়তাকে নিয়ে। এখানে এসে আবারও ক্ষত তাজা হলো। সবাই চলে যেতেই প্রিয়ম তাঁরা বেগমের সামনে হাটু মুড়িয়ে বসে পড়ে। চোখে পানি চিকচিক করছে। তাঁরা বেগম মুচকি হেঁসে মাথায় হাত বুলিয়ে বলে,
‘চিন্তা করো না বাবা। প্রিয়তার কিছু হবে না।’
প্রিয়ম মাথা গুজে দেয় তাঁরা বেগমের কোলে। মানুষটা কে কেন জানি কিছু বলতে হয় না। মনের কথা সহজেই বুঝে যায়। প্রিয়ম ধরে আসা কন্ঠে বলে, ‘প্রিয়তা মানসিকভাবে অনেক ভেঙে পড়েছে।’
তাঁরা বেগম কিছু বলে না৷ তার আদরের মেয়েটার ওপর দিয়ে কি যাচ্ছে তা তো সে ছাড়া কেউ জানে না।
____________
শিশির বাড়িতে এসে কারো সাথে কোনো কথা বলে না। অনিমা খাওয়ার জন্য শিশিরকে ডেকে গেছে। শিশির শুনেও না শোনার মতো করে চুপ হয়ে আছে। প্রিয়তা তাকে থা’প্পড় মে’রেছে বিষয়টা মানতে পারছে না৷ মেয়েটা তাকে ভীষণ ভালোবাসতো তবে কি ভালোবাসা বদলে গেছে! হাজারটা চিন্তার মধ্যেই অনিমা এসে শিশিরকে আবার ডাকে। শিশির বিরক্তির দৃষ্টি নিয়ে অনিমার দিকে তাকিয়ে আবার দৃষ্টি শীতল করে আনে। কাতর কন্ঠে অনিমাকে শুধায়,
‘আমি কি খুব খারাপ অনি?’
হঠাৎ এমন প্রশ্নে কিছুটা ভড়কে যায় অনিমা। তারপর নিজেকে সামলে হেঁসে বলে, ‘হঠাৎ এ প্রশ্ন?’
‘বলো না!’
অনিমা কেমন করে হাসে। তারপর কন্ঠে বিষাদ এনে বলে, ‘যারা একটা নিষ্পাপ মেয়েকে ভেতর থেকে ভেঙে গুড়িয়ে দেয় তারা কিি ভালো শিশির ভাই? কত বড় অন্যায় এটা জানেন! হ্যাঁ তাদের মধ্যে আমিও পড়ি। আমার জন্যই নিষ্পাপ মেয়েটার স্বপ্ন ভেঙেছে। আমি কখনো নিজেকে ক্ষমা করতে পারবো না। একটা পাপ আমাকে আজীবন তাড়া করে বেড়াবে। তবে আপনি কাজটা ভালো করেননি শিশির ভাই। ওকে এতো বেশি ভালোবাসেন যখন তখন বিয়ে করার আগে একটা বার ওর সাথে কথা বলা উচিত ছিলো। নিজের মায়ের কথা ভেবেছেন ভালো কিন্তু একবার ওর কথা ভাবলে কি খুব ক্ষতি হতে? আপনি যদি ওর কথা ভাবতেন তাহলে আজ আমাকে স্বার্থপর বলা হতো না। বোনের সংসারের স্বপ্ন ভেঙে নিজের সংসার গড়তে হতো না। প্রিয়তাও ভেতর ভেতর এতো ক্ষত বিক্ষত হতো না।’
অনিমা আর দাঁড়ায় না। নিঃশব্দে বেড়িয়ে যায়। এ সংসারে তার সময় ফুরিয়ে এসেছে। হোক পবিত্র সম্পর্ক তবুও এ সম্পর্কের দাম তো নেই। শিশির আর শিলা বেগমের একটা কড়া শাস্তি দরকার। কিন্তু আদৌও এরা নিজেদের ভুল কখনো বুঝবে নাকি আবার নতুন করে সংসার গড়বে! অবশ্য এদের দ্বারা সব সম্ভব।
____________
সকাল সকাল প্রিয়তা ঘুম থেকে উঠে কিছুক্ষণ ঝিম মেরে বসে থাকে। আজ তার প্রথম পরীক্ষা অথচ সে সারারাত পড়েই নি। আগে যা পড়া ছিলো সেটুকুই আছে। মনে মনে কঠিন এক সিদ্ধান্ত নিয়ে উঠে দাঁড়ায়। ফ্রেশ হয়ে সরাসরি লিভিং রুমে আসে। সেখানে প্রিয়ম, উদয়, তনিমা, পলক সাহেব এক সাথে বসে আছে। তাঁরা বেগম নাস্তা বানাচ্ছেন। প্রিয়তা লাজ লজ্জার কথা ভুলে সরাসরি পলক সাহেবকে গম্ভীর গলায় বলে উঠলো,
‘আব্বু আমার এক্সাম শেষ হলে আমার বিয়ের ব্যবস্থা করো। আগেই বললাম কারণ তোমাদের ছেলে খুজতেও সময় লাগবে।’
প্রিয়তার কথা শুনে প্রিয়ম শুধু মুখেই বিষম খায়। পলক সাহেব কিছুটা কেশে গলা পরিষ্কার করেন। উদয় আর তনিমা হা করে তাকিয়ে আছে প্রিয়তার দিকে। প্রিয়তা সব কিছু উপেক্ষা করে নিজের রুমে চলে গেলো। প্রিয়ম গালে হাত দিয়ে বলে,
‘এটুকু মেয়ের বিয়ের শখ জাগছে। হায় আল্লাহ তুলে নাও আমারে।’
চলবে…