#আকাশ_ছোঁয়া_ভালোবাসা♥
#সিজন_১
#পর্ব_১২
#সাহেদা_আক্তার
কান থেকে ফোন পইড়া ব্যাটারি খুলে ছিটকে পড়ল একজায়গায়। আমি চায়ের মধ্যে বইসা পড়লাম। আন্টি দৌঁড়ে এলেন। রিদিও দৌঁড়ে আইল। জিজ্ঞেস করতেসে কি হইসে। আমি পাথরের মতো বইসা আছি। আমার জগতটা ভেঙে গুড়িয়ে গেল চোখের সামনে।
এমন সময় কলিং বেল বাজল। রিদি গিয়ে দরজা খুলল। খালু আসছে। আমি তাকাইলাম ওনার দিকে। উনি আমার দিকে তাকাইতে সাহস করতেসে না। আমি আস্তে কইরা উইঠা খালুর কাছে গেলাম। বললাম, আমাকে নিয়ে যাবে? আমি যাবো। চল না খালু। আমাকে নিয়ে চলো। আন্টি এগিয়ে এসে জিজ্ঞেস করলেন, কি হয়েছে? খালু একটু ইতস্তত করে বললেন, ওর আব্বু আম্মু এক্সিডেন্ট করেছে। ওর আম্মু স্পটডেড। ওর আব্বু আইসিইউতে। যে কোনো মুহূর্তে …… খালুর ফোন এল। কথা বলে আবার সবার দিকে ফিরে বললেন, ওর আব্বুও……
– আমি তৈরী হয়ে নিই, হ্যাঁ? আব্বু আম্মু আমার জন্য অপেক্ষা করছে। আমি না গেলে আসবে না।
রিদি এসে আমাকে ঝাঁকিয়ে বলল, ছোঁয়া, তোর আব্বু আম্মু কেউ বেঁচে নেই। একটু কাঁদ। একটু কাঁদ। আমি ওর হাত সরিয়ে বললাম, কে বলেছে আব্বু আম্মু নেই। একটু আগে আমার সাথে হেসে হেসে কথা বলেছে। আব্বুটাও দুষ্ট হয়ে গেছে। বলেছে আমার জন্য জিলাপী আনবে। একদম এমন কথা বলবি না। আমি এখুনি রেডি হয়ে আসছি।
– ছোঁয়া……
আমি ওর দিকে তাকাতেই ও ভয় পেয়ে সরে গেল। আমার চোখ লাল হয়ে আছে। আমি রুমে চলে এলাম। গোসল করে সুন্দর একটা সাদা জামা পরলাম। মাথাটা বেঁধে বের হয়ে এসে বললাম, চলো খালু। এমনিতে অনেক লেট হয়ে গেছে। আব্বু নিশ্চয়ই আমার উপর অভিমান করে ফেলেছে। আম্মু বকবে। চলো চলো, দেরি হয়ে যাচ্ছে। আমি টেনে চললাম খালুকে। উনি আমার দিকে তাকাতেও পারছেন না, কাঁদতেও পারছেন না। আন্টি খালুর থেকে ঠিকানা নিয়ে নিলেন।
.
.
.
.
আমরা সোয়া দশটায় হাসপাতালে পৌঁছালাম। খালু আমাকে একটা কেবিনের কাছে নিয়ে গেলেন। সেখানে মিষ্টি খালা, সানজিদা আপু, দুলাভাই, মুনতাহা সবাই কাঁদছে। আমি মিষ্টি খালার কাছে দৌঁড়ে গিয়ে হেসে বললাম, কাঁদছো কেন? আব্বু আম্মু কি তোমাদের বকেছে? মিষ্টি খালা আমাকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কাঁদতে লাগল। আমি জড় পদার্থের মতো দাঁড়িয়ে রইলাম। খালা ছেড়ে দিতেই আমি কেবিনে ঢুকলাম। দুইটা বেড। সেখানে সাদা কাপড়ে ঢাকা দুটো মানুষ। একটা আমার আদরের আব্বু আরেকটা আমার দুষ্টু আম্মু। আমি আম্মুর কাছে গিয়ে বললাম, আম্মু, এই আম্মু, উঠো বলছি, না হলে কিন্তু ডিসের লাইন কেটে দিবো। তখন আবার লোক এনে ঠিক করাতে হবে। জানো, আজকে আমার হাত কেটে গেছে, দেখো রক্ত জমাট বেঁধে আছে। তুমি মলম লাগিয়ে দেবে না? কি হল উঠো। আব্বু, এই যে, তুমিও উঠছো না? আমি কিন্তু জিলাপির ভাগ দেবো না। বাসায় কিন্তু ফ্রিজে মিষ্টি আছে। আম্মু তোমার থেকে লুকিয়ে রেখেছে। ওগুলোও দিবো না। ওঠো, ওঠো বলছি। আমি দুই বেডের মাঝে দাঁড়িয়ে আছি। মিষ্টি খালা আমাকে টেনে বের করে আনল। আমি বার বার বলতে লাগলাম, আরে দেখো আব্বু আম্মু উঠবে। আমার সাথে দুষ্টুমি করছে। খুব দুষ্ট হয়ে গেছে। আরে ছাড়ো আমায়, ছাড়ো। সানজিদা আপু আর মিষ্টি খালা আমাকে ধরে রাখল। আমি খালি বলতে লাগলাম, ছাড়ো আমাকে ছাড়ো। না ছাড়লে কিন্তু আব্বু আম্মুকে বলে দেবো। তখন ওরা খুব বকুনি দেখে। কি হল ছাড়ো। ওরা আমার কথা শুনল না। ছাড়লো না একটিবারের জন্য।
রাত আটটা। আমি ঝিম ধরে বসে আছি বসার রুমের ফ্লোরে। বিড় বিড় করছি, আমার আব্বু আম্মুকে কোথায় রেখে এলে। নিয়ে এসো। আমার ভালো লাগছে না। আমি বিড়বিড় করেই চলেছি। সবাই বসার রুমে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। মিষ্টি খালা মাঝেমধ্যে মুখ চেপে কাঁদছে। খালু আর আঙ্কেল চুপ করে বসে আছেন। আন্টিও কিছু বলছে না। চেরি ফল একদৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। আমি সারাদিনে একফোঁটা কান্না করিনি। সবার চোখে পানি আর আমার চোখে চৈত্রের খরা।
হঠাৎ কেউ বুঝে ওঠার আগেই চেরি ফল সোফা থেকে উঠে এসে আমাকে এক টানে দাঁড় করালো। তারপরই ঠাস করে সজোরে চড় মারল। সবাই সেই শব্দে চমকে উঠল। আঙ্কেল আন্টি দৌঁড়ে এসে বললেন, এটা তুই কি করলি? আমার মুখে সাথে সাথে পাঁচ আঙুলের লাল ছাপ স্পষ্ট বসে গেল। আমি চেরি ফলের দিকে তাকালাম। তারপর সবাইকে অবাক করে দিয়ে চিৎকার করে উঠলাম। একবার দুবার তিনবার। গলা ফাঁটিয়ে যতটায় শক্তি ধরল। তারপর ওর বুকে দুই হাত দিয়ে সজোরে মারতে মারতে বললাম, কেনো মারলে আমায়? কেন? কি দোষ আমার? কি দোষ বলো? কি করেছি আমি? যখন তোমাকে আমার জগত বানালাম তখন তোমার জগতে ছিল অন্য কেউ। আমি মেনে নিলাম। সরে এলাম তোমার জীবন থেকে। নিজের জগতটাকে নতুন করে সাজালাম আমার আব্বু আম্মুকে নিয়ে। কিন্তু ততক্ষণে দেরি হয়ে গেছে। আমার জগতটাকে মুহূর্তে চুরমার করে দিয়ে পালিয়ে গেছে ওরা। কেন? আমি কেন? আমার সব ভালোবাসাকে কেন কেড়ে নিল এভাবে? কেন আমাকে অসহায় করে দিয়ে সবাইকে চলে যেতে হবে? আমি আর পাগলামি করবো না। বলো আমার আম্মুকে ফিরে আসতে। আমি সবঠিক করে করব। আমি আর আব্বুর লুকিয়ে মিষ্টি খাওয়ার কথা আম্মুকে বলব না। বলো আমার আব্বুকে ফিরে আসতে। কি হল যাও। যাও……
আমি মারতে থাকলাম। ও আমাকে আটকালো না। আমার চোখের পানির বাঁধ ভাঙল। গড়িয়ে পড়তে লাগল অঝোর ধারায়। চেরি ফল আমাকে বুকে জড়িয়ে নিল। আজ যে আমার বড়ো আশ্রয়ের প্রয়োজন। কিন্তু কার কাছে যাবো আমি? আমার নড়াচড়া বন্ধ হয়ে গেলে ও আমাকে ডাকতে লাগল। আমাকে সরিয়ে নিয়ে দেখল আমি জ্ঞান হারিয়েছি।
.
.
.
.
সকালে চোখ মেলে তাকালাম। আমি বিছানায়। হাত নাড়তেই সুঁইয়ের গুঁতো খেলাম। তাকিয়ে দেখি স্যালাইন দেওয়া। শরীরটা দুর্বল লাগছে। আমি আস্তে করে উঠলাম। টান দিয়ে খুলে ফেললাম সুঁই। কয়েক ফোঁটা রক্ত বের হলো। আমার অনুভূতি নেই। আব্বু আম্মুর সাথে আমার আনন্দ অনুভূতি সব কবরের নিচে চাপা পড়ে গেছে। পুরো রুম অন্ধকার অন্ধকার হয়ে আছে। প্রত্যেকদিন সকালবেলা আম্মু জানালা থেকে পর্দা সরিয়ে দিতো। আজ পর্দা সরানোর কেউ নেই। তাই নিজেই ধীর পায়ে গিয়ে পর্দা সরালাম। চোখে আলো পড়তেই হঠাৎ অসহ্য লেগে উঠল। ভাবলাম আবার পর্দা টেনে দেবো কিনা। কেউ একজন এসে দেখে গেল। বুঝলাম মুনতাহা এসেছিল। একটু পরে মিষ্টি খালা এসে বলল, উঠেছিস? ফ্রেশ হয়ে নে। আমি নাস্তা বানিয়েছি। খেতে আয়। আমি কাপড় নিয়ে ওয়াশরুমে চলে গেলাম। দরজা মেরে ঝর্ণা ছেড়ে দিলাম। কিছুক্ষণ পর পর একজন একজন করে ডেকে গেল। একঘন্টা হয়ে গেল। আমি কারো ডাকেই সাড়া দেইনি। চুপ করে বসে আছি ঝর্ণার নিচে। সবাই শুধু পানির শব্দই শুনতে পেল। আমি বের হচ্ছি না দেখে সবাই ভয় পেয়ে গেল। তখনই আমি বের হয়ে এলাম রুম থেকে। আমাকে কাগজের মতো সাদা লাগছে। মুনতাহা আমাকে নিয়ে সোফায় বসালো।
এমন সময় কলিং বেল বেজে উঠল। আন্টি, আঙ্কেল আর চেরি ফল আমাকে দেখতে এসেছে। আন্টি আমার পাশে এসে বসে বললেন, এই অবস্থা কেন? পুরা সাদা হয়ে আছে। সারা শরীর বরফের মতো ঠান্ডা। কপাল ধরে বললেন, কপাল তো বেশ গরম। মনে হয় জ্বর আসবে। একটা কাঁথা নিয়ে এসো। মুনতাহা কাঁথা মুড়ি দিতেই আমি ঠক ঠক করে কাঁপতে লাগলাম শীতে। মাথা রাখলাম আন্টির কাঁধে। আন্টি বললেন, দেখ, কি জোরে মেরেছিস কালকে। পুরো কালো হয়ে গেছে। মিষ্টি খালা বলল, ও মেরেছে বলে তো পাথর বুক ভেঙে কান্না করেছে। আমার তো এখন ওকে নিয়ে ভয়। আপা দুলাভাইকে খুব ভালোবাসতো মেয়েটা। ওরা চলে যাওয়ায় একদিনে কি যে হাল হল! মিষ্টি খালার চোখ থেকে পানি গড়িয়ে পড়ল। তিনি মুখ চেপে কাঁদতে লাগলেন। আঙ্কেল বললেন, ওকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যেতে হবে। এভাবে থাকলে তো মেয়েটা মরে যাবে। আমি জ্বরের ঘোরে বলতে লাগলাম, আমি আম্মুর কাছে যাবো। আব্বু আমাকে নিয়ে চলো। তোমরা না আমার কাছে আসবে বলেছিলে। কেন এলে না? এখন আমাকে তোমাদের কাছে নিয়ে চলো। আমার কথাগুলো শুনে পুরো বসার ঘর নিস্তব্ধ হয়ে গেল।
.
.
.
.
– কি বুঝলেন?
– দেখুন, ও আস্তে আস্তে দুর্বল হয়ে পড়ছে। আজ সারাদিনে জ্বর ১০৩ এর নিচে নামেনি। ওষুধ দেওয়ার পর যদি পেসেন্ট রেসপন্স না করে তবে সেটা সমস্যা।
– এখন কি করব ডক্টর? আমাদের তো কিছু মাথায় আসছে না। সদ্য আপা আর দুলাভাই চলে গেছে। বড্ড ভালোবাসতো। নিজেদেরকেই নিজেরা সামলাতে পারছি না। আর ও তো বাচ্চা মেয়ে।
– দেখুন, ওকে বোঝাতে হবে। এভাবে তো স্যালাইন দিয়ে বেশি দিন চলা ঠিক হবে না। আপনারা ওকে বোঝান। ঠিক মতো খাওয়ান। এভাবে করতে থাকলে শরীর দিন দিন দুর্বল হতে থাকবে।
– ওকে ডক্টর, আমরা চেষ্টা করব।
মিষ্টি খালা আর খালু ডাক্তারের চেম্বার থেকে বেরিয়ে আমার কাছে এলেন। আমি হেলান দিয়ে চোখ বন্ধ করে বসে আছি। তাকালেই মাথা ঘুরাচ্ছে। ঝিমঝিম করছে। মিষ্টি খালা আমার কাছে একটা পায়েসের বাটি নিয়ে এসে বলল, দেখ ছোঁয়া, তোর না পায়েস পছন্দ? আমি বানিয়ে এনেছি।
– খেতে ইচ্ছে করছে না। খাবো না।
– সোনা, এমন করে না। আমি অনেক কষ্ট করে বানিয়েছি। একটুও খাবি না?
আমি কয়েক চামুচ খেলাম। বললাম, তেতো। মিষ্টি খালা বলল, একটু তো তেতো লাগবে। জ্বর মুখ তো। আরেকটু খা। তাহলে আর জোর করবো না। আমি আরো সাত আট চামুচ জোর করে খেলাম। সাথে সাথে গা গুলিয়ে উঠল। আমি গড়গড় করে বমি করে বের করে দিলাম পেটে যাওয়া পায়েসটুকু। ক্লান্ত শরীরে বললাম, আর পারছি না। নিয়ে যাও সব আমার চোখের সামনে থেকে। আম্মুকে ডেকে দাও। ডেকে দাও। মিষ্টি খালা মুখ চেপে ধরে কাঁদতে কাঁদতে কেবিন থেকে বের হয়ে গেলেন। আমি তখনও বলছি, আম্মু আব্বুকে ডেকে দাও। আমি তাদের হাতে খাবো।
চলবে…
বি.দ্র: অনেকেই গল্প কপি করে আসলে লেখকের নাম দেয় না। এই গল্পের ক্ষেত্রেও আমি এটা দেখেছি। ? কেউ কেউ নাম দিয়েছে। আর বাকিরা লেখকের নাম না দিয়েই ফেসবুকে পোস্ট করেছে। তাই আমার বিশেষ অনুরোধ, যদি কপি করতেই হয় তবে লেখকের নামসহ করবেন। ?