#অ্যাসিড
নাফীছাহ ইফফাত
পর্ব ৯
আরিশা ঘরে ঢুকতেই মিশমি হামলে পড়ে ওকে জড়িয়ে ধরে গায়ে-মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়। ভয়ার্ত কন্ঠে বলে,
“কোথায় গিয়েছিলি তুই? মাথায় কি হয়েছে দেখি।”
‘কিচ্ছু হয়নি মিষ্টি। আমি ঠিক আছি।’ ক্লান্ত ভঙ্গিতে বলে আরিশা।
মিশমি হঠাৎ করেই তার মনে পুষে রাখা সুপ্ত ইচ্ছেটা প্রকাশ করে।
‘বড়ভাই, আরিশাকে আমি আমার সাথে নিয়ে যাবো। এভাবে এখানে ওকে রেখে যাব না আমি।’
‘মিশমি, তুই বুঝিস না কেন বলতো? আরিশাকে ছাড়া আমরা থাকতে পারবো না। তাছাড়া আরিশা এখানে যতটা ভালো আছে ততটা ভালো আর কোথাও থাকবে না।’ আশফাক আহমেদ বললেন।
‘তোমরা আমাকে কখনো বুঝলে না বড়ভাই। ও অন্তত ক’টা দিনের জন্য তো আমার কাছে থাকতে পারে। ওরই বা একা এই জঙ্গলে কতদিন ভালো লাগবে বলতো? তোমরা নাহয় বাইরে, বাজারে, দোকানে যাচ্ছো। ওর তো যাওয়ার কোনো জায়গা নেই।’ মিশমি বলে।
আরিশা সবার মন রাখতে নিজের মনের কথাটা বলে,
‘আমি জঙ্গলেই ভালো আছি মিষ্টি। আমি না থাকলে আব্বু-চাচ্চুদের কে দেখবে বলতো? আর জঙ্গলের গহীনে আমার সুন্দর বাড়িটা পাহারা দিবে কে বলো? তারচেয়ে বরং তুমি ও তানজীর কিছুদিন থেকে যাও এখানে।’
‘তুই তো সেই ওদের হয়েই কথা বলবি। আমার কদর আর কেউ বুঝলো না।’ হনহন করে রান্নাঘরে চলে গেল মিশমি।
আরমান হেসে বললো, “সবাই হাত-মুখ ধুয়ে, গোসল করে নাও। ওর রাগ এমনিতেই পড়ে যাবে।”
সবাই হেসে ওর কথায় সায় মিলিয়ে তৈরী হতে চলে গেল।
বিকেলে নির্ভীক বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিতে বাইরে যায়। নির্ভীকদের পুরোনো স্কুলের পেছনে জঙ্গলের মতো একটা জায়গা আছে। জঙ্গলের একপাশে রাস্তার ধারে পাকা রেলিং দিয়ে ঘেরাও দেয়া। সেই রেলিংয়ের ওপর বসে আড্ডা দেয় নির্ভীক ও ওর বন্ধুরা।
আড্ডার ফাঁকে দীপু বলে,
‘আচ্ছা দোস্ত, তুই না সেদিন জঙ্গলে হারিয়ে গিয়েছিলি?
‘হ্যাঁ, কোনো সন্দেহ আছে?’ চোখ ছোট ছোট করে দীপুর দিকে তাকায় নির্ভীক।
ওর তাকানোর ভঙ্গীতে দীপু হেসে ফেলে। এরপর বলে,
‘সন্দেহ নেই। কিন্তু আমি একটা হিসাব মিলাতে পারছি না।’
‘কোন হিসাব? তুই কমার্সের স্টুডেন্ট নাকি?’ টিটকারি মেরে বলে রাহী।
‘ধুর! আচ্ছা নির্ভীক, গতকাল ফেসবুকে যে সুন্দরী মেয়েটার ফটো শেয়ার করেছিস মেয়েটাকে কোথায় পেলি? জঙ্গলেই নাকি?’
নির্ভীক সোজা হয়ে বসে ঢোক গিলে। পাত্তা না দেয়ার ভঙ্গিতে বলে,
‘ঐ হবে হয়তো।’
‘দোস্ত, মেয়েটা যা সুন্দর না! আমি ভাবছি আবার ঐ জঙ্গলে যাবো।’ দীপু বললো।
নির্ভীক চোখ বড় বড় করে তাকায় ওর দিকে। দীপু ওর পাশেই বসা ছিলো। নির্ভীক দীপুর কলার ধরে নিজের দিকে এনে বললো,
‘ওকে আমি ভালোবাসি। তোর ভাবি লাগে, ভাবি। বুঝলি?’
এবার দীপু ও রাহী বিস্ফোরিত চোখে তাকায় নির্ভীকের দিকে। রাহী বলে,
‘সত্যি?’
দীপুকে ছেড়ে দিয়ে নির্ভীক বলে, ‘কি? সত্যি তুই সত্যি কাউকে ভালোবাসিস?’
‘কাউকে না। মনে হয় শুধু আরিশাকে। আমি বোধহয় ওকে ভালোবেসে ফেলেছি। লাভ অ্যাট ফার্স্ট সাইট!’ বুকে হাত রেখে আকাশের দিকে তাকিয়ে বললো নির্ভীক।
দীপু ও রাহী হা করে নির্ভীককে দেখছিলো। ওদের ফ্রেন্ড সার্কেলের সবাই স্কুল-কলেজ লাইফ থেকে প্রেম করলেও নির্ভীক কখনো সেসবের তালে ছিল না। ও থাকতো ওর পড়াশোনা নিয়ে। আর পড়াশোনার ফাঁকে ওর সঙ্গী ছিল ওর ক্যামেরা। ফটোগ্রাফি করেই অবসর সময় কাটাতো নির্ভীক। আজ পর্যন্ত নির্ভীক কোনো মেয়ের কথা এভাবে সরাসরি বলেনি। তারমানে নির্ভীক সত্যিই আরিশাকে ভালোবাসে? রাহী এই ব্যাপারে কিছু বলতে গিয়েও থেমে যায়। হঠাৎ ঝোপের আড়ালে নড়াচড়া দেখে রাহীর চোখ যায় ঘন ঝোপে। নির্ভীকের হাত চেপে ধরে ও চাপাস্বরে বলে,
‘দোস্ত, দেখ ঐদিকে।’
নির্ভীক ও দীপু একইসাথে তাকালো এবং দেখলো সানজু একটা ছেলের সাথে ঝোপ থেকে বেরিয়ে উল্টো দিকের রাস্তা ধরে বেরিয়ে যাচ্ছে।
দীপু বললো, ‘এগুলা এমনই। ক্যারেক্টারলেস!’
নির্ভীক একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে সামনে তাকিয়ে বললো,
‘ছাড়তো ওর কথা। আর শোন, কয়েকদিনের মধ্যে আমি ঐ জঙ্গলে যাচ্ছি।’
‘আবার?’ দীপু অবাক হয়।
‘হ্যাঁ, তোর ভাবিকে দেখে আসতে হবে না?’ চোখ টিপে বলে নির্ভীক।
‘হ্যাঁ দোস্ত, তোরই ত সময়।’ নির্ভীকের পিঠ চাপড়ে বলে দীপু।
‘আজীবন তো তোরাই এসব করে গেলি। আর আমি করতে গেলেই…’ দু’পাশে মাথা নাড়ায় নির্ভীক।
‘আচ্ছা, আমাদেরকে নিয়ে যাবি না?’ দীপু উৎসুক দৃষ্টিতে তাকায় নির্ভীকের দিকে।
নির্ভীক ভ্রু কুঁচকে বলে, ‘তোরা গার্লফ্রেন্ডদের সাথে মিট করতে যাওয়ার সময় আমাকে নিতি?’
‘কি বলিস দোস্ত? তুই তো যেতিস না?’
‘আচ্ছা, বাদ দে এখন। আমি আপাতত একাই যাবো। পরে কখনো তোদেরকে নিয়ে যাবো। তাছাড়া আমার শ্বশুরবাড়িতে তো তোরা এমনিতেই যাবি, তাই না?’ বলেই চোখ টিপে নির্ভীক।
দীপু বড় বড় চোখ করে নির্ভীকের দিকে তাকায়। রাহী ও নির্ভীক একে অপরের হাতে হাত মিলিয়ে হো হো করে হেসে ফেলে।
দেখতে দেখতে কয়েকটা দিন কেটে গেল। এরমধ্যে আরিশার মাটির নিচের ঘরটা অনেকটাই সাজানো হয়ে গেছে। আজ মিশমির চলে যাওয়ার দিন। বাড়ি তৈরী হওয়ার পর তানজীর ওটায় থাকতে পারবে না বলে ওর মন খুব খারাপ। আরিশা ওকে আশ্বাস দিয়েছে এই বলে, মিশমি চলে গেলেও যেন তানজীর থাকতে পারে সেই ব্যবস্থা ও করবে। তানজীরও তাই মহাখুশি।
দুপুরে খেতে বসে আশফাক আহমেদ আরিশার উদ্দেশ্যে বলেন,
‘ঐ ছেলেটা আর এসেছিলো?’
আরিশা পানি খাচ্ছিলো। হঠাৎ প্রশ্নটা শুনে বিষম খায় ও। মিশমি ওর পিঠে হাত বুলিয়ে দিয়ে বললো,
‘আস্তে খাবি তো।’
আরিশা স্বাভাবিক হয়ে মৃদু হাসলো। এরপর বললো,
‘কোন ছেলেটা আব্বু?’
‘যে ছেলে পথ হারিয়ে এসেছিলো, তুই পথ দেখিয়েছিস।’
‘না, উনি আবার কেন আসতে যাবেন?’
‘না আসলে তো ভালোই।’
মিশমি আরমানের গ্লাসে পানি ঢালতে ঢালতে বললো,
‘কোন ছেলে এসেছিলো রে আরিশা?’
‘আমি চিনি না মিষ্টি।’
‘ওহ আচ্ছা।’
কিছুক্ষণ চুপ থেকে মিশমি হঠাৎ আগের কথাটা ধরে বললো,
‘বড়ভাই, অনেক বুঝিয়েছো তোমরা আর আমিও এতদিন সব মেনে নিয়েছি। কোথাকার কোন ছেলেপিলে আসছে, কালকে আবার অন্য কাউকে নিয়ে আসবে না তার কি নিশ্চয়তা?’
‘নিয়ে আসবে না মিষ্টি। আসলেও আমি সামলে নিতে পারবো।’ অভয় দিয়ে বলে আরিশা।
‘আপু রে, তুই এত চিন্তা করিস না। কিচ্ছু হবে আরিশার। আমি দু’দিন বাজারে গিয়েছিলাম বলে ও একা ছিলো। নয়তো ওর সাথে সারাক্ষণ থাকি আমি।’ অভয় দেয় রাফসানও।
“সব বুঝলাম। তাহলে এটা বল আরিশা চুপিচুপি কাঁদে কেন? সেসব কথা কখনো জানতে চেয়েছিস? ওর কান্নার কারণ জানতে চেয়েছিস? একটা উঠতি বয়সী মেয়ে সব কথা ছেলেদেরকে বলবে এটা তোরা ভাবলি কি করে? মেয়েদের কত রকম কথা আছে, কতরকম ব্যাপার আছে সেগুলো কি ছেলেদের বলা যায়? যতই আদর করো না কেন সবকিছু ও তোমাদেরকে বলতে পারবে না।”
সবাই চুপ থাকলেও রাফসান বললো,
‘ওর কান্নার কারণটা আমি জানি। আমরা সবাই জানি।’
‘কি জানিস শুনি?’
‘ও ভাবির জন্য…’
রাফসানকে থামিয়ে আশফাক আহমেদ বলেন,
‘থাক সেসব কথা। মিশমি, তুই তো এতদিন এখানে ছিলি। তোর কি মনে হয়েছে আরিশা কোনো সমস্যায় আছে?’
‘বড়ভাই তোমাকে আমার আর বোঝাতে ইচ্ছে করছে না। তোমার মেয়েকে নিয়ে গিয়ে খেয়ে ফেলবো না আমি। তোমার মেয়েকে তোমার কাছ থেকে দূরে সরিয়েও রাখবো না। শুধু ওর নিরাপত্তার জন্য…’
এটুকু বলে হঠাৎ কি যেন ভেবে মিশমি আরমানের দিকে তাকিয়ে বললো,
‘সেঝভাই, তুমি কি বিয়ে করবে না? তুমি বিয়ে করলেই তো আরিশা সবসময়ের জন্য একজন সঙ্গী পাবে। আর নিরাপদেও থাকবে। তখন আমারও আর এত টেনশন থাকবে না ওকে নিয়ে।’
‘আমি বিয়ে করবো না। তখন সঙ্গী পাওয়া তো দূর, আমিই হয়তো আরিশাকে হারিয়ে ফেলবো।’ বিরস মুখে বলে আরমান।
‘এটা তোমার ভুল ধারণা। এমনটা না-ও হতে পারে।’
‘এমনটাই হবে। আমি নিশ্চিত।’
আরিশা বুঝতে পারলো ওর জন্যই ওর চাচ্চু-ফুফিদের মধ্যে গন্ডগোল লেগে যাচ্ছে। ও আস্তে আস্তে বললো,
‘আমি একটা কথা বলি?’
সবাই ওর দিকে প্রশ্নবোধক চাহনিতে তাকালো। আরিশা বললো,
‘আমি এখানেই থাকি। আমার কোনো সমস্যা হচ্ছে না। তবে কিছুদিন পর আমি নিশ্চয়ই মিষ্টির বাসায় যাবো। কিন্তু একটা শর্তে।’
‘হ্যাঁ আমার বাসায় যাবি তারজন্য আবার শর্ত। বল শুনি তোর শর্ত!’ ভেঙচি দিয়ে বলে মিশমি।
‘তানজীরকে রেখে যাও আজকে। কয়েকদিন পর ওকে নিয়ে আমি তোমার বাসায় যাবো।’
মিশমি সাথে সাথে রাজি হয়ে গেল। তানজীর ও আরিশা পরস্পরের দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসলো।
তুমুল ঝড়ো বাতাসে গাছপালা সব চারদিকে দুলছে। ধুলোবালি উড়ে পরিবেশ ঘোলাটে হয়ে আসছে। ধুলোবালি থেকে নিজেকে বাঁচাতে চোখ হাত দিয়ে আড়াল করে রাখে নির্ভীক। নির্ভীক গাড়ি নিয়ে জঙ্গলে ঢুকে একপাশে ঝোপের আড়ালে গাড়িটা লুকিয়ে রাখে। গাড়িটা বেশ বড় হওয়ায় ঝোপের আড়ালে রাখলেও সেটা পুরোপুরি ঢাকা গেল না। ফাঁক-ফোকর দিয়ে ঠিকই দেখা যাচ্ছে আর স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে ওটা বেশ বড়সড় একটা গাড়ি। নির্ভীক সেটা নিয়ে আর বেশি মাথা ঘামালো না। জঙ্গলে কেই বা ঢুকবে ওর গাড়ি দেখার জন্য এটা ভেবে ও ভেতরে যেতে থাকে।
ভেতরে ঢুকে ও চারপাশে তাকায়। সেদিন পুঁচকু ওকে রাস্তা দেখিয়ে নিয়ে এসেছিলো। তখনই ও রাস্তাটা মুখস্থ করে নিয়েছে। কিন্তু এখন ধুলোবালি ও বাতাসের চোটে ও আবার পথ হারাতে বসেছে।
নির্ভীক আরিশাকে দেখার জন্য অস্থির হয়ে উঠেছে। আর একটা মুহুর্তও ও আরিশাকে না দেখে থাকতে পারছিলো না। তাই তাড়াহুড়ো করে বাসা থেকে বেরিয়ে পড়ে আরিশার বাড়ির উদ্দেশ্যে। যখন বাসা থেকে বেরিয়েছিলো তখন ঝড়-বাতাসের কোনো আভাস ছিলো না। ও জঙ্গলে পা রাখতেই ঝড়ো হাওয়া শুরু হয়েছে। যেন ও শহর থেকে জঙ্গলের জন্য তান্ডব বয়ে নিয়ে এসেছে। নির্ভীক ধীরপায়ে হেঁটে আরিশার বাড়ির পেছনে এসে দাঁড়ায়। আরিশা এবং ওর পরিবারের লোকজন বাড়ির সামনে উঠানে দাঁড়িয়ে আছে। একজন বোরকা পরিহিত মহিলাকে দেখা যাচ্ছে উঠানে। আর তিনজন পুরুষ। একপাশে আরিশা ছোট একটা ছেলের হাত ধরে দাঁড়িয়ে আছে। নির্ভীক আড়াল থেকে ওদের কথা শোনার চেষ্টা করে। বোরকা পরিহিত মহিলা আরিশাকে বলছে,
‘খুব সাবধানে থাকবি। কোনো ছেলেপিলে আসলেও তোর রাস্তা দেখিয়ে দিতে হবে না। রাফসান বাসায় না থাকলে তুই বেরুবি না একদম।’
আরিশা বাধ্য মেয়ের মতো মাথা নেড়ে ‘আচ্ছা’ বলে।
রাফসানের নাম শুনে কয়েক সেকেন্ডের জন্য চমকে ওঠে নির্ভীক। পরে ভাবে, নামটা ও কোথায় যেন শুনেছে। আবার ভাবে, একই নাম অনেকের থাকতেই পারে। আরেকটা বিষয়ে নির্ভীক আবার চিন্তায় পড়ে যায়। সেদিন পথ হারিয়ে নির্ভীক আসার খবরটা কি আরিশা ওর বাড়ির লোকজনকে বলে দিয়েছে?
পরক্ষণেই আবার ভাবে, বলতেই পারে। ও তো আরিশার কাছে একজন আগন্তুক মাত্র। হয়তো এতদিনে আরিশা ওকে ভুলেই গেছে। ও-ই আরিশাকে ভেবে মরিয়া হয়ে গিয়েছিলো। একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে নির্ভীক।
আশফাক আহমেদ ও আরমান দুপুরে খাওয়া দাওয়া শেষ করে দোকানে যাওয়ার পথে মিশমিকে বড় রাস্তায় পৌঁছে দেয়। জঙ্গল পেরিয়ে বড় রাস্তায় আসলে ওখান থেকে দশ মিনিটের দূরত্বে মিশমির বাড়ি। হেঁটেই যাওয়া যায়৷ বড় রাস্তা থেকে ভাইদের বিদায় জানিয়ে বাড়ির পথে হাঁটা দেয় মিশমি। মিশমি চলে যেতেই আশফাক আহমেদ ও আরমান নিজেদের দোকানে চলে যায়।
আরমান দোকানের দিকে যেতেই দেখে জঙ্গলের খানিকটা ভেতরে ওর দোকানের ঠিক পেছনে একটা বড় গাড়ি রাখা। আরমান সন্দিগ্ধ চোখে সেদিকে তাকায়। ওর মনে নানান চিন্তা ঘুরপাক খায়। জঙ্গলের ভেতর তো কেউ ঢোকে না। তাহলে অতবড় গাড়িটা কার? কেউ ঝড়বৃষ্টির কবল থেকে বাঁচার জন্য ওখানে বসে নেই তো? না, না তা কি করে হয়? ঝড়ের প্রকোপ থেকে বাঁচতে কেউ জঙ্গলে কেন ঢুকবে? তুমুল ঝড়ে গাছপালা ভেঙ্গে গাড়ির সাথে সাথে মানুষেরও তো চরম ক্ষতি হতে পারে? তাছাড়া গাড়িটা ওভাবে ঢেকে রাখা কেন? দেখে মনে হচ্ছে কেউ গাড়িটাকে আড়াল করতেই ওটা ওভাবে রেখেছে। ভেবে কুল-কিনারা পায় না আরমান।
প্রচন্ড ঝড়বৃষ্টি হবে বোঝাই যাচ্ছে। রাফসান আরিশাকে বললো,
‘তাড়াতাড়ি গোয়ালে আয়। গরু-ছাগলগুলোকে তো নিরাপদে রাখতে হবে। তুই তাড়াতাড়ি গুদাম থেকে পাটের বস্তা-টস্তা নিয়ে আয়। যা!’
আরিশা দৌঁড়ে বাড়ির পেছনে গেল। বাড়ির পেছনে বাড়ি থেকে আলাদা একটা ঘর আছে। এক দরজা বিশিষ্ট জানালাবিহীন মাটির ঘর। এই ঘরে গরুছাগলের প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র রাখা হয়৷ এটাকে বলা হয় গুদাম ঘর। তারপাশে দুটো উঁচু টিনের ঘর। সেগুলোতে ধান, গম রাখা হয়। আরিশা গুদাম ঘর থেকে একগাদা বস্তা নিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছিলো, হঠাৎ কারো হ্যাঁচকা টানে চমকে ওঠে চোখ বন্ধ করে ফেলে ও৷ একমুহূর্ত চুপ থেকে চোখ খুলে নির্ভিককে দেখতে পায়। সাথে সাথে আবার চমকে ওঠে কিছু সময়ের জন্য অচেনা চোখগুলোর দিকে তাকিয়ে থাকে। ধাতস্থ হওয়ার পর না চেনার ভান করে বলে,
‘কে আপনি?’
নির্ভীক ফিসফিস করে বলে, “এত তাড়াতাড়ি ভুলে গেলে?”
‘মনে রাখার কথা ছিলো নাকি?’ পাল্টা প্রশ্ন করে আরিশা।
‘তা ছিলো না। কিন্তু মনে রাখলেই পারতে।’
আরিশা নির্ভীকের মুঠো থেকে হাত ছাড়িয়ে নিয়ে বলে,
‘আবার এসেছেন কেন? এবার নিশ্চয়ই পথ ভুলে আসেননি?’
“পথ ভুলে যদি পাই তোমার খোঁজ
সেই পথ আমি ভুলতে পারি রোজ।”
ঘোর লাগা কন্ঠে বলে নির্ভীক।
কথাটা আরিশার এত ভালো লাগলো যে ও খানিকক্ষণ কোনো কথাই বলতে পারল না। পরে নিজেকে সামলে বললো,
‘ঝড়-বৃষ্টির দিনে জঙ্গলে এসেছেন কেন? ফিরবেন কিভাবে?’
‘ফেরার কথা পরে ভাববো। তার আগে তোমার সাথে আমার অনেক কথা আছে।’
আরিশা অবাক হয়ে জানতে চায়,
‘আমার সাথে কি কথা?’
‘অনেক অনেক কথা জানার আছে। প্লিজ আরিশা, শুনবে আমার কথাগুলো?’
আরিশা কিছু বলার আগে রাফসানের ডাক শোনা গেল।
‘আরিশা, বস্তা কি তুই বানিয়ে আনছিস নাকি? কতক্ষন লাগে আসতে?’
আরিশা নির্ভীকের দিকে তাকিয়েই জবাব দেয়,
‘এই তো চাচ্চু আসছি।’
এরপর ফিসফিস করে বলে, ‘চাচ্চু ডাকছে। তুমুল ঝড় হতে পারে। আপনি ফিরে যান। বৃষ্টি বাড়লে পরে আর ফিরতে পারবেন না।’
‘আর ইউ ক্র্যাজি? এতদূর এসে আমি ফিরে যাবো? তোমার সাথে কথা না বলেই?’
‘তাহলে কি করবেন শুনি? ঝড়-বৃষ্টির দিনে বেরিয়েছেন কেন আপনি?’
‘আরে ঝড় তো এখানে আসার পর শুরু হয়েছে। এখনও তো ঝড়ো হাওয়া দিচ্ছে ঝড় শুরুই হয়নি। তাছাড়া এরচেয়ে ভয়ানক ঝড় তো আমার মনে চলছে।’
‘আচ্ছা আপনি একটু দাঁড়ান। আমি বস্তাগুলো দিয়েই আসছি। আর আপনি একটু আড়ালে গিয়ে দাঁড়ান। নাহয় আমার জীবনেই ঝড় শুরু হয়ে যাবে।’
নির্ভীক মুচকি হেসে সরে গেল। আরিশা দৌঁড়ে বস্তা নিয়ে গোয়ালে ঢুকলো। রাফসান সেগুলো ওর হাত থেকে নিয়ে বিরক্ত মুখে বললো,
“বানিয়ে এনেছিস বোধহয়?”
‘চা..চচ্চু, আমি গুদাম থেকে একটু আসছি।’ আমতা আমতা করে বলে আরিশা।
‘আবার গুদামে? গুদামে কি? ওখানে কেউ আছে নাকি? গুদামে মধু ঝরে ঝরে পড়ছে মনে হচ্ছে?’
আরিশা ভেতরে ভেতরে চমকালেও পরে বুঝতে পারে যে, রাফসান মজা করে বলেছে। ও বলে, ‘দরজা আটকাতে ভুলে গেছি। ঝড়ে সব লন্ডভন্ড হয়ে যাবে।’
‘যা, যা তাড়াতাড়ি আটকে আয়।’
আরিশা তানজীরকে বললো, ‘তুই চাচ্চুকে একটু সাহায্য কর হ্যাঁ?’
‘সাহায্য করতে হবে না। আমি পারব, তুই যা।’ বস্তা খুলতে খুলতে বলে রাফসান।
আরিশা যেভাবে ছুটে গিয়েছিল সেভাবেই ছুটে নির্ভীকের কাছে এসে বললো,
‘তাড়াতাড়ি বলুন কি বলবেন? চাচ্চু অপেক্ষা করছে আমার জন্য।’
নির্ভীক আরিশার চোখে চোখ রেখে বললো, ‘তোমার চাচ্চুর নাম কি?’
‘চাচ্চুর নাম? নাম দিয়ে আপনি কি করবেন?’ চোখ ছোট ছোট করে বলে আরিশা।
‘আহা! বলোই না।’
‘কেন বলবো? আপনাকে তো আমি চিনি না।’
‘ওহ হ্যাঁ, তাই তো কেন বলবে? তোমার চাচ্চুর নাম দিয়ে যদি আমি ফেমাস হয়ে যাই?’ মন খারাপ করে অন্যদিকে ফিরে গেল নির্ভীক।
নির্ভীকের গোমড়া মুখ দেখে আরিশার ভীষণ হাসি পেলো। হাসি চেপে ও বললো,
‘আমার চাচ্চু বিখ্যাত কেউ না। আর আপনি এটা জানার জন্য এতদূর এসেছেন?’
‘এটা জানার জন্য আসিনি। কিন্তু এখন জানতে ইচ্ছে করছে।’
‘কেন?’
‘তোমার চাচ্চুকে কেমন চেনা চেনা লাগছে তাই।’
‘আমার চাচ্চুকে চেনা লাগছে? সত্যি?’ অবাক হয় আরিশা।
‘হ্যাঁ সত্যি। এখন নামটা বলো প্লিজ?’
‘নাম পরে বলবো। তার আগে আপনি যে কথাটা বলতে এসেছেন সেটা বলুন।’
‘আচ্ছা বলবো। তার আগে বলো, সেদিন আমার আসার কথাটা তোমার চাচ্চুকে বলে দিয়েছো?’
‘হুম।’
‘কেন?’
‘বারে, আপনি আমার প্রেমিক নাকি যে আপনার কথা লুকিয়ে রাখতে হবে?’
এই কথায় থতমত খেয়ে গেল নির্ভীক। বিড়বিড় করে বললো,
‘হলেও কি সমস্যা?’
আরিশা মাটির দিকে তাকিয়ে বললো,
‘তাছাড়া আমি আব্বু-চাচ্চুদের কাছে কিছু লুকাই না।’
‘হুম ভালো।’ মুচকি হেসে বলে নির্ভীক।
‘আচ্ছা, এবার আপনি কি বলতে চেয়েছিলেন সেটা বলুন তো?’
‘বলছি৷ কিন্তু তার আগে তোমার আমাকে একটা কথা দিতে হবে।’
‘কি কথা?’
‘আমি যা বলবো সেসব তুমি তোমার পরিবারকে জানাতে পারবে না।’
‘মানে? কেন?’
‘আই মিন, আপাতত বলবে না। পরে অবশ্যই বলো। কিন্তু সঠিক সময় হলে বলো।’
‘সঠিক সময় কবে?’
‘সেটা পরে বলবো।’
‘আপনার কথার মাথামুণ্ডু কিছুই বুঝতে পারছি না আমি। একটু খোলাসা করে বলবেন?’
নির্ভীক কিছুক্ষণ চুপ থেকে মাথা নিচু করে বললো,
‘আমি অত লুকিয়ে-চুরিয়ে কিছু বলতে পারি না। যা বলতে চাই সরাসরি বলবো। তুমি কিছু মনে করলে বা তুমি আমাকে ফিরিয়ে দিলে কিংবা এর জন্য যদি তোমাকে আমি হারিয়েও ফেলি তাহলেও আমি আড়াল করতে পারবো না। তোমাকে কথাটা বলে হারিয়ে ফেললেও আমার ততটা কষ্ট হবে না, যতটা না বলতে পারার আফসোসে সারাজীবন হবে।’
‘কথাটা কি? আর আমাকে হারিয়ে ফেলবেন মানে কি? আমি তো আপনার কেউ না।’ ভ্রু কুঁচকে বলে আরিশা।
‘তুমি আমার অনেককিছু আরিশা। অনেক কিছু। ইউ আর মাই এভরিথিং!’
আরিশা নির্ভীকের কথার মাথামুণ্ডু কিছুই বুঝলো না। ও ফ্যালফ্যাল করে নির্ভীকের দিকে তাকিয়ে রইলো। নির্ভীক বলে গেল,
‘যেদিন প্রথম তোমাকে দেখেছি সেদিন আমার কি হয়েছিলো আমি জানি না। কেমন ঘোরের মধ্যে চলে গিয়েছিলাম। তোমার সাথে কথা বলতে অন্যরকমের ভালোলাগা কাজ করছিলো আমার ভেতর। এখান থেকে যাওয়ার পরও সারাক্ষণ তোমার কথা ভেবেছি। গত কয়েকটা দিন অনবরত তোমার কথা ভাবতে গিয়ে পাগল পাগল অবস্থা হয়েছে আমার। কোনোকিছুতে মন দিতে পারছি না আমি। শুধু তোমাকে দেখতে ইচ্ছে করছিলো। তাই তো অপেক্ষা করতে না পেরে তোমার কাছে ছুটে এসেছি। আমার জীবনে আগে কখনো এরকম হয়নি। আমার সবকিছু শুন্য শুন্য লাগে। ইভেন, তুমি জানো আমি এই কয়দিন ফটোগ্রাফিও করতে পারিনি। অথচ ফটোগ্রাফি ছিল আমার সবকিছু। তোমাকে একবার দেখার পর থেকে আমার জীবনটা পুরোপুরি পাল্টে গেছে। আমি তোমাকে খুব ভালোবেসে ফেলেছি। হুরপরী, তুমি কি আমাকে তোমার রাজ্যের রাজা হিসেবে স্বীকৃতি দিবে?”
আরিশা কি বলবে ভেবে পেলো না। এরকম পরিস্থিতিতে ও আগে কখনো পড়েনি। ওর ভেতরে কেমন যেন শিহরণ অনুভূত হচ্ছে। ওকে চুপ থাকতে দেখে নির্ভীক বলে,
‘এখনই তোমাকে কিছু বলতে হবে না। আমি আবার আসবো কয়েকদিন পর। তখন নাহয় উত্তরটা দিও।’
নির্ভীক আরিশার হাতের ভেতর একগুচ্ছ কৃষ্ণচূড়া ও একটা ছোট্ট খাম গুজে দিয়ে জঙ্গল থেকে বেরিয়ে গেল। নির্ভীক ঝড়ো হাওয়া উপেক্ষা করে দ্রুত ঝোপের আড়ালে রাখা গাড়িতে উঠে বসে৷ এরপর ড্রাইভ করে বড় রাস্তা ধরে বেরিয়ে যায়। বড় গাড়িটা বেরুতে দেখে আরমান ছুটে দোকানের বাইরে আসে। কিন্তু ততক্ষণে গাড়িটা চোখের আড়ালে চলে গেছে। আরমান চিন্তিত ভঙ্গিতে আবার দোকানে ঢুকে পড়ে।
আরিশা তখনো বাকরুদ্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। রাফসান ওকে ডাকছে অনেকক্ষণ ধরে। সাড়া না পেয়ে রাফসান নিজেই আরিশার কাছে এসে বলে,
‘কি হয়েছে তো…’
আরিশার হাতের খাম ও কৃষ্ণচূড়ার দিকে চোখ পড়তেই রাফসান আরিশাকে ঝাঁকি দিয়ে বলে,
‘এগুলো কি? কোথায় পেয়েছিস? দেখি।’
রাফসান হাত বাড়ায় আরিশার হাতের ফুলের গুচ্ছ ও খামের দিকে।
#Be_Continued_In_Sha_Allah ?