#অ্যাসিড
নাফীছাহ ইফফাত
পর্ব ১২
বাইরে তুমুল বৃষ্টি শুরু হয়েছে। ইলেক্ট্রিকের কালো তার বেয়ে পিঁপড়ের মতো বৃষ্টির ফোটা বয়ে চলেছে। জানালার কাঁচে ঝমঝম শব্দে আঁছড়ে পড়ছে বৃষ্টি। চারপাশের পরিবেশ ঠান্ডা হয়ে আছে। শিরশির করা একটা পরিবেশ। এটা এমন এক সময় যে, ফ্যান ছাড়লে ঠান্ডা লাগে, বন্ধ করলে গরম লাগে। তবে মইনুল আহসানের কেবিনে এসি চলছে। তাও তিনি দরদর করে ঘামছেন। রাগে তার সারা শরীর জ্বলে যাচ্ছে।
মইনুল আহসানকে পুরো ঘটনা খুলে বলতেই কড়া একটা ধমক খেল ইমরান।
‘অতদূর গিয়ে তুমি নির্ভীককে হারিয়ে ফেললে? আবার না খুঁজে চলেও এলে! আর ইউ ক্র্যাজি? সিরিয়াসলি? একটু অপেক্ষা করতে পারলে না? আরেকটু অপেক্ষা করলে ও নিশ্চয়ই বেরিয়ে আসতো, তাই না?’
‘স্যার, আপনি তখনকার পরিস্থিতি জানেন না। আকাশ ঘন কালো মেঘে ছেয়ে গিয়েছিলো একদম। আর সে কি ঝড়ো হাওয়া বইছিলো। হাওয়ায় গাছপালাগুলো এত বেশি দুলছিলো, ডালপালা ভেঙ্গে পড়ার…’
‘হেই শাট আপ! তুমি আমাকে আবহাওয়ার সংবাদ শোনাচ্ছো? ফাজলামো হচ্ছে এটা?’ তুমুল রেগে টেবিলে কিল দিয়ে বলেন মইনুল আহসান।
ইমরান মাথা নিচু করে বলে, ‘সত্যি বলছি স্যার।’
মইনুল আহসান এসির স্পিড বাড়িয়ে দেন। এরপর দীর্ঘশ্বাস নিয়ে নিজেকে শান্ত করে বলেন,
‘নির্ভীকও তো তোমার মতোই শহর থেকে গিয়েছিল। ঝড়ো হাওয়া দেখে শুধু তোমার নিজের বিপদের কথাই মনে পড়লো? একবারও মনে হলো না নির্ভীকেরও বিপদ হতে পারে?’
ইমরান চমকে তাকায় মইনুল আহসানের দিকে। বিস্ফোরিত কন্ঠে বলে, ‘কি বলতে চাইছেন স্যার? ওকে নিরাপদে নিয়ে আসা?’
‘রাস্কেল! আমি সেটা বলিনি। তুমি নিজের বিপদের আশঙ্কা করে পালিয়ে এসেছো। নির্ভীকও নিশ্চয়ই নিজের বিপদের কথা ভেবেছিল। ঝড়-বৃষ্টির মধ্যে ও কতক্ষন আর গহীন জঙ্গলে আটকে থাকতো? কিছুক্ষণের মধ্যে নিশ্চয়ই বেরিয়ে আসতো, তাই না?’
‘তাই তো স্যার। এটা তো ভেবে দেখিনি৷’ মাথা চুলকে কাঁচুমাচু ভঙ্গিতে বলে ইমরান।
‘সামান্য একটা বোকামির জন্য ওকে ফলো করার মোক্ষম সুযোগটা তুমি হারালে।’ ফোঁস করে শ্বাস ছেড়ে বলেন মইনুল আহসান।
‘স্যার বিশ্বাস করুন, আমি সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছি ওকে ধরার। কিন্তু পারিনি।’
‘ঐটুকু একটা ছেলেকে তুমি ধরতে পারলে না? এটা বিশ্বাস করার মতো কোনো কথা?’ বিরক্তি নিয়ে বলেন মইনুল আহসান।
ইমরান মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইলো। মইনুল আহসান পকেটে হাত ঢুকিয়ে মাথা থেকে পা সমান জানালার কাঁচের সামনে গিয়ে দাঁড়ান। সন্ধ্যা নামছে। বৃষ্টির কারণে বিকেল থেকেই সবকিছু অন্ধকার হয়ে ছিল। এখন আরও বেশি অন্ধকার দেখাচ্ছে চারপাশটা। রাস্তায় ল্যাম্পপোস্টের বাতিগুলো জ্বলে উঠেছে। বৃষ্টিকে উপেক্ষা করে প্রাইভেট গাড়িগুলো ছুটে চলেছে আপন গন্তব্যে। মইনুল আহসান গাড়িগুলোর দিকে তাকিয়ে বললেন,
‘এখন যাও তুমি। পরবর্তী মিশনের জন্য রেডি থাকো। নির্ভীকের ওপর নজর রাখো।’
‘অকে স্যার।’ মাথা নেড়ে বলে ইমরান।
‘অর ইয়াহ লিসেন! নেক্সট টাইম যেন কোনো ভুল না হয়।’
‘হবে না স্যার।’
‘নাও গো!’
ইমরান বেরিয়ে গেল। মইনুল আহসান ঠায় দাঁড়িয়ে রইলেন জানালার কাছে।
বৃষ্টি শুরু হওয়ায় বিকেলে আরিশার আর কাজ করা হলো না। তাছাড়া নির্ভীক যাওয়ার পর থেকে ওর শরীর খারাপ হতে শুরু করেছে। সকালে বেশিক্ষণ পুকুরে ডুবে থাকায় হয়তো জ্বর উঠি উঠি করছে। বিকেল থেকে বিছানায় শুয়ে আছে আরিশা। ওর পাশে তানজীর বসে গল্পের বই পড়ছে। রাফসান রান্নাঘরে রান্না নিয়ে ব্যস্ত। আরিশা একবার গিয়েছিল রান্নাঘরে। ওর ঢুলুঢুলু, ফোলা চোখ দেখে রাফসান ওকে বিশ্রাম নিতে বলেছে। আরিশার বিছানার পাশে তানজীরকে বসিয়ে রেখেছে যেন আরিশা উঠে চলে না যায়। তানজীরও মামার কথামতো বোনের পাশে বসে আছে।
আরিশার অবশ্য বিছানা থেকে উঠতে ইচ্ছে করছে না। সারাদিনের অক্লান্ত পরিশ্রমের পর ক্লান্তিতে ওর চোখ বুজে আসছে। আধোঘুম-আধো জাগরণে ওর নির্ভীকের কথা মনে পড়ে। তখন আরিশা সেভাবে কেন রেগে গেল আরিশার এখনো মাথায় ঢুকছে না। নির্ভীক ভবিষ্যতের কথা ভাবেনি বলে? ভাববেই বা কেন? নির্ভীক তো ঠিকই বলেছে। আরিশা যদি ওকে ফিরিয়ে দিতো তাহলে তো ওর স্বপ্ন ভেঙ্গে চুরমার হয়ে যেত। তারমানে কি ও নির্ভীককে ফিরিয়ে দেয়নি? গ্রহণও তো করেনি। তাহলে কি করেছে? আচ্ছা, নির্ভীক যাওয়ার সময় হাসছিল কেন? আর ও কি বুঝে যাওয়ার কথা বলছিলো? নির্ভীক কি আবার আসবে? আসলে আরিশা ওর সাথে একদমই কথা বলবে না। কেন বলবে? ও তো আরিশার কেউ না। ওর সাথে আরিশার মিল কখনোই হওয়ার নয়।
আরিশা আবার ভাবে, ও তো আসলেই নির্ভীকের কেউ না। তাহলে নির্ভীক ওকে নিজের কেউ ভাববে কেন? আচ্ছা, নির্ভীক আসলে ওর রাগ হয় না কেন? নির্ভীককে দেখলেই কেমন যেন অনুভূতি হয়। মুখে যতই আরিশা ওকে না আসতে বলুক, চলে যেতে বলুক নির্ভীক আসলে কিন্তু ওর ভালোই লাগে। কেন ভালো লাগে? নির্ভীক তো ওর কেউ না। চিনেও না কেউ কাউকে। মাত্র তিনদিনের পরিচয় ওদের। এই কদিনেই কেন নির্ভীককে ওর ভালো লাগে?
মনের ভেতর গাদা গাদা প্রশ্ন নিয়ে এলোমেলো ভাবনা ভাবতে ভাবতে আরিশা ঘুমিয়ে পড়ে।
সেদিন রাফসানের নাম শোনার পর থেকে মনের ভেতর উশখুশ করছে নির্ভীকের। নামটা ওর খুব চেনা চেনা লাগছে। মনে হচ্ছে আগেও কোথায় যেন শুনেছে। বিছানায় শুয়ে নির্ভীক এলোমেলো ভাবনা ভাবছিলো। মিসেস শায়লা এসে ওর পাশে বসেন। ভ্রু কুঁচকে ওর দিকে ঝুঁকে বলেন,
‘কি ভাবছো বাপ?’
নির্ভীকের ভাবনার সুতো ছিঁড়ে। ও কাত হয়ে মিসেস শায়লার কোলে মাথা রেখে বলে,
‘খুবই চিন্তায় আছি মম।’
‘কি হয়েছে?’
‘মম, তোমাকে কয়েকটা প্রশ্ন করবো। প্লিজ উত্তর দিও, প্লিজ মম।’ কোল থেকে মাথা তুলে মায়ের হাত ধরে বলে নির্ভীক।
ওর বলার ভঙ্গিতে অবাক হয় মিসেস শায়লা। নির্ভীকের হাত ছাড়িয়ে নিজেই ওর হাত ধরে বলেন,
‘এভাবে কেন বলছো? কি প্রশ্ন বলো আমাকে? আমি নিশ্চয়ই উত্তর দিবো।’
‘ফুফিকে নিয়ে প্রশ্ন মম!’ মায়ের চোখে চোখ রেখে বলে নির্ভীক।
মিসেস শায়লা সাথে সাথে নির্ভীকের হাত ছেড়ে দেন। নির্ভীক আবার হাত ধরে বলে,
‘মম, শুধু একটা প্রশ্ন। প্লিজ আন্সার দাও না।’
মিসেস শায়লা খানিকক্ষণ কিছু ভাবলেন। এরপর বললেন, ‘বলো?’
‘ফুফির পরিবারে কতজন লোক ছিলো, মম?’
‘তোমার ফুফি-ফুফাসহ পাঁচজন।’
নির্ভীক কিছু একটা ভাবল। এরপর বললো,
‘কে কে ছিল?’
‘আচ্ছা, এসব জেনে এখন তুমি কি করবে বলতো?’ বিরক্ত হয়ে বলেন শায়লা।
‘আমার দরকার আছে বলেই বলছি। বলো না প্লিজ!’
‘তোমার ফুফি-ফুফা, তোমার ফুফার দুই ভাই, আর বাবা।’
নির্ভীক আবার ভাবলো। ফুফি যেহেতু বেঁচে নেই তাহলে ওদের লোকসংখ্যা চারজন। আবার যেহেতু ফুফির একটা মেয়ে ছিল সেহেতু ওদের পরিবারের সদস্য আবার পাঁচজন। নাহ, মিলছে না। নির্ভীক আবার প্রশ্ন করে,
‘আচ্ছা, ফুফির দেবরের নাম কি ছিল?’
এবার চরম বিরক্তি নিয়ে মিসেস শায়লা উঠে দাঁড়ালেন।
‘এসব জেনে তোমার কি লাভ বলবে একটু? তোমার বাবা শুনলে আবার তুলকালাম কান্ড শুরু হবে। কেন বারবার ফুফি, ফুফি করছো?’
‘বাবাকে আমি সামলে নিবো। তুমি আগে আমার প্রশ্নের জবাবটা দাও। প্লিজ মম, প্লিজ। আমার খুব দরকার৷’ আকুতি করে বলে নির্ভীক।
‘এটাই তাহলে শেষ। আর কোনো প্রশ্ন করা যাবে না।’
‘অকে। বলো দেবরের নাম কি ছিল?’
‘কোন দেবর? বড়টা না ছোটটা?’
‘দুজনের নামই বলতে পারো। তবে আপাতত ছোটজনের নাম বললেই হবে।’
‘রা…’
মিসেস শায়লা নাম বলার আগেই দরজার দিকে তাকিয়ে থমকে যান। হোসাইনুল আলম দাঁড়িয়ে আছেন দরজায়। মায়ের দেখাদেখি নির্ভীকও তাকায় দরজার দিকে। ভয়ে চুপসে যায় ও। মনে প্রশ্ন জাগে, ড্যাড কিছু শুনলো না তো?’
সানজু, ইয়াদ, মিনহাজ, রাকিব ও রিয়া ভিডিও কলে কথা বলছে। গতকালকের ঘটনা নিয়ে ওরা আলোচনা করছে। রাকিব ও রিয়া সব শুনে বলে,
‘তোরা ওভাবে চলে না এলেও পারতি। হয়তো কোনোভাবে নির্ভীককে পেয়ে যেতি।’
‘হয়তো পেতাম। কিন্তু তখন ঝড়বৃষ্টি উপেক্ষা করে একচুয়েলি আমরা ওখানে থাকতে চাইছিলাম না।’ ইয়াদ বলে।
‘তোরা জানিস না, জঙ্গলের ঝড়বৃষ্টির মানে কি? পুরো ভয়ংকর হয়ে উঠেছিল জঙ্গলটা। ঘন কালো অন্ধকারে ঢেকে গিয়েছিল।’ সানজু বলে।
‘আচ্ছা বুঝলাম। এখন তোর নেক্সট প্ল্যান কি? শুনলাম নির্ভীকের বাড়িতে গিয়ে তুই ঝামেলা করেছিস? ওর দাদু ভাইয়ের তো হার্ট অ্যাটাক হলো।’ রাকিব বলে।
‘আরে ধুর! আর বলিস না। বুইড়াটা এখনো সব সম্পত্তি নিজের নামে করে রেখেছে। না আঙ্কেলকে ভাগ দিয়েছে, না নির্ভীককে।’ বিরক্তি নিয়ে বলে সানজু।
‘তুই এখনই কেন সম্পত্তি নিয়ে ভাবছিস? নির্ভীকের মন পাওয়ার চেষ্টা কর। তাহলে তো সবটা ইজি হয়ে যায়। তাছাড়া দোস্ত, নির্ভীক ছেলেটা কিন্তু ভীষণ ভালো।’ রিমি বলে।
‘তাই নাকি? বিয়ে করবি তুই? আচ্ছা আমি যখন সব সম্পত্তি নিজের করে নিবো তখন নাহয় তুই ওর পাশে গিয়ে দাঁড়াস।’ সানজু হাসতে হাসতে বলে। ওর হাসিতে তাল মিলিয়ে রাকিব বাদে সবাই হো হো করে হেসে ফেললো।
রিয়া অপমানে লাল হয়ে চুপ করে রইলো। রাকিব বললো,
‘ঠিক আছে, তোরা প্ল্যান কর। আমি আসি।’
‘আমরাও যাবো এখন। সব প্ল্যান কাল ভার্সিটিতে হবে।’
বলে ফোনের লাইন কাটে ওরা।
নির্ভীক শুয়ে শুয়ে ভাবে, ড্যাড কেন ফুফিকে সহ্য করতে পারে না? এ’বাড়িতে ফুফির কথা কেউ বলে না কেন? একজন মৃত ব্যক্তির কি অপরাধ থাকতে পারে? ফুফি তো দূর্ঘটনায় মারা গিয়েছে। যে দূর্ঘটনায় মারা যায় সে কিভাবে কোনো অপরাধ করতে পারে? নাকি কেউ ষড়যন্ত্র করে ফুফিকে মেরে ফেলেছিলো? তাই যদি হয় তাহলে ফুফির তো কোনো দোষ নেই। ফুফির নাম কেন ড্যাড সহ্য করতে পারে না? ফুফি কি ড্যাডের কোনো ক্ষতি করেছিলো?
নানান প্রশ্নে মাথার ভেতরটা গিজগিজ করছে। এতসব প্রশ্নের উত্তর একমাত্র দাদু-দাদু ভাইয়া দিতে পারে। ওরা ছাড়া ফুফির কথা এ’বাড়িতে আর কেউ বলে না। কেউ সহ্য করতে পারে না ফুফিকে। কেন পারে না? এই প্রশ্নের উত্তরও নির্ভীকের অজানা। ও মনে মনে দৃঢ় প্রতিজ্ঞা করে, সব প্রশ্নের উত্তর ওকে জানতেই হবে। এভাবে একজন মৃত ব্যক্তি সবার কাছে অপরাধী হয়ে থাকতে পারে না। কিছুতেই না।
রাহীকে ফোন দেয় নির্ভীক। ওর সব প্রশ্নের উত্তর এখন জানা সম্ভব না, আবার প্রশ্নগুলো মাথা থেকে তাড়ানোও সম্ভব না। দীপু ও রাহীর সাথে থাকলে ও সবকিছু ভুলে থাকতে পারবে।
নির্ভীকের ফোন পেয়েই রিসিভ করে রাহী।
‘দোস্ত, কি খবর? গার্লফ্রেন্ডের দেখা পেলি?’
‘হু পেলাম। আচ্ছা শোননা…’
নির্ভীককে থামিয়ে রাহী বলে, ‘আগে আমার কথা শোন। ওখানে কি হয়েছে বল?’
‘আরে সব ডিটেইলসে বলবো। আগে তুই আর দীপু আমার বাসায় চলে আয়। তারপর একসাথে সব বলবো।’ নির্ভীক বলে।
‘রাত সাড়ে নয়টা বাজে। এখন গেলে ফিরবো কবে?’
‘একেবারে চলে আয়। কাল ভার্সিটি থেকে ফিরবি।’
‘ওক্কে দোস্ত!’
‘দীপুকে তুই ডেকে নিবি না আমি ফোন দিবো?’
‘আমিই ডেকে নিচ্ছি। বারান্দায় গিয়ে ডাক দিলেই বেরুবে ও।’ হেসে বলে রাহী।
রাহী ও দীপুর বাসা পাশাপাশি। মাঝখানে শুধু ছোট একটা রাস্তার ব্যবধান।
নির্ভীক মন খারাপের ভান করে বলে, ‘তোদের এই একটা সুবিধা। যখন ইচ্ছে দেখা করতে পারিস, কথা বলতে পারিস।’
‘কেন এখন তোর সাথে কথা বলছি না? দেখাও তো করবো একটু পর।’ হেসে বলে রাহী।
কথা বলতে বলতেই দীপুকে ডেকে নেয় রাহী।
‘তাও তোদের চেয়ে আমার দূরত্বটা বেশি।’ নির্ভীক বলে।
‘দোস্ত, মনের টানই বড় টান বুঝলি?’ হো হো করে হাসে রাহী।
‘হুম, জলদি আয়। দীপুকে ডেকেছিস তো?’
‘বন্ধু, আমরা চলে এসেছি। আর দু’মিনিট।’ চেঁচিয়ে বলে দীপু।
নির্ভীক ও রাহী হেসে ফেলে। নির্ভীক বলে, ‘ওকে, ফাস্ট আয়। ফোন রাখলাম।’
আলমারি থেকে ৫/৬ টা মোটা কম্বল বের করে আরিশাকে ঢেকে দেয়া হয়েছে। তবুও সে রি রি করে কাঁপছে। সন্ধ্যার পর থেকে প্রচন্ড জ্বর ওর। সন্ধ্যা থেকে রাফসান ওকে অনবরত জলপট্টি দিয়েছে। তবুও বিন্দুমাত্র জ্বর কমেনি ওর বরং আরও বেড়েছে। বাইরে বজ্রপাতের সাথে সাথে তুমুল বৃষ্টি হচ্ছে। একেকটা বজ্রপাতের শব্দে কানে তালা লেগে যাওয়ার জোগাড়। নির্জন, নিস্তব্ধ পরিবেশটাকে ভয়াবহ শব্দে তোলপাড় করে দিচ্ছে বজ্রপাতের সেই তুমুল শব্দ।
আশফাক আহমেদ ও আরমান এখনো বাড়ি ফেরেনি। ঝড়ে আটকে গেছে ওরা। আরিশার মাথার কাছে তানজীরকে বসিয়ে বাড়ির সদর দরজার সামনে দাঁড়ায় ও। চিন্তিত মুখে সামনে তাকিয়ে থাকে। ঝড়ের প্রকোপে রাস্তাঘাটে সন্ধ্যার সময়ই অন্ধকার নেমে এসেছিলো। রাত যত বেড়েছে ঝড়ের তান্ডবও তত বেড়েছে। রাফসানের ধারণা, গাছপালা ভেঙ্গে জঙ্গলে ঢোকার পথটাও হয়তো বন্ধ হয়ে গেছে। তাই আরমান ও আশফাক আহমেদ বাড়ি ফিরতে পারছেন না। এত ঝড়ের মধ্যে যে ও গিয়ে ভাইদেরকে কিছুটা এগিয়ে আনবে তাও পারছে না। একে তো ঝড়-বৃষ্টিকে উপেক্ষা করে বেরোনো কিছুতেই সম্ভব না। তারওপর আরিশা-তানজীর ঘরে একা রয়েছে। ওদেরকে ছেড়েও যাওয়া যাবে না। তার সাথে মরার উপর খাড়ার ঘাঁ হিসেবে যুক্ত হয়েছে আরিশার জ্বর। চিন্তায় অস্থির হয়ে যায় রাফসান। কি করবে ভেবে পায় না।
সন্ধ্যার আগে আরিশাকে বিশ্রাম নিতে দিয়ে দোকান থেকে ফেরত আনা দুধগুলো রাফসান অনেক সময় নিয়ে গরম করেছে। এরপর আঁধার নেমে আসা সত্ত্বেও একা হাতে গোয়াল ও খামারের সব পশুপাখিদের সেবা-যত্ন করেছে। ঝড়ে যাতে কোনো পশুপাখির ক্ষতি না হয় সেভাবে গোয়াল ও খামারের চারপাশে মোটা পলিথিন দিয়ে পানি না ঢোকার ব্যবস্থা করেছে। এসব করতে গিয়ে ওর শক্তি যখন ফুরিয়ে এসেছে তখন আবার বিনা বিশ্রামে রান্নাঘরে ঢুকে সবার জন্য রান্না চাপিয়েছে। সারাদিনের সব কাজ শেষে যখন সে রেস্ট নিতে যাবে ঠিক তখনই আরিশার কাঁপাকাঁপি খেয়াল করে সে। এরপর থেকে আবার লেগে পড়ে আরিশার সেবায়। ক্লান্তিতে শরীর অবশ হয়ে আসে রাফসানের।
একে তো সারাদিনের ক্লান্তি তারওপর ভাইদের জন্য দুশ্চিন্তা। রাফসানের শরীর এতকিছু আর সইতে পারছে না। ও সদর দরজার সামনে ধপ করে বসে পড়ে। কি করার আছে ওর? আরিশাকে ডাক্তার দেখানো উচিত। ওর জ্বর কমছে না। কিন্তু ঝড়বৃষ্টির রাতে এই গহীন জঙ্গলে ও ডাক্তারই বা কই পাবে? আর ভাইদেরকে কিভাবে ফিরিয়ে আনবে? ওর যে শরীরে একবিন্দু শক্তি অবশিষ্ট নেই। রাফসান থম মেরে বসে থাকে দরজায়।
#Be_Continued_In_Sha_Allah ❣️