#অ্যাসিড
নাফীছাহ ইফফাত
পর্ব ১১
নিজের রুমে ইজি চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে আছেন আহমদুল হক। এক দৃষ্টিতে বাইরে তাকিয়ে আছেন তিনি। আহমদুল হকের মেজর হার্ট অ্যাটাক হয়েছে। তাই হাসপাতালেই কয়েকদিন কাটাতে হলো। আজ ওনাকে বাসায় নিয়ে আসা হয়েছে। আগের চেয়ে বেশ খানিকটা সুস্থ হয়েছেন তিনি৷
নির্ভীক দরজায় কড়া নেড়ে মুচকি হেসে বলে,
‘দাদু ভাইয়া, আসবো?’
আহমদুল হক হাতের ইশারায় ওকে আসতে বললেন। নির্ভীক ভেতরে এসে আহমদুল হকের পায়ের কাছে বসে বললো,
‘এখন কেমন আছো তুমি?’
‘আলহামদুলিল্লাহ ভালো।’
নির্ভীক খানিকক্ষণ চুপ থেকে বললো, ‘দাদু ভাইয়া, তোমাকে একটা কথা বলতাম।’
‘বলো?’
নির্ভীক যেন খানিকক্ষণ সময় নিলো। রাফসানের কথাটা বলবে কিনা ভাবছে ও। সেদিনই বলবে ভেবেছিল কিন্তু হঠাৎ উনি অসুস্থ হয়ে পড়ায় আর বলা হয়নি।
আহমদুল হক বললেন, ‘কি হলো? বলো?’
নির্ভীক চট করে সিদ্ধান্ত বদলে বললো, ‘না থাক, আরেকদিন বলবো৷ তুমি রেস্ট নাও।’ বলে উঠে দাঁড়ালো নির্ভীক।
আহমদুল হক ওকে পিছু ডেকে বললেন, ‘দাদুভাই শোনো?’
‘বলো শুনছি।’ আহমদুল হকের একহাত নির্ভীক হাতের মুঠোয় নিয়ে বলে।
‘তুমি সানজু মেয়েটা থেকে খুব সাবধানে থাকবে। ওর সাথে বেশি মিশো না যেন।’
‘আমার এমনিতেই ওকে ভালো লাগে না দাদু ভাইয়া। ও নিজেই আমার পিছু পিছু ঘোরে। ফালতু মেয়ে একটা।’
‘তোমার বাবা চায় তুমি ওকে বিয়ে করো। কিন্তু আমি চাই না।’
‘আমিও চাই না দাদু ভাইয়া। ওর ভেতরের রূপটা বাবা জানে না, আমি জানি। ওর মতো জঘন্য মানুষ আমি পৃথিবীতে আর দেখিনি।’
‘আমি সবসময় তোমার পাশে আছি। একদমই ভয় পেওনা তুমি।’
নির্ভীক মুচকি হেসে আহমদুল হককে জড়িয়ে ধরে।
সকাল থেকে আরিশা ও তানজীর গর্তের ভেতর তুমুল ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছে। ওদের সাথে অবশ্য পুঁচকুও আছে। আরিশার গর্তের নিচের বাড়িটার কাজ আজকে সম্পন্ন হবে। কাল থেকে ওরা এখানে দিব্যি সময় কাটাতে পারবে।
আরিশা ভোরে প্রায় দু’ঘন্টা পুকুরে ডুবে ছিলো। পুকুুর থেকে কাদামাটি তুলে ঘাটের পাশে স্তুপ বানাচ্ছিলো। তানজীর বসেছিলো ঘাটের একপাশে। ও সংখ্যা গুণছিলো আরিশা কতক্ষণ পানিতে ডুবে থাকতে পারে। আরিশা বড়সড় একটা গামলা নিয়ে পানিতে ডুব দেয়, প্রায় কয়েক মিনিট ডুবে গামলা ভর্তি কাদামাটি নিয়ে সাঁতরে পাড়ে আসে। কিছুক্ষণ জিরিয়ে গামলা নিয়ে আবার ডুব দেয়, আবার গামলা ভর্তি কাদা নিয়ে উঠে আসে। এসব করতে করতে চোখ টকটকে লাল হয়ে যায় আরিশার। তবুও থামে না ও। অনবরত কাজ চালিয়ে যায়।
দু’ঘন্টা পর পুকুর থেকে উঠে বেশ খানিকক্ষণ জিরিয়ে নেয় আরিশা। এসময় তানজীর ও পুঁচকুকে সাথে নিয়ে নানানরকম ফলমূল খেয়ে শক্তি বাড়িয়ে নেয় ওরা। এরপর কাদা মাটিগুলো আবার গর্তের নিচে নিয়ে যায়। দীর্ঘ পাঁচঘন্টা অক্লান্ত পরিশ্রম করার পর অবশেষে গর্তের ভেতর সব মাটি নেয়া শেষ হয়। এই কাজে আরিশাকে তানজীর, পুঁচকু ছাড়াও সাহায্য করেছে লালটু। লালটু আরিশার গরুর নাম। ওর দুটো গরু লালটু ও কালটু। লালটুর রং কালো, কালটুর রং লাল। রংয়ের বিপরীতে ওদের নাম রেখেছে আরিশা। এছাড়াও ওর আরও অনেক পোষা প্রাণী আছে। যারা আরিশার খুবই ভালো বন্ধু।
মাটি নেয়া শেষে সবাই মিলে আবার খানিকক্ষণ বিশ্রাম নেয়। এরপর শুরু হয় ওদের আসল কাজ। পুঁচকু ও তানজীর কাদামাটি থেকে পঁচা পাতা, কাঠি, কাটা, শামুকের খোল এবং আরও নাম না জানা কতশত জিনিস বেছে বেছে একপাশে সরিয়ে রাখছে। আরিশা কাদাগুলো নিয়ে খুবলানো দেয়ালে লেপ্টে দিয়ে দেয়ালগুলো মসৃণ করে তুলছে। ধীরে ধীরে গর্তটা হয়ে উঠছে মানুষের থাকার উপযুক্ত। গড়ে উঠছে বাস উপযোগী মাটির ঘর।
দুপুর বারোটা নাগাদ সবাই গর্ত থেকে উঠে আসে। আপাতত ওদের কাজ শেষ। বিকেলে আরেকটু কাজ করতে হবে। মাটি দিয়ে ঘরের আসবাব তৈরী করতে হবে। আরিশা গর্তের মুখটা ঝোপের আড়ালে ঢেকে দিয়ে নির্জন মাঠে চলে যায়। তানজীর ভীষন ক্লান্ত হয়ে পড়েছে বলে ঘরে চলে যায়।
আকাশ মেঘলা হয়ে আসছে। তুমুল ঝড়ো হাওয়া বইছে। রাফসান গিয়েছিলো বাজারে দুধ বিক্রি করতে। আরিশার এতক্ষণের কর্মকাণ্ড কিচ্ছু দেখেনি সে। আশফাক আহমেদ ও আরমান দোকানে থাকায় আরিশা নির্বিঘ্নে এতক্ষণ কাজ করতে পেরেছে। তানজীর ঘরে ঢুকতেই দেখে রাফসান দুধের বড় বড় বোতলগুলো রান্নাঘরে নিয়ে যাচ্ছে। তানজীরকে দেখে রাফসান জিজ্ঞেস করে,
‘আরিশা কোথায় রে?’
‘আরিশাপু মাঠে গেছে।’ ক্লান্ত ভঙ্গিতে হাই তুলতে তুলতে বলে তানজীর।
‘অসময়ে মাঠে কেন? ওর রান্নাবান্না শেষ?’
‘রান্না করার সময় পেয়েছে নাকি ও? কত কাজ করছিলাম আমরা সকাল থেকে।’ বিরক্ত হয়ে বলে তানজীর।
রাফসান এতক্ষণে ভালো করে তানজীরের দিকে তাকায়। সত্যিই ওকে ভীষণ ক্লান্ত দেখাচ্ছে। রাফসান ভ্রু কুঁচকে বলে, ‘কি এমন রাজকার্য করেছিলি শুনি? এত ক্লান্ত দেখাচ্ছে কেন তোকে?’
‘ছোট মামা, সব বলবো কিন্তু পরে। এখন আমাকে বিশ্রাম নিতে দাও। আর শোনো, আরিশাপু বলে দিয়েছে ওকে এখন বিরক্ত না করতে। ও গাছতলায় ঘুমাবে।’ বলে এক মুহুর্ত না দাঁড়িয়ে তানজীর ঘরে গিয়ে ঘুমিয়ে পড়লো।
তানজীর অবশ্য আরিশার ব্যাপারটা রাফসানকে বানিয়ে বলেছে। আরিশা বলেছিলো, ও কিছুক্ষণ গাছতলায় বসে চলে আসবে। কিন্তু তানজীর জানে, ক্লান্ত আরিশা গাছতলায় বসলেই ঘুমিয়ে পড়বে। আর ওকে যদি রাফসান গিয়ে ডাকে তাহলে ও বিনাবাক্য ব্যয়ে বাড়িতে চলে আসবে। এতক্ষণের সব ক্লান্তি ভুলে আবার রান্নাবান্নায় লেগে পড়বে। এটা ছোট্ট তানজীর চায় না। আরিশার সাথে থেকে থেকে সে-ও সবার কষ্ট বুঝতে শিখেছে। ওর ইচ্ছে, ও বড় হয়ে ঠিক আরিশার মতো ভালো মানুষ হবে। সবার পাশে দাঁড়াবে। নিজের খেয়ালও অবশ্য রাখবে, সাথে আরিশারও। যেটা আরিশা পারে না।
তানজীর আদৌ জানে তো, ওর আরিশার খেয়াল রাখার মতো সময় হবে কিনা? ততদিন সবকিছু স্বাভাবিক থাকবে কিনা?
নির্ভীক আজকে বেরিয়েছে বাইক নিয়ে। বড় গাড়িটা জঙ্গলে লুকিয়ে রাখা মুশকিল। ঠিক কোনো না কোনোভাবে দেখা যায়। তাছাড়া আরিশাকে যেদিন প্রপোজ করেছিলো সেদিন ওর সাথে পুঁচকুর দেখা হয়েছে। পুঁচকু ওকে জঙ্গলে ঢোকার আরেকটা রাস্তা দেখিয়ে দিয়েছে। প্রচন্ড ঝড়-বাতাস হচ্ছিল বলে ওকে অন্য রাস্তা দিয়ে নিয়ে এসেছিলো পুঁচকু। নির্ভীক বাইক নিয়ে সেই রাস্তা ধরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়।
শা শা করে বাইক ছুটছে। আরিশার বাড়ি এখনো অনেক দূরে। দূর-দূরান্ত থেকেও বনের পূর্বাভাস পাওয়া যাচ্ছে। দু’পাশে সারি সারি গাছ। ঘন গাছপালা, মাথার ওপর আকাশ দেখা যায় না। গাছপালার ফাঁক-ফোকড় দিয়ে এক চিলতে আকাশ দেখা যায় শুধু। দূরন্ত বাতাসে নির্ভীক ছুটছে তো ছুটছে। ওর মনে চলছে ভয় সাথে কিঞ্চিৎ দ্বিধা। আরিশা ওর প্রপোজাল এক্সেপ্ট করবে তো? নাকি ফিরিয়ে দিবে? যদি ফিরিয়ে দেয় তাহলে নির্ভীক আরেকটা প্রস্তাব করবে আরিশার কাছে। বলবে, আজীবন আমার বন্ধু হয়ে থাকতে পারবে না? যে করেই হোক, আরিশার সান্নিধ্যে থাকতে চায় নির্ভীক। প্রেমিক হয়ে না হোক, অন্তত বন্ধু হয়ে হলেও থাকতে চায়। কে বলতে পারে, বন্ধুত্ব থেকে হয়তো কখনো ভালোবাসা সৃষ্টি হলেও হতে পারে।
এসব ভাবতে ভাবতে লুকিং গ্লাসে হঠাৎ চোখ যায় নির্ভীকের। ওর পিছু পিছু দুটো গাড়ি আসছে। আদৌ ওর পিছু নিয়েছে কিনা জানবে বলে নির্ভীক বাইকের গতি কমায়। সাথে সাথে গাড়ি দুটোও গতি কমিয়ে দেয়। নির্ভীক আবার গতি বাড়ায়৷ গাড়িদ্বয়ের গতিও বাড়ে৷ নির্ভীক ভালোমতো খেয়াল করে দেখার চেষ্টা করে গাড়িতে কারা আছে। দূর্ভাগ্যবশত, ছোট্ট লুকিং গ্লাসে কিছুই দেখা যাচ্ছে না।
নির্ভীকের পিছু নিয়েছে দুটো গাড়ি। একটা মইনুল আহসানের সহকারী ইমরানের, অন্যটা সানজু, ইয়াদ ও মিনহাজের। দুটো গাড়ি নির্ভীকের বাইককে ফলো করে ছুটছে।
ব্যাপারটা ধরতে পেরে জঙ্গলের মুখেই বাইক থামায় নির্ভীক৷ কিছুটা দূরত্বে গাড়িগুলোও থামে। পিছু ফিরে একবার গাড়িগুলোর অবস্থান দেখে নেয় ও। এরপর বাইক নিয়ে আবার উল্টোপথে রওনা দেয়। ওর দেখাদেখি তাড়াহুড়ো করে ইমরান ও ইয়াদ দুজনই গাড়ি ঘুরিয়ে ফেলে। ওরা কিছু বুঝে ওঠার আগেই চোখের পলকে নির্ভীক বাইক নিয়ে জঙ্গলের গহীনে হারিয়ে যায়। গাড়িদ্বয় জঙ্গলে ঢুকতে গিয়েও থমকে যায়৷ জঙ্গলে গাড়ি নিয়ে ঢোকার মতো অবস্থা নেই। পদে পদে মস্ত বড় গাছ। ইমরান গাড়ি থেকে নেমে একটা গাছে জোরে ঘুষি মারে।
স্টিয়ারিংয়ে জোরে কিল দিয়ে ইয়াদ বলে,
‘ধুর শালা! এদ্দুর এসে কিনা শালাকে হারিয়ে ফেললাম?’
সানজু ভ্রু কুঁচকে সামনের দিকে তাকায়। ইয়াদকে ফিসফিস করে বলে,
‘সামনের লোকটাকে দেখ। এই লোকটা এখানে কেন?’
‘কে লোকটা? চিনিস নাকি?’ মিনহাজ বলে।
‘না চেনার কি আছে? এম.এ গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজ এর অনার।’ সানজু বলে।
‘কিন্তু এখানে এসেছে কেন?’ অবাক হয়ে বলে ইয়াদ।
‘সেটা জানতে হলে ওনার সাথে কথা বলতে হবে। চল।’ সানজু বলে।
ওরা গাড়ি থেকে নেমে ইমরানের পেছনে গিয়ে দাঁড়ায়। সানজু বলে,
‘এক্সকিউজ মি স্যার!’
ইমরান চমকে ফিরে তাকায়। সানজু বলে,
‘স্যার, আপনি এখানে?’
ব্যবসায়িক সূত্রে বিশিষ্ট শিল্পপতি ফরহাদ ইসলামের একমাত্র মেয়ে সানজুকে চেনে ইমরান। সানজুর প্রশ্ন এড়িয়ে ওকে পাল্টা প্রশ্ন করে ইমরান।
‘তুমি এখানে?’
‘একচুয়েলি, আমরা ঘুরতে প্লাস একটা কাজে এসেছি।’ সানজুর মুখে যেন কথা রেডি।
‘ঠিক আছে, ঘোরো তাহলে। আমিও এসেছিলাম একটা কাজে।’ ইমরান বলে।
‘ওয়াও! কাজ শেষ?’
‘না। যে কাজে এসেছিলাম সেটা হলো না। তাই ফিরে যাবো ভাবছি। তোমরা আরও কিছুক্ষণ থাকবে নাকি? নাকি মাত্রই এলে?’
‘হ্যাঁ…’ ইয়াদ কিছু বলতে গেলে ওকে থামিয়ে দেয় সানজু।
‘আমরা এসেছি অনেকক্ষণ হল। এখন ফিরে যাবো।’
‘তাহলে চলো, যাওয়া যাক।’ ইমরান বলে।
যে যার গাড়িতে উঠে পড়ে। ইয়াদ বলে,
‘এটা কি হলো? আমরা নির্ভীককে খুঁজবো না?’
‘কোথায় খুঁজবো? আকাশের অবস্থা দেখেছিস? যেকোনো সময় ঝড় নামবে। অন্যদিন খুঁজবো, আজকে চল।’ সানজু গাড়িতে উঠে পড়ে।
একই রাস্তা ধরে দুটো গাড়ি পর পর বেরিয়ে গেল। কেউই জানলো না, তারা একই কাজে এসেছিলো। দু’পক্ষের মিশন ছিলো এক।
নির্ভীক জঙ্গলের ভেতর দিয়ে একটা খালের পাড়ে গিয়ে পৌঁছায়। ঝোপের আঁড়ালে বাইক লুকিয়ে রেখে সামনে এগোয় ও। জঙ্গলের পাশে ছোট খাল বয়ে গেছে। সদ্য বেড়ে ওঠা ঘাসের ওপর বসে খালের কয়েকটা ছবি তুলে নেয় ও৷ খালের সাথে মেঘলা আকাশ ও পাখপাখালির ছবিও নেয়। বাতাসে গাছের ডাল দুলছে। সাথে দুলছে পাখিদের বাসাও। পাখিগুলো চি চি করে তারস্বরে চেঁচাচ্ছে। প্রচন্ড ঝড়ো হাওয়ায় ওদের বাসাগুলো ভঙ্গুর প্রায় হয়ে এসেছে। নির্ভীক দক্ষ হাতে আধভাঙ্গা পাখির বাসারও কয়েকটা ছবি তোলে। এরপর খালের পাড় বেয়ে সামনে আসতে থাকে। একসময় নির্জন মাঠের দেখা পায় ও। মাঠ দেখে মনে মনে ভাবে, ঝড়-বাদলের আগ-মুহুর্তে মাঠের মাঝখানে গিয়ে শুয়ে থাকতে পারলে ব্যাপারটা বেশ হতো। গহীন জঙ্গলে একা মাঠে শুয়ে থাকার নিশ্চয়ই আলাদা অনুভূতি আছে। সেই অদ্ভুত অনুভূতির ছোঁয়া পেতে নির্ভীক মাঠের মাঝখানে যাওয়ার জন্য পা বাড়ায়।
একটা রেইনট্রির সামনে আসতেই ওর পা থমকে গেল। মাঠের মাঝখানে আর যাওয়া হলো না, নেওয়া হলো না সেই আলাদা অনুভূতি। তারচেয়েও ভয়ানক দামি অনুভূতির সাক্ষাৎ পেয়েছে ও। নির্ভীক রেইনট্রির সামনে গিয়ে বসে। পলকহীন তাকিয়ে থাকে তার হুরপরীর দিকে।
গাছে হেলান দিয়ে নির্বিঘ্নে ঘুমোচ্ছে আরিশা। দমকা হাওয়ায় অসংখ্য নাম না জানা ফুল ওর শরীরে ও আশেপাশে ছড়িয়ে আছে। ওকে দেখে আজকে হুর পরী নয়, ফুল পরী মনে হচ্ছে। ফুলের নরম বিছানায় পরম নিশ্চিন্তে ঘুমোচ্ছে এক ফুল পরী। নির্ভীকের খুব ইচ্ছে হয় আরিশার ঘুমন্ত চেহারাটা ছুঁয়ে দিতে। কিন্তু ও সেটা করতে পারবে না। পাছে আরিশা জেগে উঠে রেগে যায় সেই ভয়ে। ও বিড়বিড় করে বলে,
‘এমন দৃশ্য যে আমি সারা জীবন দেখতে চাই হুর পরী। কিভাবে দেখি বলতো?’
নির্ভীকের মাথায় হঠাৎ দুর্দান্ত আইডিয়া খেলে যায়। ও ঘুমন্ত আরিশার হাজারটা ছবি তুলে নেয়। নানান ভঙ্গিতে, নানান কসরত করে ছবি তুলতেই থাকে ও। একসময় ক্যামেরাটা পাশে রেখে পলকহীন আরিশার দিকে তাকিয়ে থাকে নির্ভীক।
ঝিরিঝিরি বৃষ্টি শুরু হয়েছে। বৃষ্টির ফোটা গায়ে পড়তেই চোখ মেলে তাকায় আরিশা। সামনে নির্ভীককে ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে থাকতে দেখে চেঁচিয়ে বলে,
‘এ্যাঁই, কে আপনি? এখানে কি করছেন?’
নির্ভীক থতমত খেয়ে উঠে দাঁড়ায়। পরক্ষনেই নিজেকে সামলে ও বলে,
‘প্রতিবারই মনে করিয়ে দিতে হবে আমি কে? আমাকে কেন তুমি ভুলে যাও হুর পরী? আমি তো একটা সেকেন্ডও তোমাকে মনে না করে থাকতে পারি না।’
হুর পরী ডাকটা শুনে আরিশার ঘুমের রেশ কেটে যায়। হাই তুলতে গিয়েও হাইটা গিলে নেয় ও। হাই গিলে নেয়ায় চোখে পানি জমে যায় ওর।
‘আপনি আবার এসেছেন কেন?’
‘আসব না?’ অবাক হয়ে জানতে চায় নির্ভীক।
‘না।’
‘কেন? আমার তো আসার কথা ছিল।’
‘আমি বলেছি আসতে?’
‘তুমি বলোনি বলেই এসেছি৷’
‘মানে?’
‘আমি আমার চিঠির জবাব পাইনি এখনো।’
‘জবাবটা নিশ্চয়ই আপনার জানা।’
‘না তো। আমি তোমার মুখ থেকে শুনতে চাই।’
‘আমি কোনো জবাব দিবো না। আপনি এখানে আর আসবেন না। কেউ দেখে নিলে অনেক সমস্যা হবে।’ চিন্তিত মুখে বলে আরিশা।
‘কি সমস্যা হবে? আমাকে কেউ মারবে? পিটাবে? কি করবে বলো?’
‘জানি না। কিন্তু আপনি আসবেন না।’
‘কিন্তু কেন?’
‘বললাম তো সমস্যা হবে।’
‘ওহ আচ্ছা বুঝলাম। আমাকে কেউ পিটালে তোমার কষ্ট হবে তাই তো?’
‘মোটেও না। আপনার জন্য কেন আমার কষ্ট হবে? এই জঙ্গলে তেমন কেউই আসে না। আপনাকে দেখলে যে কেউ সন্দেহ করবে।’
নির্ভীকের বলতে ইচ্ছে হলো, প্রথমবার যেমন ঘুরতে এসেছি এবারও তেমন কিছু একটা তো হতেই পারতো। কেউ দেখলে তো বলতেই পারি যে, আমি ঘুরতে এসেছি।’ কিন্তু নির্ভীক সেসব কিছুই বললো না।
‘আমরা তো প্রেম করছি না যে কেউ দেখে নিলে সমস্যা হবে।’ মুচকি হেসে বলে নির্ভীক।
আরিশা খানিক চুপ থেকে নির্ভীকের সামনে থেকে চলে যায়।
নির্ভীক ওর পেছন পেছন আসে। আরিশার খোলা চুলে ঝরা ফুল লেপ্টে আছে। পেছন থেকে আরিশাকে দেখে হঠাৎ কবি বনে যায় নির্ভীক। পকেটে হাত ঢুকিয়ে ও কবিতা বলে,
“পিঠময় ছড়িয়ে রেখেছো ঘন কালো চুল
ছুঁয়েছে সেথা পরম যত্নে হরেক রকম ফুল
আমায় কেন বঞ্চিত করছো পেতে ঐ সুখ
দেখতে আমি ভালোবাসি ফুলপরীর মুখ।”
আরিশা হাঁটার গতি কমালেও থামলো না। বাড়ির দিকে ছুটে যেতে থাকে ও। নির্ভীক চেঁচিয়ে বলে,
‘আজকে যতই ছুটো, উত্তর না পেলে কিন্তু আমি যাবো না৷ তোমার বাড়ির আশেপাশেই বসে থাকবো। ঝড়-বৃষ্টি উপেক্ষা করে তোমায় ভালোবাসবো।’
আরিশা অসহায় দৃষ্টিতে তাকায় নির্ভীকের দিকে। বলে,
‘যেদিন ঝড়-বৃষ্টি থাকবে না সেদিন আসবেন। আজকে ফিরে যান দয়া করে।’
‘উত্তর দাও, এক্ষুনি ফিরে যাবো।’
আরিশা কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললো, ‘আমার কাছে আপনার প্রস্তাব গ্রহণ করা সম্ভব না।’
‘কেন?’ চুপসে যায় নির্ভীক।
‘বলা যায়, এটা একটা অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ। আমার আব্বু-চাচ্চুদের ছেড়ে, আমার বাড়ি ছেড়ে, আমার বন্ধু-বান্ধব সব ছেড়ে জঙ্গল থেকে কোথাও কোনোদিন যেতে পারব না আমি। আমি এই জঙ্গলেই জন্মেছি, এই জঙ্গলেই মরতে চাই।’
‘আমি তো তোমাকে জঙ্গল থেকে বেরিয়ে যেতে বলছি না, তাই না?’ আহত কন্ঠে বলে নির্ভীক।
‘এখন বলছেন না, কিন্তু একসময় তো বলবেন। আপনি তো আমাকে ভালোবাসেন তাই না?’
‘অনেক অনেক বেশি ভালোবাসি।’
‘তাহলে নিশ্চয়ই বিয়েও করবেন?’
‘হ্যাঁ।’ লাজুক ভঙ্গিতে জবাব দেয় নির্ভীক।
‘বিয়ের পর কি আপনি আমাকে এখান থেকে নিয়ে যাবেন না আপনার বাড়িতে? নাকি ঘর জামাই থাকবেন?’
নির্ভীক মাথায় হাত দিয়ে বললো, ‘ওরে বাপরে! তুমি তো আমার চেয়েও এডভান্স। লাভ লেটার দেয়াতে তুমি বিয়ে পর্যন্ত ভেবে নিয়েছো?’
‘ভাববো না? আপনি ভাবেননি?’
‘না তো। আমি শুধু ভালোবাসি বলে প্রপোজ করেছি। ব্যস!’
‘ভালোবাসা তাকেই বলে, যখন কাউকে একবার দেখেই পুরো ভবিষ্যত কাটিয়ে দেয়ার কথা মাথায় আসে। ভালোবাসা সেটা নয় যেটা রূপ দেখে হয়, সৌন্দর্য দেখে হয়। মানুষ সুন্দরের পূজারী। সুন্দর কিছু দেখলেই সে থমকে দাঁড়ায়। সেটা মানুষের সৌন্দর্য্য হোক বা অন্যকিছুর। এমনও তো হতে পারে আপনি আমার রূপের প্রেমে পড়েছেন। একদিন নিশ্চয়ই আমার রূপ ফুরিয়ে যাবে, সেদিন আপনি কার প্রেমে পড়বেন? সেদিন তো আপনি আমাকে ছুঁড়ে ফেলতেও দ্বিধাবোধ করবেন না।’ পুরোদমে বলে থামে আরিশা।
‘তুমি আমাকে ভুল বুঝছো হুরপরী। আমি তোমাকে সত্যিই ভালোবাসি।’
‘তাহলে ভবিষ্যতের কথা ভাবলেন না কেন?’
‘তুমি এক্সেপ্ট করলে তবেই তো ভাববো। যদি ফিরিয়ে দাও আমার স্বপ্নটা ভেঙ্গে চুরমার হয়ে যাবে না বলো? তাছাড়া মাঝখানে তো ব্রেকআপও হতে পারে। যদিও সেটা আমি কখনো হতে দেবো না।’ জিভ কেটে বলে নির্ভীক।
আরিশা ভ্রু কুঁচকে বললো, ‘ব্রেকআপ কি?
নির্ভীক চোখ বড় বড় করে আরিশার দিকে তাকায়।
‘তুমি ব্রেকআপ বোঝো না?’
‘উঁহু।’ দু’পাশে মাথা নাড়ে আরিশা।
‘ডিভোর্স চিনো, ডিভোর্স? বিবাহবিচ্ছেদ?’
‘হুম।’
‘ব্রেকআপ হচ্ছে ডিভোর্সের জমজ ভাই। ডিভোর্স হয় বিয়ের পর আর ব্রেকআপ হয় বিয়ের আগে।’
‘তারমানে আপনি ব্রেকআপের কথাও ভেবেছেন অথচ ভবিষ্যতের কথা ভাবেননি? এজন্যই আমি আপনাকে ফিরিয়ে দিলাম। গ্রহণ করলাম না আপনার প্রস্তাব। যান, চলে যান।’ তাৎক্ষণিক রেগে গেল আরিশা।
নির্ভীক ফিক করে হেসে ফেললো। বললো,
‘যা বোঝার আমি বুঝে গেছি। আসছি আমি। সাবধানে থেকো, মিষ্টি পরী।’ বলে আরিশার গাল টিপে দিতে চাইলো নির্ভীক। আরিশা এক ঝটকায় ওর হাত সরিয়ে দিলো। নির্ভীক থতমত খেয়ে হাত সরিয়ে নিলো। আবার পেছন ফিরে পিছু হাঁটতে হাঁটতে বললো,
‘বাই দ্যা ওয়ে, তুমি কি অন্যকাউকেও বিয়ে করবে না?’
‘করবো না। কোনোদিন কাউকে বিয়ে করবো না আমি৷ আপনাকে তো একদমই না।’ চেঁচিয়ে বলে আরিশা।
নির্ভীক হাঁটতে হাঁটতে মুচকি হেসে বলে, ‘পরে দেখা যাবে সব। আর শোনো, এখন থেকে ভবিষ্যতের কথা ভাববো। শুধু বিয়ে না বাচ্চা-কাচ্চা থেকে নাতি-নাতনী পর্যন্ত ভাববো। নো টেনশন হুরপরী!’
“কিচ্ছু ভাববেন না আপনি। আপনাদের মতো তথাকথিত প্রেমের সম্পর্কে আমি জড়াতে চাই না। আমাদের ধর্মে বিবাহ বহির্ভূত ছেলেমেয়ের সকল সম্পর্ক হারাম। আপনি ভাবছেন বিবাহ বহির্ভূত প্রেমের কথা আর আমি কিনা? এসব কখনোই হওয়ার নয়।” বিড়বিড় করে বললো আরিশা।
আরিশা নির্ভীকের দিকে আর ফিরে তাকালো না। ছুটতে ছুটতে বাড়িতে চলে এলো। ওর প্রচন্ড খিদে পেয়েছে। কিছু খাওয়া দরকার।
#Be_Continued_In_Sha_Allah ❣️