অসুখের নাম তুমি ৭+৮

0
861

#অসুখের_নাম
(পর্ব_৭+৮)
#সোনালী_আহমেদ

নিস্তব্ধ এলাকা। চারপাশে পাখিরা কিচিরমিচির ডেকে যাচ্ছে। তপ্ত বাতাসে গাছের ডালাপালাগুলো এদিক-ওদিক দুলছে। সূর্যের তাপ এখনো যায় নি। ভ্যাপসা গরমে সিদ্ধ হয়ে যাচ্ছে রেশমি। তার ইচ্ছা করছে রান্না-বান্না সব রেখে উড়াল দিয়ে চলে যেতে। পরক্ষনেই চিন্তা বাদ দিয়ে দিলো,দেখা যাবে মামি চিল হয়ে উড়ে গিয়ে তাকে ধরে এনে রান্নায় বসিয়ে দিবেন।
এত গরমে আগুনের পাশে কার ই বসতে মন চাইবে?

রেশমির অবস্থা অন্যন্যা দিনের মতো স্বাবাভাবিক হলে বোধ হয় এত বেগ পেতে হতো না। সমস্যা হলো সে তলপেটের ব্যাথায় ভুগছে। ব্যাথায় প্রায় জান বেরিয়ে যাচ্ছে তার।

কাউকে কিছু বলতেও পারছে না লজ্জায়। বলেই বা কি হবে? তাকে তো রাঁধতে হবেই। আজ প্রথম তার স্বামী এ বাড়ীতে এসেছে, কীভাবে সে উপোস রাখবে?

বিকাল হওয়ার আগেই তারা এসে পৌঁছায়। রেশমিদের ঘর বেশ বড় নয়। দো-চালা টিনের ঘর আর পাশে একটা ছোটখাটো রান্নার ঘর। বাড়ী থেকে একটু দূরেই টয়লেট। রুম দুটোর একটি ছোট আরেকটা অন্যটির তুলনায় সামান্য বড়। এক রুমে রেশমির মামা আর মামী থাকেন। অন্য রুমে রেশমি আর তার মা এবং মামাতো বোন রুহানী থাকে। মূলত রুম টা রুহানীর,কিন্তু রেশমিরা আসায় তাদের এখানে থাকতে দেওয়া হয়েছে। আসবাবপত্র বলতে একটা খাট, একটা ছোটখাটো টেবিল আর একটা ভাঙ্গা সুকেচ। অন্য রুমেই বাকিসব টুকটাক জিনিস রয়েছে। কয়েকদিন আগেই রেশমির মা শরীরে কঠিন অসুখ বাধিয়ে বিছানায় পড়ে আছেন। তিনি বেশ নড়াচড়া করতে পারেন না। রেশমি থাকতে সে ই তার মায়ের সমস্ত কাজ করতো। মা বিছানা থেকে নড়তে না পারার সুবাদে সে ই মায়ের গা মুছিয়ে দিতো। এমনকি তাকে ধরে নিয়ে বাথরুমেও পৌঁছে দিতো।
রেশমি এসেই মায়ের বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ে। তার কান্না দেখে সৌহার্দ গাবড়ে গিয়েছিলো। রেশমির মা সেদিকে লক্ষ্য করে তাকে কাছে ডাকলেন।

সৌহার্দ শাশুড়িকে সালাম জানাতেই তিনি তার মাথায় হাত বুলিয়ে দোয়া করে দেন। তার হাত ধরে বলেন,

–‘ কিছু মনে করো না,বাবা। কোনোদিন আমাকে ছাড়া থাকে নি তো, তাই। তোমাদের কষ্ট দেয় নি তো? মেয়েটা বড্ড অবুঝ,ওর ভুল হলে একটু বুঝিয়ে-সুঝিয়ে দিও। বাচ্চা মেয়ে আমার,তাই এখনো বুঝ হয় নি। একটু খেয়াল রেখো।’

সৌহার্দ বিষম খায়। এ মেয়ে নাকি বাচ্চা?
রেশমি তাকে বসতে দিয়ে বের হয়ে যায়। রুহানী এসে নিজেই সৌহার্দের সাথে পরিচিত হয়।

সৌহার্দকে, রেশমির মামাতো বোন তাদের এলাকা ঘুরাতে নিয়ে যায়। রেশমি কিছু বলে নি, তবে তার ও ইচ্ছা করছিলো ঘুরতে যেতে। তা আর মুখ ফুটে বললো না।

মামি এসে তাকে রান্না করার তাগিদ দিয়ে চলে যান।ঘরে ভালো কোনো সবজি নেই। রেশমি তো নানা চিন্তায় পড়ে গিয়েছিলো। সৌহার্দকে কি এই আলু যার অর্ধেকগুলো পঁচা আর এই বাসি করলা দিয়ে কি খাবার দিবে সে? মানুষ টা প্রথমবার তাদের ঘরের খাবার খাবে,সে এসব কীভাবে দিবে?
ঝটপট বাড়ীর পেছনে তাদের ছোট ফসলের ক্ষেত এ গিয়ে তাজা কিছু সবজি নিয়ে আসে।
দুইহাতে কাটাকাটি করেই রান্না চড়ায়।

এর মধ্যে তার গ্রামের সখিদের সাথেও দেখা-সাক্ষাৎ চুকিয়ে নেয়। দিনে দু-দুবার রান্না করে সে ক্লান্ত। শরীর টা বোধ হয় চলছে না।

কোনোরকম গায়ে পানি ঢেলে গিয়ে বিছানায় গা এলিয়ে দেয় । শরীর আর চলছে না। এই মুহূর্তে বিশ্রাম না নিলে বোধ হয় সে আর বাঁচবে না। পেটের ব্যাথা টা আবারো বেড়ে গেলো।
চোখ দুটো একত্রিত হয়েছে সবে। এর মধ্যেই তার মামীর হইচই শুনা যায়।

রেশমি চোখ খুলে দেখে সাঁঝ নেমে এসেছে। চোখদুটো কচলে বিরবির করে বলে ওঠে,

—‘মাত্রই তো ঘুমালাম। এত দেরী কবে হলো?’

মুখে পানির ছিঁটকা দিয়ে বের হতেই দেখে সৌহার্দ দুই হাতে বাজার নিয়ে এসেছে। মামীর মুখে বিশ্ব জয়ের হাসি। তিনি ব্যাগদুটো নিতে নিতে বলছেন,

—‘ কি দরকার এসব নিয়ে আসার? কোনে দরকার ছিলো না। শুধু শুধু কেনো নিয়ে আসতে গেলেন?’

সৌহার্দ বলে,

–‘ শুধু শুধু বলছেন কেনো? আসার সময় তো কিছু নিয়ে আসতে পারি নি তাই এখন নিয়ে আসলাম।’

–‘তবুও বাবা!কি দরকার ছিলো?’

—‘আরে ঘরে নিয়ে রাখেন, আমার দায়ওত্ব তাই এনেছি। আর শুনুন, কালো পলিথিনে আম্মার জন্য কিছু ফল এনেছিলাম ওগুলা উনাকে খেতে দিয়েন, বেশ অসুস্থ উনি।এগুলা খেলে উপকার হবে।’

রুজি ফট করে ব্যাগদুটো নিয়ে ঘরের দিকে চলে যেতে লাগলো। যেতে যেতে বলেন,

–‘ এ আর বলা লাগবে?এসব তো আপাকেই খাওয়াবো।’

রেশমি জানে মামি এসব তার মা কে দেখাবেও না। তিনি নিয়ে তার সন্দুকে তালা মেরে রাখবেন।

—‘আপনাকে এসব নিয়ে আসতে কে বলেছে?’

রেশমির ফোলা ফোলা চোখ, এলোমেলো চুল,ঘুমু ঘুমু মুখ সৌহার্দের চোখে পড়তেই থমকে যায় সে। সঙ্গে সঙ্গে চোখ নামিয়ে পাশ কেটে ঘরে ডুকে যায় সে। রেশমি হতভম্ভ হয়ে তার যাওয়ার দিকে তাকায়। তা দেখে রুহানী হেসে দেয়। রেশমির গা জ্বলে ওঠলো। সে যদি পারতো এখনই চিবিয়ে খেয়ে ফেলতো শয়তান টাকে।

ঘরের প্রায় প্রয়োজনীয় সব জিনিস ই এনেছে সৌহার্দ। তাজা গরুর মাংসের লোভ সামলাতে না পেরে রুজি এই সন্ধ্যায় আবারো রান্না বসায়। কতদিন খায় না, আহা আজ তৃপ্তি করে খাবে।

অভাবে স্বভাব নষ্ট। রুজির ও হয়েছে তাই। রান্না শেষ না হতেই পাতিলের উপর খেতে বসে যায়। গরম গরম এক প্লেট ভাত নিয়ে এসে রান্নাঘরেই সাভার করে ফেলে সে।

মাংসের ঘ্রাণ চারদিকে মৌ মৌ করছে। রুজির জামাই মাত্র এসে বাড়ীতে ডুকে। কাদা মাটিতে ভরে আছে সে। আজ বেশিক্ষণ কাজ করতে পারে নি। দুপুরেই কাজে গিয়েছে। কয়েক ঘন্টা কাজ করে হাতে গোনা কয়েক টা টাকা পেয়েছে। মুখ টা বেশ ভার করে রেখেছেন তিনি।

রেশমি এগিয়ে এসে মামাকে কল চিপে বালতি ভরে দেয়। পেটের ব্যাথা টা আরো বেড়ে গেলো। রেশমি চুপচাপ ঘরে যেয়ে বিছানায় শুয়ে পড়লো।

সৌহার্দ আর রুহানী একসাথে বসে গল্প করছে। আজ সারাদিন তারা একসাথে থেকেছে,নানান জায়গা ঘুরে গল্পগুজব করেছে। রুহানী কথা কম সৌহার্দের গায়ের উপর পড়ছে বেশি।

কথার মাঝেই রুহানী কেশে উঠলো। সৌহার্দ সাথে সাথে বলে ওঠে,

–‘ রুহা,কি হয়েছে? পানি খাবে?’

—‘না,না। ঠিক আছি। তুমি বরং বসো।’

ওদের আলাপ শুনে রেশমির গা জ্বলে উঠলো। রেগে দুম করে বসে গেলো। সৌহার্দের দিকে রাগী চোখে তাকায়। মন মেজাজ এমনিতেই ভালো ছিলো না,এবার আরো খারাপ হয়ে গেলো।

রেশমি ওঠে গিয়ে ওদের মাঝখানে বসলো। পেটের ব্যাথায় নড়তে পারছে না তবুও সে ওখানে ওদের মাঝে বসলো। সৌহার্দের দিকে এক পলক রাগী দৃষ্টিতে তাকিয়ে রুহানী কে বলে,
—‘ আপু,উনি আপনার বড়। আমার বয়সী নয় যে তুমি বলবেন। আপনি করে বলবেন।’

—‘আমি তো আপনি করেই বলছিলাম,উনিই বললেন তুমি বলতে। উনার নাকি আনইজি লাগছে।’

রেশমি সৌহার্দকে চোখ রাঙ্গায়। তারপর বলে,

—‘ আপু,উনি হয়তো জানেন না তুমি আমার বয়সী। আসলে তোমাকে দেখতে অনেক বয়স্ক লাগে তো।তাই বলেছেন হয়তো,তাই না?’

সৌহার্দ হতভম্ভ হয়ে রেশমির দিকে তাকায়। সে এমন কবে বললো? রেশমি চোখ রাঙ্গাতেই অগত্যা মাথা হেলিয়ে সায় দেয়।

রুহানীর চোখে জল চলে আসে। সে কাঁদো কাঁদো চেহারা নিয়ে উঠে চলে যায়। রেশমি বিশ্ব জয়ের হাসি দেয়।

–‘এটা কি হলো?’

–‘রুহা,তাই না?’

রেশমি দাঁত চেপে কথাটা বলে ওঠে চলে যায়।
সৌহার্দ হতভম্ভ হয়ে ওর যাওয়ার দিকে তাকিয়ে রইলো। কি হলো সব ওর মাথার উপর দিয়ে গেলো।

চলবে!
……
……
#অসুখের_নাম_তুমি (পর্ব-০৮)
#সোনালী_আহমেদ

রাতের খাবার বেশ জমজমাট হয়েছে। তাজা তাজা সবজি আর মাংস পরম তৃপ্তিতে খেয়েছে সবাই। ঘরে বড় টেবিল না থাকায়, মাটিতে পাটি বিছিয়ে খাবার দেওয়া হয়েছে সবাইকে। সৌহার্দকে নিচে বসতে বলার সময় প্রত্যেকে ভীষণ লজ্জা পেয়েছে। নতুন জামাইকে কীভাবে নিচে খেতে বলা যায়?

সৌহার্দ অবশ্য বিষয়টাকে সাধারণ ভাবেই নিয়েছে। সবার খাওয়া হলেও রেশমির খাওয়া হলো না। সৌহার্দের রুহানীর সাথে অতিরিক্ত মেলামেশা তার পছন্দ হয় নি। ভাত না খেতে পারলেও দুজনের মাঝখানে যেয়ে ঠিকই বসেছে সে। রুহানী তাকে বেশ কয়েকবার বলেছে না খেলে যেয়ে শুয়ে থাকতে। কিন্তু রেশমি নড়লো না,সে ঠাই বসে রইলো।

খাবার টেবিলেই রেশমির মা তাকে বলে ওঠে,

—‘হ্যা,রে রেশমি। তোর শশুড়বাড়ীতে কে কে থাকেন? ‘

—‘ উনাকে জিজ্ঞাস করুন।’

সৌহার্দ রেশমির ফুলে থাকার কারণ ধরতে পারলো না। সে বিনয়ের সাথে জবাব দেয়,

—‘জ্বি। আমি আমার বোন, আমার দাদী, আমার চাচা-চাচী। আর তিন চাচাতো ভাই বোন। বড় চাচাতো ভাইয়ের সাথে আমার বোনের বিয়ে হয়েছে। মেঝো চাচাতো বোন এবার স্কুল পাশ করবে।আর একটা ছোট চাচতো ভাই আছে। আমার মা-বাবা নেই। চাচা-চাচী ই আমাদের মা-বাবা।’

রাতে ঘুমানোর সময় হয়েছে আরেক সমস্যা। ঘরে মাত্র দুটো রুম। সবাই যার যার নিয়ম মাফিক জায়গাতেই ঘুমায়। কিন্তু এখন সৌহার্দকে তো আর নিচে দেওয়া যায় না। তাই রুজি তাদের রুম সৌহার্দ আর রেশমির জন্য ছেড়ে দেয়। সে আর তার স্বামী, রুহানীর রুমে নিচে মাটিতে পাটি বিছিয়ে ঘুমাবে।

সৌহার্দ অবশ্য প্রস্তাব টা শুনে তৎক্ষণাৎ না করে দেয়। সে বলে যে সে নিচে শুবে। কিন্তু রুজি তা মানতে নারাজ। জোর করে সে সৌহার্দকে তাদের রুমে দিয়ে আসে।
রেশমি ভারী অবাক হয়ে মামীর কান্ডে। তার মামী তো এ ধরনের মানুষ নয়। মেহমানকে দরকার পড়লে বাহিরে রাখবে তবুও সে বিছানা ছাড়বে না। রেশমি অনেক খুঁজে কারন বের করতে পারলো না। মামী হঠাৎ সৌহার্দের সাথে এত ভালো আচরণ কেনো করছে? কোথায় নিশ্চই স্বার্থ আছে। কারণ মানুষ স্বার্থ ছাড়া কিছুই করে না। কথা টা কেউ মানুক আর না মানুক এটাই বাস্তবতা।

গা ফুলিয়ে রুমে যায় রেশমি। সে কিছুতেই আসতে চায় নি। মায়ের পাশে ঘুমাবে সে। কাল মায়ের সাথে ঘুমাতে পারে নি। তার কত কষ্ট হয়েছিলো। সে মায়ের সাথে ঘুমাবে,রাতভর জেগে সারাদিনের সব গল্প বলবে।
ও বাড়ীতে কি কি হয়েছে কি কি দেখেছে সব বলবে। কিন্তু মা তো তাকে কঠিন আদেশের সুরে সৌহার্দের কাছে পাঠিয়ে দিয়েছে। সাথে এটাও বলে দিয়েছে যে সে যেনো কোনোদিন কোথাও স্বামী ছাড়া না ঘুমায়। রেশমি হু হা না করেই রাগে ফুলতে ফুলতে চলে আসে।

সৌহার্দের উপর সে রেগে আছে। ভীষণ রেগে আছে। সে কেনো রুহানীর সাথে এমন আলাপ করবে? এ তো অন্যায়! ঘোর অন্যায়। এর জন্য যদি সৌহার্দকে পুলিশ সারাবছর জেলে রাখে তাহলেও শাস্তি সম্পূর্ণ হবে না।

সৌহার্দ আগেই বিছানার এক পাশে শুয়ে ছিলো। রেশমিকে দেখে সে একটু নড়েচড়ে ঘুমালো। রেশমি রাগ দেখিয়ে বালিশ টা নিয়ে নিচে শুয়ে পড়লো। এ লোকের সাথে সে কিছুতেই ঘুমাবে না। নাহলে তার মনের রাগের রাজা কষ্ট পাবে। সে চায় রেশমি যাতে সৌহার্দ থেকে দূরে থাকুক। তাই রেশমিও দূরে থাকতে চাইলো।

রেশমির কান্ডে কোনো পরিবর্তন দেখা দিলো না সৌহার্দের মাঝে। সে বরং আরো একটু হাত পা ছড়িয়ে বিছানায় জায়গা জুড়ে নিলো।

সৌহার্দের কান্ড দেখে রেশমি আরো রেগে যায়। দুপদাপ বালিশ নিয়ে বিছানায় এনে শুয়ে পড়ে। সৌহার্দ কি ভেবেছে সে কি বোকা ? সে বিছানা না ঘুমালে যে সৌহার্দ খুশি হবে এটা কি সে বুঝে নাই? মনের ভেতর ভারী অভিমান নিয়ে কাত হয়ে চোখ বুঝে রেশমি।

কিছুক্ষণ বাদেই ফিসফিসানি কানে আসে।
কেউ গভীর নিঃশ্বাস ফেলে তার কানের কাছে বলছে,
–‘ আমি জানতাম না ওর নাম রুহানী। ওই বলেছে রুহা। আর ‘তুমি’ টাও ও নিজে জোর করেই ডেকেছে। আমি দুবার বারণ করেছে,ও শুনে নি।”

রেশমির ইচ্ছা করলো চোখ মেলে দেখবে। কিন্তু পারলো না। কারণ ততক্ষণে তার চোখে গভীর ঘুম নেমে এসেছিলো। সৌহার্দ চাঁদের স্নিগ্ধ আলোয় রেশমির ঘুমন্ত মুখ দেখলো। হালকা হেসে মাথায় হাত বুলিয়ে দিলো। সে জানে রেশমির মনের অভিমাণ তার প্রতি টানকে বুঝিয়ে দিচ্ছে। সে চাইলে তখনই বলতে পারতো,কিন্তু বলে নি। দেখতে চাইলো রেশমি কি করে। তার ধারনা ছিলো রেশমি নিশ্চই অন্য মেয়েদের মতো আড়ালে গিয়ে কাঁদবে কিন্তু মুখে কোনো টু শব্দ করবে না। কিন্তু কিছুক্ষণ বাদেই রেশমি তার ধারনা ভুল প্রমাণ করে দেয়।
সৌহার্দ হাসে। রেশমির হঠাৎ বড় বড় কথা,হঠাৎ বাচ্চামো তার খুব ভালো লাগছে। বহু দিন বাদে এ বাচ্চা মেয়েটা তার আবেগ গুলোকে এলোমেলো করে দিচ্ছে। সে কি এই টুকুনি মেয়ের উপর দূর্বল হয়ে পড়ছে?

ভোরের নতুন আলোর সাথে শুরু হয়ে রেশমির নব জীবনের আরেক নতুন সূচনা। পলকে পলকে সময়গুলো চলে যাচ্ছে। একটা সময় এমন আসবে যখন এই ফেলা সময়গুলোর কথা খুব মনে পড়বে। খুব ইচ্ছা করবে এই দিনগুলোতে ফিরে আসতে। খুব করে চাইবে এদিনে আবার উপস্থিত হয়ে নতুন করে শুরু করতে।

দুপুরের বেশ খানেক আগেই রওনা দেয় সৌহার্দ আর রেশমি। অবশ্য তাদের সাথে রুহানীও আসতে চেয়েছিলো। কিন্তু রেশমি সাথে সাথে না করে দেয়। সৌহার্দ পড়েছিলো মাইনকা চিপায়। না সে না করতে পারছিলো আর না হ্যা বলতে পারছিলো! রেশমি বেশ খানেক কাহিনী বানিয়ে রুহানীকে রেখে আসতে সক্ষম হয়েছে। আসার সময় সৌহার্দ তাদের হাতে কিছু টাকা দিয়ে এসেছিলো খরচ করার জন্য। রেশমির মামী –‘কি দরকার কি দরকার’ বলে টাকাগুলো ছোঁ মেরে নিয়ে নেয়। রেশমির মামীর কান্ডে মনে মনে বিরক্ত হয়। নিবেই যখন তাহলপ এত কাহিনীর কি দরকার?

বাড়ী আসার পথেই নানান ধরনের কথা বলছিলো রেশমি। সৌহার্দ গম্ভীর মুখে ছিলো,সে কোনো জবাব দেয় নি। রেশমি নিজের মতো বকবক করছিলো। বাড়ীর খুব কাছে আসতেই রেশমি প্রায় লাফিয়ে রাস্তার পাশের জমিতে নামছিলো। সৌহার্দ রেগে যায়। আশেপাশে কত মানুষ,তারা কীভাবে যে রেশমিকে দেখছে সেটা কি তার চোখে পড়ছে না।

রাগ সামলাতে না পেরে কঠিন ধমক দেয় রেশমিকে। গর্জনের মতো তার নাম ধরে ডেকে ওঠে,–‘রেশমি।’

হঠাৎ এত জোরে ধমক শুনে কেঁপে ওঠে রেশমি। যেখানে ছিলো সেখানেই দাড়িয়ে যায়। সৌহার্দ তার হাত চেপে রাস্তায় নিয়ে আসে। রেশমির হার্ট বিট জোরে জোরে আওয়াজ করতে লাগলো। সে ভয় পাচ্ছে, খুব ভয় পাচ্ছে। শক্ত করে সৌহার্দের হাত চেপে হাটতে লাগলো।
সৌহার্দ তার দিকে তাকাচ্ছেও না, সে খুব রেগে আছে।

রেশমি পুরো পথে আর কোনো কথা বললো না। সে সৌহার্দের উপর ভীষণ অভিমান করলো।ভীষণ! তার মন খারাপের সাথে আকাশ ও তাল মিলিয়ে ঝকঝক নীল আকাশ মুহূর্তেই ঘন কালো আধার করে ফেললো।

বাড়ীতে আসতেই আরেক নতুন চমক ঘটে গেলো। ঘরে এসে পৌঁছাতেই দেখে সুমি মাটিতে পড়ে আছে। আশেপাশে কাউকে দেখা যাচ্ছে না।

দৃশ্য টি সৌহার্দের বুকে গিয়ে লাগলো। তার শরীর চলছে না। কোনোরকম নিজেকে সামলে সুমির কাছে গিয়ে পৌঁছালো সে। সুমি কে ডাকতে ডাকতে চোখে জল চলে আসলো সৌহার্দের। এক মাত্র বোন তার। মা বাবা চলে যাওয়ার পর কোলে-পিঠে মানুষ করেছে তাকে। বোনের মুখের দিকে তাকিয়ে হাজারবার মরতে গিয়েও মরতে পারে নি সে। একমাত্র বোন। তার কিছু হলে সৌহার্দ বাঁচবে না, কিছুতেই না।
সব হারিয়ে বোন ই রয়েছে তার জীবনে। এ বোন ছাড়া আর মূল্যবান কোনো কিছুই তার জীবনে নেই। কোনোদিন বাঁচবে পারবে না সে।

‘সুমি’ বলে চিৎকার দিয়ে ডেকে ওঠে সৌহার্দ। তার চিৎকার শুনে সঙ্গে সঙ্গে নিচে নেমে আসে লিনা, জমিলা, সূচনা। বাড়ীতে কোনো পুরুষ মানুষ নেই।

কোনোরকম টলমল পায়ে সুমিকে নিয়ে হাসপাতালে পৌঁছায় সৌহার্দ। সৌহার্দের কষ্ট দেখে রেশমির চোখ ছলছল করে ওঠে। কিন্তু এমন কেনো হলো? সৌহার্দের কষ্ট কেনো রেশমি সহ্য করতে পারছে না।তার কেনো খারাপ লাগছে? এসব ভেবেই অস্থির হয়ে পড়লো রেশমি।

চলবে!

** উপন্যাস তো বড়ই হবে। যারা অধৈর্য্য হয়ে পড়ছেন তারা শেষ হওয়া অবধি অপেক্ষা করুন। শেষ হলেই পড়ে নিয়েন। অন্যরকম মন্তব্য করে দয়া করে আমাকে বিভ্রান্ত করবেন না। দায়বদ্ধতা নিয়েই পর্বটা লিখলাম, আপনাদের মতামত আশা করছি।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here