#অসুখের_নাম_তুমি
#সোনালী_আহমেদ
পর্ব—-৫+৬
সৌহার্দকে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে কথাটি বলে রেশমি। ঠিক তখনই উপস্থিত হয় সূচনা। পায়েসের বাটি হাতে নিয়ে বেশ হাসিখুশি মুখেই আসছিলো। মনে মনে বেশ লজ্জাও পাচ্ছিলো সৌহার্দের সামনে আসতে। কিন্তু রেশমির কথা শুনতেই থমকে গেলো। হাতে থাকা পায়েসের বাটি টা ছুটে নিচে পড়ে গেলো। মুহূর্তেই বিকট আওয়াজ ঘটলো। সবাই একসাথে সূচনার দিকে তাকালো।
সূচনার মাথায় যেনো আকাশ ভেঙ্গে পড়লো। কত শত রাত জেগে স্বপ্ন বুনেছে এ মানুষ টার জন্য। কত শত আশা নিয়ে সে এ বাড়ীতে এসেছিলো। মুহূর্তেই সব ধূলিসাৎ হয়ে গেলো।
লোকে কি বলবে? পরপর দুবার বিয়ে ভেঙ্গে গেলো তার। প্রথম এক ভাই পরবর্তীতে আরেক ভাই। এদের সাথে কি সূচনার পূর্বের কোনো শত্রুতা আছে নাকি? যদি তাকে বিয়েই না করতে চায় তাহলে পরপর দুবার এমন যেচে যেচে প্রস্তাব দিয়েছে কেনো?
সে কীভাবে মূখ দেখাবে? আশার পথে প্রায় প্রত্যেক বাড়ীর মানুষ তাকে দেখে প্রশ্ন করেছিলো সে কই যাচ্ছে?
জমিলা বেগম তখন গর্ভের সুরে বলেছিলেন,
–‘ আমার নাতির বউ করেতেই নিয়ে যাচ্ছি।’
জমিলার পাশেই সূচনা হাটতো। এই কথার বিনিময়ে সে সবাইকে লজ্জা মিশ্রিত হাসি উপহার দিতো। জমিলা বেগম তা নিয়েও খিল্লি উড়াতেন।
সূচনার জীবনে অন্য কোনো পুরুষ মানুষ না থাকায় তার সব আশা-আকাঙ্খা সৌহার্দকে ঘিরেই ছিলো। তার মনের গহীন কোণে- মনেরকৌঠায় সৌহার্দকে বন্দী করেছিলো। হবু বরকে নিয়ে স্বপ্ন বুনা কি অস্বাভাবিক? সে তো লুকিয়ে নয় সবার প্রকাশ্যেই তার নানান বাসনা প্রকাশ করেছিলো। তার সকল সই’রা জানে সৌহার্দের ব্যাপারে। এ বাড়ীতে আসার সময় শখ করে একখানা রুমাল তৈরী করে এনেছিলো সূচনা। সুতো দিয়ে আকাঁ ফুল আর নামগুলোতে যেনো তার সকল মনের আবেগ মিশ্রিত ছিলো।
কতই না লজ্জা পেয়েছিলো সৌহার্দের নামের নিচে নিজের নাম লেখার সময়। যার ফলে পুরো একটা দিন কারো সামনে উপস্থিত হতে পারে নি।
অসময়ে সূচনার উপস্থিতি জমিলা বেগমের অবস্থার আরো পরিবর্তন হয়ে গেলো।
—‘এই,দস্যি মেয়ে এসব হাবিজাবি কি বলো? কে তোমার বর? কিরে নাতি এই মেয়ে এসব কি বলো?’
সবাই নিশ্চুপ। কারো মুখে কথা নেই,লিনা বাদে। তার মুখে বিরাজমান শয়তানি হাসি। অবশ্য সে বেশ খুশি সূচনা এ বাড়ীর বউ হতে পারে নি বলে। কারণ সে জানতো সূচনাকে বউ করলে সম্পদ তার হাত ছাড়া হয়ে যাবে।
রেশমিকে নিয়ে তার চিন্তা নেই, ভাইয়ের বিয়ের সময় বেশ ঘেটেঘুটে এই মেয়েকে ঠিক করেছিলো। আর এই বুড়ো আঙ্গুল সমান মেয়ে ই বা কী করতে পারবে?
—‘ও নাতি,কথা বলছো না কেন?’
—‘হু, আমি ওর বর।’
জমিলা বেগম ঘর কাপিয়ে চিৎকার দিয়ে বলে উঠলেন,–‘কিহ!’
সবাই ভয়ে তটস্থ হয়ে আছে। সৌহার্দ মাথা ঝুঁকিয়ে রেখেছে। সে কখনো কারো সামনে মাথা নত করে থাকে না,আজ প্রথম রেশমির জন্যে মাথা নত করতে হচ্ছে।
জমিলা বেগম গম্ভীর গলায় বলেন,
—‘কবে হলো এসব?’
–‘কাল।’
—‘ কীভাবে? নাকি আগে থেকেই দেখা-সাক্ষাৎ ছিলো? যদি এমন হয় তাহলে আমার দম থাকতে ওই বেহায়া,নির্লজ্জ মেয়েকে আমি আমার ঘরের চৌকাঠেও পা রাখতে দিবো না।’
—‘ তার সাথে আমার এর আগে কখনো দেখা হয় নি।’
—‘তাহলে কীভাবে বিয়ে করেছো আমাকে না জানিয়ে?’
—‘ আমিও জানতাম না যে আমি বিয়ে করবো। কাল চাচীর সাথে উনার ভাইয়ের বিয়েতে গিয়েছিলাম। তখন,,,’
—‘ ওই আধ বুড়ো রফিক? তার না বউ আছে?’
এ কথা শুনতেই লিনা ফুসে ওঠে। রাগান্বিত গলায় ‘ আম্মা’ বলে কিছু বলতে নিচ্ছিলো তখন জমিলা বেগম চোখ রাঙ্গিয়ে বলেন,
–‘ আমাদের মধ্যে কেউ কোনো কথা বলবে না। নাহলে খুব অসুবিধা হয়ে যাবে।’
তারপর সৌহার্দের দিকে তাকিয়ে বলে,
–‘তুই বল।’
—‘হু। উনার বউ অসুস্থ,তাই চাচীর ভাই আবার বিয়ে করবেন,বউয়ের দেখাশুনার জন্য। কিন্তু বিপত্তি বাঁধে বিয়ে বাড়ীতে। রেশমিকে দেখে আমি সম্পূর্ণ অবাক হয়ে গিয়েছিলাম। এত ছোট মেয়ে আর এত বয়স্ক লোক। আমি ভুলবশত ওই রুমে ডুকে যায়,যেখানে ওকে সাজিয়ে রাখা হয়েছিলো। তখন রেশমি হুট করে আমাকে জড়িয়ে ধরে বলে’ মামা, আমি বিয়ে করবো না।’ আকস্মিক ঘটনায় হতভম্ভ হয়ে গিয়েছিলাম,দ্রুত গতিতে তাকে সরিয়ে কেটে পড়ি, রেশমি তখনও জানতো না ও কাকে ধরেছিলো। এ দৃশ্য কিছু লোকজন দেখে ফেলে,মুহূর্তেই তারা বাহিরে কুৎসা রটিয়ে দেয়। বেশ কয়েকজন রেশমিকে কলঙ্কী, বেশ্যা এমন এমন কথা শুনাচ্ছিলো। কি জানি,কি শুনে চাচীরাও পাল্টি খেয়ে যান,তারা জানায় যে এ বিয়ে হবে না। তা শুনে রেশমির মামা বললেন,
–‘ বিয়ে ভাঙ্গলে নাকি তিনি আর কোথাও বিয়ে দিতে পারবে না। তাই এ কলঙ্কের মুখ থেকে রক্ষা করতে আমিই যেনো তাকে বিয়ে করি।’
আমি বলেছিলাম, কেনো কেউ করবে না? অবশ্যই করবে। তখন একজন বলে,’সবার দরকার নেই।তুমি করবে? তুমিই তো করবে না বাকিদের কথা কেনো বলছো?
এরপর সবার কথা শুনে এক প্রকার জেদের বসেই রেশমিকে বিয়ে করে ফেলি। ‘
সৌহার্দের কথা শেষ, সে স্বাভাবিকভাবেই বসে আছে। তার মধ্যে কোনোরকম অনুতপ্ততা নেই।
বাকিদের দৃষ্টি তার দিকেই নিবদ্ধ ছিলো। তার কথা আর ভাবমূর্তি সবার মষ্তিষ্কে দু ধরনের মনোভাব সৃষ্টি করেছে।
লিনা বেগম বেশ আবেগি গলায় বলে,
—‘ মা,আপনি জানেন আমি কতবার বারণ করেছিলাম এ বিয়ে না করতে। কিন্তু আপনার নাতি জনদরদী হতে গিয়েছিলো, সে আমার কথা উপেক্ষা করে বিয়ে করেছে। এমনকি সে আমার ভাইকেও নানান কথা শুনিয়েছে। মেয়েটারে দেখতেই সে কেমন হয়ে গিয়েছিলো। নিশ্চয়ই কোনো জাদুটোনা করছে নাহলে আমার ভাইরে কেমনে এত কথা শুনিয়ে বিয়ে থেকে ঘুরিয়ে দিয়েছে? মেয়েটা বশীকরণ করতে জানে মা, একদিনেই আপনার নাতি বিয়া কইরা ফেলছে। শেষ,আপনার সংসার শেষ!’
সৌহার্দ কোনো কথা বললো না, সে প্লেট টা টেনে খেতে বসলো। এ বিয়ে নিয়ে তার কোনো মাথা ব্যাথ্যা নেই।
রেশমি চুপচাপ এক কোণে দাড়িয়ে সব শুনছে। প্রত্যেক টা মানুষকে সে নজরে রাখছে। লিনার কথা শুনে তার বেশ সময় লাগলো না চরিত্র সম্পর্কে ধারনা করতে। সে এবার সৌহার্দের দাদীর মুখপানে চেয়ে আছে, দেখতে চায় তিনি কি বলে?
জমিলা বেগম বেশ খানেক সময় নিরবতা পালন করলেন। ঠান্ডা মাথায় বিবেচনা করে বলেন,
—‘ তার মানে এ বিয়া তুই নিজ থেকে করতে চাস নাই? তোরে জোর করসে।’
সৌহার্দ জবাব দেয় না,সে আপনমনে খাচ্ছে।
জমিলা বেগম সম্মতির লক্ষণ হিসেবে ধরলেন। বেশ সময় নিরবতা পালন করলেন।
—‘ তাহলে এ মেয়েরে ছাইড়া দে তুই। আমি তোর জন্য এর থেকে ভালো মেয়ে দেখে রাখছি।’
—‘ ছাড়তে হলে বিয়ে করতাম না। বিয়ে এত সহজ না।’
—‘ আমারে একদম জ্ঞান দিবি না। তোর থাইকা আমি বহুত জানি। তুই ভালো বুঝোস? এ মেয়েরে আজকেই ছাইড়া দিবি,এখনই দিবি। আমি তোরে দুইদিনের মধ্যে বিয়া করামু।’
সৌহার্দ জবাব দেয় না,শুধু একবার রেশমির দিকে তাকায়। রেশমির চোখে জল টলমল করছে। সৌহার্দের এমন গা ছাড়া ভাব দেখে সে ফুসে উঠলো। চোখের পানি সেকেন্ডেই লুকিয়ে ফেললো। ঘরের কোণা থেকে একদম মাঝের দিকে আসলো, মাথার চুলে পেচানো গামছা টা খুলে ফেললো। সবাই তার দিকে তাকিয়ে আছে,বুঝতে চেষ্টা করছে সে কি করতে চায়?
এক রাশ ঘন চুল তার পিঠ ছাড়িয়ে কোমর অবধি ঠেকলো। রেশমি এসে সৌহার্দের পাশের চেয়ার টায় বসলো। সৌহার্দকে উদ্দেশ্য করে বলে,
–‘ আমাকে পানির গ্লাস টা একটু দিন।’
সৌহার্দ চুপচাপ এগিয়ে দিলো। তার কান্ডে বেশ অবাক সবাই। জমিলা বেগম রাগে গর্জে বলে ওঠেন,
–‘ এই মেয়ে, এসব কি ধরনের ব্যবহার?তুমি এখানে বসেছো কেনো?’
—‘ তো কোথায় বসবো?’
—‘কোথায় বসবা মানে? তুমি এখানে কেনো? যাও এখান থেকে। এক্ষুণি যাও।’
—‘ কেনো দাদী? আপনি বুঝি আপনার স্বামীর সাথে খেতে বসতেন না?’
—‘এই, কে তোর দাদী? কে তোর স্বামী। ওরে একদম স্বামী বলবি না, আজকেই চলে যাবি এ বাড়ী থেকে। শুনোস নাই ও যে তোরে সবার প্যাচে পইড়া বিয়া করছে?’
—‘ কি যে বলেন? আমি কোন দুঃখে স্বামী বাড়ী ছেড়ে যাবো? আর উনি যদি প্যাচে পড়ে বিয়া করে থাকে তাহলে রাতে কেনো আমার সাথে থেকেছে? আমার সতীত্ব শেষ করে এখন ছেড়ে দিবেন? এটা আমি মানবো? ‘
রেশমির কথা শুনে সৌহার্দ বিষম খেলো। সবাই অদ্ভুদ ভাবে তাকালো। লিনার স্বামী চুপচাপ উঠে চলে গেলেন।
জমিলা বেগম নাকমুখ ছিটকিয়ে বলে উঠেন,
—‘ ছিঃ! ছিঃ! লজ্জা শরম কি কিছুই নাই নাকি?এসব কি বলতাছো?’
—‘ভুল কই বললাম? আপনি আমার ভেজা চুল দেখছেন না। ও হো বুঝেছি, দাদাজি বোধ হয় আপনারে এমন সোহাগ করে নাই, তাই না?’
এবার কোনো দিকে না তাকিয়ে সজীব উঠে চলে গেলো। সৌহার্দ কাশতে কাশতে যক্ষা রোগীর মতো হয়ে গেলো। সূচনার দৃষ্টি রেশমির চুলের দিকে, বুকটা ধক করে ওঠলো তার। তার দুঃখের সাগর এবার কানায় কানায় পূর্ণ হতে লাগলো।
জমিলা ফুশে উঠলো। সে রেগে বলে,–‘ দাদাজী সোহাগ না করলে তোমার শশুড় আসতো না,আর শশুড় না আসলে তোমার স্বামী আসতো না।’
রেশমি কোনো প্রতিক্রিয়া করলো না,সে আপনমনে খেতে লাগলো। তার এমন ভাবমূর্তি দেখে জমিলা বেগম আরো বেশি রেগে গেলেন। তিনি,,
চলবে!
….
….
#অসুখের_নাম_তুমি
#সোনালী_আহমেদ
৬ষ্ঠ পর্ব
রেশমি কোনো প্রতিক্রিয়া করলো না,সে আপনমনে খেতে লাগলো। তার এমন ভাবমূর্তি দেখে জমিলা বেগম আরো বেশি রেগে গেলেন। তিনি পুরো টেবিল নাড়িয়ে দাড়িয়ে পড়লেন।
রেশমি বাদে উপস্থিত সবাই চমকে তার দিকে তাকায়। রেশমি দুই হাতে খেতে লাগলো। জমিলা বেগম হনহন করে তার কক্ষের দিকে চলে গেলেন।
সোহার্দ ও হাত ধুয়ে ওঠে গেলো, লিনাও চলে গেলো শাশুড়ির কান ভাঙ্গাতে। সুমি এসে তার সাথে যোগ দিলো।
কে গেলো কে এলো রেশমির তার দিকে কোনো খেয়াল নেই। সে নিজের মতো খাচ্ছে। পৃথিবী বড়ই কঠিন, এখানে অন্যের দিক দেখতে গেলে নিজেকে না খেয়ে মরতে হবে। শুধুমাত্র মায়ের অসুখের জন্য রেশমি দূর্বল হয়েছিলো নাহলে সে কখনো বিয়ে তে রাজি হতো না।
পেট ভরে খেয়ে ঢেকুর তুললো সে। মনেমনে বেশ খুশি সে,’ রেশমি এই প্রথম কোনো ভালো কাজ করেছিস। বিয়ে তে যদি রাজি না হতি তাহলে এমন বড় ঘর আর বর পেতি না।’ মনেমনে বেশ হাসলো সে। খুশিতে তার শরীর টগবগ করছে। সে ভাবে, তার মা এখন তাকে এভাবে দেখলে নিশ্চিত দু চার গা লাগিয়ে দিতো। ভাগ্যিস মা এখানে নেই,নাহলে ওই বুড়ির সাথে তর্ক করায় কত কি করতো!
দূর থেকে তার এ হাসি লক্ষ করছে সূচনা। বুক ফেটে আর্তনাদ বের হতে চাইছে। কিছুই মুখে না দিয়ে সে স্থান ত্যাগ করলো। বুকের ভেতর অচেনা অজানা ব্যাথ্যা অনুভব করছে সে।
—‘দাদীর সাথে তুমি কীভাবে এমন কথা বলতে পারছো? আমি তো অবাক।’
—‘যে যেমন তার সাথে করতে হবেও তেমন।’
—‘তাই বলে ওই আধ বুড়ো মানুষ টার সাথে?মানুষ টা বাঁচবে কয়দিন?’
—‘ বুড়ির জান শক্ত। দেইখো তোমার থেকেও বেশিদিন বাঁচবে। শুনেনন আপু,উনি কোনো আমার সাথে সাধারন বিষয় নিয়ে কথা বলে নাই। সরাসরি জামাই নিয়ে কথা বলছে, আমাকে ছেড়ে দিতে বলছে জামাইকে। এখন কি আমি উনার বয়স দেখে চুপচাপ সব শুনে নিজের কপাল পুড়ার অপেক্ষা করবো?’
—‘তবুও,,,’
—‘ তবুও কিছুই না। ওই বুড়ি সহজে মানবে না জানি। এখন তো আরে মানবে না,উঠে পড়ে লাগবে আমাকে বের করতে। আমিও কম না,হু হু। জান লাগিয়ে শেষ নিঃশ্বাস অবধি লড়াই করে এখানেই থাকবো। চুপচাপ মেনে নেওয়ার মেয়ে না আমি, এমন হলে মামীর বাড়ী থাকতে পারতাম না, আমার মামী বুড়ি থেকেও বদ। আমার বাবা সবসময় বলতেন,”বেঁচে থাকার জন্য লড়াই প্রয়োজন।” হয় সংসার করবো নাহয় সংসার ভাঙ্গবো। বিয়ে ভাঙ্গা এত সহজ? ‘
—‘বাব্বাহ, এই টুকুন পিচ্চি মেয়ের কি কথা! তোমাকে কে পিচ্চি বলে? এত বুদ্ধি কই থেকে আসছে?’
—‘ আসলে আপু, কান্ড জ্ঞান হওয়ার পর থেকে লড়াই করে এ পর্যন্ত বেঁচে আছি। বাবা বেঁচে থাকতেও খাবারের জন্য লড়াই করতে হয়েছে। মরার পর থাকার জন্য লড়াই করতে হয়েছে। সেই জন্যই এতসব বুঝি। আর আমি পিচ্চি না, আমার চৌদ্দ বছর শেষ,পনেরো চলছে।’
শেষের বাক্যটুকু বলার সময় রেশমির ভাবভঙ্গি দেখে সুমি হেসে দেয়। বাচ্চা মেয়েটার কি কথা। সে যদি রেশমির জায়গায় হতো নির্ঘাত কেঁদে কুদে সব ভাসিয়ে দিতো। ওমন কথা মুখ দিয়ে বের করলে তার গাল আর গালের জায়গায় থাকতো না। নিশ্চয়ই আঘাতের ফলে লাল টাল হয়ে যেতো।
নাস্তা শেষ করে ওঠে না দাড়াতেই নিচে এসে হাজির হোন জমিলা। রেশমি তার দিকে তাকায়। জমিলা এসে বলে,
–‘ সুমি আমার ঘরে যাও, আজ তোমার ঘরের কোনো কাজ করতে হবে না। আমার এক বস্তা সুপারি আছে,সেগুলা কেটে দাও। সুপারি শেষ,পান ও শান্তিতে খেতে পারি না। ঘরের কাজ নিয়ে চিন্তা করো না, নতুন বউ আছে না,সে সামলে নিবে। তাই না নাতবৌ?’
তো বুড়ির মাথায় এই কাহিনী চলছে। বড্ড আফসোস লাগছে। আগো একটু খোঁজ খবর নিয়ে দেখতে আমার সম্পর্কে। মামীর পুরো সংসার আমাকেই চালাতে হতো, রান্না হতে ধোয়া-মুছা পর্যন্ত। এমন কি বিয়ের দিনের রান্নাও আমি রেঁধেছি।
মনে মনে কথাগুলো আওড়ায় রেশমি। ঠোঁটে তার মিষ্টি হাসি। এ বুড়ির সম্পর্কে তার বেশ ভালো অভিজ্ঞতা হচ্ছে।
“খুব তো বউ হতে এসেছো,দেখি কতক্ষণ টিকতে পারো? দুদিনের মধ্যে বাড়ী ছাড়া না করলে আমিও জমিলা না।”
জমিলার চোখ যেনো এইকথাগুলো বলছে রেশমিকে। রেশমি হাসে, সেও চোখ দিয়ে বুঝায়, ‘ দেখা যাক।’
রান্না ঘরের এক গাদা কাজ আটিয়ে রেশমি বের হতেই লিনা এসে দাড়ায়। রেশমি তাকে দেখেই বলে,–‘ আজ কি রান্না করবো?’
লিনা এসে কচু, পাট পাতা আর হেলেঞ্চা পাতা বের করে দেয় সাথে তিন টুকরো রুই মাছের মাঝারি সাইজের পিঠের টুকরো, এক টুকরো পেটি, আর লেজ এনে দেয় ভাজি করার জন্য। রেশমি ভ্রু কুচকে তাকায়। বাড়ীতে কি এসব রান্না হবে?
লিনা চলে যেতে নিতেই রেশমি এসে সামনে দাড়ায়। লিনা রাগী চোখে তাকাতেই রেশমি বলে,
—‘আজ তো বৌভাত। আমার বাড়ীর লোকজন তো আমাকে আর উনাকে নিতে আসবে,তাই না? তাদের জন্য রান্না করবেন না? ‘
রেশমির দিকে ভ্রু কুচকে তাকিয়ে পাশ কাটিয়ে চলে যান তিনি। যেতে যেতে বলে যান,
–“ঘরে ভাত নাই বিড়ালে চাইলো ঘি!”
রেশমি সেদিক তাকিয়ে হালকা হাসলো। রান্না পর্ব চুকিয়ে নিতেই তার বাড়ী থেকে মানুষ এসে ভীড় জমালো।
মামা,মামী সাথে তাদের গ্রামের একজন মোড়ল আর এই গ্রামের মোড়ল ও এসেছেন।
রান্নার ফাঁকেই তাদেরকে লেবুর শরবত দিয়ে গিয়েছে রেশমি। লিনা নিচে এসে একবার ঘুরে গিয়েছে। সৌহার্দ এসে তাদের সালাম জানিয়ে পাশে বসেছে। জমিলা বেগম ও নিচে নেমে আসেন,উদ্দেশ্য তাদের কয়েক কথা শুনিয়ে দিবেন। সাথে রেশমিকেও বিদায় করে সূচনাকে ঘরে তুলবেন। কিন্তু এসে গ্রামের মোড়লকে দেখে তিনি অবাক।
সালাম জানিয়ে তিনিও যোগ দেন। ইজ্জত রক্ষার্থে রেশমির পরিবারকে ভালো-মন্দ জিজ্ঞাস করেন।
জমিলা বেগম বলে,
–‘ কুদ্দুস মিয়া,আপনি উনাদের সাথে?’
সৌহার্দের গ্রামের মোড়ল বলে,
–‘ সমস্যা তো বড়। আপনার নাতি তো উনাদের গ্রামের সকলকে কথা দিয়ে বিয়ে করেছেন এবং তিনি তার সব খেয়াল রাখবেন। সবাইকে ফাপর দেখিয়ে এসেছিলেন। সে জন্যেই এখানে আসতে হয়েছে যে মেয়েকে ঠিকমতো রাখছেন কি না? লোকজন অতি উৎসাহী হয়ে আছেন খবর জানার জন্য। বাহিরে কিছু লোকজন ও রয়েছেন।’
জমিলা বেগম ঢোক গিললেন। সবার আড়ালে রাগী চোখে সৌহার্দের দিকে তাকালেন।
জোরপূর্বক মুখে হাসি ফুটিয়ে বলে,
—‘ হ্যা,হ্যা আমরা তো রেশমি কে ঠিকমতোই রাখছি। এমনকি আসার পরেও একটা কাজ ও করতে দেই নাই।’
রান্না সম্পূ্র্ণ রুপে শেষ করে উপস্থিত হয় রেশমি। জমিলার কথা শুনে সে ভ্রু কুচকে তাকায়। জমিলা বেগমর মুখ পানসে হয়ে যায়। তিনি তৎক্ষণাৎ কথা ঘুরিয়ে উনাদের সামনে পানের থালি এনে দেন।
রেশমি এসে জমিলার পাশে দাড়ায়,জমিলা বেগমকে চোখ দিয়ে শাসিয়ে বলে’কি বলবো?’
জমিলা বেগম জোরপূর্বক ঠোঁটে আলগা হাসি আনে।
—‘ তা,রেশমি মা এখানে তোমার থাকতে অসুবিধা হচ্ছে না তো?’
রেশমি জমিলার দিকে এক পলক তাকায়। জমিলার মুখের অবস্থা দেখার মতো ছিলো।
রেশমি হেসে বলে ওঠে,–‘ না,একদম ই না। উনারা আমার খুব খাতির যত্ন করছেন। আর কিছু করলে তো আমি অবশ্যই আপনাদের জানাবো।’
মোড়ল বলে ওঠে,–‘আলহামদুলিল্লাহ। ‘
তারা চলে যাওয়ার কথা বলতেই রেশমি বলে ওঠে,
–‘ আরে কই যাচ্ছেন? ভাত তো খেয়ে নিতে হবে। আপনাদের জন্য তাজা রুই মাছ আর ডিম ভুনা করা হয়েছে।’
—-‘না,আজ যাই পরে একদিন,,,’
—‘পরে একদিন আবার কি?এখনই খেয়ে যাবেন। ফিরা যাত্রায় তো খেতেই হয়।পরে টরে বাদ দিন।’
রেশমি জোর করে তাদের বসিয়ে টেবিলে খাবার নিয়ে আসে। রান্নার সময় তাকের নিচে ঝুঁড়িতে কয়েকটা মুরগির ডিম দেখেছিলো সে। তখন ই সেগুলা নিয়ে রান্নায় বসিয়ে দেয়।
জমিলা আর লিনা দুজনেই দাড়িয়ে দাড়িয়ে লুচির মতো ফুলছিলো। যদি পারতো এক কোপে রেশমিকে খুন করে ফেলতো। রেশমি তাদের এই অবস্থার বেশ মজা নিচ্ছে।
সবার সাথে সৌহার্দকেও বসিয়ে দিয়েছে সে। জমিলা বেগম ইজ্জতের ভয়ে টু শব্দ করতে পারছিলো না।
খাওয়া-দাওয়া অবস্থাতেই নিচে নেমে আসে সূচনা। তার চলে যাওয়ার কথা অদ্ভুত হলেও সে যাচ্ছে না। ভালোবাসার মানুষকে পাওয়ার একটা শেষ চেষ্টা করেই যাবে। দাদী তাকে কথা দিয়েছেন তিনি সৌহার্দের সাথে তার বিয়ে দিবেন। তাকে নানান যুক্তি দিয়ে বুঝিয়েছেন যে রেশমিকে বাধ্য হয়েই বিয়ে করেছে, ওর সাথে থাকলে নাকি সৌহার্দ ভালো থাকবে না। সৌহার্দের অমঙ্গল হবে। রেশমি তো তার জন্য তৈরী হয় নি, সূচনাই তার জন্য তৈরী হয়েছে। সৌহার্দের ভালোর জন্য হলেও যেনো সূচনা থেকে যায়। সূচনা অনেক ভেবে চিন্তে রাজি হয়েছে,তাছাড়া সেই বা কি করে গ্রামে মুখ দেখাবে। এতে তার অঙ্গে কলঙ্কের দাগ লেগে যাবে।
সূচনা কে দেখে জমিলা বেগম আশ্বাস দেন যে সব ঠিক হয়ে যাবে। সূচনা মাথা নাড়িয়ে বড় নিঃশ্বাস ছাড়ে।
অতঃপর সকলকে বিদায় দিয়ে রেশমি আর সৌহার্দকে নিয়ে যায় রেশমির মামা-মামী। বিয়ের পরের দিন শশুড়বাড়ী থাকতে হয় এমন ই নিয়ম। বহু কিচ্চা-কাহিনী করে সৌহার্দকে নিতে পেরেছে রেশমি। জমিলা বেগম তো তাকে দিতেই চান নি। লিনা নিজের কপাল চাপড়াচ্ছিলো, কেনো যে সৌহার্দকে দোকানে পাঠিয়ে দেয় নি। সৌহার্দকে অনেক কিছু করেও আটকাতে পারে নি, অবশ্য লিনার মামী কম চেষ্টা করে নি রেখে যাওয়ার জন্য। তার বিন্দু পরিমান ইচ্ছা নেই ওদের নিয়ে যাওয়ার।
সোহার্দ চলে যাওয়ার সময় দুঁফোটা জল ছেড়ে দেয় সূচনা। এসব তো তার সাথে হওয়ার কথা ছিলো। রেশমির জায়গায় তার থাকার কথা ছিলো। এত কষ্ট তো তার কপালে ছিলো না তাহলে সে কেনো কষ্ট পাচ্ছে?
অনেক্ষণ দাত চেপে সব সহ্য করেছে জমিলা আর লিনা। ওরা বেরিয়ে যেতেই রাগে ফেঁপে ওঠে দুজনেই। মনে মনে কঠিন সিদ্ধান্ত নেয় যে এই মেয়েকে আর এ বাড়ীতে উঠতে দিবে না।
হঠাৎ দুজনের পেটে গুডুর গুডুর ডাক দিয়ে ওঠলো। জমিলা বেগম রান্নাঘরে যেতেই দেখলেন
পাতিলে শুধু কচু রয়েছে,বাকি সব কিছুই রেশমি খাইয়ে দিয়েছে। মাথায় দপ করে আগুন জ্বলে ওঠে তার। রেগে গর্জন করে ডেকে ওঠে, –‘রেশমিইই।’
চলবে!