অসুখের নাম তুমি ১৫+১৬

0
969

#অসুখের_নাম_তুমি
#সোনালী_আহমেদ
পর্ব—-১৫+১৬

সুমি হকচকিয়ে উঠলো। সবাই তার মুখপানে জবাবের আশায় তাকালো। সজীব আর লিনার মুখপানে চাইতেই তার শরীর ঠান্ডা হয়ে ওঠলো। সুমির হয়েছে শাখের করাত। কোন দিকে যাবে মাথায় আসছে না। সে আমতা আমতা করতে লাগলো। থমথমে মুখে মাথা উঁচু করে রেশমির দিকে এক পলক তাকিয়ে সঙ্গে সঙ্গে আগের ন্যায় মাথা নিচু করে ফেললো। তার জবাবের আশায় করুন দৃষ্টিতে চেয়ে আছে রেশমি। সে কি জবাব দিবে সবাই শুনতে চায়।

বেশ খানেক সময় মনের সাথে যুদ্ধ করে মুখ খুললো সুমি। অনেক সাহস নিয়ে বলে,

‘ভাবী যা বলছেন সব সত্যি। চাচীআম্মা সকালে আমাকে ধাক্কা মেরে ফেলে দেওয়ার পর আমার কপালের এ দশা হয়েছে। তাছাড়া ভাবীর গলার পাশে এখনও আম্মার চুড়ির দাগ বসে আছে। বিশ্বাস না হলে দেখতে পারেন।’

দুজন মহিলা উঠে গিয়ে রেশমির গলার পাশ দেখলেন। এখনো লাল হয়ে আছে। সঙ্গে সঙ্গে সবার চোখের কালো পর্দা সরে গেলো। ধিক্কার জানিয়ে লিনার আশেপাশে থু থু দিতে লাগলো। বিষয়গুলো এত দ্রুত হয়ে গেলো যে লিনার বুঝতে অনেক সময় লেগে গিয়েছে। সুমির কাজে লিনা বিষ্ময়ে কিংকর্তব্যবিমূঢ়!
যে মেয়ে কখনো তার দিকে চোখ তুলে তাকিয়ে কথা বলতো না আজ সে জনসম্মুখে তার বিরুদ্ধে আওয়াজ তুলেছে। চোখ রাঙ্গিয়ে তাকিয়ে রইলে সুমির মুখপানে।
কিন্তু সুমি আজ ভয় পেলো না,বরং মনে ভীষণ শান্তি অনুভব করলো।

কঠিন লাঞ্চনার মাধ্যমে বিচারকার্য সুষ্ঠ হয়। অপমানে লিনার চোখে জল আসতে বাধ্য হলো। মাথানিচু করে ঘরে ফিরে আসতে হয় তাকে। ঘরে এসেই দরজায় খিল মেরে নিজেকে আটকে রাখলো সে। লজ্জায় কারো সামনে উপস্থিত হলো না। দিন পেরিয়ে রাত এলো তবুও লিনা রুম থেকে বের হলো না। তার স্বামী, সন্তানেরা বেশ কয়েকবার ডেকেও কোনো সাড়া পায় নি।

সুমি আর রেশমিকে কেউ কিছু বললো না। তারা নিজেদের মতো কাজ কর্ম করে গিয়েছে। রেশমি বেশ কয়েকবার সুমিকে ধন্যবাদ জানিয়েছে তার পক্ষে জবাব দেওয়ায়। বিপরীতে সুমি সৌজন্যবোধক হাসি উপহার দিয়েছে।

অধিক সময় পেরিয়ে যাওয়ার পরেও যখন লিনার সাড়া পাওয়া গেলো না, তখন গাবড়ে যায় তার স্ব-পরিবার। বাধ্য হয়েই সজীবকে দরজা ভেঙ্গে ডুকতে হয়েছে। সজীবকে অস্থির হয়ে রুমে ডুকতে দেখে সঙ্গে সঙ্গে ডান হাতের কব্জির উপর ব্লেড দিয়ে টান মারলো লিনা। মুহূর্তেই রক্তের ফোয়ারা বইতে লাগলো হাত দিয়ে। বিষয়টি সবার জন্য বড়সড় এক ধাক্কা ছিলো। কেউ ধরতে পারলো না এসব লিনার এই মুহূর্তে করা চক্রান্ত। সজীব বদ্ধ উন্মাদের মতো আচরণ শুরু করলো। চোখের সামনে রক্ত ভাসতেই শরীর ঠান্ডা হয়ে আসলো তার।পাগলের মতো মাকে হাসপাতালে নিয়ে যেতে লাগলো। লিনা চোখের জল ফেলতে ফেলতে সজীবের হাত ধরে বলে,

‘বাবার রে,আমি জানি আমি আর বাঁচবো না। তোরা সুখে থাকিস, আমার সিয়াম রে দেখে রাখিস। তোর বউ আর বাচ্চা নিয়ে সুখে সংসার করিস। ‘

এটুকু বলেই লিনা হাপিয়ে উঠলো। মরে যাওয়ার মতো অবস্থা তার। সজীব বারবার বলতে লাগলো,

‘মা তোমার কিছু হবে না।’
———————-
অনেক্ষণ পর ডাক্তার এসে লিনার সুস্থতার খবর জানালো। বস্তুুত লিনার হাতের চামড়া খানিকটা কেটে গিয়েছিলো। ডাক্তার ও বিষয়টা স্পষ্ট জানালো। কিন্তু লিনার বিষয়টা সবাই অতি রঞ্জিত ভাবে নিলো। হাসপাতালে বাচ্চারা কেঁদে ভাসিয়ে দিতো লাগলো।
বাড়ীতে নিয়ে আসার বেশকিছুক্ষণ পর সজীব মায়ের কাছে গেলো। তাকে দেখেই লিনা আফসোসের সুরে বললো,
‘হাহ্,বেঁচে গেলাম রে বাবা। তোর বউয়ের সুখের সংসার আর করা হলো না। কীভাবে যে বেঁচে গেলাম! কতবার দোয়া করেছি,মরে যাই যাতে তোর বউ সুখে সংসার করতে পারে।’

‘ এসব কি বলো মা? তুমি মরে গেলে আমরা কীভাবে থাকতাম?’

‘কেনো,তোর বউ আছে। আমি জানি তোরা খুব সুখে সংসার করতি। অথচ দেখ বেঁচে গেলাম।’

‘মা,দোহাই লাগে চুপ করো। আজ তোমার কিছু হলে ওই মেয়ের সাথে সংসার করা দূর,তাকে এক কাপড়ে বিদায় করে দিতাম।’

সজীবের চক্ষুজোড়া লাল হয়ে ওঠলো। হাতে মুষ্ঠিবুদ্ধ করে বসে রইলো। মায়ের সাথে কিছু সময় কাটিয়ে রুমে চলে আসলো।
রুমে এসেই সুমির চুলের গুছি মুঠোয় পুরে বলে,
‘খুশি তো। আমার মা মরে যাচ্ছিলো খুশি হয়েছিলি না? বেঁচে যাওয়ায় বুঝি খুব কষ্ট হচ্ছে?’

সুমি কাতরাচ্ছে। চুলে ভীষণ ব্যাথা পাচ্ছে। গোড়া টনটন করছে। অশ্রুসিক্ত নয়নে সজীবের দিকে তাকালো। সাথে সাথে সজীব ছেড়ে দিলো। তার হাতে এক গাছি চুল ও উঠে এসেছে। সুমি ব্যাথাতুর দৃষ্টিতে একবার চুল তো আরেকবার সজীবের দিকে তাকাচ্ছে। সজীব বেশিক্ষণ সুমির দিকে তাকাতে পারলো না। ঘুরে গেলো, তার বুকের গভীরেও সে একই কষ্ট অনুভব করছিলো। মায়ের অবস্থা তার উপর এতটাই প্রভাব ফেললো যে সে কি করছে না করছে মষ্তিষ্ক সজাগ করতে পারলো না। সুমি চুপ করে রইলো। কোনো প্রতিত্ত্যুর করলো না।
সেদিনের পর থেকেই শুরু হলো সুমির নরক যন্ত্রণা। উঠতে বসতে স্বামী,শাশুড়ির শরীর জ্বালানো কথা সাথে সব ধরনের কাজ। অন্তঃসত্ত্বা হওয়া স্বত্তেও তাকে দিয়ে ভারী কাজ করানো হতো। এমনকি ধোয়া কাপড় গুলোও ধুতে হতো।

রেশমির এসব সহ্য হচ্ছিলো না। কিন্তু সে যতবার প্রতিবাদ করতে যেতো ততবার ই সুমির উপর আলাদা অত্যাচার হতো। যতটুকু পারতো ততটুকু সে সাহায্য করতো। মাঝে মাঝে সুমির এত কষ্ট দেখে রেশমি কেঁদে দিতো।

না সইতে পারা রেশমিও একদিন এসবে অভ্যস্ত হয়ে ওঠলো। সুমিকে যত কাজ করতে দেওয়া হতো তার সবকিছুই সে করে দিতো। যাতে সুমি একটু শান্তি পায়।

হঠাৎ একদিন খবর আসলো সুমির বাচ্চা নষ্ট হয়ে গিয়েছে। তখন সুমির চারমাস চলছিলো। তার জীবনে অনেক বড় ধাক্কা ছিলো এ ঘটনা। সবার উপর প্রভাব ফেলেছিলো বাচ্চা নষ্ট হওয়ার ঘটনা। সেদিন চাপা স্বভাবের সুমি টাও গলা ছেড়ে কেঁদেছিলো। তার আর্তনাদের ধ্বনি কাঁদতে বাধ্য করেছিলো মানুষজনকে। বাচ্চা বাচ্চা করে কাঁদতে লাগলো রাত-দিন। তার এই আহাজারি দেখে শাশুড়ি বলে,’ এসব তার ঢং। বাচ্চা টাকে সে ইচ্ছা করেই নষ্ট করেছে।’ বাচ্চা নষ্ট হওয়ার পরেও কম কথা শুনতে হয় নি সুমিকে। যা মুখ দিয়ে আসতো তাই বলতো লিনা। এসব শুনে সুমি নিজেকে গুটিয়ে নিলো সবার থেকে। সুমির অবস্থা বেগতিক দেখে রেশমি কাঁদতে কাঁদতে বলে,

”আপু,আমি যদি জানতাম সেদিন সাক্ষী দেওয়ার পরিণাম এমন হবে তাহলে জীবনেও আপনাকে সাক্ষী দিতে দিতাম না।”

সুমি কোনো প্রতিক্রিয়া দেখালো না। সে কেমন যন্ত্রের মতো হতে লাগলো। কারো সাথে কথা বলতো না,মিশতো না,সবসময় একাকী থাকতো।

‘আপু,তুমি ঠিক আছো তো?’

সুমি মাথা নাড়িয়ে জবাব দিতো,
‘হ্যা,ঠিক আছি। কি হবে আমার?’

রেশমি আর করার মতো কোনো প্রশ্ন পেতো না। সুমি তার সাথে স্বাভাবিক দেখাতো। রেশমি জানে, যতটা স্বাভাবিক সুমি নিজেকে দেখাচ্ছে সে ঠিক ততটা স্বাভাবিক নয়। হয়তো বড় কিছু চলছে সুমির ভেতরে যা সে টের পাচ্ছে না। অবশেষে বাচ্চার শোক কাটাতে না পেরে কিছুদিনের মধ্যেই দুনিয়ার মায়া ত্যাগ করলো সুমি। মানুষিক চাপের ফলে তার নিঃশ্বাস নেওয়ার সকল বায়ু কার্বন-ডাই-অক্সাইডে পরিণত হয়ে গিয়েছিলো। যেখানেই নিঃশ্বাস নিতো সেখানেই বিষ পেতো। তাই বাঁচতে পারলো না বেশিদিন এই বিষাক্ত পরিবেশে। চলে গেলো সবাইকে মুক্ত করে। নিষ্ঠুর পৃথিবী তাকে শান্তিতে বাঁচতে দিলো না । সে কি চেয়েছিলো? এক মুঠো সুখ। আর তো বেশি কিছুই চায় নি। তিনবেলা খেটে খেয়ে স্বামীর সাথে সুখে সংসার করতে চেয়েছিলো । হেসে খেলে বাঁচতে চেয়েছিলো। এর থেকে তো আর বেশি কোনো প্রত্যাশা ছিলো না তার।

এ শহরে সুখের বড্ড অভাব। বড্ড অভাব! সকলে যাকে সুখি মানুষ হিসেবে চিনতো বাস্তবে তার জীবনে সুখের ফোঁটাও ছিলো না। ছিলো না কোনো আনন্দ, ছিলো শুধুই হতাশা আর এক সাগর দুঃখ।

#চলবে……

….
#অসুখের_নাম_তুমি’
পর্ব নং– ১৬
লেখিকাঃ #সোনালী_আহমেদ

সূর্যের প্রখর তাপমাত্রায় গরম হয়ে উঠছে বাসা-বাড়ীর টিন-ছাদ। এত এত গরমের মধ্যেও বাড়ীভর্তী মানুষ। লোকজনে গিজগিজ করছে ঘরবাড়ী । চারদিকে শোকের মহল। কান্নাকাটির আওয়াজ দূর-দূরান্ত থেকে শুনা যাচ্ছে। ইতোমধ্যে সুমির মৃত্যুর সংবাদ ছড়িয়ে গিয়েছে চারদিকে। তাকে এক পলক দেখতেই এত মানুষের ভীড়। লোকজনের মুখে চলছে আফসোসের সুর। সুমির মৃত্যুর সংবাদ শুনলেই প্রত্যেকের মুখে অবিশ্বাসের তাক লেগে যায়। এ যেনো কোনো বিষ্ময় আর অবাক কান্ড। বিশ্বাস ই করতে চায় না কেউ। সাদা কাপড়ে মুড়িয়ে ঘরের মাঝখানেই শুইয়ে রাখা হয়েছে তাকে। মানুষজন আসলেই মুখের কাপড় টা উল্টিয়ে দেখানো হয়।

কি সুন্দর! সাদা গোলগাল মুখ। মৃত্যুর কোনো ছাপ তার মুখে পরিলক্ষিত হচ্ছে না। দেখতে সুস্থ স্বাভাবিক মানুষের মতো লাগছে। মনে হচ্ছে চোখ বন্ধ করে ঘুমিয়ে আছে,এক্ষুণি বোধ হয় চোখ খুলে ফেলবে। অথচ এমন কিছুই ঘটবে না।

জমিলার চোখ ফুলে ঢোল হয়ে গিয়েছে,সাথে হাত পা দুটোও। তবুও নাতনির কাছ থেকে সরছেন না। কেঁদে কেঁদে তিনি বলছেন,

‘ ও নাতিন, আমারে রেখে তুই চলে গেলি?তোরে ছাড়া আমি কীভাবে থাকবো রে?’

সুমির কোনো নড়চড় নেই। মরা মানুষ আবার নড়ে নাকি? জমিলার অবস্থা খারাপ হতে দেখে লোকজন তাকে সরিয়ে নিতে চাইছেন কিন্তু তিনি নড়ছেন না। সুমিকে ধরে তার কান্নার শেষ নেই। নাতিন যে তার বড় আদরের,কীভাবে সহ্য করবে আর কীভাবেই বা মেনে নিবেন?

লিনা অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছে। এটা তার নাটক কি না তা কারো বোধগম্য হচ্ছে না। তবে সুমির মৃত্যুতে সে বেশ বড়সড় ধাক্কা খেয়েছে। এই মেয়ের কারণেই ছেলেকে হাতের মুঠোয় রাখতে সক্ষম হয়েছিলেন তিনি। সজিবকে সবসময় সুমির ভয় দেখিয়ে আঁচলে বেঁধে রেখেছেন। এবার কি হবে? সৌহার্দের অঢেল টাকা হাতিয়েছেন সুমির উছিলায়। কিন্তু এখন তো ডিম পাড়া হাস টা উড়াল দিলো, কীভাবে ভোগ করবেন টাকা আর সম্পত্তি।

এদিকে সজীব লা-পাত্তা। তার কোনো খবর নেই। সুমির মৃত্যুর সংবাদ শুনার পর তার আর খবর নেই।বাচ্চা নষ্ট হওয়ার পর প্রথমবারের মতো কিছু হারিয়েছে এমন অনুভূতি হয়েছিলো তার।হৃদয়ে শূন্যতা অনুভব করতো। ভেতর থেকে একদম ভেঙ্গে গিয়েছিলো। কিন্তু সুমিকে অধিক মাত্রায় ভেঙ্গে পড়তে দেখে নিজের টা প্রকাশ করলো না। খুবই স্বাভাবিক ভঙ্গিমায় চলাচল করেছে। বাচ্চা নষ্ট হওয়াটাকে তুচ্ছ ব্যাপারের মতো সুমির সামনে তুলে ধরেছে। যাতে সুমির ভেতরের হাহাকার টা একটু হলেও কমে আসে। কিন্তু আফসোস তা আর হলো কই? বরং তাকে রেখে বুকে এক আকাশ অভিমান পুষে ছেড়ে চলে গেলো। বুকের এক অংশে তীব্র হাহাকার অনুভব করছে সজীব। মা কে খুশি করতে কারণে অকারণে সুমির উপর অত্যাচার করেছে। সে কখনো ভাবে নি অত্যাচারের পাল্লা এত বেশি হবে যে তার বউ পৃথিবী ছেড়েই চলে যাবে। হাত পা ছুড়ে কাঁদছে সে। তার একেক টা গগন ভুলানো চিৎকারে আকাশ কেঁপে উঠছে। কিন্তু আফসোস এখন কেঁদে কোনো লাভ নেই। যে চলে যাবার সে তো চলে গিয়েছে। প্রায় মানুষজন সজীবের মতো। যখন থাকে তখন মূল্য দেয় না,যখন হারিয়ে ফেলে তখন সেটার জন্য আফসোস করে কেঁদে মরে।
এর অন্যতম একটি কারন হলো, লোকজন যখন ভালো কোনো জিনিস খুব সহজে পেয়ে যায়, তখন সেটা তাদের কাছে হয়ে যায় মূল্যহীন।তারা ভাবে এটা তো এমনিতেই পেয়ে গিয়েছি,এটাকে কেনো দাম দিবো! অথচ মূল্য না দিতে দিতে একসময় যখন জিনিস টা হারিয়ে ফেলে তখন সে জিনিসের মূল্য অনুভব করে। বুঝতে পারে জিনিস টা তাদের জীবনে কতটা প্রয়োজনীয় ছিলো। তখন বুঝে আর কোনো লাভ হয় না। তারা শূন্যতায় ভুগতে থাকে, এক বুক হতাশা নিয়ে কাটাতে হয় জীবন।

স্ত্রীর লাশ কাঁধে নিয়ে এলোমেলো পায়ে চলছে সজীব। তার হাত-পা নিশ্চল। এক কদম যেতেই ঢুলেঢালে যাচ্ছে সে। অনর্গল স্রোতের ধারা বইছে চোখ দিয়ে। পৃথিবীর সবচেয়ে বড় হতভাগা ব্যক্তি বোধ হয় সজীব। যে স্ত্রীর লাশ কাঁধে বয়ে নেওয়ার ভাগীদার হয়েছে। উন্মাদের মতো কত সময় যে সে কেঁদেছে তার হিসাব নেই। এক ঘরে এক রুমে দুজন মানুষ এত বছর থাকছে। তাদের প্রেম হওয়া তো অনিবার্য ছিলো। কিন্তু সজীব নিজেকে প্রেমিক পুরুষ বলে আক্ষায়িত করে না। সে জানে,পৃথিবীতে যদি নিকৃষ্ট স্বামী খোঁজা হয় তাহলে সর্বপ্রথম তার নাম আসবে। লিনা কে সম্পত্তির প্রলোভন টা সে ই দেখিয়েছিলো। যাতে সুমিকে বিয়ে করতে পারে। তার আকাঙ্ক্ষা ছিলো দিনশেষে যেনো সুমি তার কাছেই থাকে, তার দৃঢ় বিশ্বাস ও ছিলো থাকবে। কারন সুমির যে আর যাওয়ার কোনো জায়গা নেই। সে যত মারুক কাটুক, শেষে তার কাছে, তার ঘরেই থাকবে। কখনো ভাবে নি যে এ মেয়েটা কোনো একদিন টুপুস করে পৃথিবী ছেড়ে চলেও যেতে পারে।

যত কদম পা দিচ্ছে সে তত কদমে চোখের জল পড়ছে তার। বুক জ্বালা করছে, শরীর টলছে। নিঃশ্বাস আটকে আসছে। তার মনে হচ্ছে সে আর বাঁচবে না। কবরের উপর শেষ মুঠ মাটি সে দিলো। কাঁদতে কাঁদতে কবরের উপর শরীর ছেড়ে দিলো। শেষ হয়ে গেলো সুমির জীবনযাত্রা। রইলো না তার জীবনে আর কোনো অধ্যায়।

কেটে গেলো আরো কয়েকটি মাস। বদলে গেলো গুটি কতক মানুষের জীবন-ধারা। ধীরে ধীরে স্বভাবগতভাবেই অভ্যস্ত হয়ে উঠলো নতুন জীবনধারায়। চলতে লাগলো দিন। কাটতে লাগলো সময়।

——————————-

ডিসেম্বর মাস। শীতের মৌসুম চলছে। ঠান্ডা পড়া সবে শুর হয়েছে। তবুও কি নিদারুণ শীত লাগছে সৌহার্দের। গায়ে গরম কাপড়ের সাথে কম্বল জড়িয়ে বসেছে সে।অনেকদিন পর চিঠি লিখতে বসেছে । বিদেশে আসার অর্ধ বছর পেরিয়ে যাচ্ছে। এতগুলো সময় পেরিয়ে যাওয়ার পরেও কোনো কিছুতে মন বসাতে পারে নি সৌহার্দ। সবকিছুতেই সে বিরক্ত হতো,অস্থির হতো। কিছুই ভাল্লাগতো না। চোখের সামনে শুধু পরিবারের প্রতিচ্ছবি। রেশমির হাসিমাখা চেহারা। সারাক্ষণ তার মন ভীষণ অস্থির থাকে বাড়ী এবং দেশের জন্য। প্রত্যেককটা সময় কবে দেশে ফিরবে তার দিন গুণতে থাকে সে। আজ চিঠি লেখার কারণ টা বিশেষ।এর আগে একবার চিঠি পাঠিয়েছে,সাথে টাকা-পয়সাও। কিন্তু ফিরতি কোনো জবাব আসে নি। ভাগ্যের কি নিষ্ঠুর পরিহাস, সুমির মৃত্যুর চারদিনের দিন এই টাকা আর চিঠি পাঠিয়েছিলো। জবাব আসবে কীভাবে?কেউই তো জবাব দেওয়ার মতো অবস্থায় ছিলো না। সেসব তো আর সৌহার্দের জানা নেই। তাই আজ আবার চিঠি লিখবে রেশমিকে উৎসর্গ করে। তার মনে বাচ্চা বউটার জন্য অনেক কথা জমেছে।

বেশ কিছু সময় পরেও সাদা কাগজের উপর কালো বল পয়েন্টের কোনো দাগ দেখা গেলো না। কি লিখবে সেটাই মাথায় আসছে না তার। কলম চলছে না,মাথা টা কেমন ফাঁকা ফাঁকা। অনেক ভাবনা চিন্তার পর কলম তুললো সৌহার্দ। লিখতে লাগলো,

প্রিয় অসুখ,

শিরোনাম টুকু উচ্ছারণ করতেই হয়তো তোমার কপাল কুঁচকে গিয়েছে। ভাবছো তোমার নাম না লিখে অসুখ কেনো লিখলাম। এই প্রশ্নের জবাব দিতেই এই চিঠি টি।

এমন অসুখ কারো হয়েছে বলতে পারো? যে অসুখ কাউকে বাঁচতে দেয় না,খেতে দেয় না,এমনকি শুতেও দেয় না। সর্বক্ষণ শুধুই পীড়া দেয়। আজ অবধি না পেরেছে ডাক্তার না পেরেছে কবিরাজ, তবুও দেখিয়েছি সকল হসপিটাল। তুমিবিহীন এ অসুখের নেই কোনো ঔষধ -নেই কোনো ট্যাবলেট। এ অসুখের একমাত্র মেডিসিন যে তুমি। তাই তো সুস্থ হই নি আমি। অসুখে যে বড্ড অসুস্থ আমি, ‘অসুখের নাম তুমি’ । হ্যা অসুখের নাম তুমি। যার এক পলক চাহনির জন্য মরিয়া হয়ে আছি আমি। যাকে স্পর্শ করার জন্য দিনরাত ছটফট করছি আমি। কবে দেখবো তোমায়- কবে মিটবে আশা? কেনো এত খারাপ অসুখের নেশায় জড়িয়েছো আমায়। যার উত্তাপে দিনদিন জ্বলে পুড়ে ছারখার হচ্ছি। বৃষ্টি হয়ে নেমে নিভিয়ে দাও না এই আগুন। যাতে দু-দন্ড সময় শান্তিতে ঘুমাতে পারি। জানো, তোমার চিন্তায় কতশত রাত নির্ঘুম কাটে। চুপিচুপি এসে কপালের মধ্যভাগে অধর যুগল স্পর্শ করিয়ে ঘুম পাড়িয়ে দাও। যাতে বাকি সময় নিশ্চিন্তে কাটাতে পারি।

এই তুমি কি জানো?
তোমার নেশা কত ভয়ংকর।
জানো কি- এ নেশার কত অসীম ক্ষমতা?

ইতি,
তুমি নামক অসুখে আক্রান্ত ব্যক্তি।

সৌহার্দ আরো একটা চিঠি লিখলো। সেটা পারিবারিক। সেখানে দাদী,চাচী,বোন সাথে ছোট এক লাইনে রেশমির কথাও জিজ্ঞেস করলো। সে কীভাবে থাকছে তার বর্ণানাও দিলো। প্রথম চিঠি টা গোপনে যাতে রেশমির হাতে পৌঁছায় তার ও ব্যবস্থা করলো। এবারের টাকার সাথে আরো কয়েক টা নোট বেশি দিলো। সে নোটগুলো সুমির জন্য বরাদ্দ করে দিলো। সেগুলা দিয়ে সে যেনো ভালো ফলমূল আর শাক-সবজি খায়। বাচ্চা যেনো সম্পূর্ণভাবে সুস্থ থাকে সেটার বিশেষ সতর্ক বার্তাও বোনের জন্য লিখেছে। টাকা পাঠাতে দেরী হওয়ার জন্য ক্ষমাও চেয়ে নিয়েছে, সাথে উল্লেখ করলো,

‘ কাগজপত্রের মেয়াদ শেষ হয়ে যাওয়ায় গত মাসের টাকাগুলো লেগে গিয়েছে। তাই টাকা দিতে দেরী হয়েছে। তুই রাগ করিস নি তো?’

চলবে!

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here