অসুখের নাম তুমি ১৩+১৪

0
753

‘অসুখের নাম তুমি’
পর্ব–১৩+১৪
#সোনালী_আহমেদ

সৌহার্দের অবাক অবস্থা দেখে কোনো ভাবাবেগ দেখা দিলো না রেশমির মধ্যে। চোখ বন্ধ করতেই সৌহার্দ তাকে টেনে বসিয়ে দিলো।বিরক্তিকর দৃষ্টিতে চোখ মেলতেই, সৌহার্দ মুখ অন্ধকার করে ফেললো।
মেঝেতে দৃষ্টি ফেলে হতাশার সুরে রেশমিকে বলে,
‘কাল আমি চলে যাবো। আর তুমি এখন ঘুমাচ্ছো?’

রেশমি অকপটে জবাব দেয়,
‘ তো কি করবো? আপনাকে নিয়ে নাচবো?’

সৌহার্দ রেশমির গা ঘেষে বলে,
‘না, জড়িয়ে ধরলেই হবে।’

রেশমি সরে বসলো।তার ফর্সা গালে লাল আভা দেখা দিলো। কাচুমাচু করে এদিক-ওদিক তাকাচ্ছে।

‘ বিশ্বাস করো, তোমার লজ্জা পাওয়া দেখে আমার শরম লাগছে।’

‘আপনি খুব খারাপ। সরে বসুন না।’

‘উহু,নো সরাসরি।’

সৌহার্দ এক টানে রেশমিকে কাছে নিয়ে আসলো। রেশমির গাল আগের থেকে আরো বেশি লাল হতে লাগলো। হুটহাট সৌহার্দের স্পর্শ সে মেনে নিতে পারছে না। এত লজ্জা লাগছে যে মন চাইছে মাটি ফাঁক করে নিচে ডুকে যাই। চুপ করে বেশ কিছুক্ষণ এভাবেই সময় কাটালো দুজন। নিরবতা ভেঙ্গে রেশমি বলে ওঠে,
‘আপনি সত্যি কাল চলে যাবেন।’
‘হু’
‘আমার কি হবে,কীভাবে থাকবোই বা আমি?’

সৌহার্দ দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। তার কাছে এর জবাব নেই। বুক টা খাঁ খাঁ করছে। তার নিজের কাছেও খারাপ লাগছে। সে নিজেও যেতে চাইছে না। কিন্তু না চাইলে কি আর সব হবে? তাকে যেতেই হবে। বহু ধার-দেনা জমেছে। বিদেশ গিয়ে এসব চুকাতে হবে। তাছাড়া বোনের পাশাপাশি বউয়ের দায়িত্ব এসে জমেছে তার কাঁধে। সংসারের জন্য হলেও তাকে যেতে হবে।

ভাবনা চিন্তার সুতো ছেড়ে যায় বুক ভেজা অনুভব করতেই। রেশমি কাঁদছে। চোখের পানি, নাকের পানি সব এক করে ফেলছে। ইতোমধ্যে সৌহার্দের শার্টখানার বিচ্ছিরি হাল হয়ে গেছে।

‘এই বোকা মেয়ে,কাঁদছো কেনো?’

রেশমি নাক টেনে টেনে বললো,
‘আমার ইচ্ছা হয়েছে।’
‘তো দূরে যেয়ে কাঁদো না। আমার জামা ভরিয়ে দিচ্ছো কেনো?’
‘আপনার কি সমস্যা,এটা আমার স্বামীর শার্ট। আমি শতবার নষ্ট করবো আপনার কি?’

সৌহার্দ হাসে। কদিন আগেও যে মেয়েকে চিনতো না আজ সে মেয়ে তার জন্য কাঁদছে। না কখনো দেখেছিলো না কখনো কথা হয়েছিলো তবুও এ কয়দিনে কি টান তৈরী হয়ে গিয়েছে। দুনিয়ার সব ভালোবাসা যেনো একত্র করে তার জন্য ঢেলে দিচ্ছে।

রেশমির মাথাটা বুক থেকে তুলে দুটো গালে পরপর বারকয়েকবার ঠোঁট ছুঁয়ে দিলো সৌহার্দ। তাকে আশ্বাস দিয়ে বলে,
‘মাত্র চার বছর। এরপর তো আমি আবার চলে আসবো। তখন তুমিও বড় হয়ে যাবে। আমরা একসাথে আবারো সংসার করবো। একদম কেঁদো না।’

রেশমি থামলো না। কাঁদতে না বললেই কি কাঁন্না থেমে যায়! সে নাক টেনে টেনে তার কথার ফুলঝুরি মেলে ধরলো। সৌহার্দ কীভাবে থাকবে,কীভাবে চলবে,কার দিকে তাকাবে,কার দিকে তাকাতে পারবে না, কবে ফিরে আসবে,ফিরে আসলে কি করবে,কয়টা বাচ্চা নিবে, কীভাবে ঘর সাজাবে এসব নিয়ে সারারাত্রি গল্প করেছে। তাকে এক ফোঁটাও ঘুমাতে দেয় নি,নিজেও ঘুমায় নি।

দুপুর পেরিয়ে বিকাল ঘনিয়ে আসলো। সৌহার্দকে কিছুক্ষণবাদেই রওনা দিতে হবে। সকাল থেকে সবার সাথে কথা হলেও জমিলা বেগমের সাথে তার দেখাও হয় নি। দরজায় খিল মেরে নিজেকে আটকে রেখেছে জমিলা। সারাদিনেও কোনো খাবার মুখে তুলে নি সে। রেশমি আর সুমি তাকে বার কয়েকবার ডেকেছে কিন্তু সে সাড়া দেয় নি। যেনো পণ করে রেখেছে কারো সাথে কথা বলবে না।

বাড়ীর প্রত্যেকটা সদস্যের মুখ ঈষৎ কালো দেখাচ্ছে। দায়সারাভাবে যে যার কার্য পালন করছে। সৌহার্দ চলে যাবে সেজন্য আজ কোনো কর্তা বাহিরে যায় নি। ঘরে বেশ ভালো ভালো খাবার রান্না হচ্ছে। সুমি নানান জিনিস ভাইয়ের জন্য প্যাকেট করেছে তা অবশ্য লিনার আড়ালে।

জমিলার ঘরের দরজায় বেশ কয়েকবার কড়া নেড়ে কোনো সাড়া পেলো না সৌহার্দ। শেষ সময়ে জমিলা বেগম বের হলেন, তবে কোনো কথা বললেন না। সৌহার্দ তাকে জড়িয়ে ধরে অনেক্ষণ কেঁদেছিলো। তিনি কোনোরকম পরিবর্তন দেখালেন না। শেষে সৌহার্দ রেশমি আর সুমি দুজনকেই তার হাতে দিয়ে তাদের দেখে রাখতে বলেছে এবং ছোট ভেবে ক্ষমা করতে বলেছে। নাতির উপর যতই রেগে থাকুক, শেষে নিজেকে সামলাতে পারে নি। হু হু করে কেঁদে দিলেন।

জমিলা বেগম আঁচল দিয়ে চোখের জল মুছতে মুছতে বললেন,
‘সাবধানে যাবি। খবরদার আজেবাজে কিছু মুখে দিবি না। বিদেশিরা বড্ড খারাপ,তাদের দূরে থাকিস।’

সৌহার্দ মাথা নাড়িয়ে সায় দিলো। সৌহার্দ রেশমিকে ডেকে জমিলার সামনে আনলো। তার হাত ধরিয়ে বললো,
‘দাদী, ও অনেক ছোট। বুঝ-জ্ঞান কম। ওর মাকে আমি আশ্বাস দিয়েছি যে ওকে আমি দেখে রাখবো। কিন্তু এখন তো আমি তো চলে যাচ্ছি,তাই আমার দায়িত্ব তোমাকে দিয়ে দিলাম। তুমি রাখবে না ওর খেয়াল?’

জমিলা বেগম কোনো জবাব দিলেন না। সৌহার্দ উঠে সুমির কাছে যেতেই হু হু করে কেঁদে ওঠলো সুমি। ভাইকে কত দিনের জন্য চোখের আড়াল করতে চলেছে তার জানা নেই। তার মনে পড়ে প্রথম যেদিন ভাই চলে যাচ্ছিলো সেদিন কতই না কেঁদেছিলো। কতগুলো দিন মুখে ভাত তুলতে পারে নি। যত বারই মুখে ভাত দিতে যাচ্ছিলো ততবারই ভাইয়ের চেহারা মনে পড়ে গিয়েছিলো। ভাই কীভাবে খাচ্ছে?কিছু খেয়েছে কি না? এসব ভাবলেই আর খাওয়া হতো না।

‘ছুটকি, শুন। আমি যখন আবার আসবো তখন যেনো চ্যাম্পের সাথে খেলতে পারি। তার জন্য তুই প্রতিদিন ওকে আমার কথা বলবি। যেনো সে আমাকে চিনতে পারে। কিরে বলবি তো?’

সুমি ভাইয়ের বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ে কাঁদছে। সে মুখ ফুটে বলতে চাইছে,’ভাই যে বাচ্চার কথা তুমি বলছো তাকে তো তার বাবা-দাদী চায় না। তাকে মেরে ফেলার জন্য তারা উঠে পড়ে লেগেছে।’ কিন্তু বলতে পারলো না। ভাই তাকে নিয়ে চিন্তিত থাকুক এটা সে চায় না।
খুব কষ্টে নিজেকে সামলিয়ে ভাইকে বলে,

‘ ভাই,আবার যখন আসবে তখন যেনো তোমার নিজেরও একটা চ্যাম্প হয়,আর খুব খুশিতে সংসার করিও। কেউ থাকুক আর না থাকুক তোমরা দুজন একসাথে সুখে সংসার করবে। কথা দাও।’
সৌহার্দ বোনের কথার আগামাথা কিছুই বুঝলো না। সে প্রশ্ন করতে নিচ্ছিলো এসব কি বলছিস তুই’ কিন্তু সেটা আর করা হলো না। সুমি তাকে প্রশ্ন করতেই দিলো না। শুধু ওয়াদা নিয়ে নিলো।

পালাক্রমে রেশমির কাছে আসতেই সৌহার্দের দম আটকে গেলো। মুখ দিয়ে দুজনের কোনো কথা হলো না। চোখে চোখ রেখেই তাকিয়ে ছিলো। শত শত না বলা কথা ব্যক্ত হচ্ছিলো। রেশমির চোখে জল ছলছল করলেও তা গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে না। সে যথাসম্ভব নিজেকে সামলিয়ে রাখছে।

গাড়ির হর্ণ বাজতেই সে মুখ খুললো,বলে,
‘ভালো থেকো,সবার খেয়াল রেখো।’

রেশমি ঠোঁট কামড়ে মাথা নাড়ালো। বিয়ের সপ্তাহ না ফুরাতেই স্বামী চলে যাচ্ছে। ঠিকঠাক এক রাতের জন্য কাছে পেয়েছিলো। আর সকাল না হডেই বিদায় দিতে হচ্ছে। এ কোন দোষের শাস্তি পাচ্ছে সে। বুক দক করে ওঠছে,গলায় কান্না দলা পেকে গিয়েছে। ইচ্ছে করছে গলা ফাটিয়ে কাঁদতে। সে বুঝতে পারছে না এত কষ্ট কেনো হচ্ছে তার? সৌহার্দ তো চলে যাচ্ছে। তার কি হবে?কীভাবে থাকবে সে? সবাইকে কীভাবে সামলাবে? তার ইচ্ছা করলো, শাড়ির আঁচলে বেঁধে সৌহার্দকে আটকে রাখতে।

সবার চোখে জল। এ যেনো কান্নার অনুষ্ঠান চলছে। বহু কষ্টে সৌহার্দ নিজেকে সামালিয়ে সবাইকে বিদায় দিয়ে বের হয়ে যায়। সময় হয়ে গিয়েছে,তাকে যে যেতেই হবে।

#চলবে….
©সোনালী আহমেদ
~~তাড়াহুড়ো করে লিখেছি,জানি বেশ আগোছালো হয়েছে।ভুল ত্রুটি ক্ষমা করবেন।
…..
…..
#অসুখের_নাম_তুমি
১৪তম পর্ব
সোনালী আহমেদ

শূন্য নিরবতায় গ্রাসিত হয়েছে চারপাশ। উঁইপোকার চিঁ চিঁ আওয়াজ ব্যতীত অন্য কোনো প্রকার আওয়াজ ভেসে আসছে না। শুনশান পরিবেশের ফলে স্থান টা ভুতূড়ে অনুভূত হচ্ছে। হিমশীতল বাতাসের সাথে ছমছমে ভাব টা আরো বেড়ে গেলো। বিছানায় উল্টো হয়ে বালিশে মুখ গুঁজে বিরতিহীনভাবে কেঁদে চলছে রেশমি। সৌহার্দ চলে যাওয়ার পর যে কান্না শুরু করেছে এখনও পর্যন্ত তার কান্না চলছে। চোখ মুখ ফুলে ঢোলের মতো হয়েছে।
লোকটা কে আমার?কিছুদিন আগেও তো চিনতাম না,তাহলে তার চলে যাওয়া আমাকে এতটা কষ্ট দিচ্ছে কেনো? শুধু মাত্র স্বামী বলেই এত কষ্ট অনুভব করছি? রেশমির মনে মনে করা প্রশ্নের বিপরীত কোনো জবাব আসলো না। দীর্ঘশ্বাস ফেলে উঠে বসলো। গলা টা শুকিয়ে গিয়েছে,ভীষণ তেষ্টা পেয়েছে, এই মুহূর্তে পানি পান করা একান্ত প্রয়োজন। চোখ দিয়ে অনর্গল অশ্রু পড়া বন্ধ হলো না। গ্লাসে অর্ধেক পানি ঢেলে গটগট করে সবটুকু সম্পূর্ণ করলো সে। বিছানা টা গুছাতে যেয়ে দেখলো বালিশের একপাশে ভিজে একাকার। এত কান্নার পরেও চোখ দিয়ে পানি পড়ছে,তার চোখে এত পানি। রেশমির মুখে হালকা বিষ্ময় ভাব দেখা দিলো। বিছানার একপাশে সৌহার্দের খুলে রাখা ফুল হাতার শার্ট পড়ে আছে। রেশমি খুব যত্নে হাতে নিলো, কয়েক পলক একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে বুকের সাথে মিলিয়ে নিলো। শার্ট টাকে সৌহার্দ ভেবে বেশ শক্ত করেই খানিকক্ষণ জড়িয়ে ধরে রইলো। একটুপর তা মুখের সামনে এনে বেশ কতগুলো চুমু খেয়ে নিলো। তার কল্পনায় এটা তার স্বামী,কোনো শার্ট নয়। গালের সাথে মিলিয়ে আবারো কতক্ষণ কাঁদলো। এ লোকটাকে সে প্রচুর মিস করছে। সৌহার্দ যদি দেশে থাকতো নিশ্চিত রেশমি তাকে এত কাঁদানোর জন্য আচ্ছামতন ধোলাই দিতো।
শার্ট টাকে চোখের সামনে এনে ঠোঁটে অভিমানের রেশ ফুটিয়ে বলে,
‘ আপনি খুব পাষাণ। আমাকে এত কষ্ট দিচ্ছেন, এসবের শোধ আমি তুলবোই। নির্লজ্জ বেহায়া লোক, এত সুন্দরী বাচ্চা একটা মেয়েকে কষ্ট দিতে আপনার খারাপ লাগছে না।’
রেশমির কথার বিপরীত জবাব আসলো না। রেশমি দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। এটা তো সৌহার্দ নয় যে জবাব দিবে,এটা তো তার ব্যবহৃত পোশাক। যে নিষ্প্রাণ, নির্জীব। বেশ যত্ন করেই শার্ট টি গুছিয়ে ভাঁজ করে সন্দুকে তুলে রাখলো রেশমি। এটাকে সে ধুবে না, কারণ শার্ট টা থেকে সৌহার্দের গায়ের মিষ্টি গন্ধ ভেসে আসছে। ধুলেই তো এ গ্রাণ গায়েব হয়ে যাবে তাই সে এটা ধুবে না।
মেঝেতে পা দিতেই তার গতকাল রাতের কথা মনে পড়ে গেলো। মনে পড়লো বেশ কিছু আপত্তিকর মুহূর্তে। পরক্ষণেই লজ্জায় গাল লাল হয়ে ওঠলো। এ লোকটা খুব বদ। চলে যাওয়ার পরেও রেশমিকে লজ্জা দেওয়া ছাড়ছে না। রেশমি এরুপেই ঘরের আনাচেকানাচে দেখছে আর সৌহার্দের সাথে কাটানো মুহূর্তগুলো মনে করছে। কখনো হাসছে,কখনো লজ্জা পাচ্ছে,কখনো রাগে মুখ লাল করছে তো কখনো কান্নায় চোখ ভিজিয়ে তুলছে। এক মিশ্র অনুভূতি নিয়ে রাত পার করলো।
__________________
সূর্যের উত্তাপে ঘর গরম হয়ে আছে। প্রায় সব শীতল জিনিসগুলিও গরম হয়ে ওঠছিলো। জলজ্যান্ত মানুষগুলোও সিদ্ধ হয়ে যাচ্ছিলো। এত গরমে ঘুমানো যায়?গেলেও রেশমি ঘুমাতে পারলো না। বিছানা ছেড়ে উঠে গেলো। বাহিরে আসতেই সে ক্রন্দনের আওয়াজ পেলো। দ্রুতগতিতে পা চালিয়ে কান্নার উৎসের দিকে যেতে লাগলো। সুমির রুমে আসতেই চমকে উঠলো রেশমি। সুমির কপাল বেয়ে চুইয়ে রক্ত গড়িয়ে পড়ছে। সুমি সে স্থানে হাত দিয়ে চাপাস্বরে আর্তনাদ করছে। রেশমি প্রায় লাফিয়েই সুমির কাছে পৌঁছালো। কয়েক মুহূর্ত নিজের আঁচল ছেঁড়ার বৃথা প্রয়াস করলো। নিজের কাপড় ছিঁড়তে ব্যর্থ হতেই তৎক্ষণাৎ সুমির আঁচলের এক পাশে ছিঁড়ে ক্ষত স্থান বেঁধে দিলো। গ্লাস ভর্তি পানি এনে খাইয়ে দিলো। রক্ত বন্ধ হওয়ার নাম নিচ্ছে না। রেশমি চিন্তা আর ভয়ে অস্থির হয়ে পড়লো। সুমির হাত দিয়ে তার কপাল চাপ দিয়ে ধরিয়ে সে বাহিরে বেরিয়ে গেলো। ঘরের একটু আশেপাশে খুঁজতেই কাঙ্ক্ষিত পাতার লতা পেয়ে গেলো। জড়মূর্তি নিয়ে হাতের তালুতে পিষিয়ে নিতে সুমির ক্ষতস্থানে লাগিয়ে দিলো। কয়েক মহূর্ত পর পরেই রক্ত পড়া বন্ধ হয়ে গেলো। আশ্চর্যজনকভাবে এতগুলো সময়ের মাঝে সুমির আশেপাশে কেউই আসে নি।

‘আপু, ব্যাথা করছে?’
সুমি মাথা নাড়িয়ে না বলে। মুখ দিয়ে উত্তর দেওয়ার মতো শক্তি এবং ইচ্ছা কোনো টাই পাচ্ছে না।
‘এমন কীভাবে হলো?’

‘প্ পড়ে গ্ গিয়ে।’

‘মিথ্যা বলবা না। তোমার চোখে আমি অন্যকিছু দেখছি। আমাকে স্পষ্ট বলো,কে কি করেছে?’

‘শুধু শুধু ভুল ভাবছো। বলছি তো পড়ে গিয়ে এমন হয়েছে।’

‘ পড়ে গিয়ে থাকলে এতক্ষণে তোমার আশেপাশে কাউকে না কাউকে দেখতাম। এটা কারো সজ্ঞানে করা কাজ সেজন্যই সে ভ্যানিশ হয়ে গিয়েছে।’

সুমি প্রতিত্ত্যুর করলো না। চোখ বন্ধ করে রাখলো। কপালের পাশ টা টনটন করছে। ছুঁয়ে ঘষাতে ইচ্ছা করছে। কিন্তু তা করা যাবে না। দেখা যাবে রক্তের ফোয়ারা ছুটে নদী বানিয়ে ফেলেছে।

রেশমি বেশ নরম সুরে বললো,

‘ভাইয়া এমন করেছে না?’

সুমি চমকে ওঠলো। হকচকিয়ে চারপাশে তাকালো। সে দ্রুতগতিতে মাথা নাড়িয়ে বলে,

‘না,না। উনি কেনো এমন করবে?’

‘তাহলে কে করেছে?’

আগের ন্যায় এবারো কোনো আশানুরুপ জবাব না পেয়ে হতাশ হলো রেশমি। তবুও হাল ছাড়লো না। সুমিকে ভালো করে কথা দিয়ে চেপে ধরতেই সব বলে দিলো। সকালে ঘুম থেকে ওঠতে একটু বেলা হয়েছিলো বলেই লিনা এসে তার এ হাল করেছে। মূলত তাকে ধাক্কা দিয়ে চলে যাওয়ার সময় খাটের কার্নিশে লেগে কপালের ব্যাথাটুকু পেয়েছে। তবুও টু শব্দ করলো না সুমি। রেশমির মথায় আগুন জ্বলছে। এরা বউ শাশুড়ি কি পেয়েছে, কেউ নাত বৌকে মারছে তো কেউ ছেলের বউ মারছে। পেয়েছা টা কি,চুপ করে আছে দেখেই কি এসব করা হচ্ছে। দাঁত চেপে রাগ টুকু হজম করে নিলো রেশমি। সুমিকে নিয়ে তার রুমে শুয়ে দিলো। কিন্তু ও মেয়ে কি আর এ অবেলায় শোবার মেয়ে, বারংবার চেষ্টা করলো উঠে যাওয়ার। অবশেষে রেশমি ধমক দিয়ে দরজা আটকিয়ে চলপ গেলো।
আধা ঘন্টার মধ্যেই নাস্তা তৈরী করে ফেললো। সবাইকে নাস্তা দেওয়া হলেও লিনাকে নাস্তা দেওয়া হয় নি। লিনা তখন পাশের বাড়ীতে বউয়ের গুন গাইতে গিয়েছিলো। সবাইকে বলেছে সুমি তাকে খাবার দেয় না,তার সাথে অসদাচরণ করে। বাড়ীতে এসে যখন নাস্তা দেখতে পেলো না তখন চিৎকার দিয়ে উঠলো।

রাগে ক্ষোভে ফেটে পড়লো সুমির উপর। তীক্ষ্ণ চাহনি নিক্ষেপ করে প্রশ্ন করলো,
‘এখনও আমার নাস্তা তৈরী হয় নি। তোমার এত স্পর্ধা কই থেকে আসলো ভাবতেই অবাক লাগছে আমার।’

‘আমার থেকে। এই যে আমার থেকে। আমি রেশমি,অর্থাৎ আপনার পুত্র বধুর ভাবী থেকেই এসেছে তার এত স্পর্ধা।’

লিনা তেড়ে এসে রেশমির গলা চেপে ধরলো। আকস্মিক কান্ডে তাল হারিয়ে ফেললো রেশমি। লিনা হুট করেই যে কাজ করে ফেলবে সে ভাবতে পারে নি। অনেক টানাটানি করলো ওর হাতের সাথে তবুও সরাতে পারলো না। এদিকে ওর প্রায় দম নিঃশ্বাস আটকে আসছে।
সুমির দিকে তাকালো একপলক, সুমি বারবার তাকে ছেড়ে দেওয়ার জন্য আর্তনাদ করছে।
লিনা শুধু গলা চেপে ধরে নি সাথে বিশ্রি গালিও দিচ্ছিলো। গালি যখন রেশমির বাবা পর্যন্ত গড়ালো তখন আর সামলাতে পারলো না সে, পা দিয়ে সর্বোচ্চ শক্তি দিয়ে পাড়া দিয়ে ধরলো লিনার পা। লিনার হাত আলগা হতেই রেশমি ওই হাত মুচড়ে ঘুরিয়ে পেছনে নিয়ে গেলো।

দাঁত চিবিয়ে বলতে লাগলো,
‘আমি সুমি আপু না যে চুপচাপ সব সহ্য করবো। আমি রেশমি, আর এই রেশমি প্রতিবাদের আওয়াজ তুলা ব্যতীত অন্যকিছুই করে না। আপনি ভাববেন না, আমার সাথে যা ইচ্ছা তাই করতে পারবেন, যদি ভেবে থাকেন তাহলে আপনি পৃথিবীর সবচেয়ে বোকা প্রাণী। ফের যদি কোনোদিন আপনি আমার গায়ে হাত তুলার চেষ্টাও করেন তাহলে আপনার হাত টা আলগা করে দিবো। যাতে কোনোদিন ওই হাত দিয়ে খেতে না পারেন। মনে রাখবেন,আমি রেশমি।’

লিনা ছাড়া পেতেই হাত-পা দুটো ধরেই আর্তনাদ করতে লাগলো। লিনার আর্তনাদের আওয়াজ পেয়ে হুড়মুড় করে নেমে আসে জমিলা,নিলা, সিয়াম, সজীব ও তার বাবা।

হন্তদন্ত হয়ে সকলে কি হয়েছে বলতে লাগলো।
লিনা ফ্লোরে বসে মাথা ঠুকড়াচ্ছে। হাত ধরে চেঁচিয়ে বলে ওঠলো,
‘ মেরে ফেলেছে,মেরে ফেলেছে আমাকে।’

জমিলা লিনার অর্ধ কথা শুনতেই বলে ওঠলো,
‘হায়,হায়!সর্বনাশ। আমার বাপের জন্মেও আমি এমন মেয়ে দেখি নি, যে কিনা শাশুড়ির গায়ে হাত তুলে। এমন মেয়ে আমার ঘরে থাকবার একদন্ড ও যোগ্য নয়। ডাকো ওর মামা-মামীকে আজকেই বিদায় করবো এই মেয়েকে।’

ঘরের বাকি সদস্য নিরব ভূমিলা পালন করলো। রেশমি কোনো কথা বলে নি। সে গলার পাশে হাত বুলাচ্ছে। লিনার হাতের চুড়ির ছাপ একপাশে বসে গিয়েছে। সে অংশ টা টনটন করছে। সুমি একবার মিনমিন করে বলেছিলো যে ‘রেশমি মারে নি,শুধু নিজেকে রক্ষা করেছে।’ কিন্তু কেউ তার কথা কানে তুললো বলে মনে হয়না।

ঘরের উঠোণে বৈঠক বসেছে। গ্রামের বেশ প্রভাবশালী কয়েকজন লোক এসেছে। তাদের নিকট এক পাক্ষিক বিষয় তুলে ধরা হয়েছে, যার হিসাব মতে সম্পূর্ণরূপে রেশমি দোষী।

বেশ কয়েকজন লিনার এক পাক্ষিক কথা শুনে বললো, ‘ওকে যেনো এমন সাজা দেওয়া হয় যাতে গ্রামের দ্বিতীয় কোনো মেয়ে শশুড়-শাশুড়ির দিকে তাকিয়েও কথা বলতে না পারে। ‘
এলাকার অর্ধেকের মানুষ জানে লিনা সৌহার্দ আর সুমিকে ছোট থেকেই লালন-পালন করছে এবং তাদের দেখে রাখছে। যার ফলে সবাই রেশমিকেই খারাপ ভাবছে।

রেশমিকে একবারও কেউ প্রশ্ন করলো না যে আদৌ এসব করেছে কি না। সবার হাবভঙ্গি এমন দেখে সে নিজেই বলে ওঠলো,
‘ আপনারা তো সিদ্ধান্ত শুনানোর আগে আমার কিছু কথা শুনে নিন।তারপর না হয় সিদ্ধান্ত শুনাবেন।’

রেশমির কথাতে অর্ধেকেরও বেশি মানুষ বিপক্ষে চলে গেলো,কেউ শুনতে চাইলো না। গুটিকয়েকজন বললো তাকে তার কথা বলতে দেওয়া হোক। অবশেষে সবদিক বিবেচনা করে রেশমিকে তার বক্তব্য বলার সুযোগ দেওয়া হলো।

রেশমি এক পলক সবার দিকে তাকিয়ে শুরু থেকে শেষ অবধি সবকিছু বলতে লাগলো। তার কথা শেষ হতেই বেশ কয়েকজন অট্টহাসিতে ফেটে পড়লো। তাদের বক্তব্য এসব রেশমির বানানে গল্প।

‘এসব আমার কোনো বানানো গল্প নয়। আপনাদের বিশ্বাস না হলে সুমি আপুকে প্রশ্ন করুন। আপু,তুমিই বলো।’

সুমি হকচকিয়ে উঠলো। সবাই তার মুখপানে জবাবের আশায় তাকালো। সজীব আর লিনার মুখপানে চাইতেই তার শরীর ঠান্ডা হয়ে ওঠলো। সুমির হয়েছে শাখের করাত। কোন দিকে যাবে মাথায় আসছে না। সে আমতা আমতা করতে লাগলো। থমথমে মুখে মাথা উঁচু করে রেশমির দিকে এক পলক তাকিয়ে সঙ্গে সঙ্গে আগের ন্যায় মাথা নিচু করে ফেললো। তার জাবাবের আশায় করুন দৃষ্টিতে চেয়ে আছে রেশমি। সে কি জবাব দিবপ সবাই শুনতে চায়।

চলবে!
®সোনালী আহমেদ

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here