অলকানন্দার নির্বাসন (স্টিফেন স্পেশাল পর্ব,)

0
526

#অলকানন্দার_নির্বাসন
#মম_সাহা

স্টিফেন স্পেশাল পর্ব,

ঘোর আধাঁর মাখা প্রকৃতির এক কোণায় দাঁড়িয়ে চন্দ্র বিলাস করতে ব্যস্ত নন্দা। বিকেলেই বিদায় নিয়ে চলে গেছে শতাব্দরা। সারাদিন পর অবসর পেল সে। চাঁদের জোছনায় তার সারা অঙ্গ যেন আহ্লাদে মাখামাখি। তার ধ্যান-জ্ঞান জুড়ে একটি বেঁচে থাকতে চাওয়া জীবনের প্রতিচ্ছবি আঁকানো। মানুষ বাঁচার জন্য কত কিছুই না করে! তার জলজ্যান্ত প্রমাণ সে নিজে। আহারে জীবন! এত বেদনা, তবুও বেঁচে থাকার শখ তার কম না।

“আমি কী তোমার হাতটা একটু ধরিতে পারি, সানশাইন?”

নন্দার ধ্যান ভাঙলো, ভ্রু যুগল তার কুঁচকে এলো আপনা-আপনি। প্রায় ঠেস মেরে সে বলে উঠল,
“ব্যাপারটা ভূতের মুখে রাম নাম হয়ে গেল না?”

নন্দার তাচ্ছিল্যে হাসল স্টিফেন নিজেও। দু’কদম এগিয়ে এসে সেও হেয়ালি করে বলল,
“ব্যাপারটা কী খারাপ? ভূত যদি একটু রাম নাম গাহিতে চায় তবে মনুষ্য জাতির সমস্যা কী? ভালো তো সবাই ই হইতে চায়। সেই ভালো হওয়ার বীজটা অঙ্কুরেই বিনষ্ট করিবার সাধ্যি কেবল মানুষেরই আছে। আর একমাত্র তাই ভূতেরা চাইয়াও ভালো হইতে পারে না।”

খুব নীরবে স্টিফেন যেন নন্দার গালে সপাটে চ ড় বসিয়ে দিল। নন্দারও তাচ্ছিল্য দৃষ্টি মুহূর্তে নত হয়ে এলো। সে অন্য দিকে দৃষ্টি দিয়ে বলল,
“কী বলতে চান, বলুন?”

“আমায় কী একটু ভালোবাসিত পারো না, সানশাইন? ধরো হঠাৎ পরিচিত হওয়া পথের পথিককে যতটুকু ভালোবাসা মানুষ দিয়া থাকে ঠিক ততটুকুই। দেওয়া যায় কি-না?”

“না।”

নন্দার কঠোর কণ্ঠ, স্টিফেন তবুও নির্লিপ্ত। বুক ভরা এক দীর্ঘশ্বাস ফেলল সে হাসতে হাসতে। নন্দার থেকে সে কিছুটা দূরে দাঁড়িয়েই নিজের দু’হাত পেছনে আড়াআড়ি করে রাখলেন। দৃষ্টি রাখলেন নীরব, নিশ্চল, জ্বলজ্বল করা ঐ চাঁদের দিকে। নন্দা স্টিফনকে স্থায়ী ভাবে দাঁড়াতে দেখে যেই-না চলে আসতে নিবে ঠিক তখনই মানুষটার ফ্যাকাসে স্বর পাওয়া গেল,
“আচ্ছা, ভালোবাসিতে হইবে না আমায়, ঘৃণাতেই আমি মানিয়ে নিব। তাই বলিয়া কী একটু পাশেও দাঁড়াইয়া থাকা যায় না? আমি বোধকরি অতটাও ছোঁয়াচে নই!”

নন্দা আর যেতে পারল না। চুপ করে সেখানেই দাঁড়িয়ে পড়ল। স্টিফেন আপন মনেই কথা বলতে শুরু করল,
“জানো সানশাইন, এই যে দেশ, এই যে মাটি, তার প্রতি আমার কী ভীষণ টান! কেন বলো তো এত টান? তুমি ভাবিতেছো, হয়তো আমার জন্মটা এই জন্মভূমিতে হইয়াছে, সেইজন্য। তাই-না? কিন্তু মোটেও তা না। আমার জন্ম হইয়াছিল আমার পিতারই মাতৃভূমিতে। আর সবচেয়ে মজার বিষয় কী জানো? তুমি যাকে আমার মাতা বলিয়া জানো, তিনি কিন্তু আমার জন্মদাত্রী জননী নয়।”

নন্দা শেষ বাক্য শুনে যে আশ্চর্য রকমের বিস্মিয় হলো তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। সে হতভম্ব কণ্ঠে বলল,
“কী! তবে যে বিয়ের দিন বললেন আপনার মা এই দেশের?”

“আমি কিন্তু আমার জন্মদাত্রীর কথা বলিতেছি। আর জন্মদায়িনীই যে সবসময় মাতা হইতে হইবে তা কোথায় উল্লেখ আছে?”

“আমি আপনার কথা বুজছি না।”

স্টিফেন আবারও দীর্ঘশ্বাস ফেলল। বিবশ কণ্ঠে বলল,

“একটা গল্প শোনাই? শুনিবে?”

নন্দা হ্যাঁ অথবা না কিছুই উচ্চারণ করল না। কিন্তু তার ঠাঁই দাঁড়িয়ে থাকা এবং নীরবতার মাঝেই স্টিফেন যেন উত্তর খুঁজে পেল। তাই সে নিজেই বলা শুরু করল,
“পৃথিবীর উন্নত একটি দেশে এক অসাধারণ নারীর সাথে সাক্ষাৎ হয় একজন আর্টিস্টের। আর্টিস্ট কী জানো? আর্টিস্ট মানে হইলো চিত্রশিল্পী। সুন্দরী নারী ছিলেন মডেল। দু’জনের পরিচয়টা হইয়া ছিল অনেকটা অসাধারণ ভাবে। চিত্রশিল্পী একটি পরিত্যাক্ত সংবাদপত্রে একজন মডেলের সাদা-কালো ছবি দেখিয়াছিল যার মুখ ছিল পোশাকের ডিজাইন অনুযায়ী আবৃত। দেখা গিয়াছিল বাদামি চুল গুচ্ছ এবং ঘোলা চক্ষু যুগল এর বেশি আর কিছুই জানতে পারেনি সে। তা দেখেই যাদুকরের ন্যায় সেই আর্টিস্ট আঁকিয়া ফেলে এক নারী অবয়ব। এবং সে জায়গায় জায়গায় ঘুরে কেবল সেই নারী মূর্তিকে খুঁজে বেড়ায়। এবং অতঃপর সে দেখা পায় সেই নারীর। তার কাঙ্খিত নারীর। এবং চিত্রশিল্পীর এই অসাধারণ আগ্রহ দেখিয়া নারীটি তাকে বিবাহ করিতে রাজি হয়। এবং অবশেষে সেই সুন্দর শহরকে সাক্ষী রাখিয়াই তাহাদের একটি সংসার হয়।”

স্টিফেন থামে। । নন্দা তখন মনোযোগী শ্রোতা। সম্পূর্ণ কথা জানার জন্য সে বিচলিত। স্টিফেনকে থামতে দেখে সে কিছুটা বিরক্ত হলো বটে। বিরক্ত কণ্ঠেই বলল,
“তারপর?”

“তারপর তাহাদের ঘর আলো করিয়া একটি পুত্র সন্তানের জন্ম হয়। সন্তানের পিতার তো আনন্দের অন্ত ছিলো না কিন্তু ভিন্নতা দেখা দেয় মডেলের ভেতর। সেই অসাধারণ নারী ভাবতে থাকে সে শিকলে বাঁধা পরে যাচ্ছে। এবং তার জন্য সে ছটফট ছটফট করছিল একটু মুক্তি পাওয়ার আশায়। আর তার মুক্তি হিসেবে তার কাছে আসে তার রঙিন দুনিয়ার এক বন্ধু ম্যাভেন অ্যানে। অ্যানে ছিল খুব চতুর লোক। তিনিও একজন পুরুষ মডেল। তাহার সৌন্দর্য যেকোনো নারীকে মুগ্ধ করিতে পারিত। এবং অবশেষে, চিত্রশিল্পীর সেই নিখাঁদ ভালোবাসাকে পরিত্যাক্ত ঘোষণা করিয়া সেই নারী সৌন্দর্যকে বাছিয়া নিয়া ছিল। কিন্তু সেটা প্রকাশ্যে সে আনেনি। যেহেতু তার স্বামী খুব ধনী ছিলেন সেহেতু এমন একটা টাকার স্তূপকে তো কেহই অস্বীকার করিতে পারে না তাই না? কিন্তু সেই লেডি ভুলেও জানিতে পারেন নাই যে তার স্বামী সবটাই জানিত। ভালোবাসা সবচেয়ে বড়ো শিকল কি-না! সেই শিকল যে সবার ছাড়িয়া যাওয়ার সাধ্য নাই। ঠিক তখনই তার পুত্র যখন দুই বছরের শিশু, তাকে নিয়ে তার পিতা আরেকটি দেশে আসে। কেবল হাওয়া বদলের জন্য। কিন্তু বিভিন্ন কাজে যুক্ত হইতে হইতে তিনি আটকে পড়েন সেই দেশের ভেতরই। তার পুত্রও ধীরে ধীরে বড়ো হইতে লাগিলেন। তার স্ত্রী মাঝে মাঝে এ দেশে এসে ঘুরিয়া যাইতেন স্বামী সন্তানের কাছে। প্রকৃতপক্ষে তার মন তো পড়িয়া থাকিত তার প্রেমিকের কাছে। তার মাঝেই একটা অদ্ভুত ঘটনা ঘটে সেই চিত্রশিল্পীর সাথে। তিনি যে দেশে ঘুরতে আসিয়া ছিলেন, সে দেশে কিছু কুসংস্কার তখন গোরা শক্ত করে দেশের মাটিতে রাজত্ব করিতে ছিল। সেই কুসংস্কারের দোহাই দিয়েই সে দেশের অনেক মেয়ে বলি হইতে লাগিল। এবং সেই দৃশ্যপটেরই একদিন মুখোমুখি হন চিত্রশিল্পীটা। তার সামনেই একটা মেয়ে দেখতে কুৎসিত বলিয়া তাকে তার বাবা-মা ত্যাগ করিয়া ছিলেন। তার দূর্দশা দেখিতে না পারিয়া আর্টিস্ট মেয়েটিকে বিবাহ করিয়া সম্মান দিতে চান। এবং তা-ই করেন। অতঃপর সেই মেয়েটির কোলে পিঠে করেই লোকটার সন্তান বড়ো হইতে লাগিল। সব ঠিকই ছিল। লোকটার প্রথম স্ত্রী আসিতেন, কয়েকদিন থাকিতেন, তার স্বামীর দ্বিতীয় বধূকে বড়ো অত্যাচার করিতেন আবার নিজের দেশে ফিরিয়া যাইতেন। চিত্রশিল্পী লোকটাও কিছু বলিতেন না। ভালোবাসিতেন কি-না সেই মহিলাকে! ভালোবাসার কাছে তো সব দোষ ক্ষমার যোগ্য। কিন্তু তাহাদের পুত্র সেসব মানিতে পারিত না। তারপর জীবনে এলো ভয়াবহ দুর্যোগ। পুত্র তার মাতার অবাধ প্রেম ও প্রেমিকের কথা একদিন জানিতে পারিল। মাতা প্রেমিকের সাথে বুদ্ধি করিল তার স্বামী ও স্বামীর দ্বিতীয় স্ত্রীকে মারিয়া ফেলিবেন। তাহলে সকল সমস্যা সমাধান। তাদের পুত্র এটা মানিতে পারিলেন না। শোনা যায়, তাই নাকি ছাঁদ হইতে নিজের মাতাকে ধাক্কা দিয়া মারিয়া ফেলিয়া ছিল পুত্র। ভালোই করিয়াছিল। বিশ্বাসঘাতকদের কী বেঁচে থাকা উচিত? একদমই নয়। স্ত্রীর মৃত্যু মানিতে পারেননি সেই চিত্রশিল্পী, অতঃপর একদিন নিজেও আ ত্ম হ ত্যা করিলেন। ঐ যে সকলে বলেনা? ভালোবাসার কাছে এসে সকলকেই থামতে হয়। সে তো স্ত্রীকে সত্যিই ভালোবাসিয়া ছিল। তারপর পুত্রের স্থান হয় ঐ অবহেলিত কুৎসিত নারীটির কোলে এই বাংলায়।”

স্টিফেনের কথা থামে অথচ অলকানন্দা অবাক হয়ে দেখল তার শব্দ ফুরিয়েছে। গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠছে কি যেন! শিরশির বাতাস তার মনে ভীতি তৈরী করেছে। সে অস্ফুটস্বরে বলল,
“সেই পুত্র কে? আর সেই মানুষ গুলোই বা কে?”

“আমার মাতা ক্যারেন বেথ ছিলেন একজন মডেল। আমার পিতা ছিলেন একজন আর্টিস্ট। আর আমার কুৎসিত মায়ের নাম কাদম্বরী।”

নন্দা দু’পা পিছিয়ে যায়। ঘামে তার শরীর ভিজে একাকার। তা দেখে স্টিফেন রহস্য করে বলল,
“বিশ্বাসঘাতকতার দন্ড বিধি কেবল মৃত্যু, তাই না।”

#চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here