#অলকানন্দার_নির্বাসন
#মম_সাহা
১৯ এর বিশেষ পর্ব:
হেমন্তের আকাশে আজ বোধ করি সকল নিয়ম অমান্য করেই অবাধ্য বর্ষণ লীলা ঘটতে শুরু করলো। যেই বর্ষণের আশীর্বাদে শীতল হলো গ্রাম থেকে শহর সবটুকু অঞ্চল। তুলোর মতন ভাসা ভাসা মেঘ গুলোকে আর দেখা গেল না। পাংশুটে এক রঙ গগন বক্ষ জুড়ে নৃত্য জুড়িল। অঘোষিত নিশ্চুপতা নিয়ে অলকানন্দা দাঁড়িয়ে রইলো নিজের সদ্য জন্মানো শ্বশুরবাড়িতে। তার পাশে অ্যালেন দাঁড়ানো, অথচ যাকে সে বিয়ে করেছে- মিস্টার স্টিফেন. সে লোকটার এক চুলও দেখা নেই। সাদা শাড়িতে বৈধব্যের চিহ্ন, আর সেই চিহ্ন ঘোচাতেই হয়তো তার কপালের লাল টকটকে সিঁদুরটা নিজের শোভা বাড়িয়ে দিয়েছে। অলকানন্দাকে দরজার সামনে দাঁড় করিয়ে রাখা হলো বেশ অনেকটাক্ষণ। কার জন্য রাখা হলো, কেন রাখা হলো এর কোনো সঠিক ব্যাখ্যা নেই তার কাছে। তবুও সে ধ্বংসস্তূপে দাঁড়িয়ে থাকা ক্ষুদার্থ কাকের মতন শূন্য চোখে দাঁড়িয়ে রইলো। তার হয়তো পেটের ক্ষিধে না, মনের ক্ষিধে। একটু বাঁচতে চাওয়ার ক্ষিধে।
কিন্তু অন্দরমহলে নতুন বউ এসেছে- কথাটা ছড়িয়ে যেতেই সকল ভীড় জমা হলো। সবই কর্মচারীদের ভীড়। নানান রকমের মানুষ। অ্যালেন শীতল কণ্ঠে বলল,
“এরা আমাদের সার্ভেন্ট। আসুন, দাঁড়িয়ে আছেন কেন বাহিরে?”
অ্যালেনের প্রশ্ন যেন গুরুতর অবাক হলো অলকানন্দা। চোখ-মুখ পিটপিট করে বলল,
“আপনিই তো দাঁড় করিয়ে রেখেছেন কিছু না বলে। আচ্ছা, বরণ হবে না?”
“বরণ!”
অ্যালেন যেন আকাশ থেকে পড়ল। ‘বরণ’ কথাটা সে এই জীবনে শুনেনি বোধহয়। তার চোখ-মুখ তা-ই বুঝালো। অলকানন্দা কিঞ্চিৎ লজ্জা পেল। নতুন বউ হয়ে নিজের মুখে বরণের কথাটা বলাটা কী তার নির্লজ্জের মতন কর্মকান্ড হলো! তার কী উচিত হয়নি এটা বলা? অলকানন্দা যখন অপ্রত্যাশিত লজ্জায় মাথা নুইয়ে ফেলল তখন অ্যালেন ফ্যালফ্যাল নয়নে তাকিয়ে প্রশ্ন ছুঁড়ল,
“লজ্জা পাচ্ছেন কেন!”
অলকানন্দা বুঝল, হয়তো বরণ নামক সংস্কৃতিটার সাথে পরিচিত নয় অ্যালেন। নাহয় জেনেও আবার সে জিনিসটা জানার কৌতূহল নিয়ে কখনোই মানুষটা প্রশ্ন করত না। অলকানন্দা খুব গোপনে হতাশার শ্বাস ফেলল। সেও কেমন বোকা! এত অসম্মানের পর কেউ তাকে কেবল বাঁচানোর জন্য বিয়ে নামক চুক্তি সম্পন্ন করল আর সে কি-না বরণও ভেবে ফেলেছে! কী বিলাসিতা!
অলকানন্দা যেই না বাড়ির ভিতরে চরণ যুগল ফেলতে নিবে ঠিক তখনই কোথা থেকে যেন লাল টকটকে এক চকচকে শাড়ি পরে উপস্থিত হলো একটি মিষ্টি বউ। যার চোখের নিচে ইতিহাসে বিধ্বস্ত হওয়া কলুষিত অতীতের ন্যায় কাজল লেপ্টানো। কী গাঢ় তার অন্ধকার! মনে হচ্ছে কোনো অদৃশ্য মরিচীকা হাসছে নিরীহ নয়ন জোড়ার কাজলে। যে ইতিহাস লুকায়িত, খুব আড়ালে রাখা। মানুষটার সিঁদুর কপাল জুড়ে লেপ্টানো, চুলের খোঁপায় সতেজ বেলীমালা গাঁথা। কিন্তু অদ্ভুত ভাবে মানুষটার সকল লেপটানো সাজেও কেমন যেন মুগ্ধতা। যেন সৃষ্টিকর্তার বড়ো কোমল এবং করুণ সৃষ্টি।
অলকানন্দার দৃষ্টি যখন মুগ্ধ, ঠিক তখনই মেয়েটা ছুটে এলো, কেমন অদ্ভুত এবং তাড়াহুড়ো কণ্ঠে কর্মচারী এক মেয়েকে উদ্দেশ্য করে বলল,
“এই তোরা উলু দে, শঙ্খ ফু দে। নতুন বউ এয়েছে (এসেছে) অথচ তোরা কিচ্ছুটি করিসনি! কেমন মেয়েছেলেরে তোরা? নতুন বউকে যে বরণ করতে হয় জানিস নে? সব গুলো অকাজের। তোদের রেখেছে কেন? আজই বিদেয় করবো তোদের।”
মুগ্ধ করা মেয়েটির কন্ঠ কেমন জড়িয়ে জড়িয়ে আসছে। সে যে স্বাভাবিক নয় তা তার অদ্ভুত আচরণেই বেশ পরিলক্ষিত। অলকানন্দা বিস্মিত নয়ন জোড়া মেলে তাকিয়ে দেখছে সে মেয়েকে। এত সুন্দর মেয়ে! যেন বিধাতা বড়ো মায়া করে বানিয়েছে তাকে। অথচ মেয়েটার এমন অবস্থা কেন! তার কী মানসিক স্বাস্থ্য ভালো না?
অলকানন্দার ভাবনার মাঝেই অ্যালেন উচ্চ এবং কর্কশ স্বরে বাড়িরই এক কর্মচারীকে ডাকল,
“দেবু, এই দেবু, তুমি কোথায় আছো? ও বাহিরে কী করিতেছে?”
অ্যালেনকে সচারাচর এত কর্কশ কণ্ঠে কথা বলতে দেখা যায় না। অলকানন্দা ভারী বিস্মিত হলো। তার মাঝেই এলোমেলো সেই নারীটা দূর দূর করে তেঁড়ে এসে বলল,
“এই, তুমি কিছু বুঝো বাপু আমাদের রীতিনীতির ব্যাপারে? একটা চড় দিবো বড়ো মানুষের মুখে মুখে কথা বলো। আমি তোমার বড়ো হই না? আর নতুন বউ এলে তো বরণ করতেই হয়। জানোনা তুমি? নতুন বউ, দাঁড়া দেখিনি, তোকে একটু বরণ করি।”
অ্যালেন হয়তো আবার ধমক দিতো কিন্তু তাকে থামিয়ে দিল অলকানন্দা। দুর্বল কণ্ঠে বলল,
“আহা, করুক না একটু বরণ।”
অ্যালেন কথা বলল না। ভেতরে চলে গেল গটগট পায়ে। হয়তো দেবু নামের মানুষটাকে খুঁজতেই। সেই অস্বাভাবিক বউটা এগিয়ে এলো। অলকানন্দা মেয়েটার দিকে তাকাল, বাইশ কিংবা তেইশ বছরের একটা মেয়ে হবে। অ্যালেনের থেকে কমপক্ষে আট নয় বছরের ছোটো হবে, কিন্তু তবুও মেয়েটা নিজেকে বড়ে দাবী করল। কিন্তু কেন? কে এই মেয়ে!
অলকানন্দার ভাবনার মাঝে চারপাশে শঙ্খধ্বনি বেজে উঠলো, মেয়েটা তার কাঁপা কাঁপা হাতে কী শূন্য চোখে বরণ করল অলকানন্দাকে। অলকানন্দার ঘোর লেগে এলো। কেমন এলোমেলো দৃষ্টি মানুষটার। মেয়েটা সাজানো বরণ ডালা হাতে রেখেই আহ্লাদী স্বরে বলল,
“এই নতুন বউ, পা রাখ দেখি এই দুধের থালাটায়। দেখি রাখ পা।”
অলকানন্দা তার পায়ের সামনে পেতে রাখে দুধ আলতা মেশানো থালাটার দিকে তাকাল। কতগুলো গোলাপ পাপড়ি ভাসছে সেখানে। অলকানন্দা সেখানে পা রাখতেই আৎকে উঠে গগন কাঁপিয়ে একটি চিৎকার দিলো। তার সামনের এতক্ষণ মুগ্ধতা দান করা মেয়েটা কেমন পাষাণ হয়ে ওঠল। বরণ ডালাটা ছুঁড়ে মারল অলকানন্দার দিকে। তার প্রদীপের আগুন গিয়ে অলকানন্দার সাদা থানে লালাভ অগ্নিরূপ ধারণ করল। মুহূর্তেই সবটা গোছানো এলোমেলো হয়ে গেল। চিৎকারে ছুটে এলো অ্যালেন। ঐ অস্বাভাবিক মেয়েটাকে ভয়ঙ্কর ভাবে হাসতে দেখে অ্যালেন আরও ক্ষুব্ধ হলো। মেয়েটাকে বেশ ধাক্কা দিয়ে ব্যতিব্যস্ত কণ্ঠে বলল,
“কী করলে এটা বিহারিণী! কী করলে!”
অলকানন্দার ভীত, উত্তেজিত মন থেমে গেল। সে অদ্ভুত কন্ঠে কেবল উচ্চারণ করল, “বিহারিণী!”
#চলবে
[৮০০ শব্দ]