#অলকানন্দার_নির্বাসন
#মম_সাহা
রষ রহস্যের ৩৯:
সময়টা পৌষের প্রথম সপ্তাহ। আড়মোড়া ভেঙে শীত তখন উপস্থিত কুয়াশার চাদর জড়িয়ে। শুনশান নিরবতায় চারপাশ হতবিহ্বল। নন্দা বসে আছে মানুষ খেঁকো মাগুর মাছ অবস্থান করা তাদের খুব গোপনের কৃষ্ণচূড়ায় আচ্ছাদিত সেই বাগানে। জলের মাঝে মিহি স্রোত। ঝপাৎ ঝপাৎ শব্দে মাগুর মাছ গুলো আনন্দে লাফাচ্ছে। কিসের আনন্দ তাদের! হয়তো নতুন খাবার পাবে সে আনন্দ।
নন্দার বিপরীতেই বসে আছে বিহারিণী। তার চোখে-মুখে বরাবরের কুটিল হাসি। আজ আবার তার মুখের ভেতর পান পাতা শোভা পেয়েছে। ইদানীং সে প্রচুর পান খাচ্ছে। পান খেয়ে ওষ্ঠ লালভ করে রাখছে। হাঁটা চলায় এসেছে ভিন্নতা। পরিবর্তন গুলো খুব ধীরে ধীরে হলেও দৃষ্টি এড়ায়নি নন্দার। বিহারিণী আশপাশে তাকিয়ে শুধাল,
“এখানে নিয়ে এলে যে?”
“ভাবছি তোমার সাথে একটু সুখ-দুঃখের আলাপ করব।
আজ বিকেলটা সুখ-দুঃখের আলাপের জন্য দারুণ মানানসই।”
নন্দার কথায় বিহারিণী ভ্রু কুঞ্চিত করল। বিস্মিত কণ্ঠে বলল,
“আজকাল যার প্রতি বড্ড অনীহা জন্মেছে তাকে সুখ-দুঃখের আলাপ শোনাবে। এমন ভীমরতির কারণ কী, অলকানন্দা?”
“কী করবো বলো, ভাই! বিহারিণী মহলের ব্যাপারে তুমি যতটুকু জানো, ততটুকু কী কেউ জানে বলো? তাই তোমার সাথেই একটু আলাপ-আলোচনা করতাম।”
বিহারিণীর হাসি-হাসি মুখটা কিছুটা চুপসে এলো। কপাল কুঁচকালো নিজ গতিতে। বার কয়েক চোখের ভারী পল্লব ঝাপটে বলল,
“ঐ মহলের ব্যাপারে আর কিইবা বলবে? শুনলাম জমিদারি সব শেষ। নিলামে গিয়েছে মহল। সবাই তীর্থক্ষেত্রে গিয়েছে। এটার ব্যাপারে আর কী বলবে?”
“তোমার মায়া হচ্ছে না একটুও? আমি তো কেবল একমাস থেকেছি, তাতেই এত মায়া হচ্ছে। আর তোমার তো ভালোবাসার স্থান ছিল। এমনকি, তোমার নামে খোদাই করে বাড়িটার নাম রাখা হয়েছিল।”
নন্দার কথার প্যাচে যে খুব ভালো করে জড়িয়েছে বিহারিণী, তা আর বুঝতে বাকি রইল না তার। সে দৃষ্টি ঘুরালো। আমতা-আমতা করে বলল,
“ওরা আমাকে কষ্ট দিয়েছিল।”
“আমাকেও কম দেয়নি।”
বিহারিণীর কথা থেমে গেল। সে কূল-কিনারা হাতড়েও বোধহয় কথা খুঁজে পেল না। এবার নন্দার মুখে হাসি। হাসির ঠিকানা স্থানান্তর হয়েছে। নন্দা পুকুরের দিকে দৃষ্টিপাত করল। দীর্ঘশ্বাস ফেলে শুধাল,
“জানো? আমি নবনীলকে খুব বিশ্বাস করতাম। এতটা বিশ্বাস বোধহয় আমি এ অব্দি কাউকে করিনি। কিন্তু সে আমার বিশ্বাস ভেঙেছে। আচ্ছা, বিশ্বাসঘাতকতার শাস্তি কী হতে পারে?”
“শাস্তির কথা বলে কী লাভ? সে তো আশেপাশে কোথাও নেই।”
বিহারিণীর কথায় নন্দার হাসি প্রশস্ত হলো। উত্তর দিল,
“নেই কে বলেছে? সে আছে। আমাদের আশেপাশেই হয়তো আছে।”
নন্দার কথায় সামান্য ভড়কে গেল বিহারিণী। কণ্ঠ স্বর খাদে নামিয়ে কিছুটা মেঘমন্দ্র কণ্ঠে বলল,
“আশেপাশে মানে? কোন আশে-পাশে? কোথায় সে?”
“সে কোথায় তা পরে বলছি। আগে তার কিছু গুণগান শুনে নেও। শুনবে?”
নন্দার মুখ জুড়ে রহস্য খেলা করছে। ঘামছে বিহারিণীর স্বত্তা। সে জবাব দেয়নি। আর সে যে জবাব দিবে না এটাও নন্দার ভালো করে জানা ছিল। নন্দা জবাবের অপেক্ষাও করল না। বরং চঞ্চল স্বরে বলল,
“নবনীল প্রথম আমার জীবনে অনুপ্রেরণার গল্প হয়ে এসেছিল। মানুষটাকে আমি বিশ্বাস করতাম। যেমন করে ভক্ত বিশ্বাস করে তার ভগবানকে ঠিক তেমন করে। আমার স্বামী মা রা গেলেন, পরিস্থিতি আমার বিপরীতে। জানো? আমার খুব সাধের চুল ছিল, সেগুলোও আমাকে ফেলে দিতে হয়েছিল। তারপর আমার খুড়োশ্বশুর এবং পিসিমা কতকিছু বলেছেন। তখনও আমি এত ঘাত-প্রতিঘাতের জন্য তৈরি ছিলাম না। কিন্তু আমার পাশে দাঁড়ায় আমার শাশুড়ি, প্রসাদ ঠাকুর জামাই আর নবনীল। এবং এরপর আমি লড়াই করার আত্মবিশ্বাস পাই। বলা যায় নবনীলের সাহায্যে একে একে আমি নিজের ক্ষমতার বহিঃপ্রকাশ ঘটাতে শুরু করি। এই শক্ত হওয়ার মাঝে প্রথম বিপর্যয় ঘটে আমার জীবনে আমার বোনের তীব্র ক্ষতির মাধ্যমে। তার জিহ্বা কেটে দেওয়া হয়, সম্মানও নষ্ট করা হয়। ভাবলাম, সাহেবরা করেছেন। সাহেবদের তো নাকি ছুঁকছুঁকানি থাকে। বোনকে শহরে পাঠালাম। নিজেও গেলাম। ফিরে এসে শুনি নবনীল কোনো একটা কাজে চলে গিয়েছে। আমার তখন দিক হারা অবস্থা। তবুও শক্ত রইলাম। গ্রামের সমস্যা শক্ত হাতে মেটানোর চেষ্টা করলাম। নবনীলকে চিঠিও লিখলাম। কিন্তু ফলাফল শূন্য। এরপর একে একে ধ্বংস শুরু। অতঃপর সবশেষে চরিত্রহীন হয়ে গ্রাম ছাড়লাম। কেউ বিশ্বাস করেনি আমাকে জানো? তবুও যার মাধ্যমে সতী হবো ভেবেছিলাম তাকেও হারালাম। এই যে আমার বিপর্যয় গুলো, এগুলোর সময় একবারও নবনীল পাশে ছিল না। আমার তখন মনে হতো উনি পাশে নেই বলেই বিপদ হচ্ছে, হয়তো পাশে থাকলে হতো না। অথচ, দেখো আমি কী বোকা! আমি একবারও ভাবিনি, কেন সে যাওয়ার পরই এত সমস্যার সৃষ্টি হবে? তবে সে-ই হয়তো সমস্যার সৃষ্টিকর্তা! নবনীলের কথায় আমি ভালোবাসা দেখতাম। ভাবতাম লোকটা হয়তো ভালোবাসে আমাকে, কিন্তু……. সব ভুল, সব মিথ্যে।”
নন্দার কথা থামল৷ একটু জিরিয়ে নেওয়ার জন্য বোধহয় এই বিরতি। বিহারিণীর বিহ্বল দৃষ্টি তার দিকেই। হয়তো পরবর্তী জানার আকাঙ্খা। নন্দার বিরতি শেষ হলো, কণ্ঠে আবার প্রতিধ্বনিত হলো শব্দ,
“পরে তো সেদিন জানলেই, আমার এমন একটা খারাপ তকমার পেছনে নবনীল দায়ী। কিন্তু কেন সে এটা করেছিল, সেটা কী জানো? আর এভাবে সে উধাও হয়ে কোথাই বা গেল সেটাও তো সকলের অজানা তাই না?”
বিহারিণীর কণ্ঠ কাঁপছে, তবুও শুধাল, “হ্যাঁ।”
“কিন্তু আমি জানি। এই সবই আমার জানা, তাও বহুদিন ধরে।”
বিহারিণী যেন আর স্থির হয়ে বসতে পারল না। তড়িৎগতিতে উঠে দাঁড়াল। তোতলাতে তোতলাতে বলল,
“কী বলছ! তুমি জানো? কীভাবে জানো? মজা করছ তাই না?”
”মজা করব কেন? এখানে কী মজার কথা হচ্ছে? তুমি উঠে যাচ্ছ কেন? বসো।”
বিহারিণী বসল না। কেমন ভয়ার্ত মুখভঙ্গি তার। তার ভেতর এখান থেকে যাওয়ার তাড়া দেখা গেল। কিন্তু নন্দা নাছোড়বান্দা, হাসতে হাসতে বলল,
“এমন করছো কেন? বসো।”
বিহারিণী বসল। নন্দা আবার বলতে শুরু করল,
“জানো, আমার নবনীলকে প্রথম সন্দেহ হয় পিসিমা মা রা যাওয়ার পর। পিসিমা নাকি মা রা যাওয়ার আগের দিন আমাদের এই বাড়ির সামনে এসেছিলেন। এই খবর পেয়ে আমি ভেবেছিলাম হয়তো উনি মানে সাহেব কিছু করেছেন। তাই তার প্রতি রাগ আরও বাড়ে। প্রথমে আমার বোনকে তারপর পিসিমার মৃত্যুর জন্য তাকেই দায়ী করি আমি। কিন্তু এরপর পেলাম অন্য খোঁজ, পিসিমা আমাকে চিঠি দিয়ে গেছেন একটা ধাঁধা। তুমিই বললে তার পানের বাটায় খোঁজ করতে। করলামও…..কিন্তু…..”
নন্দা আবারও থামল পর পর ভেসে এলো দীর্ঘশ্বাস। বিহারিণী থামল। তাকে স্থির দেখা গেল। সে নিশ্চুপ চোখে চাইল। বলল,
“কিন্তু কী?”
“সেদিন খোঁজ পেলাম। চিঠিও পেলাম। কিন্তু তেমন কিছুই পেলাম না। কেবল পুরো চিঠি জুড়ে মনে হলো সকল দোষ সাহেবের। এমন একটা চিঠি পিসিমা কেন লিখবে! কিন্তু আমাকে সাহায্য করল তরঙ্গিণী। উনি জানালেন এটা পিসিমার হাতের লিখা না। পিসিমার লিখা গোছালো আর সুন্দর। আমরা দু’জন মিলেই চিঠির খোঁজ শুরু করলাম কিন্তু ফলাফল শূন্য। যখন হতাশ হয়ে ফিরবো তখন নবনীলের ঘরে আমি উঁকি দেই এবং কি মনে করে যেন সেখানে খোঁজ করি। এবং অবাক করা ব্যাপার হলো আমরা সত্যিকারের চিঠিটা পেয়ে গিয়েছিলাম। কী লিখা ছিল জানো?”
বিহারিণী থমকে গেল। হতভম্ব স্বরে বলল,
“পেয়ে গিয়েছিলে মানে? কীভাবে পেলে!”
“পাওয়ার কথা ছিল না বুঝি?”
নন্দা ভ্রু-দ্বয় কুঞ্চিত করে প্রশ্ন করল। বিহারিণী অস্থির। এখান থেকে পালিয়ে গেলে যেন বাঁচে। আর সেই সুযোগও খুঁজছিল। কিন্তু তাকে থামিয়ে দিল নন্দা। খুব আলগোছে শক্ত বাঁধনে বেঁধে ফেলে মেয়েটাকে। বিহারিণী বিস্মিত, কিংকর্তব্যবিমুঢ়। কাঁপতে কাঁপতে বলল, “বাঁধছো কেন? ছাড়ো আমাকে। ছাড়ো বলছি।”
“আজ যে কোনো ছাড়াছাড়ি হবে না। এবার শোনো, পিসিমা’র সে চিঠিতে জানতে পারলাম তোমার কথা। বিহারিণীর মতন অবয়ব সে দেখেছে এই মহলে এসে। এতেই সে ভীত হয়েছিল। এবং সে ধারণা করেছিল তার কোনো ক্ষতি হতে পারে। এবং সেটা তার সন্তানের হাতেই। মানুষটার ধারণা ঠিক। নবনীলই তাকে মেরেছে। কীভাবে মেরেছে জানো? বালিশ চাপা দিয়ে। আর এই কথা নবনীল নিজে স্বীকার করেছে। আর এই যে আমার বোনের জিহ্বা কা টা র ব্যাপারটা, সেটাও নবনীল করেছিল। কেন জানো?”
বিহারিণী জানতে চাইল না উত্তর। পরাজিত মানুষের ন্যায় বসে রইল। বেশ অনেকক্ষণ, অনেকটা ক্ষণ পর কেমন অদ্ভুত স্বরে জিজ্ঞেস করল, “নবনীলকে তুমি মেরেছ?”
#চলবে…..
#অলকানন্দার_নির্বাসন
#মম_সাহা
রষ রহস্যের বর্ধিতাংশ [৩৯]
“কীভাবে মা র লে তাকে? তোমার মায়া হয়নি? তুমি না তাকে ভালোবাসতে?”
বিহারিণীর প্রশ্নে বাঁকা হাসল নন্দা। পা নাড়াতে নাড়াতে খামখেয়ালি মেজাজে বলল,
“আমিও ভাবতাম, আমি তাকে ভালোবাসি। ওমা, এখন দেখি ভালোবাসা-বাসির এই পৃথিবীতে আমি ভালো লাগাকে ভালোবাসা বলে ভুল করেছিলাম। তাকে মা র তে মোটেও খারাপ লাগেনি। এই যে এখানটায় এনে, তার শরীরের ভেতর ধারাল ছুরি টা প্রবেশ করালাম। তারপর তোমার অস্ত্র নিরব। আমার ভালো লাগার সমাপ্তি।”
বিহারিণীর দৃষ্টি ভাষাহার। দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
“বাকিটুকুও বলে ফেলো। কীভাবে জানলে, কী করলে সবটাই শুনি। শেষবারের মতন সকল অজানা জেনে যাই। আমি ভালো করেই বুঝতে পেরেছি, আমার আয়ু ফুরিয়ে এসেছে। যাকে একসময় ভালোবেসেছ বা ভালো লেগেছে তোমার, তাকে এমন ভাবে মা রতে পারলে আমার ক্ষেত্রে যে তোমার হাতও কাঁপবে না তা বেশ বুঝতে পারছি। বাকিটা নাহয় বলে দেও। মৃত্যু ভীতি নিয়ে বেঁচে থাকাটা দুঃসহ।”
“আরে হ্যাঁ, তুমি একদম ঠিক ধরেছ। তোমার আয়ু আর বোধহয় আধঘন্টা। তো এবার বাকিটা শুনো, পিসিমার চিঠির ভেতরই ছিল তার আপন মানুষের নিষ্ঠুর বর্ণনা। নবনীল পিসিমার সন্তান ছিলেন না কখনোই। কারণ পিসিমাও বিয়ের সাথে সাথে বিধবা হয়ে ছিলেন। নবনীল ছিল পিসিমা’র শ্বশুর বাড়ির এক কর্মচারীর সন্তান। পিসিমা সদ্য স্বামী হারা হয়ে তখন দিকভ্রান্ত। তার দিক হলো এই ছেলে। পিসিমা’র ভারী স্বর্ণের বিনিময়ে সে পেল সন্তান। সন্তান নিয়ে তার জীবন সহজ ছিল না। বৈধব্যের কটুক্তি নিয়ে বেঁচে থাকা যেখানে কঠিন সেখানে আরও একটা ছোটো প্রাণের ভরসা হলো সে। ধীরে ধীরে বেড়ে উঠল সেই ছোটো ছেলেটা রাজার মতন। কখনো সে বুঝতেই পারেনি, সে অন্যকারো সন্তান। কিন্তু সত্য চাপা থাকে না। সে একদিন জেনে গেল সত্যিটা। সুদর্শনের সাথে ঝগড়া হওয়ার সময় উনিই তাকে রাগের মাথায় এটা বলে ফেলেছিল। এরপর থেকেই নবনীলের ভেতরে তীব্র রাগ দেখা যায়। পিসিমা তো মা ছিলেন, তিনি বুঝতেন ছেলের এই রাগ। তারপর বিহারিণী মহলের সকল উত্থান পতনে তারা ছিল অটল হয়ে প্রত্যক্ষদর্শী। বিহারিণী মহলের একজন হয়ে উঠে। তারপর তোমার সাথে উনার বিয়ে হলো। নবনীলও তোমাকে পছন্দ করে ফেলল। এরপর তোমাদের প্রেমানন্দ চলতে থাকল। আর একদিন সেটা ধরা পড়ে হাতে-নাতে। নবনীলের কথা তখন কেউ জানতে পারেনি বলে শাস্তিটা হয় একপাক্ষিক। নবনীলের প্রতি তোমার রাগ বাড়ে। এই সাহেবদের কাছে যখন তুমি আস তখন হয়তো তোমার অবস্থা অবনতির দিকে ছিল কিন্তু তুমি কিছু ভুলোনি। বিহারিণী মহলের প্রতিটা মানুষের ধ্বংস চেয়েছিলে এমনকি নবনীলেরও। অথচ নবনীল সেটা ধরতেই পারেনি। সে বরং নিজের ভুলের জন্য তোমার কাছে সবসময় ক্ষমা চেয়েছে। আর তুমিই তাকে বানিয়ে ফেললে অস্ত্র। বিহারিণী মহলের ব্যবসা-বাণিজ্য অনেকদিন যাবত খারাপ যাচ্ছিল কিন্তু কেউ সেটার কারণ উদঘাটন করতে পারেনি কিন্তু তুমি জানো সেটার কারণ। তুমিই নবনীলকে দিয়ে এটা করিয়েছিলে। এমনকি মনোহর ঠাকুরপো’র মতন ভালো ছেলেটাও নারীর সান্নিধ্যে এসে খারাপ হয়। স্বাভাবিক, আগুনের পাশে ঘি রাখলে সেটা গলবেই। এসব কর্মকান্ড তুমি এখানে বসেই করেছ অথচ কেউ জানেনি। আর নবনীল একসময় যে ভালোবাসা অস্বীকার করেছিল, সেই পাপের প্রায়শ্চিত্ত করতে গিয়ে হাজার খানেক পাপ করে ফেলল অথচ বুঝতেই পারল না। ভালোবাসা অন্ধ কিনা! বুঝবেই বা কীভাবে! আর তুমি……. হিংসার বশবর্তী হয়ে একটা পরিবার ধ্বংস করে দিলে। সোনার সংসার ছিল। টক, ঝাল, মিষ্টি একটা সংসার। তোমার জন্য সবটা শেষ। সব। তোমার শাস্তি কী হওয়া উচিত বলো?”
বিহারিণী চোখে-মুখে তাচ্ছিল্য হাসি। কড়া কণ্ঠে বলল,
“সেদিন আমিও মরে যেতে পারতাম, নন্দা। ওরা আমাকে মে রে জলে ভাসিয়ে দিয়েছিল। দোষ কী আমি একা করেছিলাম? প্রেম করলাম দু’জনে আর শাস্তি একজনের নামে কেন হবে বলো তো! রাগ লেগেছিল আমার খুব। কিন্তু সবটা তো পিসিমা’র জানার কথা না!”
“সবটা উনি জানাননি। তবে উনি জানিয়ে ছিল, তার ছেলের সাথে যে সে বাড়ির বউয়ের গোপন একটি পাপের সম্পর্ক ছিল সেটা সে জানত এবং সেজন্যই আমি বউ হয়ে যাওয়ার পর সে আমাকে সহ্য করতে পারল না। তার ভয় হলো, আমিও না আবার কোনো সর্বনাশ করি। পিসিমা’র চিঠি পড়েই তোমার উপর সন্দেহ গাঢ় হয়। এরপর আবার প্রসাদ ঠাকুর জামাই এবং তরঙ্গিণীকে নিয়ে বাজে কুৎসা রটে। সেটাও বিশ্বাস করলাম। কিন্তু কয়েকদিন আগে তরঙ্গিণীর সাথে দেখা হওয়ার পর আমার ভুল ভাঙে। সে জানায় তাকে নবনীল শহরে চলে যেতে বলেছিল। এবং সে যেহেতু নবনীলকে মানে তাই চলে গিয়েছিল শহর এবং প্রসাদ ঠাকুর জামাই নাকি চলে যায় তীর্থক্ষেত্রে। সে তরঙ্গিণীকে এটা বলেছিল। তার নাকি আর সংসার করার মন মানসিকতা কুলচ্ছিল না। অথচ এটাও তোমার বুদ্ধি। প্রতি পদে পদে বিহারিণী মহলের সম্মান রাস্তায় নিয়ে এসেছিলে তুমি। কেউ জানতেই পারেনি। কৃষ্ণপ্রিয়ার মতন সরল মেয়েটাও তোমার ক্রোধের অনলে জ্বলে গেল। জ্বলে গেল আমার চরিত্রের পবিত্রতা। বিহারিণী মহল মুহূর্তেই ধূলোয় মিটে গেল। যে মহলটা তোমায় ভালোবাসা দিয়েছে, তোমার নামে নিজেকে বিলীন করেছিল তার প্রতি এত হিংসে!”
“একটি কথা শুনেছ, নন্দা? নারীর ছলনার তুলনা আগুনকেও হার মানায়। নারীর ক্রোধের তেজে অগ্নির রঙও ফিঁকে হয়। নারীর ঘৃণার ভার অনেক। সে ভার বহন করার ক্ষমতা করো নেই। বিহারিণী মহলেরও না।”
“তাদের তখনকার সিদ্ধান্তটা কী এতই ভুল ছিলো? যাকে এত ভালোবাসা দিয়েছিল, বিশ্বাস করেছিল, তার বিশ্বাসঘাতকা মানা যায়? তারাও মানতে পারেনি। হয়তো তোমার শাস্তিটা বেশি হয়েছিল কিন্তু ভুল ছিল না তো সেটা। আর না অকারণের ছিল। তবে এতটা পাষাণ কীভাবে হলে! আর আমার বোন…. সে কী ভুল করেছিল বলো? তাকেও এই হিংসার দহনে শেষ করে দিলে। নবনীলের একটা পাপের শাস্তি এতকিছু ছিল, তোমার এতগুলো পাপের শাস্তি কী হবে বলো?”
“তোমাকে দমানোর জন্য এটা করা হয়েছিল কিন্তু স্টিফেনরা কীভাবে যেন বাঁচিয়ে ফেলল তাকে! আমি তোমাকেও সহ্য করতে পারিনা নন্দা। তোমার এত সুখ আমার সহ্য হয় না। তোমার স্বামীকে কবেই মে রে ফেলতাম কেবল ভালোবেসে ফেলেছিলাম…….
বিহারিণীর কথা থামার আগেই তার ঘাড় থেকে মাথাটা আলাদা হয়ে গেলো। গল গল করে বেরুতে লাগল র ক্তের স্রোত। নন্দার চোখে-মুখে তীব্র ঘৃণা। তার হাতের ধারাল ছু রিটা র ক্তে মাখামাখি। বিহারিণীর পা দু’টো ছটফট ছটফট করতে করতে থেমে গেল। চারপাশের বন্য পাখিরা ভয়ঙ্কর কিছু দেখে শোরগোল শুরু করে ছুটতে লাগল। নন্দার হুট করে কান্না পেল। ভীষণ কান্না। অন্নপূর্ণার ধ্বংসাবশেষ দেহটা ভেসে উঠল চোখের সামনে। কীভাবে একটা মেয়ে হয়ে আরেকটা মেয়ের এমন সর্বনাশ করল! কীভাবে এত গুলো মানুষের মৃত্যু লিখেছিল এ নারী! এত পাষাণ! নন্দা বার কয়েক ছু রি চালাল বিহারিণীর পেটে। শরীরটা আর নড়লো না, প্রথমবারের মতন চিৎকারও করল না। এখানেই যেন একটি ক্রোধের মৃত্যু হলো। একটি অসম্ভব রকমের ঘৃণার মৃত্যু হলো। মাগুর মাছেরা উৎসব করল। জলের রঙ বদলে হলো লাল।
_
বেলী দিয়ে সজ্জিত শয়নগৃহ। চারদিকে জ্বলজ্বল করছে দীপশিখা। লাল বেনারসি শরীরে জড়িয়ে নন্দা সেজেছে মোহমায়া। শরীরে মাখা সুগন্ধীটার চওড়া ঘ্রাণ ছড়িয়ে পড়েছে চারপাশে। তন্মধ্যেই স্টিফেন ঘরে প্রবেশ করল। নন্দার মনোমুগ্ধকর, মাতোয়ারা রূপে সে যেন হোঁচট খেল। নন্দা হাসল, কিছুটা কাছে এগিয়ে বলল,
“কেমন লাগছে?”
স্টিফেন ঘোরগ্রস্ত। তবে নন্দার এগিয়ে আসাটা ঘনিষ্ঠতার লক্ষণ যে, তা বুঝতে বাকি রইল না তার। সে এগিয়ে গেল। মুহূর্তেই নন্দাকে বাহুবন্ধনে আটকে নিয়ে বলল,
“এ কেমন রূপ তোমার, সানশাইন?”
“পছন্দ হয়েছে?”
স্টিফেন জড়িয়েই রাখল, বলল,
“তোমাকে কেমন ভয়ঙ্কর সুন্দর লাগিতেছে! তবে লাল কেন?”
“লাল ভালোবাসার প্রতীক বলে।”
স্টিফেন মনে মনে হাসল। নিজের মনকেই শুধাল,
“সেজন্যই কী তোমার হাতে র ক্তা ক্ত ছু~রি ছিল? ভালোবাসার প্রতীক এত ভয়ঙ্কর কেন, সানশাইন!”
অথচ নন্দা মনের কথা শুনতে পারে না বলে জানতেও পারল না, তার হিংস্রতার গল্প কাউকে বিস্মিত, হতভম্ব করেছে।
#চলবে