অলকানন্দার নির্বাসন পর্ব ৩১

1
603

#অলকানন্দার_নির্বাসন
#মম_সাহা

৩১.

হেমন্তের ধানে ভরা যৌবন লাভ করেছে প্রকৃতি। ঝুম বরষার মৌসুম নয় তবুও ক্ষণে ক্ষণে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে সাথে বজ্রপাত। আকাশের গম্ভীর গর্জনে কাঁপছে ধরণীর সত্তা। প্রতিমার মাথায় বিভিন্ন ব্যাথা নাশক প্রলেপ লেপা হচ্ছে। মেয়েটার জ্বরে শরীর লাল হয়ে আসছে। স্টিফেন সাহেব চিকিৎসক এনেছে। নন্দা ব্যস্ত হাতেই সেবা করছে প্রতিমার। তাকে সাহায্য করছে ললিতা। সদ্য ভোরের কোনো চিহ্ন গগন আবরণে নেই। মনে হচ্ছে যেন মধ্য রাত। প্রকৃতির কারণেই সময় বুঝা যাচ্ছে না।

স্টিফেন গম্ভীর দৃষ্টিতে চাইল, রাশভারি কণ্ঠে বলল,
“উনার মাথার ক্ষতটা কিসের? কীভাবে এটা হইয়াছে?”

“খুব সম্ভবত ভারী কিছু দিয়ে ওর শ্বশুর বাড়ির মানুষ ওর মাথার পেছনটাতে আঘাত করেছিল জ্ঞান হারানোর জন্য। সতীদাহ প্রথার বিরুদ্ধে বিভিন্ন আইন-কানুন জারি করলেও বিভিন্ন জায়গায় এখনো সেই পরিবর্তন পৌঁছাতে পারেনি। যার ফলস্বরূপ এটা এখনো প্রচলিত। কিন্তু দেখা যায় ইদানীং অধিকাংশ নারী এই প্রথা মানতে চায় না, বিশেষ করে অল্প বয়সী নারীরা যাদের বিয়ে হয়েছে বেশ কিছুদিন হয়না অথচ স্বামী মারা গিয়েছে। তাদের কাছে দেখা যায় স্বামীর প্রতি টানের চেয়ে নিজের জীবনের মায়া বড়ো হয়ে দাঁড়ায় আর তাই তারা স্বামীর সাথে একই চিতায় উঠতে চায় না। তাই বাঁচতে চাওয়ার জন্য অনেক হইচই এবং কান্নাকাটি করে তারা, যেটা তাদের শ্বশুর বাড়ির পরিবারের জন্য মঙ্গলজনক নয়। কারণ এই খবর দারোগা সাহেবদের কাছে গেলে তাদের জেল হতে পারে। তাই ইদানীং যেই নারীকে দাহ্য করবে ভাবে, তাকে আগে আফিম বা নেশা জাতীয় কিছু দিয়ে বেহুঁশ করা হয় কিংবা মাথার পেছনে আঘাত করা হয় জোরে যেন তাদের জ্ঞান হারিয়ে যায়। এটাই হয়তো হয়েছে এই প্রতিমার সাথে।”

ললিতার কথা উপস্থিত সকলে মনোযোগ সহকারে শুনল। এই তথ্য সকলের অবগত নয় যার ফলস্বরূপ সকলেই বিস্মিত হলো। স্টিফেন মুগ্ধ কণ্ঠে বলল,
“আপনি এত কিছু জানিয়াছেন কী করিয়া?”

ললিতা হাসে। আনমনেই তপ্ত এক শ্বাস ফেলে বলে,
“জানতে হয় আরকি। আমি এই সতীদাহ প্রথার বিপরীতে কাজ করতে চাচ্ছি। সুন্দর, পুষ্পের ন্যায় প্রাণ গুলো অকালে ঝরে যাবে তা আমার যে সহ্য হয় না। তাই যত পারছি সে সম্পর্কে জানার চেষ্টা করছি।”

“ইন্টারেস্টিং! তবে এসব কুসংস্কার তো নারীদের জন্য ক্ষতিকারক। সানশাইনও স্বীকার হইয়াছে। আমি জানিনা কেন ধর্ম এসব করিতে বলিয়াছে।”

“ধর্ম কখনো এসব করতে বলেনি। বেদ, পুরাণ, গীতা, উপনিষদ ইত্যাদির কোথাও এমন কোনো ধর্মীয় বিধির বিধান দেওয়া নেই। এটার সৃষ্টি হয়েছে ভ্রান্ত ধারণা থেকে। একবার পার্বতী দেবীর বাবা ভরা আসনে পার্বতী দেবীর স্বামী শিবকে অপমানিত করেছিলেন যা মানতে পারেনি সতী স্ত্রী। তাই তিনি সেই অপমান সহ্য করতে না পেরে নিজেই আগুনে নিজেকে আহুতি দেন যেটার নামকরণ সতীদাহ রাখা হয়। এবং পরিবর্তিতে কিছু নারী স্বামীর গত হওয়ার শোক সামলাতে না পেরে স্বামীর সাথে নিজেকে আহুতি দিতেন। এবং সেই দাহ্যকে পবিত্রতা ধরা হতো। মানা হতো স্বামীর সাথে তার বিধবা স্ত্রীকে দাহ্য করা হলে সেই পরিবার স্বর্গবাসী হবে। আর তাছাড়া শ্বশুরবাড়ির লোক বিধবা পুত্রবধূকে বোঝার ন্যায় মনে করেন যার ফলস্বরূপ তারা এই প্রথাকে অবশেষে নিয়ম বলে প্রচলন করা শুরু করেন।”

পুরো ঘর নিস্তব্ধতায় ছেয়ে গেছে। মন্ত্রমুগ্ধের মতো সকলে ললিতার কথা শুনছে। শতাব্দ প্রশংসা করে বলল,
“তুই তো অনেককিছু জানিস! কাহিনী কী? কীভাবেই বা জানলি এতকিছু?”

ললিতার ঠোঁটের কোণে খামখেয়ালির হাসি। কথাটা কেমন ঝেরে ফেলার ভঙ্গিতে বলল,
“আগ্রহ থেকেই জেনেছি। সেসব বাদ দিয়ে এবার প্রতিমার দিকে নজর দে। মেয়েটাকে সুস্থ করতে হবে।”

বাহিরে ঝড় তখন ধ্বংসাত্মক রূপ লাভ করেছে, ঘন ঘন বিদ্যুৎ চমকানোর আভা ছুঁয়ে দিচ্ছে ঘরের চারপাশটা। নন্দার হুট করে বিহারিণীর কথা মনে পড়ল। মানুষটা তো ছাঁদে একা আছে, এই ঝড়ে একা থাকতে পারবে আদৌও! নন্দা আগ-পিছ না ভেবেই দ্রুত ছুটে গেল ছাঁদের উদ্দেশ্যে। তার পিছু পিছু ললিতা যেতে নিলে তাকে থামিয়ে দিল স্টিফেন। মুচকি হেসে বলল,
“আমি যাইতেছি, আপনি এই ঝড়ে ভিজিয়া যাইবেন। সানশাইনের জন্য তার স্টিফেন আছে।”

প্রকৃতিতে তখন ভরা বর্ষা, চমকাচ্ছে বিদ্যুৎ। বড় বড় তালগাছগুলো আকাশ ছুঁয়ে যেন ওলট-পালট করে রেখেছে চারপাশ। কমলা এবং কালো মেশেলে এক ধরনের রং পুরো আকাশ জুড়ে খেলা করছে। দূর হতে ভেসে আসছে পশুপাখির হাহাকার, কাঁদছে মানুষ নিজের সবটুকু অসহায়ত্ব দিয়ে। প্রকৃতির এই অশান্ত রূপে স্তম্বিত অলকানন্দা। ছাদের রুক্ষ মেঝেতে পা রাখতেই সে থমকে গেল। এ কেমন অপরিচিত আকাশ এ কেমন অপরিচিত চারপাশ! নন্দা চেনেনা এই অশান্ত প্রকৃতি আবহাওয়া। মুহূর্তে বৃষ্টির জল ছুঁয়ে দিল তার লতার মতন অঙ্গখানি। ভিজে গায়ের সাথে লেপটে গেলো মূল্যবান সেই মসলিন শাড়ি। জড়োয়া গহনা তখন বিদ্যুতের সাথে তাল মিলিয়ে এক নতুন আলোর সৃষ্টি করছে। নন্দা আনমনে চারপাশ ফিরে তাকালো। ছাদের শেষ কিনারার ঘরটা ফাঁকা। কেউ নেই সেই ঘরের আশেপাশে। মুহূর্তে চমকে গেল নন্দা। জল জ্যান্ত মানুষটা গেল কোথায়? মরিয়া হয়ে উঠল তার বক্ষ পিঞ্জিরার প্রাণ পাখিটা। আজ ছাদের কিনার থেকে রবীন্দ্র সংগীত ভেসে আসছে না। ভেসে আসছে না কারো আকুতি মাখা গানের কন্ঠ। কোথায় হারিয়ে গেল সেই কন্ঠের অধিকারিণী! নন্দার চিত্ত বিচলিত, ঘনঘটা আঁধার হাতরে সে চিৎকার করে ডাকল,
“বকুল ফুল তুমি কোথায়? বকুল ফুল তুমি কি শুনতে পাচ্ছ?”

প্রতিত্তোরে কোনো শব্দ ভেসে এলো না বরং আকাশের অনবরত গভীর ডাকের সাথে সেই শব্দটা মিশে আরো ভয়ঙ্কর পরিবেশ সৃষ্টি করল। সামনে ভেসে উঠলো বিহারীণির সাথে কাটানো ছোট ছোট মুহূর্ত। যে মুহূর্তগুলো স্মৃতিতে ভেসে উঠলে খিলখিল হাসিতে ভোরে উঠে চারপাশ। তন্মধ্যেই কারো হাতের স্পর্শ বাহুতে অনুভব করতেই ভয়ে ছিটকে উঠলো সে। অস্ফুটস্বরে শুধাল,
“কে! কে!”

আকাশ থেকে তখন বিদ্যুতের রুপোলি আলোয় ঝলমল করে উঠলো স্টিফেনের সিক্ত মুখোবয়ব। মায়া মায়া নীল আঁখিদুটিতে অপারগ মুগ্ধতা। ঠোঁটে লেপটানো মিষ্টি হাসি। ছোটো কণ্ঠে শুধাল,
“বকুল ফুল বুঝি তোমার বড়ো প্রিয়?”

নন্দার ভীত মস্তিষ্ক স্থির হলো। চোখ ঘুরিয়ে আশেপাশে চাইল। স্টিফেনের থেকে নজর ঘোরানোর মিছে প্রচেষ্টা আর কি। ওই মায়াময় নজর গুলো যে তাকে চরম সর্বনাশের আভাস দেয়। নন্দাকে চুপ থাকতে দেখে স্টিফেন আবার জিজ্ঞেস করল,
“বকুল তোমার প্রিয়?”

নন্দা দায়সারা উত্তর দিল, “হ্যাঁ “।

“পৃথিবীতে সবাই তোমার প্রিয় একমাত্র আমি ছাড়া। আমার এমন শাস্তির কারণ কি? আমি কি জানিতে পারি? তোমাকে ভালোবাসার অপরাধেই কি আমার এই শাস্তি? তবে তাও খুশি, তোমাকে ভালোবাসা যদি অপরাধ হয় তবে আমি সেই অপরাধের শাস্তি চিরজীবন মাথা পাতিয়া নিতে রাজি।”

নন্দার ভীষণ মায়া হল স্টিফেনের জন্য। লোকটা কেন এত ভালোবাসার কাঙালি! বারবার তাড়িয়ে দেওয়ার পরও কেন ভালোবাসার আবদারের ঝুলি নিয়ে হাজির হয় নন্দার দোরে! মনে হয় কত দিনের ভালবাসার তৃষ্ণায় তৃষ্ণার্ত সে। নন্দা চেয়েও সে তৃষ্ণা মেটাতে পারে না কোন সে দায়ে! কিসের এত বাধা নিষেধ? কিসের এমন বিরাট দেয়াল! যে দেয়াল ভেদ করে ভালোবাসা পৌঁছাতে পারেনা স্টিফেনের হৃদয় আঙিনা অব্দি। নন্দার জানা নেই সেই উত্তর তবুও মন চায় কিছুটা ভালোবাসা উজার করতে এই মানুষটার নামে।

নন্দা কে চুপ থাকতে দেখে স্টিফেন বলল,
“চিন্তা নেই সানশাইন, আপনার বকুল ফুল সুরক্ষিত আছে। সে তার স্নিগ্ধতায় জড়াইয়া আছে। আপনার প্রিয় কিছুকে কখনোই আমি মূর্ছা যাইতে দিবোনা। তাইতো…… ”

নন্দা আড় চোখে চাইল। স্টিফেনের কণ্ঠ অনুসরণ করে প্রশ্ন করল,
“তাইতো কী?”

স্টিফের রহস্যময় হাসলো। গগণ সীমানায় চোখ রেখে ঠাট্টা করে বলল,
“তাইতো তোমার প্রিয় পুরুষ এখনও বাঁচিয়া আছে। নাহয় কবেই সে এই পৃথিবীর বক্ষে হারাইয়া যাইত!”

“আমার প্রিয় পুরুষ! কে সে?”

নন্দার বিস্মিত কণ্ঠস্বরের প্রশ্নে স্টিফেনের বিস্তৃত মাখা হাসির প্রশস্ততা কমলো। তপ্ত শ্বাস ফেলে বলল,
“অবুঝ সাজিতেছ সানশাইন! মানুষ সব ভুলিতে পারে কিন্তু প্রেম…. তা কখনো ভুলিয়া যাইত পারেনা। তবে হ্যাঁ, তুমি যদি আমাকে খুশি করিবার জন্য ভুলিয়া যাওয়ার অভিনয় করিয়া থাক তবে আমি ধন্য। অন্তত তোমার কণ্ঠ হইতে বের হওয়া অন্য পুরুষের নাম আমার সহ্য হইবে না। এত ভাবনার মাঝে, আমার পছন্দ নিয়া ভাবিয়াছ বলিয়া আমি ধন্য বোধ করিতেছি। চলো যাওয়া যাক।”

কথাটা বলেই স্টিফেন আর এক মুহূর্ত দাঁড়ালো না। দ্রুত পায়ে নিচে নেমে গেল। যেন তার প্রগাঢ় অভিমান সে নন্দাকে দেখাতে চায় না। অবশ্য যে অভিমানের মূল্য দেয় না তাকে অভিমান দেখানোটা বোকামি। তখন কষ্ট বাড়ে, দুঃখ বাড়ে। প্রিয় মানুষটার প্রিয় না হওয়াটা যে পৃথিবীর সর্ব কষ্টের মাঝে অন্যতম কষ্ট। আর যাইহোক, এই কষ্ট বুকে নিয়ে ভালো থাকা যায় না। আর স্টিফেন বরাবরই বুদ্ধিমান, সে ভালো থাকতে জানে। হোক সেটা বাস্তবে কিংবা কল্পনা।

_

একটি নতুন দিন গান শোনালো ব্যথার, যন্ত্রণার, দুঃখের ও হাহাকারের। কৃষক জমিতে ফসলের পরিমাণ ডুবিয়ে দিয়েছে অনাকাঙ্ক্ষিত জল। কয়েকদিনের অতিরিক্ত বর্ষায় ভেসে গেছে সোনার ফসল গুলো। ঘরে ঘরে আনন্দ উৎসব এখন পরিণত হয়েছে তুমুল দুঃখে। সোনার ফসল ঘরে তোলার আগেই সৌভাগ্য নিয়েছে বিদায়। হাহাকারে হাহাকারে ভারী হয়েছে প্রকৃতি। একটা ভীত মস্তিষ্ক বারবার কৃষকদের জানান দিচ্ছে তাদের জীবন আরও দুর্বিষহ হওয়ার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। ইংরেজদের করের বোঝা শোধ করবে তারা কোন উপায়ে! শখের ধান তাদের সকল শোধের হিসাব নিয়ে বিদায় নিয়েছে। তাদের জীবন আরো ভয়াবহ কিছুর দিকে এগিয়ে যাচ্ছে।

নন্দা আজ খুব সকালে ঘুম থেকে উঠে পড়েছে। বিহারিণী মহল থেকে তার পরিচিত একজন দাসী এসেছে তার জন্য একটি জরুরী খবর নিয়ে। নন্দা ঘুম ঘুম চোখে সেই দাসীর খবর পেতেই ছুটে গেল। আকাশ তখনো ঘন কালো মেঘে ঢেকে আছে, ক্ষণে ক্ষণে চমকাচ্ছে বিদ্যুৎ, পুরো গগন বক্ষে নৃত্য করছে গম্ভীর ডাক যা মানুষের সত্তা কাঁপিয়ে দিচ্ছে। নন্দা ভ্রু যুগল কুঞ্চিত করল, পরিচিত দাসীকে দেখে শুধালো,
“এখানে কি কাজ? কে পাঠিয়েছে তোমাকে?”

চির পরিচিত দাসী মালতি কিছুটা এধার ওধার চাইল। মনের মাঝে কেমন তার বোধহয় খুত খুত ভাব। কিছু একটা গোপন করার তীব্র প্রচেষ্টা। তার অঙ্গভঙ্গিতে কিছু গোপন করার চেষ্টা বেশ ভালোভাবেই প্রতিফলিত হয়েছে। নন্দা চোখগুলো ছোট ছোট করে চাইল। সন্দিহান কণ্ঠে বলল,
“আড়ালে কিছু বলতে চাও?”

নন্দার এহন প্রশ্নের অপেক্ষাতেই যেন ছিল মহিলা। তৎক্ষণাৎ মাথা নড়িয়ে বলল,
“হ্যাঁ, হ্যাঁ, গোপন কথা আছে। আড়ালে চলুন। আপনার বাড়ির কিছু বিশ্বাসঘাতক গোপন কথা প্রচার করে দিবে।”

“আমার বাড়িতে বিশ্বাসঘাতক! কে সে? নামটা বল একবার।”

মালতি ভীতু দৃষ্টিতে আশেপাশে তাকাল ভীতু ভীতু কণ্ঠে বলল,
“এখন এত কিছুর সময় না। আপনি জানেন বিহারিনী মহলের অবস্থা কি?”

মালতির কন্ঠ স্বরে নন্দার কৌতুহল সৃষ্টি হলো। বিস্মিত কন্ঠে বললো,
“কী অবস্থা?”

“আপনাদের বাড়ির তরঙ্গিনী পালিয়েছে। এবং কার সাথে পালিয়েছে জানেন? আপনার ননদিনী মনময়ূরীর স্বামী প্রসাদের সাথে। ওরা দুজন গত পরশু রাতে কোথায় যেন চলে গিয়েছে। মনময়ূরী পুরো ভেঙে পড়েছে। তাকে সামলানো যাচ্ছে না। বাড়ির মাঝে কান্নাকাটির রোল। আপনি আসার সাথে সাথে নাকি লক্ষী বিদায় নিয়েছে সে বাড়ি থেকে– সকলের মুখোমুখি এই কথা। আপনার শাশুড়ি সুরবালা দেবী ভেঙে পড়েছেন অনেকটা। আপনাকে ভুল বোঝার দায়ে নাকি তার কপাল পুড়েছে। এই অনুশোচনায় মানুষটা দিন দিন কেমন যেন প্রাণহীন হয়ে যাচ্ছে।”

অলকানন্দা কিছুটা হতভম্ব হয়ে গেল। প্রসাদ নামের যেই লোকটাকে সে এত শ্রদ্ধা করতো সে কিনা অবশেষে এমন রূপ বদলালো! আর যাই হোক মনময়ূরীর স্ত্রী হিসেবে স্বামীভক্তি সব সময়ই ছিল। এমন একটা মেয়েকে ঠকানো মোটেও উচিত হয়নি। মেয়েটা যে স্বামীকে বড্ড ভালোবাসতো। তাইতো তার স্বামী বুঝি নন্দার প্রতি দুর্বল হয়ে গিয়েছে ভেবে নন্দাকে কতই না ছোট বড় কথা বলেছিল!

নন্দার খারাপ লাগল। চোখের উপর ভেসে উঠলো সেই সাজানো গোছানো বাড়িটি। যার দেয়ালের কোল ঘেঁষে নন্দা বুনে ছিল সুখে থাকার স্বপ্ন। যা আজ গাংচিল হয়ে উড়ে গেছে বহুদূর। শকুনের এক ধ্বংসাত্মক থাবা ছিঁড়ে ফেলেছে সেই রঙিন স্বপ্ন। ছোট্ট নন্দার ভালো থাকার সেই স্বপ্ন আজ শুয়ে আছে পরিত্যাক্ত কোনো ইচ্ছে দাফনের কবরে। নন্দার বুক চিরে হতাশার শ্বাস বেরিয়ে এলো যৌথ এই সোনার সংসারের দুর্দশা তার কাছে বড় যন্ত্রণা ঠেকলো। যতই হোক এক সময় সে ওই সংসারে আপন হয়ে ছিল।

ভাবনার জগত থেকে বেরিয়ে নন্দা হতাশার শ্বাস ফেলল। ক্ষীণ স্বরে উত্তর দিল,
“আমি যাব ওই বাড়িতে, তুমি এখন যাও।”

মালতি চলে যেতেই নন্দা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলল। বুকটা তার ভীষণ ভারী লাগছে। চোখের সামনে সুরবালা দেবীর আদরের সেই মায়াময় চেহারা ভেসে উঠলো। মানুষটা একদিন তাকে মায়ের স্নেহ দিয়েছিল। এই মানুষটার বিপদে না দাঁড়ালে যে বড় স্বার্থপর লাগবে নিজেকে।

ভাবনাটুকু ভেবে যেইনা নন্দা অলস ভঙ্গিতে পিছনে ঘুরল তৎক্ষণাৎ বিহারিণীর হাস্যজ্জ্বল চেহারাটা দৃষ্টিগোচর হল তার। মেয়েটার মুখে লেপ্টে আছে কি সুন্দর হাসি! তবে এই হাসির ধরন ভিন্ন। যেন কাউকে অবলীলায় তাচ্ছিল্য জানাচ্ছে। নন্দার চোখে চোখ পড়তেই বিহারিণী হাসতে হাসতে বলল,
“এমনটা তো হওয়ারই কথা ছিল। পাপ যে নিজের বাপকেও ছাড়ে না।”

“তুমি কি বলতে চাচ্ছো?”

নন্দার প্রশ্নে কোন ভাবাবেগ হলো না বিহারিণীর। বরং সে ফিসফিস করে বলল,
” কোথাও পড়েছিলাম– ‘আমার প্রিয় কৌটায় সোনালী আস্তরণে রয়েছে কত গীতিকাব্য বন্দী।’ তা এই ধাঁধার কোন উত্তর পেলে?”

নন্দা ডান-বামে মাথা নাড়াল। স্মিত কণ্ঠে বলল,
“নাহ্।”

“তোমার পিসি শাশুড়ি তো অনেক পান খেতে ভালোবাসতেন। তার কৌটার রং কি বলতো?”

বিহারিণীর খেয়ালী কথায় নন্দা চমকে উঠলো। হুট করেই তার আবছা স্মৃতির আস্তরণে ভেসে উঠলো পিতলের কারুকার্য শোভিত পানের কৌটা খানি। যা লক্ষ্মী দেবীর বড় পছন্দের ছিল। বিহারিণী কি এটাই বুঝাইতে চাইলো!

ততক্ষণের বিহারিণী তার মেঘের মতন অঙ্গখানি দুলাতে দুলাতে প্রস্থান নিয়েছে। নন্দাকে আর প্রশ্ন করার সুযোগও দেয়নি।

#চলবে

1 COMMENT

  1. অনেক ধন্যবাদ গল্পঃ টা দেওয়ার জন্য পরবর্তী পার্ট তারাতারি দেবেন।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here