অলকানন্দার নির্বাসন পর্ব ১৯

0
634

#অলকানন্দার_নির্বাসন
#মম_সাহা

১৯.

হেমন্তের আকাশে মেঘেদের রঙ বদল ঘটেছে। সাদা তুলোর মতন কোমল, নরম মেঘগুলো কালো, ঝাপসা, ধোঁয়াশা রূপ ধারণ করেছে। প্রকৃতিতে বাজছে ঝড়ের আগমনী ঢাক। হা হুতাশ শুরু করে দিয়েছে পশু পাখি। একটা এলোমেলো ভাব যেন! অলকানন্দার বিমূঢ় নয়ন। প্রাণ নেই তার সেই নয়ন যুগলে। সে মানতে পারছে না কৃষ্ণপ্রিয়ার বিদায়। যেই গঙ্গায় ডুব দিয়ে নিজের সকল কলঙ্ক মুছে ফেলতে পারতো হঠাৎ করে শুনলো সেই গঙ্গা ই নাকি পানিশূন্য হয়ে পড়েছে। কে মুছাবে তবে তার কলঙ্ক? কে ঘুচাবে অপবিত্রতা? শেষ মুহূর্তে সে কী বাঁচতে চেয়েও বাঁচতে পারলো না! অলকানন্দার মাথা ঘুরে এলো। তার শরীর যেন আর সহায় দেয় না। মনে হয়, মরে গেলেই যেন সকল দুঃখের সমাপ্তি হবে। এত এলোমেলো জীবন, এত কালি মাখানো কলঙ্ক নিয়ে বেঁচে থাকাও যে দায় হয়ে যাবে!

অ্যালেন হয়তো বুঝে বঙ্গ নারীর সম্মান হারানোর যন্ত্রণার আকুলতা। সে ভরসা দিয়ে বলে,
“ডোন্ট ওরি। আমরা আছি।”

অলকানন্দা ভরসা পায় না। কৃষ্ণপ্রিয়ার আকস্মিক বিদায় ভাবায় তার চিত্ত। নিজে তো সতী হয়েই মারা গেল তবে সকল কলঙ্কের ভাগীদার কেন তাকে করে গেল? এতটা আক্রোশ তো মেয়েটার কখনো ছিল না। তবে এ কেমন নিষ্ঠুরতা! অলকানন্দার শ্বাস প্রশ্বাস অস্বাভাবিক হয়। তার এক মুহূর্তের জন্য মনে হয়, এই বেঁচে থাকায় কোনো মহত্ত্ব নেই কেবল ধিক্কার ছাড়া। স্টিফেন জোর গলায় তখন শব্দ তুলে,
“অলকানন্দা আমাদের সাথে যাবে।”

গ্রামবাসীর মনে একটা নিবিড় আক্রোশ থেকে থেকে যেন কঠোরতার হাঁক পারে। এমন করে তারা হেরে যেতে পারেনা। তাদের এক পাক্ষিক যুদ্ধে তারা যেন জয় দেখতে চায়। তাই জীবন-মরণ সংশয় নিয়েও তারা প্রশ্ন তুলে,
“কী পরিচয়ে ও যাবে আপনাদের কাছে? রক্ষিতা?”

স্টিফেন ক্ষুব্ধ হয়। আরও কঠোর হয় তার বিচার প্রকৃতি। জনসম্মুখে এই ধিক্কার ছুড়ে মারা লোক গুলোর জিহ্বা কাটতে নেয় কিন্তু থামিয়ে দেয় অলকানন্দা। সেই নিভু নিভু কণ্ঠেই আবদার করে,
“ওরা সহজ সরল মানুষ, সাহেব, ওদের ছেড়ে দেন।”

স্টিফেন ভীষণ তাচ্ছিল্যে হাসে। কিন্তু শুনে না কারো বারণ। জনসম্মুখে নির্দয়ের ন্যায় কেটে ফেলে লোক গুলোর জিহ্বা। ওরা কী ভীষণ যন্ত্রণায় হাহাকার করে ওঠে। কাঁপে গ্রামবাসীর বুক। এমন নিষ্ঠুরতা দেখে তাদের দমও বন্ধ হয়ে আসে। অলকানন্দার ভীতু ভীতু নজর বন্ধ হয়ে আসে। কাঁপতে থাকে তার চিকন, সরু ঠোঁট গুলো। স্টিফেন সেদিকে তাকিয়ে গাম্ভীর্য নিয়ে বলে,
“আপনার প্রজারা হৃদয়হীন। এমন প্রজাদের জন্য মহৎ হওয়া অন্যায়। ভালো মানুষ হওয়া ভালো কিন্তু অতিরিক্ত ভালোমানুষি ভালো নয়।”

অলকানন্দা গাছের সাথে নিবিড় ভাবে হেলান দিয়ে থাকে। কতক্ষণ সবটা একদম চুপচাপ থাকে। গ্রামবাসীর বুক কাঁপে। সাহেবদের সাথে যে তারা কোনো জোরই খাঁটাতে পারবে না সেটা তাদের ভালোই জানা। তারা আর চেষ্টাও করেনা কোনো শব্দ বলার। কিন্তু স্থানও ত্যাগ করেনা। তাদের একরোখা স্বভাব দেখেই বুঝা যাচ্ছে তারা এর শেষটা দেখতে চায়। অলকানন্দাও কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে বলে,
“সাহেব, মানীর অপমানের চেয়ে মৃত্যু উত্তম। আমার দেহে যা কলঙ্ক লেগেছে তা আর বাড়াতে চাইনা। এত অসম্মান নিয়ে যে বেঁচে থাকা দায়!”

অলকানন্দার এহেন সময়ে এমন ভাব উদয় দেখে অ্যালেন কিছুটা বিরক্ত হলো, বিরক্ত কণ্ঠে বলল,
“আপনি কী বাঁচিতে চান না?”

“চাই, তবে সম্মানের সাথে। যাদের একসময় এত ভালোবাসেছি, যাদের কাছ থেকে এত ভালোবাসা পেয়েছি, তাদের চোখেই ঘৃণিত হয়ে বেঁচে থাকাটা অনেক কষ্টের সাহেব।”

“আপনি তাদের কাছ থেকে সত্যিই ভালোবাসা পেয়ে ছিলেন?”

স্টিফেনের রাশভারী কণ্ঠের প্রশ্নের উত্তর দিতে পারেনা অলকানন্দা। হতাশার শ্বাস বেড়িয়ে আসে তার বুক চিরে। সে নিজে নিজেই প্রশ্ন তুলে, সত্যিই কী ভালোবেসেছিল তারা!

যখন একটা সঠিক পদক্ষেপের আশায় সকলেই দিকভ্রষ্ট, ঠিক তখন অ্যালেন স্টিফেনকে গোপনে ডাকে। তাদের মাঝে যেন কী নিয়ে কথা কাটাকাটি হয়। অলকানন্দা সেদিকে না তাকিয়েই আশেপাশে খুঁজতে থাকে নিজের বাবাকে। বাবা এতক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকলেও এখন তাকে দেখা যাচ্ছে না। কেন দেখা যাচ্ছে না? তবে কী বাবা কন্যার মৃত্যু দেখার সাহস করতে পারলেও বেঁচে থাকাটা দেখার সাহস করতে পারেনি? বাবা নামক শব্দটা আজ এত কলুষিত কেন! অলকানন্দার বুক ভার করে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে। শরীরে ভোঁতা যন্ত্রণা হয়। কী অসহ্যকর সে যন্ত্রণা! অলকানন্দা মৃদু স্বরে ব্যাথায় শব্দ করে। মাথা থেকে পায়ের নখ অব্দি তার ব্যাথা। এত মার সে কখনোই খায়নি। এত আঘাত সে কখনো অনুভব করেনি। মনে মনে সে তেজস্বিনী রূপ ধারণ করে, একটা নিবিড় রাগে সে বিড়বিড় করে। আজ বেঁচে ফিরতে পারলে তার সবটুকু ভালো থাকা যারা কেড়েছে তাদের বেঁচে থাকাটা সে মুশকিল করে দিবে। এই পৃথিবী ভালোর মূল্য দিতে জানেনা।

অ্যালেন আর স্টিফেন বেশ অনেকক্ষণ কি নিয়ে কথা কাটাকাটি করে অবশেষে আবার সকলের মাঝে উপস্থিত হলো। সকলে বেশ আগ্রহ নিয়েই তাদের দিকে তাকিয়ে রইলো। নিশ্চয় কিছু একটা ফলাফল এখন ঘোষণা করা হবে। যেটা নির্ধারণ করবে অলকানন্দার ভাগ্যের চাঁকা। আর ঠিক তাই হলো। সকলের টান টান অপেক্ষাকে বিশ্রাম দিয়ে অ্যালেন উচ্চারণ করল শব্দযুগল,

“আপনারা উনাকে আমাদের সাথে নিয়ে যাইতে দিবেন না কারণ আমরা উনাকে নিয়া গেলে উনার পরিচয় রক্ষিতা হইবে তাই তো? তবে আমরা একটা সিদ্ধান্ত নিয়াছি, স্টিফেনের সাথে আজই উনার বিবাহ কার্য সম্পাদন করিব। আর তারপরই তাকে আমরা আমাদের বাড়িতে নিয়া যাইব। এতে আপত্তি নেই, আই হোপ?”

এমন একটা সিদ্ধান্তের জন্য কেউই বোধহয় প্রস্তুত ছিল না। সকলের চোখে মুখে বিস্মিত ভাব দেখা দিল। স্বয়ং অলকানন্দাও যেন আকাশ থেকে পড়েছে। অ্যালেনের চোখ-মুখ কোমল থাকলেও স্টিফেন বরাবরের ন্যায় কঠোর হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। চোখ-মুখে তার কিসের এক দাম্ভিকতা! গ্রামবাসীর মাঝেই খুব প্রবীণ একজক কিছুটা সাহস করেই বলল,
“অলকানন্দা তো বেধবা, তার উপর আপনারা ভিন্ন ধর্মের, জাতের। এ কী বিচার আপনাদের!”

সকলেই বৃদ্ধার প্রশ্নে মাথা নাড়ল। সত্যিই তো, বেধবা মেয়েদের তো বিয়ে হয়না। তার উপর আবার ভিন্ন জাত! এ কী অনাসৃষ্টি কাণ্ডকারখানা!

অ্যালেন দুই পকেটে তার দু’হাত গুঁজল। অলকানন্দার দিকে তাকিয়ে মাথা নাড়াতে নাড়াতে বলল,
“হেই বিউটিফুল লেডি, আমি আপনাকে এক্সপ্লেইন করছি। প্রথমত, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর বিধবা বিবাহ প্রথা চালু করিয়াছেন। এর আইনসম্মত সেটা, তাই এটাই আপনার কোনো বাঁধা নেই। দ্বিতীয়ত, স্টিফেনের বাবা ছিলেন খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বী আর ওর মা বাঙালি এবং সনাতন ধর্মাবলম্বী। আর সেই সূত্রে স্টিফেনের বড়ো হওয়াটা ছিল তার মায়ের ধর্মে, সংস্কৃতিতে। যার জন্য স্টিফেন বাংলা ভাষা এত ভালো ভাবে বলিতে পারে। স্টিফেন সনাতন ধর্মেই সকল নিয়ম কানুন করে। আপনার আর কোনো প্রশ্ন আছে?”

অলকানন্দা দিক শূন্য হলো। সে সুদর্শনকে হয়তো স্বামী হিসেবে মানেনি কিন্তু ছিল তো স্বামীই, এটা অস্বীকার করার জোঁ নেই। তাছাড়া শুধু অলকানন্দা কেন, এ সমাজের কোনো মেয়েই দ্বিতীয় বার বিয়ে করার কথা কল্পনাতেও ভাবতে পারেনা, আর সেখানে এই ভিনদেশী পুরুষকে বিয়ে করতে হবে! এটা আদৌও সম্ভব! অলকানন্দা দুর্বল কণ্ঠে বলল,
“অসম্ভব।”

স্টিফেন কড়া চোখে চাইল অলকানন্দার পানে। অ্যালেন আশ্বাস দিল স্টিফেনকে খুব গোপনে। তারপর ধীরে অলকানন্দার কাছে গিয়ে বেশ বিজ্ঞ কণ্ঠে বলল,
“একটু বাঁচার জন্য মানুষ পৃথিবীর সব থেকে নিকৃষ্ট কাজও করিতে রাজি হইয়া যায়, সেখানে তো এটা সামান্য বিয়ে। এই বিয়ে যদি আপনার মঙ্গল কামনাই করে তবে কেন করবেন না? কোনো কিছুই আমাদের জন্য অসম্ভব নহে। আমরা চেষ্টা করিলেই পারিব। আর, আজ আমরা যদি আপনাকে এখানেই রাখিয়া চলিয়া যাই তবে আপনার আর প্রাণে বাঁচা হইবে না। মানুষ নিজেকে বাঁচানোর জন্য কত কিছুই করে, আপনি কেন পারিবেন না?”

অ্যালেনের কথা যুক্তিযুক্ত কিন্তু তা হজম হলো না অলকানন্দার। সে বেশ সন্দেহবশত প্রশ্ন ছুঁড়ল,
“আপনারা আমার এত ভালো করার জন্য উঠে পড়ে লেগেছেন কেন? কী লাভ আপনাদের?”

“আপনি খুব সাহসী নারী আছেন। এমন একটা গোল্ড হারাইতে দিতে পারিনা। আপনার এতটুকু বয়স অথচ তেজ দেখিলে যে কেউ অবাক হইতে বাধ্য। আর সেই জন্যই আপনাকে বাঁচাইতে চাইতেছি। এখন আপনার নিজের নিজেকে হ্যাল্প করিতে হইবে। নাহয় আপনি কিন্তু বাঁচিতে পারিবেন না।”

অ্যালেনের কথা গুলো অলকানন্দার মস্তিষ্ক জুড়ে উথাল-পাতাল ঢেউ তুলল। সত্যিই তো! এ ছাড়া যে তার গতি নেই। এখানে সে থাকলে বাঁচতে পারবে না কিন্তু তাই বলে বিয়ে! অলকানন্দা স্টিফেনের দিকে চাইল। লোকটার চোখ-মুখ আগের মতনই শক্ত, কঠোর। চোখেদের নিজস্ব কোনো ভাষা নেই, কেমন প্রাণহীন তারা! এমন একটা মানুষকে বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নেওয়া আদৌও যুক্তিযুক্ত!

#চলবে

[কী হবে বলো তো!]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here