অলকানন্দার নির্বাসন পর্ব ১৪

0
626

#অলকানন্দার_নির্বাসন
#মম_সাহা

১৪.

দামোদর গ্রামের পাশ দিয়ে বিশাল এক দিঘি স্রোতশূন্য হয়ে নিবিড় ভাবে অবস্থান করেছে। রোদের আলোতে দিঘির জল অপরূপ সুন্দর লাগে। একদম স্বচ্ছ, পরিষ্কার। কিন্তু আকাশ বাদলা হলেই দিঘির জল গুলো কালো কুচকুচে লাগে। কেমন কুৎসিত! দিঘির জলের এ পরিবর্তনকে গ্রামবাসী বহু বছর যাবত অলৌকিক কিছু ভেবে আসছে যার জন্য তারা প্রায় প্রতি তিথিতে গঙ্গাপূজা করে। তাদের বিশ্বাস, অলৌকিক কিছুর পুজো করলে তা কখনো আর হিংস্র হয়ে কারো বিপদ ঘনিয়ে আনবে না। শুধু তাই না, তারা এই দিঘির কয়েক প্রান্তে বিশাল ঘাটও নির্মাণ করিয়েছে জমিদার সুদর্শনকে বলে। একটি ঘাট ছিল প্রচন্ড রাজকীয়। গ্রামের দক্ষিণ দিকে সে ঘাটটি পড়েছিল। জমিদার বাড়ির কাছাকাছি। বিরাট কারুকার্জ শোভিত সেই ঘাট ছিল বিদেশি কোনো পাথরের। রাত হলেই যেন সে পাথর থেকে আলো ছড়াতো। দামোদর গ্রামে সেটা পৃথিবীর অষ্টম আশ্চর্য হিসেবে ধরা হয়েছিল। এত সুন্দর জিনিস তারা এর আগে কখনোই দেখেনি যে! তাদের ধারণা দিঘিটি অলৌকিক বলে পাথর গুলোও এমন আলো ছড়ায়। অথচ এটিকে বলা হয় ‘মার্বেল পাথর’। যার আলাদা নিজস্বতা আছে। কিন্তু গ্রামবাসী সেটা মানতে নারাজ। এই ঘাটেই বিকেল হলে বিভিন্ন বাড়ির বউ, মেয়েরা লুকিয়ে আসে, এত অসাধারণ দৃশ্য দেখার উত্তেজনা তারা দমিয়ে রাখতে পারেনা। আজ সেই দিঘির পাশ কেটেই গঙ্গাপুজো অনুষ্ঠিত হচ্ছে। বিশাল আয়োজনেই হচ্ছে সে পুজো। এই দিনটাতে গ্রামের সকলেই এখানে উপস্থিত থাকে। এমনকি মেয়ে বউরাও।

অলকানন্দাও এখানে এসেছে। যদিও সে নব বিধবা, নিয়ম অনুসারে সন্ধ্যার পর তার ঘর ছেড়ে বাহির হওয়া উচিত নয় কিন্তু অলকানন্দা এসব নিয়ম খুব কম মান্য করে বলেই এখানে এসেছে। তার উপর তার একটা প্রয়োজনীয় কাজও আছে। তার মেঝো বোনটাকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছেনা সেটা নিয়েও এখানের দায়িত্বরত দারোগা বাবুর সাথে কিছু কথা বলবে সে। আর সেই দারোগা বাবু আজ এই অনুষ্ঠানে যোগ দিবেন।

বিশাল এক আয়োজনে মুখরিত দিঘির চারপাশ। চারদিকে মশালের লালাভ আগুন সেই মুখরিত পরিবেশকে করেছে উজ্জ্বল। অলকানন্দারা পুরো পরিবারসহ পুজোতে আসতেই তাদের আপ্যায়ন করতে ব্যস্ত হয়ে গেলো গ্রামের বেশিরভাগ মানুষ। কেউবা বসার জায়গা করে দিল, কেউবা এগিয়ে দিল জল, কেউবা ব্যস্ত হাতে শুরু করল বাতাস। অলকানন্দা চারপাশে চাইলো, তার দিকে বিস্মিত দৃষ্টি অনেক মহিলাদের। সদ্য বিধবা মেয়ে এমন ভাবে সবকিছুতে নিজে আধিপত্য বিস্তার করিয়েছে এটা আবার কিছু নারীর সহ্যও হলোনা। তাই তো কয়েকজন বয়োজ্যেষ্ঠ মহিলা এগিয়ে এলেন। তাদের শরীরে শোভা পাচ্ছিলো নানা রকমের গহনা। সব স্বর্ণেরই। তারা এগিয়ে এসে প্রণাম ঠুকলো ‘বিহারিণী মহলের’ সকলের উদ্দেশ্যে। সকলে সাদরে প্রণাম গ্রহণও করলো। তন্মধ্যেই সম্ভ্রান্তশালী এক নারী সুরবালার উদ্দেশ্যে বলল,
“দিদি, আপনার পুত্র তো কয়েকমাস আগেই মারা গেল তাই না?”

সুরবালার মুখটা এতক্ষণ যাবত হাসিখুশি থাকলেও কথাটা শুনে হাসিটা কিঞ্চিৎ থিতিয়ে এলো। সে ক্ষীণ স্বরে জবাব দিল,
“হ্যাঁ।”

“তাহলে আপনার সদ্য বিধবা বউ এই রাতের বেলা এখানে উপস্থিত হয়েছে যে! যতই হোক, নিয়মকানুন বলেও তো কিছু আছে তাই না? বিধবা মেয়েদের তো একটু বাছ-বিচার মানতে হয়।”

অলকানন্দা মহিলাটার পানে চাইলো। মহিলাটার চোখ-মুখে কেমন নিবিড় ক্ষোভের ছোঁয়া। অথচ অলকানন্দা মহিলাটাকে চেনে না। তবে তার জন্য মহিলার এমন আচরণের কারণই বা কী! নবনীল অলকানন্দার পাশেই ছিল। অলকানন্দার মনের জেগে ওঠা প্রশ্নটা বুঝতে তার বেশি সময় লাগল না। তাই তো সে এক গাল হেসে অলকানন্দাকে প্রায় ফিসফিস করে বলল,
“তোমার শ্রেণীতে পড়ে প্রতিমা আছে না? প্রতিমার মা উনি।”

অলকানন্দা এবার মহিলার ক্ষোভের কারণ বুঝলো। শীতল কণ্ঠে বলল, “ওহ্।”

কিন্তু থেমে নেই মহিলা। সে একের পর এক ধর্ম বাক্য পাঠ করেই যাচ্ছেন। সুরবালা বিরক্ত হলেন। কপাল কুঁচকে বললেন,
“দিদি, যার ভালো সে বুঝে নিবে, তাই না?”

ভদ্র মহিলার উৎসাহ নিয়ে জ্ঞান বাক্য পাঠ করা সেখানেই থেমে গেলো। সুরবালার কথায় সে প্রায় বিরক্ত হয়েই বলল,
“দিদি, সময় থাকতে সামলান। নাহয় পস্তাতে হবে।”

সুরবালা দেবী যেন গায়েই মাখলেন না সে কথা। তার ভাব ভঙ্গিতে প্রশ্রয় না পেয়ে ভদ্রমহিলা মুখ বাঁকিয়ে চলে গেলেন। সুরবালা তা দেখে হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেন। কঠিন স্বরে বললেন,
“মানুষরা কেন যেন অন্যের ভালো সহ্য করতে পারেনা কে জানি!”

সুরবালার কথাটা সহ্য হলো না পানকৌড়ির। সে মুখ ঝামটি মেরে বলল,
“বড়োমা, তুমি তোমার পুত্রবধূকে একটু বেশিই উপরে তুলে ফেলছো। মানুষ তোমাকে ভালোে জন্যই সাবধান হতে বলছে। তুমি বুজছো না। পরে সময় গেলে হা হুতাশ করবে।”

“রক্ষা করো মা আমার। এত ভালো তোমাদের করতে হবেনা।”

পানকৌড়িও আর কথা আগাতে পারল না। মনময়ূরী অন্যদিনের মতন তার সাথে যোগ দেইনি তাই কথা আগানোর ভরসাও সে পেল না। তন্মধ্যেই ইংরেজি সাহেবরা উপস্থিত হলেন সে অনুষ্ঠানে। অলকানন্দা আজ কপাল অব্দি ঘোমটা দেয়নি যার ফলস্বরূপ তার মুখটা স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। গোলগাল কিশোরী চেহারা। সাহেবরা অনুষ্ঠানে প্রবেশ করতেই গ্রামবাসীরা সকলে স্থান ছেড়ে উঠে দাঁড়াল। একেকজন ভয়ে প্রায় জবুথুবু হলো। কেউ কেউ বসার জায়গা পরিষ্কার করে দিল। তন্মধ্যেই পুজোর জন্য তুলে আনা এক কলস জল নিয়ে যাওয়ার সময় কিশোর ছেলে পা পিছলে পড়ে গেলো। মাটির কলস ভেঙে চুরমার। ততটুকুতেও ক্ষান্ত হয়নি, কলসের বেশি খানিকটা জল গিয়ে পড়লো সাহেবদের মাঝে একজনের শরীরে। সে ক্ষ্যাপে গেলেন। শক্ত বুট জুতা পরিহিত পা নিয়েই জোরে একটা লাথি দিল ছেলেটার বুকে। আৎকে উঠলো সকলে। আর্তনাদ করে উঠল ছেলেটা। অলকানন্দাও এমন নৃশংসতায় বাক্ হারা প্রায়। সাহেব দ্বিতীয় বারের মতন লাথি দিলেন ছেলেটার পেটে যার দরুন ছেলের নাক দিয়ে গলগল করে রক্ত ঝরা শুরু হল। তৃতীয় বারের মতন পা আগাতে নিলেই রুখে দাঁড়াল অলকানন্দা। বজ্রকণ্ঠে বলল,
“আর এক পা-ও আগাবেন না সাহেব। খবরদার।”

সাহেব থেমে গেলেন। অলকানন্দা এতক্ষণে খেয়াল করল এটা আর কেউ না, মিস্টার স্টিফেন। অলকানন্দা ভারী অবাক হলো। লোকটাকে সে একটু কঠিনই ভেবেছিল কিন্তু তাই বলে এতটা মায়াদয়াহীন মানুষ!

স্টিফেনের পা থেমে গেলে। শুভ্রা রাঙা শাড়ি পরিহিতা শুভ্র নারী অলকানন্দার চোখ-মুখে উপচে পড়া তেজ দেখে সাহেব ভ্রু কুঁচকালেন। বেশ তাচ্ছিল্য করে বললেন,
“আপনি বাড়াবাড়ি করিতেছেন একটু বেশি।”

“এই গ্রামের মানুষ গুলোর দায়িত্ব আমার। তাদের ভালোর জন্য আমি কেবল একটু না, অনেকটাই বাড়াবাড়ি করতে পারি, সাহেব।”

মিস্টার স্টিফেন হো হো করে হেসে উঠলেন। অলকানন্দার বাঁধন না মেনেই ছেলেটার বুকে শক্ত এক লাথি দিলেন। দাঁত কিড়মিড় করে বললেন,
“এত সাহস দেখাইতেছেন? আমি কিন্তু সেই সাহস দুই মিনিটেই ভেনিশ করিয়া দিতে পারিব। দেখিবেন?”

অলকানন্দার মাঝেও একটা তেজ কাজ করল। সে রণমুর্তি ধারণ করে বলল,
“দেখি সাহস।”

অ্যালান থামানোর চেষ্টা করলো স্টিফেনকে কিন্তু সে থামলো না। তার চোখের ইশারা পড়তেই একটা লোক সেখান থেকে প্রস্থান নিলো। তার মিনিট দুইয়ের মাঝেই সে লোকটা একটা বিধ্বস্ত মেয়েকে উপস্থিত করালো। তেরো কিংবা চৌদ্দ বর্ষীয়া হবে! পোশাক ছেঁড়া, ছিন্নভিন্ন অবস্থা।

অলকানন্দা চমকে গেলো নিজের বোনকে দেখে। বিস্মিত কণ্ঠে বলল,
“অন্নপূর্ণা!”

#চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here