#অলকানন্দার_নির্বাসন
#মম_সাহা
১০.
বাহিরের আলতো বাতাসে প্রদীপ শিখা প্রায় নিভু নিভু, ফুরিয়ে এসেছে তার আয়ু তবুও বেঁচে থাকার তার তীব্র ইচ্ছে যেন বিহারিণী মহলের অবহেলার বিধবা অলকানন্দার মতন তার তেজ! অলকানন্দা সেই নিভু নিভু প্রদীপ শিখায় দৃষ্টি মেলে নবনীলের উদ্দেশ্যে প্রশ্ন ছুঁড়ল,
“আপনাকে কেন অপছন্দ করব বললেন না?”
“আমাকে অপছন্দ করার অনেক কারণ আছে আপনার, তার মাঝে একটি হলো আমি আপনার প্রিয় শত্রু লক্ষ্মী দেবীর আদরের পুত্র।”
অলকানন্দা হয়তো এমন একটা কথার জন্য প্রস্তুত ছিল না। তার চোখে মুখেই সেই চমক ভাব পরিলক্ষিত হলো। সে বিশ্বাসই করতে পারল না যে নবনীল ঐ মহিলার ছেলে। অলকানন্দার হাবভাব দেখে হাসল নবনীল। ডান ভ্রু ক্ষানিকটা উঁচু করে বলল,
“কী? অবাক হচ্ছেন?”
অলকানন্দা মাথা নাড়াল। অস্পষ্ট স্বরে বলল, “হ্যাঁ।”
“অবাক হওয়ার কিছু নেই, আপনি হয়তো শুনেননি লক্ষ্মী দেবীরও যে একটা পুত্র সন্তান আছে। তাছাড়া অবশ্য এ বাড়িতে আমাকে তেমন কেউ পছন্দ করেনা তাই হয়তো আলাদা ভাবে কেউ আমার কথা বলারও প্রয়োজনবোধ করেনি। আর যে পছন্দ করতো সে হয়তো বলার সুযোগ পায়নি।”
“আপনার মতন একটা ছেলেকে অপছন্দ করার কারণ কী! কত মিশুক!”
“সব কথা একদিনে বলে দিলে পরে তো কথা বলার জন্য আরকিছুই থাকবে না। কিছু কথা নাহয় পরের জন্য থাকুক।”
অলকানন্দা হালকা মিঠে আঁধারে নবনীলের দিকে তাকিয়ে রইল। ছেলেটাকে তার বোধগম্য হলো না যেন। লক্ষীদেবীর ছেলে কিনা এত ভালো! এতটা আকাশ পাতাল তফাত মা ছেলের মাঝে হয়?
“মা আর ছেলের মাঝে মিল খুঁজে পাচ্ছেন না বুঝি? মিল থাকতেই হবে এমন কোনো বাধ্যবাধকতা আছে কোথাও?”
নবনীল অলকানন্দার মনের কথা ধরে ফেলেছে দেখে অলকানন্দা আরেক ধাপ বেশি অবাক হলো। ছেলেটার মাঝে কিছু তো একটা আলাদা আছে। নাহয় এমন ভাবে সব জেনে যায় কীভাবে? একটা অন্যরকম ব্যাপার।
ওদের ভাবনার মাঝেই বৈঠকখানা থেকে ডাক ভেসে এলো৷ কিসের একটা হৈচৈ হচ্ছে যেন! দু’জনই প্রায় বিস্মিত ভঙ্গিতে ছুটে গেল বৈঠকখানায়।
অন্দরমহলে বেড়েছে কোলাহল। গ্রামের মানুষ অনেকেই ভীড় করেছে এখানে। হৈচৈ হট্টগোলে দিশেহারা বাড়ির সকলে। অলকানন্দা এগিয়ে এলো পিছে পিছে নবনীলও এলো। তাদেরকে খুব গভীর দৃষ্টিতে পরোখ করল প্রসাদ। দু’জনকে একসাথে দেখেই সে চোখ বাঁকালো। বিরক্ত হলো। বাহিরের হৈচৈ তখন তীব্রতর। হৈচৈ ছাঁপিয়ে গ্রামের একজন মুরব্বির কণ্ঠ ভেসে এলো,
“নন্দনমশাই, সুদর্শন বাবা জমিদারিতে থাকার সময় তো গ্রামে এমন অনাসৃষ্টি হয়নি। যেই আপনার ছেলে মনোহর জমিদারীতে এলো তখনই গ্রামের মেয়ে-বধুরা এত অনিরাপদ হয়ে গেল! কেউ জল ভরতে একা যেতে চাচ্ছে না, মেয়েরা ইস্কুলে একা যেতে চাচ্ছে না। বাড়িতে থাকতে হচ্ছে। এ কেমন বিচার?”
“মেয়ে মানুষের ধর্মই বাড়িতে থাকা, তাহলে সমস্যা কোথায়?”
নন্দন মশাইয়ের উত্তরে হৈচৈ সমাগম থেমে গেল। বৃদ্ধ বিস্মিত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল,
“আপনি এখানে সমস্যা খুঁজে পাচ্ছেন না! আপনার পুত্র যদি গ্রামের মেয়ে বৌদের সাথে এমন অনাসৃষ্টি ব্যবহার করতে থাকে তবে তো গ্রামে টিকে থাকা মুশকিল হবে।”
“মুশকিল হলে অন্য কোথাও চলে যাবেন, সমস্যা কোথায়? এখন কী আমার পুত্রকে আমি ঘরে বসিয়ে রাখব? ছেলেদের ঐ একটু সমস্যা থাকেই, আপনারা নিজেদের বৌকে সামলে রাখলেই তো হয়।”
ভীড়ের মাঝ থেকে একজন মধ্যবয়স্ক লোক এবার সামনে এগিয়ে এলো, চোখে মুখে তার রাগ লেপ্টানো। সে কঠিন স্বরে বলল,
“আপনার ছেলে আজ আমার ইস্কুল যাওয়া কন্যার সাথে খুব বাজে ব্যবহার করেছে। মেয়েটার জামার একাংশ ছিঁড়েও ফেলেছে। এত বাজে আচরণ করেছে যে আমার মেয়েটা এখন ঘরে পড়ে আছে। আমার মেয়ের আর বিয়ে হবে? এই কলঙ্ক কীভাবে মুছবো আমি?”
“মেয়ে মানুষদের এত ইস্কুলে পাঠানোর প্রয়োজনই বা কী? তোমাদের আদিখ্যেতা দেখলে আমারই গা জ্বলে যায়।”
এতক্ষণ শুভ্রা রাঙা পর্দার আড়ালে দাঁড়িয়ে সবটাই শুনছে অলকানন্দা। বাড়ির বাকি মহিলারাও সেখানে উপস্থিত ছিলেন। অলকানন্দা ঘুরে কৃষ্ণপ্রিয়ার দিকে তাকালো। মেয়েটার চোখ-মুখ শুকনো, মাথা নতজানু। যেন স্বামীর সকল পাপের দায়ভার তার।
“ছোটো বউ, তুমি কী বলবে তোমার স্বামীর এমন কীর্তির কথায়?”
কৃষ্ণপ্রিয়া ঘাড় উঠিয়ে তাকাল অলকানন্দার পানে। কিন্তু সে জবাব দেওয়ার আগেই জবাব দিল লক্ষ্মী দেবী,
“ও কী বলবে হ্যাঁ? ও কী বলবে? মেয়েছেলেদের সব ব্যাপারে কথা বলা সাজে না।”
“তাহলে আপনি কেন এ ব্যাপারে কথা বলতে আসছেন? অন্যকে যেটা বলেন, নিজে সেটা মানতে পারেন না?”
অলকানন্দার জবাবের বিপরীতে ধমকে উঠে লক্ষ্মী দেবী, “বউ!”
“বড়ো বউ ঠিকই বলে দিদি। আমার ছেলেটার এমন অবনতি সত্যিই লজ্জার কারণ। এমন ছেলে বুঝি গর্ভে ধরে ছিলাম! এরচেয়ে সন্তান ছাড়া থাকতাম তাও বোধকরি সম্মানের ছিল।”
“মা, অমন কথা বলবেন না।”
কৃষ্ণপ্রিয়ার কথার বিপরীতে হাসল অলকানন্দা। অতঃপর মেয়েটার থুতনি কিছুটা উপরে উঠিয়ে বলল,
“যে স্বামীর জন্য সারাজীবন মাথা নিচু করে চলতে হয় তার প্রতি এত মায়া তোমার? ভালোবাসা ভালো তবে সেটা অন্ধ ভালোবাসা হলে পরিহার করতে হবে।”
“তুমি কী বুঝবে বড়দি স্বামীর মর্ম! বিয়ের এক মাসেই তো সাদা শাড়ি পড়েছ।”
কৃষ্ণপ্রিয়ার কথায় দাম্ভিকতার ছাঁপ। মেয়েটার এমন উত্তরে হতভম্ব অলকানন্দা। এমন ভাবে মেয়েটা কথা বলবে সে যে ঘুণাক্ষরেও টের পায়নি। তাই উত্তর দেওয়ার ভাষা সে প্রায় হারিয়ে বোকা চোখে তাকিয়ে রইলো। কিন্তু ততদিনে অলকানন্দার লড়াইয়ে হয়তো নিবিড় ভাবে যোগ দিয়েছে অনেকে। তার ফলস্বরূপই তরঙ্গিণী জবাব দিল,
“তোর লাল শাড়ির এত গর্ব কৃষ্ণা? অমন শাড়ি পরেও কী লাভ যদি সম্মানই না থাকে? তোর লাল শাড়ি তো কোনো কিছুই করতে পারল না। না তোর মাথা উঁচু রাখতে পারল আর না তোর শরীরে থাকা মারের চিহ্ন লুকাতে পারল। তবে এত বড়ো বড়ো কথা কিসের? এর চেয়ে অলকানন্দা ঢেড় সম্মানে আছে। তার সাদা শাড়িতে তার সম্মান আছে।”
অলকানন্দা কৃতজ্ঞতার দৃষ্টিতে তাকালো তরঙ্গিণীর পানে। মেয়েটাকে বুঝতে পারা দায়। কখন কী বলবে ধারণা করা অসম্ভব।
এর মাঝেই বিচারকার্যে হাহাকার শোনা গেল। মেয়েটার বাবা কেঁদে কেটে লুটিয়ে পড়েছে নন্দন মশাইয়ের পায়ের কাছে৷ দু-হাত জোর করে বলছে,
“আপনি এর একটা বিহীত করুন নন্দন মশাই। আমাদের যে আপনি ছাড়া কেউ নেই। আপনি বিচার না করলে আমরা কার কাছে যাবো? আমার মেয়েটার ভবিষ্যত কী?”
লোকটার প্রশ্নে গম্ভীর দেখাল নন্দন মশাইকে। সবাই ই তার উত্তরের অপেক্ষায় রইলো। সবার অপেক্ষার ছুটি দিয়ে অতঃপর নন্দন মশাই বললেন,
“ঠিকাছে, তোমার মেয়ের ক্ষতিপূরণ দিয়ে দিব। কী চাই বলো? জমিজমা না টাকা-কড়ি?”
অলকানন্দা হতভম্ব চোখে চাইল তার খুড়োশশুড়ের দিকে। লোকটা কী আদৌও মানুষ! সে নিজেকে আর দমিয়ে রাখতে না পেরে পর্দা থেকে বেরিয়ে এলো। কণ্ঠ উঁচু করে বলল,
“জমি দিয়ে কলঙ্ক ঢাকবেন? তা কোন জমির এত ক্ষমতা যে নারীর কলঙ্কের দাঁগ মুছে? আমিও দেখতে চাই সে জমি।”
উপস্থিত সকলেই বিস্মিত নয়ন জোড়া মেলে তাকিয়ে রইলো সাদা শাড়িতে আচ্ছাদিত একটি পবিত্র কিশোরীর পানে। যার চক্ষু কথা বলছে যুগ বদলের, যার অস্তিত্ব রচিত করতে চাইছে ইতিহাস। কিন্তু আদৌও এমন একটা পিছিয়ে পড়া সমাজ মানবে নারীর আধিপত্য? দূর থেকে বিজয়ীর হাসি হাসছে নবনীল। নারী শক্তিকে মূলত সামান্য ভেবে যে সমাজ ভুল করছে তাদের হয়তো এখন সেই নারীর ক্ষমতাই চলতে হবে। অলকানন্দার এই কতৃত্ব পুরুষ সমাজের কাছে আশীর্বাদ স্বরূপ মনে হবে নাকি তাদের দম্ভ মেয়েটাকে আরও নিচে নামাবে?
#চলবে