অরোনী তোমার জন্য~১৭

0
911

অরোনী, তোমার জন্য~১৭
লিখা- Sidratul Muntaz

অরোনী দুইহাতে রাফাতের পিঠ জড়িয়ে ধরে আচমকা কেঁদে উঠল। রাফাত হতভম্ব কণ্ঠে বলল,” আরে কি হলো? কাঁদার মতো কি বললাম আমি?”
অরোনী চোখ মুছে বলল,” তুমি কি এইসব আমার জন্য করেছো, কেন? আমি তো তোমাকে এতোকিছু করতে বলিনি। শুধু বলেছিলাম একবার আমার মন জয় করতে। কিন্তু তুমি বার-বার আমার মন জয় করে নিচ্ছো। আর আমাকে একবারও সুযোগ দিচ্ছো না৷ এটা ঠিক না। খুবই আনফেয়ার।”
রাফাত হেসে বলল,” তোমাকে আমি ভালোবাসি বলেই তো সব করতে পারি তোমার জন্য। তুমি এমনিই আমার মনের মালকিন হয়ে বসে আছো৷ আবার নতুন করে মন জয় করার কি দরকার?”
” দরকার আছে। তোমাকে ঈর্ষা হয়। তুমি এতো ভালো কেন? আর আমি এতো খারাপ কেন?”
” তুমি খারাপ না অরোনী৷ তুমি আমার মনের মতো। আমি ভালো কারণ তুমি ভালোবাসাময়। তোমাকে ভালোবাসতে বাসতে আমিও ভালো হয়ে গেছি। ভালোবাসা মনকে শুদ্ধ বানায়। নিষ্কলুষ প্রেমিক বানায়। তোমাকে ভালোবাসার দায়ে বেপরোয়া, লাফাঙ্গার ছেলেটা হঠাৎ সংসারী হয়ে ওঠেছে। যে কখনোই নিয়মমাফিক চলতে পছন্দ করতো না সে এখন সকাল আটটা থেকে রাত আটটা পর্যন্ত অফিসের ডিউটি সামলাচ্ছে। যে অল্পতেই অধৈর্য্য হয়ে মার-পিট লাগিয়ে দিতো সে এখন কত বেশি ধৈর্য্যশীল। মাঝে মাঝে নিজেকে দেখলে অবাকই লাগে। অরোনী,তোমাকে পাওয়ার জন্য আমার এই পরিবর্তন।কিন্তু তুমি আমাকে কখনোই বদলাতে বলোনি। তবুও আমি বদলেছি, নিজের ইচ্ছায়। যে ভালোবাসার দায়ে পড়ে যায় সে কখনও কারো বলার জন্য অপেক্ষা করে না। নিজের ভালোবাসাকে জয় করার জন্য পৃথিবীর সাথেও যুদ্ধ করতে পারে। আর আমাকে তো যুদ্ধও করতে হয়নি।খুব সহজেই তোমাকে পেয়ে গেছি। শুধু নিজেকে একটু ঠিক করতে হয়েছে। কারণ, ভালোবাসার দায় আমার ছিল। আমি এইটা বুঝে নিয়েছিলাম যে সবকিছু ছেড়ে থাকতে পারলেও তোমাকে ছাড়া আমার চলবেই না। তাইতো নিজেকে এতো পাল্টেছি৷ নাহলে দ্রুত তোমাকে বিয়ে করতে পারতাম না। অরোনী, অবশেষে তুমি আমার হয়েছো। তোমাকে পাওয়ার পর মনে হয়েছে আমি আমার পৃথিবী পেয়ে গেছি। তুমি আমার পাশে সারাজীবন থাকবে। এর চেয়ে আনন্দের ব্যাপার আমার জীবনে আর একটিও নেই।”
অরোনী মাথা নিচু করে বলল,” তুমি আমাকে ছেড়ে কখনোই কোথাও যেতে পারবে না। আমার এক মুহূর্তের দূরত্বও সহ্য হবে না। অফিসে থাকলে কমপক্ষে দুইঘণ্টা পর পর ফোন করতে হবে। বাড়ি ফেরার পর সম্পূর্ণ সময় আমার কাছে থাকতে হবে। এক মিনিটের জন্যেও যদি কোথাও যাও তাহলে আমি তোমার নাক ফাটিয়ে দিবো।”
রাফাত আশেপাশে একটু তাকিয়ে বলল,”একটা দড়ি পেলে ভালো হতো। সারারাত আমার সাথে তোমার হাত বেঁধে রাখতাম। সকালে অফিসে যাওয়ার সময় খুলে দিয়ে যেতাম।”
অরোনী চোখ পাকিয়ে বলল,” ফাজলামি হচ্ছে?”
রাফাত ডাকাতের মতো শব্দ করে হেসে দিল। অরোনী কাঁদো কাঁদো মুখে তাকাচ্ছে৷ রাফাত একটু করুণ স্বরে বলল,” ভালোবাসার কত ক্ষমতা দেখেছো? বদমেজাজী মেয়েটিকে দিয়েও কেমন ন্যাকা ন্যাকা আচরণ করাচ্ছে!”
” আমি ন্যাকা আচরণ করছি?”
অরোনীর চোখে রাগের বিচ্ছুরণ দেখা গেল। রাফাত মাথা নেড়ে বলল,” একটু-আধটু তো করছোই। বলছো আমি একমিনিটের জন্যেও কোথাও যেতে পারবো না। যদি টয়লেট লাগে? সেটাও কি একমিনিটের মধ্যেই সেরে আসতে হবে?”
” উফ, এতো ফাজিল কেন তুমি? ধ্যাত!”
অরোনী রেগে বারান্দা থেকে বের হয়ে যেতে নিল। রাফাত হাত ধরে বলল,
” শোনো, শোনো, গোসলটাও কি আমরা একসাথে করবো?”
” আল্লাহ! চুপ, একদম চুপ। তোমার মুখে আমি স্ট্যাপলার মেরে দিবো।”
অরোনী বিছানায় এসে বসল। রাফাত তখনও দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে হাসছে। অরোনী দুইহাত মাথায় ঠেকালো। তার এখন এতো লজ্জা লাগছে! হুট করে সে কেন এতো আবেগী হয়ে উঠল? কারণটা অরোনীর কাছে পরিষ্কার। এতোদিন সে শুধু রাফাতের প্রতি মুগ্ধ হয়েছে। কিন্তু ভালোবাসা অনুভব করেনি। এই অনুভূতিটা তার কাল থেকে উপলব্ধি হয়েছে। সেজন্যই মন বার-বার নিয়ন্ত্রণ হারাচ্ছে। অরোনীর মন চাইছে, খুব পাগলামি করতে। সে এতোটাই আনন্দিত যে হাজার পাগলামি করলেও ক্লান্ত হবে না। তার পাগলামি করার খায়েস ফুরোবে না। এই মুহূর্তে অরোনীর আরেকটা উপলব্ধিও হয়েছে৷ এখন থেকে রাফাতের প্রতি সে সবচেয়ে নির্ভরশীল। তার মনে হচ্ছে পৃথিবীর সবচেয়ে ভয়ংকর জায়গাতেও রাফাতের হাত ধরে সে চলে যেতে পারবে। তার একদম ভয় লাগবে না। শুধু রাফাত সাথে থাকলেই হলো।
অরোনীর পাশে রাফাত এসে বসতেই অরোনীর ঘোর কাটল। তবে রাফাতের দুষ্টমির ঘোর এখনও কাটেনি। সে হঠাৎ গলা ঝেরে বলল,
” আচ্ছা অরোনী, তুমিই না একবার বলেছিলে আমি নাকি তোমার জীবনের সবচেয়ে বড় ভুল? এখন কি মনে হচ্ছে? সবচেয়ে বড় ঠিক?”
অরোনী চোয়াল শক্ত করে উত্তর দিল,
” সবচেয়ে বড় মিথ্যুক তুমি!”
রাফাত ফ্যাকাশে কণ্ঠে জানতে চাইল,
” মিথ্যাটা কি বললাম?”
অরোনী হাত ভাজ করে অন্যদিকে চাইল। অভিমানী স্বরে উত্তর দিল,” আমাদের বাসর রাতের কথা মনে আছে? তুমি বলেছিলে যেদিন আমি তোমাকে ভালোবেসে পাগলামি শুরু করবো সেদিন তুমিও আমাকে একটা কথা বলবে।”
রাফাত একটু মনে করার চেষ্টা করল। তারপর হঠাৎ চোখ বড় বড় করে তুমুল উৎসাহে বলল,” এর মানে কি তুমি আমাকে ভালোবাসো?”
অরোনী লাজুক হেসে বলল,” বুদ্ধু, এটাও কি বলে দিতে হয়?”
রাফাত অরোনীর মুখ দুইহাতে চেপে ধরে বলল,” কথাটা তাহলে বলেই ফেলি?”
” বলো।”
রাফাত কোনো কথাই বলল না। অরোনীকে স্তব্ধ করে দিয়ে কথা বলার সম্পূর্ণ ব্যবস্থাই বন্ধ করে ফেলল। অরোনী নিজের ঠোঁটের উপর ভারী স্পর্শ অনুভব করে চোখ বুজে নিল। সেই মুহূর্তে হঠাৎ করেই জানতে ইচ্ছে হলো, তার চেয়ে সুখী আর কি কেউ আছে?

রাতে ঠিক হলো সবাই মিলে লুডু খেলবে। অনেকদিন একসাথে আড্ডা দেওয়া হয় না। লুডু খেলার মাধ্যমে সুন্দর সময় কাটবে। অথৈ আর রাফাত লুডু বোর্ড আর গুটি সাজাতে ব্যস্ত। অরোনী নীপাকে ডাকতে গেল রান্নাঘরে।
” ভাবী, চলো আমরা লুডু খেলছি। ”
নীপা হেসে বলল,” সেই সময় আছে নাকি আমার? একটু পর তোমার ভাই আসবে অফিস থেকে। ওর জন্য খাবার গরম করতে হবে।”
” ভাইয়া যখন আসবে তখন খাবার গরম করবে৷ এখন কেন? এখন আমাদের সাথে খেলো।”
” এখন আমাকে থালা-বাসন ধুঁতে হবে অরোনী। যাও তোমরা খেলো।”
শারমিন তখন রান্নাঘরেই ছিলেন। তিনি নীপাকে বললেন,” এগুলো আমি ধুঁয়ে ফেলবো। যাও তুমি ওদের সাথে খেলো গিয়ে মা। ”
” আপনি একা এতোকিছু পারবেন?”
” ইশ, কেন পারবো না? তোমার চেয়ে ভালো পারবো। যাও তুমি।”
অরোনীর খুব ভালো লাগলো। তার ভাবী আর মায়ের সম্পর্কটা বেশ সুন্দর। একদম যেন মা-মেয়ে। এই জায়গায় যদি অরোনী আর রাবেয়া থাকতেন তাহলে নিশ্চয়ই তিনি অরোনীকে খোঁচা মেরে কথা শুনিয়ে দিতেন। অবশ্য এখন রাবেয়া বদলে গেছেন। তবুও আগের কথাগুলো ভেবে অরোনী দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। নীপা আর অরোনী একটিম, অথৈ আর রাফাত একটিম। লুডু খেলায় বিজয়ী হয়েছে রাফাতের টিম। অরোনী রেগে বলল,” চিটিং হয়েছে।আবার গেইম হবে।”
রাফাত কলার উঁচু করে বলল,” হোক। একবার যখন জিতেছি তখন আবারও জিতবো।”
অথৈ এই কথা শুনে হাসতে হাসতে রাফাতের সাথে হাত মেলালো। অরোনী রাগে গজগজ করছে। তার মনে হচ্ছে তাদের সাথে অন্যায় হয়েছে৷ রাফাত আর অথৈ চালাকি করেছে।শারমিন রান্নাঘর থেকে সবার হৈচৈ শুনে মুচকি হাসছিলেন। অনেকদিন পর বাড়িটা গমগম করছে। অথৈও হাসছে। হঠাৎ কলিংবেল বাজল। অনিকেত এসে গেছে। চারবছরের জারা দ্রুত দরজা খুলতে গেল। বাবা এলে সবার আগে দরজা খুলতে ছুটে যাবে এই মেয়ে। অন্যকেউ যদি আগে দরজা খুলে দেয় তাহলেই ভ্যাক করে কেঁদে ফেলবে। অনিকেত ভেতরে ঢুকেই মেয়েকে কোলে নিল।
” আমার মামনি, কেমন আছো?”
জারা আহ্লাদী কণ্ঠে বলল,” বাবা, এনেচো?”
” কি আনবো মা?”
জারা ঠোঁট উল্টে কেঁদে ফেলতে নিচ্ছিল৷ তখনি অনিকেত পকেট থেকে লজেন্স বের করে দিল। লজেন্স পেয়ে জারা ভীষণ খুশি।
ঘুমাতে যাওয়ার সময় নীপা তেলের বোতল হাতে শারমিনের ঘরে ঢুকল। বলল,” আসুন মা, আপনার চুলে তেল মেখে বেণী করে দেই।”
শারমিন বিরক্ত কণ্ঠে বললেন,” এই রাত-বিরাতে তোমাকে এসব করতে কে বলল? ”
” সমস্যা নেই মা। জারা ঘুমিয়ে পড়েছে।”
” জারা ঘুমিয়েছে তো কি? তুমি নিজের ঘরে যাও। ছেলেটা সারাদিন বাহিরে থাকে। এতোরাত করে বাড়ি ফিরেছে আর তুমি আমার ঘরে এসে বসে আছো এটা কোনো কথা? তোমাকে না বলেছি অনিকেত বাসায় থাকলে তুমি ওকে সময় দিবে? আমার কাজ আমি নিজে করতে পারি৷ তেলও আমি দিতে পারবো। দাও।”
নীপা বুঝিয়ে দেওয়ার জন্য হাত নেড়ে নেড়ে বলল,” আঙুলে অল্প করে নিয়ে ভালোমতো তালুতে ম্যাসাজ করবেন মা। তাহলে মাথা ঠান্ডা থাকবে।”
” ঠিকাছে বুঝেছি৷ আর পাকামি করতে হবে না। পাকা মেয়ে একটা! যাও তুমি।”
নীপা হাসিমুখে বের হয়ে গেল। অরোনী দরজার সামনে দাঁড়িয়ে পুরো ব্যাপারটা দেখল। তার মাঝে মাঝে ঈর্ষা হয় নিজের ভাবীকে। তার মায়ের মতো শাশুড়ী যদি সেও পেতো! রাবেয়া এখন বদলেছেন ঠিক, কিন্তু শারমিনের মতো বুঝদার হতে পারেননি।তিনি অরোনীকে রাত দুইটা পর্যন্ত নিজের ঘরে আটকে রাখেন। রাফাত অফিস থেকে ফেরার পর অরোনীর জন্য অপেক্ষা শুরু করে। সেই অপেক্ষা আর শেষ হয় না।এসব কি কোনো বিবেকবান মানুষের আচরণ হতে পারে? আহারে, অরোনী কেন একটা বুঝদার শাশুড়ী পেল না? তার ভাগ্যটা কেন নীপার মতো হলো না? নিজের ঘরে ফেরার সময় অরোনী ধমক শুনে হঠাৎ থেমে গেল। ধমক এসেছে ভাইয়ার বেডরুম থেকে। অরোনী একটু এগিয়ে যেতেই শুনল অনিকেত নীপাকে ধমকাচ্ছে। কারণ নীপা তার পাঞ্জাবী ধুঁয়ে ইস্ত্রি করেনি। ড্রয়ারে ওভাবেই রেখে দিয়েছিল। এখন পাঞ্জাবীটা কুচকে আছে। সেজন্যই ভারী কণ্ঠে ধমকানো হচ্ছে বউকে। অরোনীর মনটা চট করে খারাপ হয়ে গেল। তার ভাই একটু মেজাজি এটা সে জানে। ভাইয়ের মেজাজ সে নিজেও পেয়েছে। কিন্তু ভাইয়া মোটেও বিবেকবান মানুষের মতো চিন্তা করছে না। নীপা ভাবী সারাদিন সংসারের কত কাজ করে। জারাকে সামলে রাখে। বাড়িতে কোনো কাজের লোকও নেই। তবুও সামান্য ভুলের কারণে ভাইয়া কিভাবে তাকে কথা শোনাচ্ছে৷ আহারে, নীপার শাশুড়ী ভাগ্য ভালো হলেও স্বামী ভাগ্য খুব একটা ভালো নয়। এদিক দিয়ে আবার অরোনী ভাগ্যবতী। তার স্বামী তাকে সবদিক দিয়ে বোঝে। অরোনীর একটু আগের আক্ষেপটা নিভে গেল। মুহূর্তেই মনে হলো, পৃথিবীতে কেউই আসলে পুরোপুরি সুখী না। কোনো একদিক দিয়ে সবারই ঝামেলা থাকে। অপূর্ণতায় পরিপূর্ণতাও থাকে। তবুও সুন্দর আমরা হেসে-খেলে কাটিয়ে দেই। মেনে নেই, মানিয়ে নেই। কষ্টগুলো দূরে ঠেলে সুখ খুঁজে বেড়ানোর এই অদ্ভুত খেলার নামই তো জীবন।

সকালে রাফাত অফিসে যাওয়ার জন্য তৈরী হচ্ছে। আর অরোনী তাকে অবিরত বিরক্ত করছে। রাফাত গলায় টাই বাঁধছিল। অরোনী তার গলা জড়িয়ে ধরল। আহ্লাদী স্বরে বলল,” আমি বেঁধে দেই?”
রাফাত ভ্রু কুচকে হাসল। নরম গলায় বলল,” দাও!”
অরোনী টাই বাঁধার নাম করে বাকিটাও খুলে ফেলল। তারপর টাই হাত দিয়ে ভাজ করে রাফাতের ঘাড়ের সাথে লাগিয়ে নিজের দিকে হেচকা টান মারল। রাফাত নিচু হয়ে ঝুঁকে এলো অরোনীর মুখের কাছে। অরোনী আলতো করে রাফাতের কপালে চুমু দিল। রাফাত উষ্ণ গলায় জিজ্ঞেস করল,” কি ব্যাপার?”
অরোনী ঢং করে বলল,” তুমি আমার থেকে এতো লম্বা হলে কেন? তাই এটা তোমার শাস্তি। একমিনিট ঘাড় নিচু করে থাকতে হবে।”
” শুধু নিচু করেই থাকবো? আর কিছু করবো না?”
অরোনী লাজুক হেসে বলল,” নাহ।”
রাফাত অরোনীর ঠোঁটে চুমু দিতে চাইল। অরোনী ছুটে পালালো, টাই হাতে নিয়েই। রাফাত ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখল দেরি হয়ে যাচ্ছে৷ হতাশ গলায় বলল,” টাই দাও প্লিজ।”
” পারলে নিজে এসে নিয়ে যাও আমার থেকে।”
রাফাতকে চ্যালেঞ্জ করেই অরোনী ঘরময় দৌড়াতে শুরু করল। রাফাত আত্মবিশ্বাসী কণ্ঠে বলল,” ওকে, লেটস সী।”
পাঁচ সেকেন্ডের মধ্যেই অরোনীকে ধরে ফেলল রাফাত। অরোনী ধপাস করে বিছানায় শুয়ে পড়ল। টাই কিছুতেই দিবে না। রাফাত ছিনিয়ে নিল। অরোনী তখন রাফাতের গলা জড়িয়ে ধরল।
” তোমাকে অফিসে যেতে দিবো না।”
রাফাত বিছানায় বসে গানের সুরে বলল,” যদি রেখে দিতে পারো, থেকে যেতে চাই..।”
অরোনী শোয়া থেকে উঠে রাফাতের কোলে মাথা রাখল। ভ্রু নাচিয়ে বলল,” কিভাবে রেখে দিতে হয় আমার জানা আছে।”
এই কথা বলেই অরোনী প্রেমময় দৃষ্টিতে তাকালো। নিঃসংকোচ আহ্বান। রাফাত দ্রুত অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে বলল,” শিট, এমন করো না অরোনী। সত্যি যেতে ইচ্ছে করছে না।”
অরোনী জিতে যাওয়ার মতো বলল,” ইয়েস! তাহলে যেও না।”
” কিছুদিন পরেই ঈদের ভ্যাকেশন। এখন অফিস মিস দিলে বস মাইন্ড করবে।”
” বস তো তোমার দুলাভাই হয়। প্রবলেম কি? একটু ছাড় দিতে পারে না?”
” দুলাভাই বলেই তো শালাকে শালার মতো খাটায়। দেখো না?”
অরোনী খিলখিল করে হাসতে লাগল। তারপর হঠাৎ মনখারাপ করে বলল,” আচ্ছা তোমার কি অফিসে যেতে কষ্ট হয় খুব?”
” উহুম। অফিসে যেতে কষ্ট হয় না। কিন্তু তোমাকে রেখে যেতে কষ্ট হয়।”
” তাহলে নিয়ে যাও।”
” সম্ভব হলে সত্যি নিয়ে যেতাম।”
” এই শোনো, কাছে আসো।”
রাফাত কাছে এলো। অরোনী ফিসফিস করে বলল,” তোমাকে সুন্দর লাগছে।”
এই বলেই দৌড়ে চলে যাচ্ছিল। রাফাত হাত ধরে বলল,” আমার কথা শুনবে না?”
” কি?”
রাফাতও অরোনীর মতো ফিসফিস করে বলল,
” তোমাকে…হট লাগছে।”
অরোনীর মুখটা দীপ্তিহীন হয়ে গেল। রুবায়েতের কথা মনে পড়ে গেছে। ঘৃণায় গা গুলিয়ে আসতে চাইল। আবার সেই অস্থিরতা, হতাশা আর মনখারাপ ফিরে এলো। রাফাত বিচলিত গলায় বলল,” অরোনী কি হয়েছে?”
অরোনী তাড়াহুড়ো করে বলল,” কিছু না। আমি তোমার জন্য টেবিলে ব্রেকফাস্ট দিচ্ছি। দ্রুত এসো।”
অরোনীর আহ্লাদী কণ্ঠের কঠিন পরিবর্তন রাফাতের নজর এড়ালো না। অরোনী হাতটা ছাড়িয়ে চলে গেল। রাফাত একটু অবাক! এই সামান্য কথায় কি অরোনী মাইন্ড করেছে? এর চেয়েও অনেক টাইট কথা বলে রাফাত। কখনও অরোনী এমন করেনি।

শারমিন রাফাতকে অনুরোধ করলেন যেন যাওয়ার পথে অথৈকে স্কুলে নামিয়ে দেয়। অন্যদিন অথৈ রিকশায় করে যায়। আজ যেহেতু দু’জন একইসময় বের হচ্ছে তাই একসাথেই গেল। রাফাত গেইট দিয়ে বের হওয়ার সময় জিজ্ঞেস করল,” আইসক্রিম খাবে অথৈ?”
অথৈ বলল,” না।”
রাফাত ভ্রু কুচকে তাকালো। মেয়েটার আজ কি হয়েছে? অথৈ এর আইসক্রিম খুব পছন্দ। তাই রাফাত প্রস্তাব করেছিল। কিন্তু দেখে মনে হচ্ছে অথৈ এর মনখারাপ। কেন? তার তো আজ খুশি থাকার কথা! গাড়িতে বসে অথৈ কোনো কথা বলল না। তাকে খুব চিন্তিত দেখালো। মনে হচ্ছে বড় কোনো সিদ্ধান্ত নিয়ে দ্বিধায় আছে। রাফাতই আগ বাড়িয়ে টুকটাক কথা বলছিল। অথৈ শুধু মাথা নেড়ে উত্তর দিচ্ছিল। গাড়ি স্কুলের সামনে থামানোর পর রাফাত বলল,” নাও, চলে এসেছি।”
অথৈ একটু ইতস্তত করে বলল,” আচ্ছা ভাইয়া, তোমাকে একটা প্রশ্ন করবো?”
” হুম করো?”
” ধরো তুমি হঠাৎ করে কিছু টাকা পেয়ে গেলে। টাকাটা তোমার প্রয়োজনও ছিল। কিন্তু সেই টাকা কে দিয়েছে, কিভাবে এসেছে, তা তুমি কিছুই জানো না। এবার কি সেই টাকা খরচ করা উচিৎ হবে? ”
রাফাত একটু ভেবে বলল,” আমার মতে অবশ্যই উচিৎ হবে। ”
অথৈ বিস্মিত কণ্ঠে বলল,” অবশ্যই উচিৎ হবে? ”
” হুম। কারণ টাকাটা অন্যসময় এলো না। ঠিক যখন প্রয়োজন তখনি এলো। কেন? এটাই তো ডেস্টিনি। আল্লাহ চায় আমি যাতে আমার প্রয়োজনটা পূরণ করতে পারি। সেজন্যই ব্যবস্থা করে দিয়েছেন।”
” কিন্তু এটা তো একটা রহস্যের মতো।”
” প্রয়োজনের সময় রহস্য খুঁজতে হয় না। শুধু প্রয়োজন মেটাতে হয়। রহস্য নিয়ে পরেও চিন্তা করা যাবে। ঠিক বলেছি না?”
” হুম। ঠিক।”
” ওকে। এবার তাহলে বায়।”
” বায়।”
অথৈ গাড়ি থেকে নামল। রাফাত ইশারায় তাকে বিদায় জানিয়ে উল্টোদিকে গাড়ি ঘোরালো। অথৈ মিষ্টি করে হাসল। আজ সকালে সে ড্রয়ারে কচকচে দু’টো একহাজার টাকার নোট পেয়েছে। তখনি সন্দেহ হয়েছিল যে টাকাটা রাফাত ভাইয়া রেখেছে কি-না! এখন রাফাতের সাথে কথা বলে সে পুরোপুরি নিশ্চিত হলো। অথৈ কাল পর্যন্তও এই নিয়ে অনেক দুশ্চিন্তায় ছিল। কিন্তু এখন তার কিছুটা হালকা লাগছে। তবে পুরোপুরি নয়। মনের মাঝে এখনও দ্বিধা। পরিবারের কাছে ঘন ঘন মিথ্যে বলে সে টাকা যোগাড় করছে। কাজটা কি ঠিক? এভাবে মিথ্যে বলার জন্য তার কি জঘন্য পাপ হচ্ছে না?

চলবে

( গল্প প্রায় শেষদিকে।)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here