অবাধ্য প্রেম(দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ) পর্ব ৮

0
420

#অবাধ্য_প্রেম( দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ)
#পর্ব_৮( প্রথম অংশ)
#নন্দিনী_নীলা

কানের কাছে ডিপ ডিপ শব্দে আমার তন্দ্রা ছুটে যায়। কারো শরীরে উত্তাপে আমি মুখ গুঁজে আছি। মনে হচ্ছে কেউ নিজের বাহুবন্ধনে আবদ্ধ করে রেখেছে আমার এই শরীরটা। আমি তার বুকের বা পাশে মাথা রেখে আছি। এজন্যই তার বুকের হৃদ স্পন্দনের শব্দ আমার কানে বাঁশির মতো দোল খাচ্ছে। চোখ পিকপিট করে তাকানোর চেষ্টা করি। পারিনা মাথাটা ভার হয়ে আছে। নরবার চেষ্টা করি পারছিনা শরীর অসার হয়ে আছে। সাথে কেউ এমনভাবে নিজের বাহু বন্ধনে আবদ্ধ করে রেখেছে আমাকে যে আমি নড়াচড়া করার শক্তিটুকু পাচ্ছি না। এমনিতেই মনে হচ্ছে আগের তুলনায় আমার শরীরের শক্তি অনেকটাই কমে গেছে। তাই শক্তি প্রয়োগ করেও কাজ হচ্ছে না। আমি ছটফট করে যাচ্ছি। অনেক কষ্টে চোখ টেনে তাকালাম। চারপাশে কালো আবরণ যেন ঘুরে উঠলো। আমি দুই তিন বার চোখ বন্ধ করে তাকালাম। আসতে আসতে চোখটা ক্লিয়ার হলো।

এমন ভাবে মানুষটার বুকে মিশে আছি উচু হয়ে তার মুখটাও দেখতে পাচ্ছি না। কিন্তু পরক্ষণে চমকে উঠলাম। এটা একটা পুরুষ। আমি কোন পুরুষালী বুকে লেপ্টে আছি ভাবতেই কেঁপে উঠলাম
নিজে থেকে তার বাহুবন্ধন থেকে সরতে না পারলেও ছটফট ঠিকই করতে পারলাম কথা বলে উঠলাম দুর্বল গলায়। ফট করেই নিবিড়ের ঘুম ছুটে গেল। বাঁধন আগলা হয়ে গেল। তাতেই ছোঁয়া ধাক্কা দিয়ে সরে আসল নিজের সিটে। আর সোজা হয়ে বসল। সামনে তাকাতেই নজরে এলো একটা পরিচিত মুখ। ইভা আপু!!
আমি চোখ বড়ো বড়ো করে তাকিয়ে আছি। ইভা আপু আমার সামনের সিটে আমার মুখোমুখি বসে আছে। তার চোখ বন্ধ ঘুমিয়ে আছে বোধহয়। তার পাশেই বসে আছে আকাশ ভাই।
আমি তাকে দেখে আরো চমকালাম। এসব কি হচ্ছে পরিচিত মানুষের মুখ দেখছি কেন? আচ্ছা এটা কি স্বপ্ন আমি কি স্বপ্ন দেখছি। তাই হবে। আমি তো একটা অপরিচিত মেয়ের পাশে বসেছিলাম ট্রেনে। তার কথা ভাবতেই আমি নিজের পাশে তাকালাম। এবার আরেকটা ঝটকা গেলাম। নিবিড়?
না এ সম্ভব‌ই না এটা স্বপ্ন‌ই আমি বরংচ আরেকটু ঘুমিয়ে নেয় মাথাটা ও ভার হয়ে আছে কিসব আবুল তাঁবুল দেখছি।

আমি সত্যি চোখ বন্ধ করতে চাইলাম কিন্তু কেন জানি পারলাম না। এতো বাস্তবিক স্বপ্ন দেখে আমার মনে লোভ জাগল। বাস্তবে তো তার দেখা পাবোনা স্বপ্নে তাকে দেখেই একটু চোখের তৃষ্ণা মেটাতে সমস্যা কি‌? আমি ছলছল নয়নে নিবিড়ের দিকে চেয়ে আছি। নিবিড় আড়মোড় ভাঙ্গে। তিনি ও আমার দিকে তাকায়। সেই গভীর দৃষ্টি! স্বপ্নেও এই দৃষ্টি আমার কাছে এতোটা বাস্তব লাগছে কেন? মনে হচ্ছে সত্যি নিবিড় আমার পাশে বসে আমার দিকে চেয়ে আছে। এতো সুন্দর স্বপ্ন মনে হয় আগে কখনো দেখিনি। এতো সুন্দর কেন স্বপ্নটা?
নিবিড়ের গভীর দৃষ্টির দিকে আমি তাকিয়ে থাকতে পারছি না। অজান্তেই কেঁপে উঠছি।
মন বলছে চাইলে ছুঁয়ে দিতে পারব নিবিড় কে।
স্বপ্ন কে কি ছুঁয়ে দেখা যায়? একবার চেষ্টা করতে ত বারণ নাই‌।

আমি নিজের কাঁপা কাঁপা হাত উঁচু করে নিবিড়ের দিকে বাড়িয়ে দিলাম। মনে মনে শুকনো ঢোক গিলছি। ছুঁয়ে দিলেই যেন স্বপ্নটা ভেঙে যাবে। এতো তাড়াতাড়ি স্বপ্ন টা ভেঙে যাক আমি চাইনা। স্বপ্নে হলেও আমি নিবিড়কে দেখতে চাই অনেকটা সময়।
নিবিড়ের গালে আমার হাত স্পর্শ করবে আর একটু এগুলেই আমি হাত গুটিয়ে নেবার কথা ভাবলাম।
সেই মুহূর্তে আমাকে চমকে দিল। কল্পনার নিবিড়। আমাকে অবাক করে দিয়ে নিবিড় নিজের পুরুষালী হাতে আমার হাত ধরে ফেলল। আমি চোখ বড়ো বড়ো করে ফেললাম।

নিবিড় আমার হাত টেনে নিজের ডান গালে স্পর্শ করতেই আমি অবিশ্বাস্য স্বরে বললাম,”এতো বাস্তবিক কল্পনার জগত ও হয় বুঝি? এই স্বপ্নে আমি আপনাকে ছুঁয়ে দিলাম কীভাবে নিবিড়‌? আগে তো শত কেঁদে ও আপনাকে একটু ছুঁতে পারতাম না। এমন মাজিক্যালি ঘটনা ঘটছে কেন? এতো সুন্দর স্বপ্ন দেখার পর। আমি আপনি ছাড়া থাকব কি করে? প্লীজ এমন সুন্দর স্বপ্নে আপনি আসবেন না। আমি সহ্য করতে পারি না।”

বলেই ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে ছোঁয়া। নিবিড় ছোঁয়া হাত নিজের গালে চেপে ধরে ছিল। গাল থেকে হাত সরিয়ে সামনে এনে হাতের উল্টো পিঠে ওষ্ঠ ছুঁয়ে দেয়। ছোঁয়া কান্নার মাঝেও কেঁপে উঠল। সাথে ওর কান্না ও কমে এলো। চোখ ভর্তি অশ্রু নিয়ে নিজের হাতের দিকে হা করে চেয়ে আছে। নিবিড় পর পর তিনবার ছুঁয়ে দিল।

তারপর মাথা তুলে ছোঁয়ার চোখের দিকে তাকিয়ে বলল,” তুমি কোন স্বপ্ন দেখতেছ না ছোঁয়া।এটা বাস্তব। আমি তুমি কাছাকাছি আছি।”

কথা বলছে এমন কথা তো সব সময়‌‌ই বলে নিবিড় স্বপ্নে। আমি বিশ্বাস করলাম না। এখনো আমি সব কিছু আমার কল্পনা ভাবছি। নিবিড় আমাকে স্পর্শ করেছে তবুও বিলিভ করছি না। চুপ করে সময়টা উপভোগ করছি যে কোন সময় সব কিছুই মিলিয়ে যাবে হাওয়ায়। অন্য স্বপ্ন থেকে স্বপ্নটা যেহেতু গভীর আমি নিবিড় কে একটু ছুঁয়ে দেব।
নিবিড় ছোঁয়ার দিকে তাকিয়ে আছে। ছোঁয়া গভীর মনোযোগ দিয়ে কিছু ভাবছে। নিবিড় আরেকটু এগিয়ে আসলো। ছোঁয়া কে কিছু বলতে যাবে তার আগেই ছোঁয়া ফট করে নিবিড়ের দুগাল নিজের হাত দ্বারা বেষ্টিত করল। নিবিড়ের কথা বলা অফ হয়ে গেল। ছোঁয়ার হাতের স্পর্শে নিবিড় শান্ত হয়ে গেল। ছোঁয়া কি তাহলে বুঝতে পেরেছে এটা স্বপ্ন না। ছোঁয়া কি করতে চাইছে দেখার জন্য ও চাতক পাখির মতো তাকিয়ে আছে।
ছোঁয়া নিবিড়ের দাড়িওয়ালা গালে হাত রেখে চাপ দিল।

তারপর বলল,” আপনি নিজেকে পরিবর্তন করে এসেছেন! এই দাড়ি ওয়ালা গালে আমি চুমু খেতে পারব না।” বলেই ছোঁয়া টেনে ধরল নিবিড়ের মাথা। নিবিড় অবাক হলেও টান পেয়ে মাথা নিচু করল। ছোঁয়া উঁচু হয়ে কপালে অধর পরশ দিল। নিবিড় আবেশেই চোখ বন্ধ করে প্রিয়তমার আদর স্পর্শ অনুভব করল।

ছোঁয়া নিবিড়ের গালে থেকে হাত সরিয়ে এবার জরিয়ে ধরে বুকে মুখ গুঁজে রইল। চিরচেনা সেই পারফিউম এর ঘ্রাণ নাকে আসতেই চোখ বুজে ঘনঘন শ্বাস নিতে লাগল। সময়টা এতোটা ভালোবাসা ময় আর এতোটা মধুর লাগছে কেন? হারিয়ে গেল আমি থাকব কি করে?

” আপনি যাচ্ছেন না কেন? সকাল হয়ে গেল অথচ আমার স্বপ্ন কাটছে না কেন?”

চোখ কচলাতে কচলাতে ছোঁয়া জানালা দিয়ে বাইরে তাকাল। ঘুটঘুটে অন্ধকার থেকে আলোর ঝিলিক দেখা যাচ্ছে কয়টা বাজে এখন? নিবিড়ের সাথে ফোন দেখতেই সেটা চাপ দিল। লেখা ভেসে উঠল,৫:০২ বাজে।
ফোনের স্কিনে নিজের একটা ছবি দেখতে পেয়ে চমকে উঠলো। এটা তো নিবিড়ের ফোনে ছিল।এই স্বপ্নে নিবিড়ের বন্ধু থেকে শুরু করে ফোন ও আমি দেখতে পাচ্ছি অদ্ভুত। মাথা চেপে ধরে বিরবির করছে ছোঁয়া। নিবিড় অনেক ভাবে বোঝানোর চেষ্টা করেছে এটা স্বপ্ন না। এমনকি ছোঁয়া কে চিমটি পর্যন্ত দেওয়া হয়েছে। স্বপ্ন সত্যি বলে বিশ্বাস করাতে কিন্তু পারছে না। ওর শুধুই মনে হচ্ছে এটা খুবই বাস্তবিক স্বপ্ন। এই স্বপ্নটা খুবই তীব্র যা বাস্তবকে গুলিয়ে ফেলা যায়।
ছোঁয়ার নিজেকে পাগল পাগল লাগছে এবার নিবিড় চিৎকার করে উঠল,” তুমি কি চাও না আমি তোমায় খোঁজে পাই। এজন্য এই সত্যি কি তুমি মানতে পারছো না। আমি তোমাকে পেয়ে গেছি এটা তুমি সহ্য করতে পারছ না।”

ছোঁয়া অবাক চোখে তাকাল নিবিড়ের দিকে। এদিকে চেঁচামেচি শুনে ইভা ও আকাশ ও উঠে গেল। দুজনে চোখ কচলে অবাক হয়ে তাকালো সামনে। নিবিড় রাগী গলায় কথা বলছে। আর ছোঁয়া হতবিহ্বল চোখে তাকিয়ে আছে। কি হচ্ছে ওরা দুজন কিছুই বুঝতে পারছেনা। আকাশ ও ইভা চোখে মুখে পানি দিয়ে এলো এবার ঘুম ছুটেছে।

আমি বিস্মিত নয়নে তাকিয়ে আছি নিবিড়ের দিকে। নিবিড় একের পর এক কথা বলে যাচ্ছে। যাতে স্পষ্ট রাগ দেখা যাচ্ছে।

” এতো ঘৃণা করো আমাকে যে। নিজের সামনে জলজ্যান্ত আমাকে স্বপ্ন বলে তাড়িয়ে দিতে চাইতেছ।” রাগে কাঁপছে নিবিড়‌।

ইভা এসে ছোঁয়ার মাথায় হাত দিয়ে জ্বর আছে কিনা দেখে বলল ,” কি হয়েছে ছোঁয়া নিবিড় এতো রেগে আছে কেন?”

এদিকে আকাশ নিবিড় কে শান্ত করার চেষ্টা করছে।‌পাশের কেবিন থেকে তৌহিদ রিসা বাকিরা দৌড়ে আসে। আফিয়া ওই কেবিনে থেকেই লক্ষ্য করছে কি হয়েছে।

আমি এবার নিশ্চিত হলাম এটা স্বপ্ন ছিল না। এটা বাস্তব। সত্যি আমি নিবিড়ের কাছেই আছি। নিবিড় আমাকে খুঁজে পেয়েছে‌। আচ্ছা কিভাবে পেল?
আমি তো একটা মেয়ের সাথে বসে ছিলাম সেখান থেকে এখানে আর ওরাই বা এখানে কি করছে? হাজারটা প্রশ্ন মাথায় এসে ভিড় করল। আর এদিকে নিবিড় রেগে ফায়ার হয়ে গেছে।

নিবিড় শান্ত হ‌ওয়ার আগে আমার দিকে তাকিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে বলল,” তুমি খুশি হও বা না হ‌ও। আমার কাছে থাকতে চাও বা না চাও আই ডোন্ট কেয়ার বাট তোমাকে আমার সাথেই থাকতে হবে। আর আমাকে রেখে চলে যাওয়ার মাসুল ও দিতে হবে। মাইন্ড ইট।”

আমি আর কথা বলার মতো কিছু পেলাম না। চুপ করে নিবিড়ের কথা শুনলাম। সামনে কি ঝড় আসতে চলেছে আমি জানি না। কিন্তু এই মুহূর্তটা যে স্বপ্ন না ভেবে আমার বুকটা প্রশান্তিতে ভরে গেল। আনন্দে চোখ ছলছল করে উঠল।

#চলবে….

#অবাধ্য_প্রেম( দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ)
#পর্ব_৮( বর্ধিতাংশ)
#নন্দিনী_নীলা

ট্রেন গন্তব্যে এসে থামতেই সবাই নামতে লাগলো। নিবিড় সেই যে আমার সাথে কথা বলেছিল তারপর আর আধা ঘন্টা চলে গেছে । নিবিড় না আমার দিকে তাকিয়েছে আর না কথা বলেছে। চোখ মুখ কঠিন করে বসে ছিল। বাকিটা সময় আমার পাশে বসে ছিল ইভা আপু তিনি আমাকে সমস্ত ঘটনায় খুলে বলেছে আমি নাকি জ্বরে বেহুশ হয়ে গেছিলাম। যে মেয়েটার পাশে বসে ছিলাম তার নাম রাত্রি। সেই মেয়েটা নাকি ভয় পেয়ে চিৎকার করেছিল। আর এদিকে ইভা আপুরা বান্দরবান যাচ্ছিল ট্যুরে।
সব শুনে আমি চোখ বড়ো বড়ো করে তাকিয়ে ছিলাম নিবিড়ের দিকে। তার দৃষ্টি ফোনে, বা মাথা উঁচু করে দুই একটা কথা বলেছে বন্ধুদের সাথে।

রাত্রি নামের মেয়েটার সাথে দেখা হলো ট্রেন থেকে নামতেই। তৌহিদ ভাইয়া তাকে ধরে নিয়ে এসেছে আর জিজ্ঞেস করছে কোথায় যাবে রাত্রি ও বান্দরবান যাবে তার নানু বাড়ি সেখানে। এটা শুনেই তৌহিদ ভাইয়া আমাদের সাথে যাওয়ার তোষামোদ করতে লাগল। রাত্রি রাজি হয়ে গেছে।

আমার পাশে এসে ফিসফিস করে বলল,” তোমার জন্য আমি কাল কতো ভয় পেয়েছিলাম জানো?”

আমি অপরাধী ন্যায় তাকালাম। রাত্রি বলল,” তোমার কি জ্বর চলে গেছে?”

” জ্বর নাই শরীর এমনিতেই ক্লান্ত লাগছে। আর কালকের জন্য সরি।”

রাত্রি বলল,” কাল তো বয়ফ্রেন্ড এর কোলে ছিলে। এখনো কোলে বসে থাকো তাহলে আর ক্লান্ত লাগবে না। আমি কতো কষ্ট পাইছি জানো।”

আমি অবাক গলায় বললাম,” তুমি কষ্ট পাইছো কেন?”

রাত্রি কিছু বলতে যাবে তৌহিদ এসে আটকে দিল। আর বলল জিপ ঠিক করা হয়ে গেছে। জিপে ওঠার আগে সকালের নাস্তা করে নেবে এখানের একটা হোটেল থেকে। সবাই হোটেলে গিয়ে বসলাম। রুটি ভাজি খেয়ে নিলো। আমি খুব একটা খেতে পারলাম না মুখটা তেতু হয়ে আছে। নিবিড় নিজের ব্যাগ থেকে ওষুধ বের করে আমার সামনে রাখলো। আমি অসহায় চোখে নিবিড়ের দিকে তাকালাম নিবিড় চলে গেল। এতো রাগ!

জিপে উঠার পর আমার এক পাশেই ইভা আপু অন্য পাশে রাত্রি বসে ছিল। নিবিড় যে আমার উপরেই রেগে আছে এটা সবাই বুঝতে পেরেছে। কারণ অনেকক্ষণ ধরে নিবিড় আমার সাথে কথা বলে না। এজন্য নিবিড়ের সাথে আমার বসা হবে না সবাই ভেবে নিয়েছিলো। আমি এতদিন পরে প্রিয় মানুষগুলোকে পেয়ে খুবই আনন্দিত। জমিয়ে আড্ডা দিচ্ছিলাম ইভা আপু, রাত্রি, আকাশ ভাইয়া, সবার সাথে। একমাত্র আফিয়া আমার সাথে একটাও কথা বলে নি। শুধু তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে আমাকে পরোক্ষ করছিল। তার চোখে আমার জন্য রাগ আমি স্পষ্ট দেখতে পেয়েছি। আমিও আগবাড়িয়ে কথা বলিনি।

সবাই জিপে উঠে বসে আছি। এদিকে নিবিড় আর তৌহিদ ভাইয়া কোথায় যেন গেছে। তাদের জন্য ওয়েট করছি গাড়িতে বসে রাত্রির সাথে কথায় কথায় ওর সম্পর্কে জেনে নিলাম। রাত্রি অনার্স প্রথম বর্ষের এখনো ভর্তি হয় নাই আবেদন করেছে অর নাকি পছন্দের ভার্সিটিতে আসে নাই। এজন্য ও প্রাইভেটে ভর্তি হবে। ওর নানু বাসা বান্দরবান। মামাতো বোনের বিয়ে উপলক্ষেও হঠাৎ করে এসেছে একাই। ওর বড় ভাইয়ের আসার কথা ছিল আজকে কিন্তু সবকিছু ঠিক করার পরে তিনি নাকি হঠাৎ বিজনেসের কাজে জরুরী ভিত্তিতে কুমিল্লা গেছে। আর বলেছে সেখান থেকে এসে নিয়ে যাবে বিয়ের আরও তিন দিন পর কিন্তু রাত্রি খুবই চঞ্চল মেয়ে আর জেদি। ও যেহেতু ভেবেছে গতকাল যাবে তাই গতকাল‌ই। এজন্য বাসার কাউকে না বলেই একাই টিকেট নিয়ে চলে এসেছে রাগ করে।
জেদ করে আসার কথা শুনে আমি রাত্রি কে একটু নীতিবাক্য শুনালাম কারণ এখন তো পরিবারের সবাই হয়তো ওর জন্য টেনশনে আছে। আর ও ফোন অফ করে রেখেছে কারো সাথে যোগাযোগ করেনি। এ কথা শুনে রাত্রিও বুঝতে পারলে ও ভুল করেছে। তাড়াতাড়ি ফোন অন করল।

এদিকে নিবিড় আর তৌহিদ ভাইয়া এসে পরল। নিবিড় এসেই আমার দিকে একবার তাকাল তারপর ইভা আপুর হাত ধরে টেনে উঠিয়ে দিল। ইভা আপু তো চিৎকার করে উঠল। কে শোনে কার কথা। আমি ও অবাক চোখে তাকিয়ে আছি। রাত্রি ফোনে কথা বলছে। নিবিড় ইভা আপুর জায়গায় বসল।

ইভা আপু গাল ফুলিয়ে বলল,” মুখে বললেই হতো ওখানে বসতে চাস। এমন ভাবে ভয় দেখালি কেন?”

নিবিড় বলল,” অনেকে মুখের কথা বুঝতে চায়না। তাই কাজে করায় বিশ্বাসী এখন আমি।”

” ধুর তোদের রহস্য কথা শুনে আমি আর পাগল হতে চায় না।”

রাত্রি কথা শেষ করে আমার দিকে তাকিয়ে মিষ্টি করে হাসল,” আম্মু আব্বু নাকি আমার চিন্তায় কাল থেকে বসে আছে। এখন থানা যেতো কল না দিলে। ধন্যবাদ তোমার জন্য আমি ছেলেমানুষী পাগলামি বুঝতে পারছি।”

” বাবা মা কে কখন কষ্ট দিও না। থাকতে ওদের ভালো রাখতে না পারলে পরে সেই তোমাকেই আফসোস করতে হবে।”

জিপ ছাড়ল। উঁচু নিচু আঁকাবাঁকা রাস্তা বেয়ে চলছে। শীতল হাওয়া মন মস্তিষ্ক ঠান্ডা করে দিচ্ছে। সারি সারি পাহাড় ঘন সবুজ পাহাড়, নাম না জানা গাছগাছালি। প্রকৃতি মুগ্ধ করা সৌন্দর্য, অপরুপ দৃশ্য দেখছি সাথে ঝাঁকুনি খাচ্ছি। মন বসছে এই সিট বেল ছিঁড়ে আমি জিপ থেকে ওই গহীন অরণ্যে পড়ে যাব। ভয়ে আমার বুক ঢিপঢিপ করছে।
তখনি নিজের পেছনে একটা হাতের অস্তিত্ব পায়। নিবিড় খুব সাবধানে আমার পেছনে দিয়ে কোমর চেপে ধরল। টেনে নিজের সাথে মিশিয়ে রাখল‌। তার দৃষ্টি বাইরের অরণ্যে। আমি চকিতে মাথা তুলে নিবিড় দিকে তাকিয়ে আছি। নিবিড় এদিকে তাকালোই না। আমি তার এক পাশের গালের দিকেই চেয়ে আছি। চোখ নামিয়ে তাকালাম নিবিড়ের হাঁটুর ওপর থাকা ডান হাতটার দিকে। আমি নিজের ডান হাত বাড়িয়ে এতটা টেনে নিজের দুহাতের মাঝে নিলাম। নিবিড় আমার স্পর্শ পেয়ে চোখ বাঁকা করে তাকাল তারপর আগের ন্যায় বসে র‌ইল।

এদিকে রাত্রি জহরি নজরে চেয়ে আছে নিবিড়ের হাতের দিকে। নিবিড় ছোঁয়ার কোমর চেপে জরিয়ে রেখেছে হাত।‌ তা দেখছে আড়চোখে। তৌহিদ রাত্রি কে লজ্জায় লাল নীল হতে দেখে অবাক চোখে তাকিয়ে আছে। অতঃপর মাথা নিচু করে নিচু স্বরে বলল,” আমি তো এখনো এমন কিছু করিনি যে তুমি লজ্জায় লাল হবে। ব্যাপার কি ব্লাসিং খাচ্ছ কেন?”

রাত্রি লজ্জিত মুখে বলল,” ধুর আমি অন্যের ভালোবাসা দেখে মুগ্ধ প্লাস লজ্জা পাচ্ছি। আপনি খালি উল্টা পাল্টা বুঝলেন কেন?”

তোহিদ ঠোঁট কামড়ে ধরে হেঁসে বলল,” ও তাই। আমাকে বয়ফ্রেন্ড বানিয়ে নাও সুন্দরী। আমার ভালোবাসা দেখে না হয় লজ্জিত মুখটা এই বুকের লুকিয়ে রেখো।”

তৌহিদ নিজের বক্ষস্থলের দিকে ইশারা করল। রাত্রি চোখ কটমট করে বলল,” আপনি খুব নির্লজ্জ তো। এসব বলতে লজ্জা লাগছে না। ছিহ আপনার সাথে আর কথা বলব না আমি।”

” সুন্দরীদের রাগলে ঠিক পাকা টমেটোর মতো লাগে। মন চায় খপ করে ধরে গিলে খেয়ে ফেলি।”

” ছিহ কি অশ্লীল কথাবার্তা।”

আফিয়া রক্তবর্ণ চোখে ছোঁয়া আর নিবিড়ের দিকে তাকিয়ে আছে। নিবিড় রাগ করে অন্য দিকে তাকিয়ে আছে আর ছোঁয়া নিবিড়ের হাত শক্ত করে ধরে নিবিড়ের বাহুতে মাথা রেখে আছে। ঝাঁকুনিতে দুল খাচ্ছে সবাই। কারো দিকে কারো নজর নাই যে যার মতো ব্যস্ত। নিবিড় ছোঁয়াকে আগলে রেখেছে কোমর চেপে ধরে সব কিছুই লক্ষ্য করছে আফিয়া‌। এসব জাস্ট সহ্য করতে পারছে না। সব কিছু তছনছ করে ফেলতে ইচ্ছে করছে।
____________________________________

দশটায় আমরা সবাই গন্তব্যে এসে পৌঁছালাম। মাঝখানে নেমে গেছে রাত্রি। ওর মামাকে কল করে জানিয়েছেন তিনি গাড়ি নিয়ে আসছে ওকে নিতে। রাত্রি নামতেই তৌহিদ ভাইয়া মুখ কালো করে ফেলেছে। ইভা আপু রাত্রির নাম্বার নিয়েছে।
ছেলেরা ছেলেদের রুমে ও মেয়েরা মেয়েদের রুমে চলে এলাম। কটেজ টা দারুন সুন্দর কাঠের তৈরি। আর প্রত্যেক রুমে সাথে কি দারুন বেলকনি। বেলকনিতে ছোট ছোট কাঠ দিয়ে বানানো মাঝে মাঝে ফাঁকা এজন্য নিচে তাকালেই নিচের পাহাড় দূরে মাটি দেখা মিলে। হাউজটা যেন ঝুলন্ত এমন টাইপের। দুইটা খাট রুমে। একটায় রিসা আপু আর আফিয়া চলে গেল। অন্যটায় আমি আর ইভা আপু।

সাজ কড়া আলনা আছে একটা সেখানে প্রয়োজনীয় পোশাক রেখে ব্যাগ একপাশে রাখা হলো। ছোট একটা ট্রি টেবিল ও সিঙ্গেল একটা সোফা। তার পাশেই একটা ড্রেসিং টেবিল আছে। বড় একটা আয়না যেখানে নিজের মাথা থেকে পা পর্যন্ত ভালো করেই দেখা যায়। আফিয়া সোফায় নিজের ব্যাগ রেখে বাথরুমে চলে গেল ফ্রেশ হয়ে এসে বিছানায় শুয়ে পরল। আমি চারপাশ দেখছি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে আমাদের রুমের দুই রুম পরে নিবিড়দের রুম।

সবাই ফ্রেশ হলে এলে আমাকে ইভা আপু ওয়াশরুমে পাঠালো।
একেবারে গোসল করে এসেই নিজেকে ফ্রেশ লাগতে শুরু করল।
ভেজা চুল ছেড়ে বিছানার এক কোনে বসে আছি। আফিয়া আমার দিকে আড়চোখে তাকিয়ে বসা থেকে উঠে দাঁড়ালাম আর আমার দিকে এগিয়ে এলো। আমি চমকে ওঠে নিজেও উঠে দাঁড়ালাম।
আফিয়া আমার হাত ধরে টেনে আয়নার সামনে নিয়ে এলো।

আমি হকচকিয়ে গেলাম। ইভা আপু ফোন চাপতে ছিল এসব দেখে এগিয়ে এলো।

” কি করছিস?”

আফিয়া তার কথার উত্তর দিল না আয়নার দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বলল,, ” ছোঁয়া লুক। দেখো তো দুজনের মাঝে কে বেশি সুন্দরী।”

আমি তাকালাম। আফিয়া আপু একটা গাঢ় সবুজ গাউন পড়েছে হাঁটু অবধি। সাদা ছেলোয়ার ও সাদা
ওরনা গলার সাথে লাগিয়ে রেখেছে। কালার করা লম্বা চুল গুলো এক পাশ দিয়ে বুকের উপর থেকে কোমর পর্যন্ত ফেলে রাখা। ফর্সা গায়ে অপূর্ব সুন্দরী লাগছে তাকে। এখন আফিয়া একটুও সেজে নাই ফর্সা ত্বক একদম স্বচ্ছ। খুব সুন্দর লাগছে তাকে খাড়া নাক, গোলাপি ঠোঁট বড়ো বড়ো চোখ মাশাআল্লাহ। নিঃসন্দেহে তিনি সুন্দরী তালিকা থাকা মেয়েদের মধ্যে একজন। আমি এবার নিজের দিকে তাকালাম। আমার গায়ের রঙ কালো না আবার ফর্সা ও না। হলুদ করে উজ্জ্বল শ্যামলা বর্ণের। কালো চুল আমার, সেটা কোমর পর্যন্ত না, পিঠ পর্যন্ত। আমার ঠোট গোলাপি না। আমার পরনে গোলাপি রঙের সেলোয়ার কামিজ। সব মিলিয়ে আফিয়া আপুর সামনে আমি মেয়েটা খুব‌ই অসুন্দর। কিন্তু নিজেকে আমি কখনো অসুন্দর ভাবি না। আমার এই সৌন্দর্য নিয়েই আমি যথেষ্ট খুশি।

তাই আমি আয়নার দিকে তাকিয়ে বললাম,” আমরা দুজনেই খুব সুন্দরী আপু। আপনি সাদা সুন্দরী। আমি শ্যাম সুন্দরী‌।”

আফিয়া হয়তো চেয়েছিল আমি ওকে সুন্দরী বলি আর নিজেকে অসুন্দর ভেবে মুখ কালো করে থাকি। কিন্তু আমি তা করিনি এজন্য আফিয়া আপু খুব রেগে গেল। আমার হাত মুচড়ে ধরে বলল,” এই চেহেরা নিয়ে তুই আমার সাথে সুন্দরী প্রতিযোগিতা করিস।”

ইভা আপু জোর করে আমাকে তার থেকে ছাড়িয়ে নিল। আর তখনি দরজায় টোকা পরল। বাইরে এসে দেখি নিবিড়রা সবাই দাঁড়িয়ে আছে। আমি হাত চেপে ধরে বাইরে আসলাম। আমার চোখ ছলছল করে উঠছিল। তা সবার অগোচরে মুছে নিলাম। হাতে ব্যাথা করছে। লাল হয়ে উঠেছে আমার হাত।
নিবিড় হঠাৎ করেই আমার হাত চেপে ধরলো। আমি কিছু বলব তার আগেই টেনে হাঁটতে লাগল।

” আস্তে ধরেন ব্যাথা পাচ্ছি।”

#চলবে…….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here