#অবশেষে_বৃষ্টি
পর্ব ৭
#নীলাভ্র_নেহাল
.
রাত বাড়ছে। সায়ানের বন্ধু হাইওয়ে থেকে রিসিভ করে নিয়ে আসলো ওদেরকে। রাস্তা থেকে অনেক দূরে ক্ষেতের মাঝখানে একটা বাড়ি। দূর থেকে লাইটের আলো জ্বলজ্বল করতে দেখা যাচ্ছে। ক্ষেতের মাঝখান দিয়ে যাওয়ার সময় ঝিঁঝির ডাক কানে আসছিল। পৃথার ভয় কেটে গেছে অনেকটা। কারণ সায়ানের বন্ধুকে দেখে বেশ ভালো মানুষ মনে হচ্ছে। আচার আচরণের বেশ বিনয়ী।
বন্ধুর নাম জিয়ান। বাসার দরজা খুলে দিলো জিয়ানের ছোট বোন। সায়ানকে দেখে সালাম জানালো। সায়ান জিজ্ঞেস করলো কেমন আছো?
মেয়েটা ‘ভালো আছি’ বলে পিছনে পৃথাকে দেখে বললো, আপু কেমন আছেন? পৃথার হাত ধরে ওকে বাড়ির ভেতরে নিয়ে গেলো জিয়ানের বোন। সায়ান কিছুটা চিন্তামুক্ত হলো। আর যাই হোক, অন্তত পৃথা এই মেয়েটাকে পেয়ে নিশ্চিত হয়েছে নিশ্চয়ই।
জিয়ানের আম্মু অনেক মিশুক মহিলা। সায়ান ও পৃথাকে সাদরে গ্রহণ করলেন। সায়ানের ধারণা ছিল মহিলা পৃথাকে দেখে রাত্রিবেলা খিটমিট করবেন কিংবা আশ্রয় দিতে চাইবেন না। সেসবের কিছুই হলো না। বরং উনি খুব যত্নে পৃথাকে বরণ করে নিলেন।
খাওয়াদাওয়া শেষ করে আলাপচারিতার পর্ব শেষ করে জিয়ানের আম্মু জিজ্ঞেস করলেন, তোমাদের সম্পর্কের কথা বাসায় জানে?
সায়ান ই উত্তর দিলো, জ্বি আন্টি। আমার বাসায় জানে, ওর বাসায় এখনো জানানো হয়নি।
– বিয়ের চিন্তা ভাবনা কবে তোমাদের?
– এখনো চিন্তা করিনি ওটা নিয়ে।
মহিলা বললেন, বিয়ের চিন্তা না করে এভাবে ঘুরে বেড়ানো কি ঠিক? কিছু মনে কোরো না বাবা। আমি আমার ছেলেকেও একই কথা বলে রেখেছি। কারো সাথে সম্পর্ক গভীর হলে যেন আমাদেরকে জানায়। আমরা বিয়ের ব্যবস্থা করবো কিংবা কথা পাকা করে রাখবো। যে সম্পর্কের ভবিষ্যৎ নেই, সেটাকে আগানো উচিত না। সম্পর্ক যাই হোক না কেন আগে ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবা উচিত।
সায়ান বললো, আন্টি আমার বাসা থেকে কোনো সমস্যা নেই। খুব শীঘ্রই পৃথার বাসাতেও জানাবো। আর পৃথা এ বছরই ফার্স্ট ইয়ারে উঠেছে, ওর বাসায় এখন জানালে প্রতিক্রিয়া খারাপ হবে।
আন্টি চুপ থেকে বললেন, তোমরা যে আজকে এখানে থেকে যাচ্ছো এটা নিশ্চয়ই বাসায় জানে না। পৃথার বাসায় দুশ্চিন্তা করবে না?
সায়ান বলল, আমরা ভেবেছিলাম সন্ধ্যার আগেই শহরে পৌঁছতে পারবো। কিন্তু আজকে সেটা সম্ভব হলো না। বাসায় বলেছে এখানে এক বন্ধুর বাসায় থেকে যাবে।
আন্টি পৃথার দিকে তাকালেন, তুমি মুখ শুকনো করে বসে আছো কেন? কোনো সমস্যা?
– না আন্টি।
পৃথা হাসার চেষ্টা করলো। আন্টি আবারও বললেন, তুমি এক কাজ করো। তোমার মাকে ফোন দাও আমি কথা বলছি।
পৃথা ও সায়ান একে অপরের মুখের দিকে চাওয়াচাওয়ি করলো। এই পরিস্থিতি কিভাবে সামাল দেবে, চিন্তিত দেখালো পৃথাকে।
আন্টি বললেন, আমি তোমার মাকে বুঝিয়ে বলবো যে তোমরা একটা বিপদে পড়েছ। আমি আমার বাসায় রেখেছি, কোনো সমস্যা হবে না। আমি তো তোমার মায়েরই মত।
সায়ান বুদ্ধি করে বলল, কিন্তু আন্টি ওর বাসায় তো আমাদের সম্পর্কের কথা জানে না। আমার সাথে বেরিয়েছে শুনলে রেগে যাবেন। পৃথারও আর এখানে পড়াশোনা করা হবে না।
– তুমি কি শিউর যে তুমি পৃথাকেই বিয়ে করবে? সেটা যখনই হোক? এরকম প্রতিশ্রুতি করতে পারো?
– হ্যাঁ। আমি পৃথাকেই বিয়ে করবো সেটা যখনই হোক না কেন। সেই সৎসাহস আমার আছে।
পৃথা অবাক হয়ে সায়ানের দিকে চেয়ে রইলো। সায়ানকে অনেক আত্মবিশ্বাসী দেখাচ্ছে। দৃঢ় কন্ঠে সায়ানের বলা কথাগুলো ভালো লাগলো ওর। এই কি সেই সায়ান যে বাইকে বসে বারবার ব্রেক কষছিল যাতে পৃথার শরীর ওর শরীরে ধাক্কা খায়? ছেলেটা কয়েকদিনের শোকে অনুতাপে একেবারে বদলে গেছে।
সায়ান ভাবছে, আন্টি যদি পৃথার মাকে কোনোভাবে ম্যানেজ করতে পারে তাহলে আর পৃথার খালাকে ফোন দিয়ে মিথ্যে বলতে হবে না। আর কিডন্যাপিং এর নামে টেনশন ও দিতে হবে না। যদি পরিস্থিতি খারাপের দিকে এগোয় তবে সরাসরি বিয়ের কথা বলবে ওর বাসায়। মনেমনে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হয়ে সায়ান বললো, আন্টি আপনি যদি ওর বাসায় ম্যানেজ করতে পারেন, সারাজীবন কৃতজ্ঞ থাকবো আন্টি। নয়তো বিষয়টা চেপে যেতে হবে। পৃথার বাবা মা গ্রামে থাকেন।
আন্টি হেসে বললেন ,আরে বোকা ছেলে বাসায় যাতে কোনো প্রবলেম ফেস করতে না হয় সেজন্যই তো আমি বলছি পৃথার বাসায় ফোন করো। আমি কথা বলবো। আমাকে কি তোমার এতটাই খারাপ মা মনে হয় যে আমি সব বলে দিবো?
সায়ান উঠে গিয়ে জিয়ানের মায়ের কোলের কাছে বসে পড়লো। হাত দুটো ধরে বলল, থ্যাংক ইউ আন্টি। থ্যাংক ইউ সো মাচ।
পৃথা সাহস পাচ্ছিল না বাসায় ফোন করার। কারণ বাবা মাকে না বলে কখনো কোথাও যায়নি ও। মাত্র ক’দিনেই শহরে এসে একা একা ঘুরতে শিখে গেছে শুনলে বাবা মা কি ভাব্বেন কে জানে। অবশ্য এটাও ঠিক যে কিডন্যাপ বা অন্যকিছুর নামে মিথ্যে বললে আরো হাজারটা মিথ্যে বলতে হবে। তারচেয়ে ভাগ্য সুপ্রসন্ন হয়েছে, এখন সত্যিটাই বলে দেয়া উচিত। সত্য সবসময়ই জিতে যায়। বাকিটা পরে দেখা যাবে। অন্তত বাসার মানুষদেরকে মিথ্যে টেনশন তো দিতে হবে না।
পৃথা ভয়ে ভয়ে ওর আম্মুর নাম্বার দিলো। জিয়ানের আম্মু কল দিলেন ওর বাসায়। সালাম দিয়ে বললেন, আপা ভালো আছেন?
ওপাশ থেকে কি বললেন বোঝা গেলো না। আন্টি বললেন, আমি আপনারই এক বোন বলছি। ঢাকা থেকে বলছিলাম।
আন্টি কথা চালিয়ে গেলেন। বললেন, পৃথা বন্ধুদের সাথে ঘুরতে গিয়েছিল, বাসায় বকা খেতে হবে জন্য বাসায় জানায়নি। কিন্তু বিপদে পড়ার কারণে সময়মত বাসায় পৌঁছাতে পারে নি। এখন আন্টি ওনাদের বাসায় রেখে দিয়েছেন। নিজের মেয়ের মত যত্নে রাখবেন, কোনো সমস্যা হবে না। এ ধরণের নানান কথা গুছিয়ে বলার পর আন্টির মুখে হাসি দেখা গেলো। সায়ান ও পৃথা আন্টির দিকে হা হয়ে তাকিয়ে আছেন। পৃথার চোখেমুখে উদ্বেগ, কি যে হবে এবার! মা কি সহজভাবে নিতে পারবে? তবে আন্টি বলেননি ছেলে ফ্রেন্ড নাকি মেয়ে ফ্রেন্ড। সিস্টেমে কথা বলেছেন। মা কে ম্যানেজ করাও যেতে পারে। মনেমনে প্রার্থনা করছে পৃথা।
আন্টি পৃথার দিকে ফোন এগিয়ে দিয়ে বললেন, তোমার সাথে কথা বলবেন।
পৃথা ভয়ে ভয়ে ফোন হাতে নিয়ে কানে ধরলো। খুব টেনশন হচ্ছে ওর। কিন্তু ওপাশ থেকে মায়ের গলায় তেমন উদ্বেগ পাওয়া গেলো না। মা বললেন, তুই যেখানেই যাস আর যেখানেই থাকিস আমাকে জানিয়ে যেতে সমস্যা কোথায় বল তো?
– মা, ভয় লাগছিল। কখনো তো তোমাকে না বলে কোথাও যাই নি।
– এখন বড় হইছিস, ভার্সিটিতে পড়িস, বাইরে থাকিস। বন্ধুদের সাথে যাবি। কিন্তু আমাকে বললে আমি কি পারমিশন দিতাম না? কখনো কোথাও যেতে চাইলে আমি কি না করতাম?
– না।
– তাহলে? তোর বাবা শুনলে কেমন মন খারাপ করবে জানিস?
– হুম। বাবাকে জানিও না মা। আর কক্ষনো আমি তোমাদেরকে না বলে কোথাও যাবো না।
– ঠিক আছে। মনে থাকে যেন। যেখানেই যাস, আমাদেরকে বলে যাবি। তোর খালাকে জানিয়েছিস?
– না। ভয় পাচ্ছি জানাতে। যদি বকা দেন?
– আচ্ছা আমি ওকে ফোনে বলে দিবো যেন তোকে বকা না দেয়। কালকে সকাল সকাল বাসায় চলে যাবি। আর এখানে যে বান্ধবীর বাসায় আছিস, ওরা অনেক ভদ্র মানুষ কথা শুনে মনে হল। কোনোরকম বেয়াদবি করবি না। ভদ্র হয়ে থাকবি।
– আচ্ছা মা।
– নিজের যত্ন নিস। আর আমাকে ঘুমানোর আগে কল দিবি।
– আচ্ছা মা।
মা ফোন রেখে দিলেন। পৃথার চোখ ছলছল করছে। কার জন্য, কিসের জন্য এভাবে বাড়ির বাইরে বেরনোর সাহস পেয়েছে ও? কখনো বাবা মাকে না বলে কোথাও যায়নি যে মেয়েটা, সে আজ অনেক বড় দুশ্চিন্তায় তাদেরকে ফেলে দিতে চেয়েছিল। অথচ মা কত সুন্দর করে কথা বললেন। নিজের উপর অভিমান জমছে পৃথার। মা তো সন্তানদের ভালো চান, মাকে না জানিয়ে কোনো সন্তানেরই কিছু করা উচিত না। সায়ানের সাথে সম্পর্ক হলে তো মাকে জানাত অবশ্যই। কিন্তু সায়ানের সাথে কোনো সম্পর্কই তো হয়নি। যার সাথে কোনো সম্পর্কই নেই, তার সাথে এভাবে বের হওয়াটা একদম ঠিক হয়নি। অনেক বড় ভুল হতে পারত, এই ভেবে নিজের কাছে নিজেকেই খারাপ লাগছে পৃথার।
সায়ান বলল, আন্টি কি বললেন?
– মা ভেবেছে আমি বান্ধবীর বাসায় আছি।
– তোমাকে বকা দিয়েছেন?
– না।
– কিছু বলেননি?
– বললেন কোথাও যাওয়ার আগে যেন মাকে জানিয়ে যাই।
– উফফ বাবা, বাঁচলাম।
পৃথা উঠে দাঁড়িয়ে বলল, আমি একটু বাথরুম যাবো।
বাথরুমে এসে কল ছেড়ে দিয়ে দেয়ালে হেলান দিয়ে কান্না করলো পৃথা। খুব কান্না আসছে। কার জন্য ও বাবা মাকে, খালাকে মিথ্যে বলতে যাচ্ছিল? কিডন্যাপের মত টেনশন দিতে যাচ্ছিল? শুধুমাত্র একটা ছেলের জন্য? কে হয় ছেলেটা ওর? যে বাবা মা ছোটবেলা থেকে আদর যত্নে মানুষ করেছেন, তাদেরকে না জানিয়ে একটা ছেলের প্রতি এত দরদ কেন আসছে? আর কক্ষনো সায়ানের সাথে বের হবে না ও। কাঁদতে কাঁদতে এই সিদ্ধান্ত নিলো পৃথা।
প্রত্যেকটা মেয়েরই তার পরিবারের কথা ভাবা উচিত। আবেগের বশে গা ভাসিয়ে দিয়ে জীবনকে নিজের ইচ্ছামত চালানো যায় না। এ জীবন বাবা মায়ের দান, সে জীবনকে নিয়ে খেলা করার অধিকার কোনো সন্তানের নেই। এখন বাবা মা হাতখরচ না দিলে যে সন্তানকে না খেয়ে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরতে হবে, সে কি করে বাবা মাকে টেনশন দিতে চায়?
কাঁদছে পৃথা। কাঁদছে আর আপনমনেই বলছে, আমি আর কখনো বাবা মাকে মিথ্যে বলবো না। এ যাত্রায় বেঁচে গেছি। আর কোনোদিনো এরকম কাজ আমি করবো না।
অনেক্ষণ পর বাথরুম থেকে বেরিয়ে আসার পর জিয়ানের ছোটবোনের রুমে গেলো পৃথা। মেয়েটার নাম জিনিয়া। ও পৃথাকে দেখে বলল, আপু আসেন না। আমার সাথে ঘুমাতে কি সমস্যা হবে? নয়তো আমি আম্মুর রুমে চলে যাই।
– আরে না না। আপনিও থাকুন। একসাথে গল্প করা যাবে।
এমন সময় দরজায় সায়ান এসে দাঁড়ালো। পৃথা নির্বিকার ভাবে তাকালো সায়ানের দিকে। সায়ান বলল, একটু আসবে?
– সকালে কথা বলি?
সায়ান কিছু বললো না। কিন্তু দাঁড়িয়ে রইলো দরজায়। পৃথা বেরিয়ে আসতে আসতে বলল, আসুন।
বারান্দায় এসে দাঁড়াল দুজনে। এখান থেকে বাইরে শুধুই অন্ধকার আর ঝিঁঝির ডাক। খুব নির্জন একটা বাড়ি। শান্ত, কোনো শব্দ নেই।
নির্জনতা ভেঙে সায়ান বললো, সরি পৃথা।
চমকে উঠলো পৃথা, সরি কেন?
– তোমাকে কাঁদানোর জন্য।
– কি করে বুঝলেন আমি কেঁদেছি?
– তোমার চোখ দেখে। বাথরুমে এতক্ষণ কাঁদছিলে, সেটা কি বুঝতে অসুবিধা হবার কথা?
পৃথা চুপ করে রইলো। সায়ান বললো, আমাকে ভুল বুঝো না। তখন ওরকম একটা সিদ্ধান্ত নেয়াটা আমার উচিৎ হয় নি। সরি পৃথা। আর কখনো এরকম করবো না।
পৃথা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো, ভুলটা তো আমারই। কেনই বা আপনার সাথে আসতে গেলাম।
সায়ান অবাক হয়ে তাকালো পৃথার দিকে। পৃথা বললো, বাদ দিন না। রাত অনেক হয়েছে। আমার খুব মাথা ব্যথা করছে। ঘুমাতে হবে।
সায়ান কিছু বললো না। কিছু শোনার অপেক্ষাও করলো না পৃথা। বারান্দা থেকে বেরিয়ে গেলো ও। সায়ান অবাক হয়ে পৃথার পথের দিকে তাকিয়ে রইলো। পৃথা কি অভিমান করেছে! ভুল বুঝলো না তো!
বুকটা চিনচিন করে উঠলো সায়ানের।
চলবে..
#অবশেষে_বৃষ্টি
পর্ব ৮
#নীলাভ্র_নেহাল
.
রাতে জিনিয়ার সাথে গল্প গুজব করে মন ভালো হয়ে গেলো পৃথার। জিনিয়া মায়ের অনেক প্রশংসা করলো। মানুষ হিসেবে তিনি যেমন ভালো ও উদার, তেমনি মা হিসেবেও। ছেলেমেয়েদের মন বুঝেন ঠিকই তবে আচরণ করেন বন্ধুদের মতন। যাতে বাচ্চারা কেউ খারাপ পথে না যায়। বাবা মা সবসময় বন্ধুর মত সহযাত্রী হয়ে পাশে থাকলে সন্তানও পাশে থাকবে।
পৃথাও নিজের মায়ের গল্প করলো, বাবার গল্প করলো। সময়গুলো কেটে গেলো নির্বিঘ্নে। পৃথা ফোন খুলে খালাকে একবার কল দিয়ে সরি বললো। ফোনে বারবার মেসেজ আসছে সায়ানের নাম্বার থেকে। কিন্তু এই মুহুর্তে মেসেজ দেখার ইচ্ছে একেবারেই হচ্ছে না। পৃথা ফোন উল্টো করে রেখে দিলো। সায়ান যত ইচ্ছে মেসেজ পাঠাক।
খুব ভোরেই ঘুম ভেঙে গেলো। জিনিয়া সাথে নিয়ে হাঁটতে গেলো বাইরে। আশেপাশে কোনো ঘরবাড়ি না থাকায় খোলা প্রান্তরে কোনো সারাশব্দ নেই। সকালের হাওয়ায় কিছুক্ষণ হাঁটাহাঁটি করেই মন সতেজ হয়ে উঠলো। বাসায় ফিরে এসে দেখলো আন্টি নাস্তা বানিয়ে ফেলেছেন। মা ফোন দিলে কথা বলল পৃথা। মা তারাতাড়ি বাসায় যেতে বলেছেন। কিন্তু সায়ান এখনো ঘুম থেকে ওঠে নি। জিয়ানও ওঠে নি। সায়ানকে ডাকতে হলে নিজেকেই যেতে হবে ওর রুমে। সায়ানের সাথে কথা বলার কোনো ইচ্ছে করছে না। রাত থেকে মন শুধু অনুতাপের আঁচলে ঠাই নিয়ে শান্তির ছায়া খুঁজে বেড়াচ্ছে। সায়ানকে এ ছায়ায় আশ্রয় দিতে চায় না পৃথা।
বাধ্য হয়ে জিয়ানের রুমে যেতে হলো। দরজায় শব্দ করলে জিয়ান এসে খুলে দিয়ে বলল, গুড মর্নিং।
পৃথা হাসিমুখে বলল, গুড মর্নিং ভাইয়া। উনি এখনো ওঠেননি?
– না। ডেকে দিবো?
– দিন না প্লিজ।
জিয়ান বিছানার কাছে গিয়ে সায়ানের নাম ধরে ডাকতে লাগলো। সায়ান চোখ মেলে তাকালো, এত সকালে কি?
জিয়ান পৃথাকে বলল, তোমরা কথা বলো। আমি বাইরে যাচ্ছি।
জিয়ান বাইরে চলে গেলে গুটিগুটি পায়ে বিছানার কাছে এগিয়ে গেলো পৃথা। সায়ান আড়মোড়া ভেঙে উঠে বসল, কি গো? এত সকালে উঠেছো?
– আমাদেরকে এখনই রওনা দিতে হবে। মা সকাল সকাল বাসায় যেতে বলেছে।
– আচ্ছা উঠতেছি। তুমি কখন উঠলে?
– কিছুক্ষণ আগে।
– রাতে অনেক মেসেজ দিয়েছি কল দিয়েছি। বাট রিসিভ করলে না, নো রিপ্লাই। হোয়াই?
পৃথা চুপ করে থেকে উত্তর দিলো, মনটা ভালো ছিলো না।
– মন খারাপের মুহুর্তটুকু আমার সাথে শেয়ার করতে পারতে না?
– আমার ব্যাপারে জোর খাটাবেন না। পারসোনাল জোর খাটানো আমি পছন্দ করি না। ইচ্ছে হলে শেয়ার করবো, ইচ্ছে না হলে করবো না।
– তাই?
– অবশ্যই তাই।
– পৃথা, আমাকে না বললে আমি কি করে তোমার মন ভালো করে দেবো?
– আমি মন ভালো করে দেয়ার দায়িত্ব তো কাউকে দেইনি। আমার মন যেভাবে খারাপ হয়েছে, সেভাবে ভালো হবে। আপনাকে কে ভাবতে বলেছে?
– আমি ভাব্বো না? এতটাও স্বার্থপর আমি নই।
– এখানে স্বার্থপরতার কিছু নেই। প্রত্যেকের ব্যক্তিগত মন খারাপের কারণ থাকতে পারে। সবকিছু জানার চেষ্টা করা উচিত নয়।
– আমি কি তোমার এতটাও কাছের কেউ নই যার সাথে ব্যক্তিগত ব্যাপার শেয়ার করা যাবে? নই?
পৃথা সায়ানের চোখে চোখ রেখে বললো, এখনো অতটাও কাছের কেউ হন নি।
সায়ান রেগে গেল, তাহলে আমার সাথে কেন এসেছো? এতদূর? কিসের ভরসায়? কিসের টানে? হোয়াই গার্ল হোয়াই? তোমরা মেয়েরা আসলে পরিস্থিতি যখন যেরকম থাকে সেই সুযোগের সাথে সাথে পাল্টে যাও। মেয়েদের ক্যারেক্টার টাই এরকম।
– শুনুন, মেয়েদের ক্যারেক্টারের সাথে আমাকে মেশাবেন না। মানছি আমি মেয়ে কিন্তু তাই বলে যা ইচ্ছে তাই বলতে পারেন না।
– তো কি বলবো? দুদিন আমার সাথে ঘুরলে, সারাদিন সময় কাটালে, পার্কে গেলে, রেস্টুরেন্টে গেলে, লং ড্রাইভে গেলে, রাত জেগে কথা বললে, এখন বলছো আমি তোমার ব্যক্তিগত কেউ নই? বাহ, ভেরি ফানি।
পৃথা ভীষণ অপমানিত বোধ করছে। কিন্তু দুদিন সময় দেয়ার কারণে সায়ান এভাবে কটুক্তি করবে তাও ও কখনো বুঝতে পারে নি।
পৃথার চোখ জলে ভরে উঠলো। বলল, আমি শুধু চেয়েছিলাম আপনাকে বুঝতে। একজন মানুষকে না চিনে, না জেনে তার সাথে সম্পর্কে জড়ানো উচিৎ না। জানার জন্যই মিশেছি। এটাকে খারাপ চোখে দেখতে পারেন না। অবশ্য ভালোই হল, সম্পর্কে জড়ানোর আগেই আপনার আসল রূপটা বেরিয়ে এলো।
সায়ান উত্তেজিত হয়ে বলল, আসল রূপ মানে? আমি তোমাকে রাগ দেখাই নি৷ জাস্ট তোমার কথার পিঠে কথা বলেছি।
– যথেষ্ট হয়েছে। নিজেকেই জিজ্ঞেস করুন কতটা বেশি বলে ফেলেছেন?
সায়ান নিশ্চুপ। পৃথা বলল, আন্টি আমাদের অনেক উপকার করেছেন। তার সামনে আমাদের ইমেজ নষ্ট করার মানে হয় না। আমাদের ঝগড়া তর্ক এখানে বন্ধ রাখুন। তারাতাড়ি তৈরি হয়ে চলে যেতে হবে।
সায়ান বিছানা থেকে উঠে জানালার পাশে গিয়ে দাঁড়াল। ওকে খুব রাগত দেখাচ্ছে। জানালার গ্লাসে আস্তে একটা ঘুষি দিয়ে বলল, শিট!
পৃথা কাছে এগিয়ে এসে বলল, রাগটাকে একটু সংযত করার চেষ্টা করবেন। একদিন কেউ না কেউ আপনার স্ত্রী হবে, সে হয়তো রাগটাকে পছন্দ নাও করতে পারে।
সায়ান পৃথার দিকে তাকালো। এক মুহুর্ত দাঁড়িয়ে রইলো না পৃথা। পাশের ঘরে গিয়ে দ্রুত হাতমুখ ধুয়ে তৈরি হয়ে নিলো। নাস্তার টেবিলে খেতে বসেও পৃথা একবারও সায়ানের দিকে তাকালো না। সায়ান কয়েকবার তাকালো, পৃথার সাথে চোখাচোখি হবার আশায়। কিন্তু চোখাচোখি হলো না। ও মনেমনে কষ্ট পেতে শুরু করেছে।
সবার থেকে বিদায় নিয়ে বেরিয়ে পড়লো ওরা দুজন। বাইকে ওঠার সময় পৃথার হাতে হেলমেট দিয়ে সায়ান করুণ স্বরে বলল, স্যরি। সবকিছুর জন্য স্যরি পৃথা।
পৃথা কিছু না বলে দৃষ্টি ফিরিয়ে নিলো। তারপর ছাড়লো একটা দীর্ঘশ্বাস। সায়ান বাইক ছাড়ল, এগিয়ে চললো দ্রুত গতিতে। কিন্তু কারো মুখে কোনো কথা নেই। কিছুদূর যাওয়ার পর একটা দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে সায়ান জিজ্ঞেস করল, কিছু নেবে? চিপস? আইসক্রিম?
পৃথা বলল, না।
এর বাইরে আর কোনো কথা হল না। সায়ান জিজ্ঞেস করল, পানি?
– না।
– রোদে কষ্ট হচ্ছে?
– না।
অনেক ভাবে সায়ান চেষ্টা করলো পৃথার সাথে আলাপ জমানোর। কিন্তু হলো না। এতদিনের প্রচেষ্টা, কাছে আসা, একটা সম্পর্ক গড়তে গিয়েও বোধহয় আর গড়া হলো না। নিমেষেই সবকিছু শেষ হয়ে যাচ্ছে। এর আগে কোনো মেয়ের পিছনে এত পরিশ্রম দেয়নি সায়ান। আজ এতদিন ধরে ঘুরেও যদি ফলাফল শূন্য হয় তবে কিভাবে হবে! কিছুই ভালো লাগছে না সায়ানের।
পৃথাকে বাসার কাছাকাছি নামিয়ে দিয়ে সায়ান বলল, বাসায় কি বলে আমাকে জানিও। কোনো দরকার লাগলে ডেকো।
– দরকার হবে না।
– কাল ভার্সিটি যাবে?
– জানিনা। নাও যেতে পারি।
– আমি এখানে অপেক্ষা করবো।
– লাগবে না। আমি রিকশা নিয়ে চলে যেতে পারবো।
– প্লিজ, প্লিজ এমন কোরো না। সামান্য ঝগড়া হতেই পারে। এভাবে মুখ ফিরিয়ে নিও না।
– আমি বুঝতে পারিনি স্রোতে গা ভাসিয়ে কোথায় ভেসে যাচ্ছিলাম। থ্যাংকস, আমার ভুলটা বুঝিয়ে দেয়ার জন্য।
– মানে!
– ভালো থাকবেন।
পৃথা হাঁটা ধরলো। সায়ান বাইক রেখে ছুটে গেলো পৃথার সামনে। কথা বলার চেষ্টা করলো কিন্তু পৃথা পাত্তা দিলো না। রাগে নিজের মাথার চুল নিজেরই ছিড়তে ইচ্ছে করছিল সায়ানের। পরবর্তীতে মনে হল এই রাগটাকে নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসতে হবে। আর যেভাবেই হোক, পৃথার মন গলাবেই ও। অবশেষে বৃষ্টি নামবেই।
৮
পরদিন ভার্সিটিতে এসে পৃথার পিছে পিছে লেগে রইল সায়ান। অনেক কে দিয়ে চিরকুট পাঠাতে লাগল৷ প্রত্যেকটা চিরকুটে লেখা, মাফ করা যায় না?
পৃথা বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে। সায়ান দূর থেকে কান ধরে দাঁড়িয়ে আছে। কিছু বলার জন্য পৃথা এগোতে লাগল এমন সময় অর্পা এসে সায়ানের কান টেনে ধরে নিয়ে যেতে লাগল। সায়ান অর্পার থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে পৃথার সামনে এসে দাঁড়াল। পৃথা বলল, উনি টেনে যাচ্ছিল। গেলেন না কেন?
– কারণ আমার কাছে তুমি সবচেয়ে ইম্পর্ট্যান্ট।
– কি লাভ এসব করে?
– দেখো, আমাদের অনেক কথা হয়েছে। আমরা একসাথে অনেকটা সময় পার করেছি। আমি কিছুটা বুঝি তোমাকে। এভাবে নিজেকে কষ্ট দিও না।
পৃথা বাঁকা হাসি দিয়ে বলল, আপনার বুদ্ধিমত কাজ করলে কি হতো জানেন? আমার বাবা হার্ট এটাক করত।
– ওটার জন্য তো স্যরি বলেছি। আর কক্ষনো তোমাকে শহরের বাইরে নিয়ে যাবো না।
– কিন্তু এরকম সিচুয়েশনে যে কখনো পড়তে হবে না এটার কোনো নিশ্চয়তা নেই। আমি প্রেম টেমে জড়াতে চাইছি না। প্রচন্ড প্যারাদায়ক একটা জিনিস।
– প্রেমে পড়লে একটু আধটু প্যারা নিতেই হবে। এটাকে এনজয় করতে হবে।
– কোনো দরকার নেই। আপনি প্লিজ আমাকে আর প্রেমের কথা বলতে আসবেন না।
সায়ান হেসে বলল, আমি তোমার সাথে কথা না বললে কি তোমার ভালো লাগবে?
– লাগবে।
– ঠিকাছে। তাহলে কথা বলা বন্ধ। ভালো থেকো।
– আপনিও ভালো থাকবেন।
পৃথা চলে যাচ্ছিল। সায়ান ওর হাত টেনে ধরে ওকে দেয়ালে ঠেস দিয়ে ধরে বললো, কই যাচ্ছো তুমি? একদম মেরে ফেলবো। তুমি আমার। এই কয়েকদিনে আমাকে একদম পাগল করে দিয়েছো। তোমাকে বউ না করে শান্তি পাবো না আমি।
– কিহ? নাটক হচ্ছে?
– নাহ। গল্প তৈরি করছি। তুমি যদি আমাকে এভোয়েড করে চলো তো আমাকে তোমার গলায় দড়ি দিয়ে বেঁধে দিবো।
পৃথা হেসে ফেললো। সায়ানের চোখের দিকে তাকিয়ে রইল অনেক্ষণ। সায়ানের চোখের চাহনি মারাত্মক, পৃথা তাকিয়ে থাকতে থাকতে ওর প্রেমে নতুন করে পড়তে আরম্ভ করেছে। দূর থেকে এই দৃশ্য দেখে জ্বলে পুড়ে অঙ্গার হয়ে যাচ্ছে অর্পা। সায়ানের বদলে যাওয়ার কাহিনি তাহলে এটাই। এবার তো একটা কিছু করতেই হবে। এই হাসির পরিণাম এই মেয়েকে দেখিয়ে ছাড়বে অর্পা।
চলবে..