#অবশেষে_বৃষ্টি
পর্ব ২১
#নীলাভ্র_নেহাল
.
বসে থাকতে থাকতে হঠাৎ বারান্দায় শুয়ে পড়ে সায়ান। আকাশে লক্ষ লক্ষ নক্ষত্র। এখান থেকে দেখে মনে হচ্ছে তারা গুলো অনেক কাছে চলে এসেছে। এই বুঝি ঝুপ করে গায়ের উপর পড়বে। মাথার উপর ঝুলে আছে এমন একটা ভাব। কি সুন্দর ঝিলমিল করছে তারা গুলো! পৃথা কিছু একটা বলে গল্প জমাতে চাইছে। কিন্তু কি বলে শুরু করবে বুঝতে পারছে না। সায়ান ও নিশ্চুপ। এভাবে চুপচাপ বসে থাকতে সংকোচ লাগে পৃথার। তার উপর নিশুতি রাত। রাতের নির্জনতা আর ঝিঁঝিঁর ডাকে নিজেকে হারিয়ে ফেলতে মন চাইছে। অনেক্ষণ চুপ থাকার পর পৃথা বলল, আমার এক বান্ধবীর রিসেন্টলি ব্রেক আপ হয়েছে। ও ছেলেটাকে খুব ভালোবাসত।
– ব্রেকাপ হয়েছে কেন?
– ছেলেটা ওকে রেখে অন্য একটা মেয়ের সাথে জড়িয়েছিল। শুনেছি তাকে বিয়ে করে ফেলেছে। এমতাবস্থায় আমার বান্ধবীর কিছু করার ছিল না।
– ওহ আচ্ছা। বিয়ে করে ফেললে আর তার কাছে যাওয়ার উপায় নেই। সো স্যাড..
– ছেলেরা এমন কেন করে?
– মেয়েরাও এমন করে। ছেলে মেয়ে বিষয় না। বিষয় হচ্ছে সত্যিকার ভালোবাসা। এটা সবাই সবাইকে দিতে পারে না। আর কার মন কখন চেঞ্জ হয়ে যায় কেউই জানেনা।
– হুম। মাঝেমাঝে দেখি অনেক বছর সংসার করার পরও আরেকজনকে বিয়ে করে ভেগে যায়।
– আসলে একটা কঠিন সত্য কি জানো? কেউ যদি তোমাকে রেখে আবার কাউকে ভালোবাসে তাহলে বুঝতে হবে সে তোমাকে ভালোই বাসেনি। তোমার প্রতি তার একটা আলগা মোহ ছিল। যেটাকে সে ভালোবাসা বলে চালিয়েছে।
সায়ানের কথাটা ভীষণ ভালো লাগলো পৃথার। এমন করে সত্যিটা কারো কাছে শোনা হয়নি। ও বলল, ভালোবাসা একটা অদ্ভুত বিষয়। মনের অজান্তেই এটা জন্মে আর বেড়েও চলে।
– আমার দূর্ভাগ্য যে অনেক চেষ্টা করেও কারো মনে সে অনুভূতি টুকু জাগাতে পারিনি।
– এমন করে বলছেন কেন? আপনার মত একজন মানুষকে অনেক মেয়েই চায় নিশ্চয়।
– সে চাওয়াতে আসল চাওয়াটুকুই থাকে না, যা আমি চাই। প্রেম ভালোবাসা প্রাপ্তিটাও একটা সৌভাগ্যের মত। কারো থাকে, কারো থাকে না।
– হুম। জানিনা সৌভাগ্য কিনা। তবে ভাগ্যে বেশ জোটে।
– তাই?
– হ্যাঁ। এই ক’বছরে অনেকেই প্রেমের জন্য এগিয়ে এসেছিল। কেউবা বিয়ের জন্য। আমার ইচ্ছে করে নি।
– বলেছিলাম না.. হা হা হা।
সায়ান হাসছে। হাসতে হাসতে মাথাটা হাতের উপর নিয়ে পৃথার দিকে তাকাল। দূর থেকে আলো এসে পৃথার ঠোঁটের উপর পড়েছে। কি আকর্ষণীয় লাগছে দেখতে। শিউরে উঠল সায়ান।
পৃথা বলল, আজ কি সারারাত বাইরে শুয়েই কাটিয়ে দেয়ার ইচ্ছে?
– একজন সঙ্গী পেলে আমার থাকার আগ্রহটা আরো তুমুল হতো হয়তো। হা হা..
– আমাকে সঙ্গী হিসেবে কেমন লাগে?
– তা কি তোমার অজানা?
– এই কয়েক বছরে কি সবকিছু বদলায় নি?
– কিছু কিছু জিনিস হয়তো কখনোই বদলায় না। যেমন কারো প্রতি প্রেম, আবেগ, মোহ, আকর্ষণ।
– আর অনুভূতি?
সায়ান পৃথার হাতটা নিয়ে নিজের বুকের উপর ধরে বলল, টের পাচ্ছো?
পৃথা বেশ টের পাচ্ছে সায়ানের বুকটা ধকধক করছে। জোরে জোরে বিট হচ্ছে। শিউরে উঠলো পৃথার শরীর।
সায়ান বললো, কি ভাবছো?
– একটা চুম্বন, আমাকে অনেক গুলো রাত ঘুমাতে দেয়নি। সেটাই ছিল আমার জীবনের প্রথম আর শেষ চুম্বনও। এর আগেও কেউ আমার ঠোঁটে ঠোঁট রাখার সাহস করেনি, আর পরেও না।
– কারো দখল করা সম্পত্তিকে আগলে রেখেছো মনে হচ্ছে?
– এটাকে সম্পত্তি বলা যায়?
– না, সম্পদ।
– তাহলে?
– ভুল বলে ফেলেছি। আগলে রাখা হচ্ছে?
– জানিনা। কিচ্ছু জানিনা।
সায়ান মুচকি হেসে পৃথার পাশে শুয়ে পড়ল। দুজনে পাশাপাশি খানিক দূরত্বে শুয়ে রইলো বারান্দায়। খোলা বারান্দা। উপরে বিশাল তারা ভরা আকাশ। শো শো করে বাতাস বইছে। শরীরে একটা হিমশীতল অনুভূতি। গল্প করতে করতে কখন ঘুমিয়ে পড়েছে পৃথা, সায়ানও তা টের পায়নি। কিন্তু সায়ানের চোখে ঘুম নেই। পৃথাকে জাগিয়ে দেবার সাধ্যও ওর হল না। এমন নিষ্পাপের মতন ঘুমাচ্ছে, তাকে কি করে জাগিয়ে দেয়া যায়? ওকে একা ফেলে রুমেও যাওয়া যাবে না। তারচেয়ে ভালো হয় এখানে বসে ওকে পাহারা দিলে।
সায়ান পাশেই দূরত্ব বজায় রেখে শুয়ে রইলো। যাতে পৃথার পায়ের সাথে পা টাও স্পর্শ না করে। এতটাই সাবধানে রইলো ও। বুঝতেই পারল না কখন ঘুমে ঢলে পড়েছে।
প্রায় শেষ রাতের দিকে একবার ঘুম ভেঙে গেলো সায়ানের। পাশে তাকিয়ে দেখে দুজনে ঘুমের মাঝে গড়াতে গড়াতে অনেক কাছাকাছি এসে শুয়ে আছে। সায়ান অন্ধকারেই পৃথার মুখের দিকে চেয়ে রইলো। কিছুটা সময় বয়ে গেলো নিরবে। নিজেকে সংযত করে রেখেছে সায়ান। সেই কবেই নারীদেরকে শ্রদ্ধা করতে শিখেছে। পৃথার যেন কোনো অবমাননা না হয়।
পৃথা আচমকা একটা হাত তুলে দিলো সায়ানের গায়ের উপর। সায়ান নিশ্চুপ হয়ে রইলো। একদিকে হার্টবিট বাড়ছে, অন্যদিকে একটা অজানা ফিলিংস হচ্ছে। #পৃথা গায়ের উপর হাত রেখেছে, উফফফ। একরকম জাপটে ধরেই গভীর ঘুমে তলিয়ে গেল পৃথা। শুধু ঘুম নেই সায়ানের চোখে। পৃথার হাত সরিয়ে দিতে গেলে যদি ও জেগে যায়, তখন ভুল বুঝতে পারে। তারচেয়ে না জাগিয়ে দেয়াটাই ভালো। ও হাত সরিয়ে নিলে সায়ান দূরে সরে যাবে।
সায়ান আবার ঘুমিয়ে পড়েছে বুঝতেই পারেনি। ভোরবেলা ঘুম ভাংল পৃথার। কারো শরীরের উষ্ণতা টের পাচ্ছিল খুব করে। ঘুমের ঘোরে আরো শক্ত করে জাপটে ধরছিল। একটা শান্তি শান্তি অনুভূতি। একবার মনে হয়েছিল স্বপ্ন। পরক্ষণেই মনে হলো অবন্তি। খানিক সময় বাদে ভ্রম দূর হল পৃথার। সায়ানের শরীর বুঝতে পেরে চোখ মেলে দেখে সত্যিই ও সায়ানকে জড়িয়ে ধরে ঘুমাচ্ছে। লজ্জায় দ্রুত নিজেকে ছাড়িয়ে নিলো। তারপর উঠে এক দৌড়ে রুমে চলে এলো।
রুমের দরজা খোলা রেখে বান্ধবীরা ঘুমাচ্ছে। ওরা হয়তো পৃথার জন্যই দরজা খোলা রেখেছিল। পৃথা রুমে ঢুকে আস্তে আস্তে অবন্তির পাশে শুয়ে পড়ে। চোখে আর ঘুম আসে না। অস্থির লাগছে ভীষণ। সায়ান যদি টের পেয়ে থাকে পৃথা ঘুমের ভেতর ওকে জড়িয়ে ধরেছিল তাহলে কি ভাব্বে কে জানে। যদিও সায়ানকে দেখে ঘুমন্ত মনে হচ্ছিল। তবুও লজ্জা লাগছে পৃথার। বিছানায় শুয়ে ছটফট করতে লাগলো শুধু।
১৫
সকালের নাস্তা করার পর হ্যালিপ্যাডের পাশের দোলনায় দোল খেয়ে অনেকটা সময় কাটিয়ে দিলো পৃথা। কটেজে ফিরে রুমে ঢোকার আগেই সায়ান এসে বলল, আজকে বিকেলে আমরা চলে যাবো। আমাদের চান্দের গাড়িতে তিনজন যেতে পারবে। তোমরা কি আমাদের সাথে যেতে চাও?
পৃথা বলল, আমরা সিএনজিতে এসেছিলাম। তাহলে সিএনজিকে আসতে বারণ করে দেই।
– চান্দের গাড়িতে যেতে পারলে আর সিএনজি কেন?
– থ্যাংকস।
পৃথা রুমে এসে অবন্তিকে বলল, আজকেই আমরা বিকেলে রওনা দিবো।
– মানে কি? তুই না বললি অনেকদিন থাকবি?
– হ্যাঁ। সাথে এটাও বলেছিলাম যে যতদিন আমার ইচ্ছে করবে। আমার আজকে চলে যেতে ইচ্ছে করছে তাই চলে যাবো।
– অদ্ভুত!
– অদ্ভুতের কি দেখলি?
– ঠিকাছে ভাই। সিএনজিকে বলে দিবো?
– দরকার নেই।
– কেন?
– আমরা চান্দের গাড়িতে যাবো।
– গাড়ি কই পাবি?
– সেটা আমার উপর ছেড়ে দে।
অবন্তি আর কথা বাড়াল না। পৃথাকে এখানে এসে অন্যরকম লাগছে। আগে কখনো এরকম লাগেনি। নাকি প্রকৃতি দেখে মেয়েটা বদলে গেলো কি জানি বাবাহ। সবকিছু আজগুবি লাগছে। অবন্তিকে সময় না দিয়ে ও বেশিরভাগ সময়ই বাইরে ঘুরে বেড়ায়।
পৃথা ফ্রেশ হয়ে এসে অবন্তিকে নিয়ে বসল। বুঝিয়ে বলতে লাগ নানান কথা। অবন্তি বললো, আমি বাসায় গিয়ে বাবাকে বলবো বিয়ে করতে চাই। আমার একা থাকতে ভালো লাগছে না।
– এখনই বিয়ে করবি?
– হ্যাঁ। তাহলে ছেড়ে যাওয়ার ভয়ও থাকবে না। আমি একা থাকতে পারবো না রে। আমার কষ্ট হয়। কারো ভালোবাসা আর কেয়ার ভীষণ মিস করি।
– বুঝতে পারছি।
– কিচ্ছু বুঝিস নি। কারো কেয়ার পেলে বুঝতি।
– যা পেয়েছি তাতেই বুঝতে পারছি।
– তুই আবার কার কেয়ার পেলি?
পৃথা হাসল। সায়ানের শরীরের উষ্ণতা, ওর কথা, ঝরণায় যাওয়ার মুহুর্তে ওর করা কেয়ার সবকিছুই পৃথাকে উদাস করে দিচ্ছে। কেমন যেন লাগে। ভোরবেলা থেকেই অস্থির হয়ে আছে ওর মনটা। আর ভালো লাগছে না।
অবন্তি পৃথাকে মিটিমিটি হাসতে দেখে বুঝে গেল ও প্রেমে পড়েছে। কিন্তু মুখে কিছু বলল না। যার যা খুশি করুক।
পৃথা গুণগুণ করে গান গাইতে লাগল। অবন্তি হা হয়ে দেখতে লাগল ওর চেনা বান্ধবীকে।
চান্দের গাড়িতে ফেরার সময় সায়ান অবন্তির মুখোমুখি বসল। দুজনে বারবার চোখাচোখি হচ্ছিল আর হাসছিল। গাড়ি আঁকাবাঁকা রাস্তা দিয়ে সাঁই সাঁই করে ছুটে চলছে। থেকে থেকে হেসে উঠছে সবাই।
খাগড়াছড়িতে এসে বাসের টিকেট কাটা নিয়ে বাঁধল ঝামেলা। পৃথাদের ফিরতি বাসের টিকেট কাটা নেই। তিন বান্ধবী পড়ে গেলো দুশ্চিন্তায়। সায়ান কাউন্টারে ঘুরে এসে দেখল সৌদিয়া বাসের পিছনের দিকে কয়েকটা সিট বাকি আছে। সায়ান ওর এক বন্ধুকে রাজি করিয়ে পৃথাকে বলল, তোমার দুই বান্ধবী কে আমাদের সিটে যেতে বলো। আর তুমি আমি আর আমার ফ্রেন্ড আমরা সৌদিয়া বাসে টিকেটের ব্যবস্থা করি। যদি পিছনেই দিকে বসে যেতে তোমার আপত্তি না থাকে। তোমার বান্ধবীকে তো আর আমার সাথে যেতে বলতে পারবো না। আর এই ফ্রেন্ড ছাড়া আমার কোনো বন্ধুই অন্য বাসে যেতে রাজি হবেনা। কারণ সবার গার্ল ফ্রেন্ড আছে।
– আচ্ছা ঠিকাছে। আপনি আর আমি সৌদিয়ায় যাই।
পৃথা অবন্তিকে এসে কথাটা বলতেই অবন্তি বুঝে গেলো পৃথা সায়ানের সাথে যেতে বেশি আগ্রহবোধ করছে। তবে তাই হোক। অবন্তি রাজি হয়ে গেল। এরপর সায়ান ও ওর বন্ধুর সিটে অবন্তি ও তার বান্ধবী উঠে চলে গেলো। আর সৌদিয়া বাসের পিছনের দিকে টিকেট কেটে বসে অপেক্ষা করতে লাগল সায়ান ও পৃথা। ওদের বাস ছাড়বে আরো কিছুক্ষণ পরে।
বাস ছাড়ার আগ পর্যন্ত কাউন্টারেই বসে থাকতে হলো। একসাথে বসে চা খেল সায়ান ও পৃথা। সায়ান এখানকার আদিবাসিদের সম্পর্কে গল্প শোনাচ্ছিল। সন্ধ্যা নামার সাথে সাথে আজকের সন্ধ্যাটাকে সবচেয়ে অপূর্ব বলে মনে হচ্ছিল পৃথার। বুকের ভিতর টানটান উত্তেজনা কাজ করছে। পৃথা আমতা আমতা করে সায়ানক জিজ্ঞেস করলো, শুনুন..
– হ্যাঁ বলো..
– মানে আমি আর আপনি কি পাশাপাশি সিটে বসবো?
– হ্যাঁ। কেন কোনো সমস্যা?
– না।
– সমস্যা হলে বলো। চেষ্টা করে দেখি মহিলা সিট পাওয়া যায় কিনা।
– না না থাক। লাগবে না।
সায়ান চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে মুচকি হাসল। একসাথে পাশাপাশি সিটে বসে ঢাকায় যাবে ভেবে উত্তেজনা কাজ করছিল পৃথার। বাসেও অনেক গল্প হবে তাহলে!
চলবে..
#অবশেষে_বৃষ্টি
পর্ব ২২
#নীলাভ্র_নেহাল
.
খাগড়াছড়ি থেকে বাস ছাড়ল রাত ন’টায়। বাস ছাড়ার আগে সায়ান অনেক গুলো চিপস, চকোলেট, পেপসি, কেক এসব নিয়ে আসলো। পুরো প্যাকেট টা পৃথার কোলের উপর দিয়ে বললো, এগুলো বসে বসে খাও আর বাস জার্নি এনজয় করো।
– তাই বলে এতগুলো?
– হুম। পুরো রাস্তা খাবা।
– আপনি খাবেন না?
– আমি তো ঘুমাবো। একবারে ঢাকায় পৌঁছে তারপর ঘুম থেকে উঠবো।
পৃথার মনটা খারাপ হয়ে গেলেও সায়ানকে বুঝতে দিলো না। জানালা খুলে দিয়ে অন্ধকারেই বাইরে তাকিয়ে রইলো। চাইলেই খুব সুন্দর একটা জার্নি হতে পারে, উপভোগ্যকর। আর সে কিনা ঘুমাবে! মনেমনে কিছুটা রাগও জন্মালো পৃথার।
সায়ান একটা চিপসের প্যাকেট খুলে দিয়ে বললো, নাও।
পৃথা চিপস না নিয়ে অন্যমনস্ক হয়ে বাইরে তাকিয়ে রইলো। সায়ান একটা চিপস বের করে পৃথার মুখের সামনে এগিয়ে দিয়ে বলো, হা করো।
পৃথা সায়ানের দিকে তাকালো। এখন আবার ভাব জমানো হচ্ছে। চোখে রাগ স্পষ্ট। সায়ান জানতে চাইলো রেগে আছো কিনা? পৃথা বলল, না।
– কিঞ্চিত রেগে আছো।
– হ্যাঁ আছি।
– রেগে থাকলে চিপস খাওয়া যাবে না এমন আইন কে বের করেছে?
– আমি করেছি।
– রাগের কারণ কি জানতে পারি?
– না পারেন না।
– ও আচ্ছা।
– আমার সামনে ও আচ্ছা ও আচ্ছা করবেন না।
– তাহলে কি করবো?
সায়ান ফ্যালফ্যাল করে পৃথার দিকে তাকিয়ে রসিকতা করতে লাগলো। পৃথা হাসি আটকাতে পারলো না। জানালা দিয়ে শিরশির করে হাওয়া আসছে। চুল উড়ছে দিগ্বিদিক হয়ে। পৃথা চিপসের প্যাকেটে হাত ঢুকানোর সময় কাকতালীয় ভাবে সায়ানও হাত ঢুকিয়ে দিলো। তারপর দুজনে একসাথে হাত বের করতে গিয়ে ফেটে গেলো চিপসের প্যাকেট। চিপস গুলো ছড়িয়ে ছিটিয়ে সায়ানের গায়ের উপর পড়ল।
খিলখিল করে হেসে উঠলো পৃথা। সায়ান গায়ের উপর থেকে একটা একটা করে চিপস তুলে খাওয়া শুরু করল। হাসতে লাগলো পৃথা।
চিপস শেষ করে সায়ান বাসের সিটে হেলান দিয়ে বললো, এখন আমি ঘুমাবো।
ক্ষণিকের জন্য রাগটা ভুলে গেলেও আবার রেগে গেলো পৃথা। কিন্তু রাগ করার মত অধিকার তো ওর নেই। আর কেনই বা রাগবে। সায়ান ওর কে! এসব ভেবে মুখ অন্যদিকে ফিরিয়ে রইলো। অন্ধকারে কিছু দেখা যাচ্ছে না। সায়ান বুঝতে পারছে না পৃথা রেগে আছে কিনা।
কিছুদূর আসার পর এক জায়গায় চেকিং হচ্ছে। এখান থেকে সবগুলো বাস একসাথে ছাড়বে। বাসের সব যাত্রীর ছবি তোলা হচ্ছে। সায়ান মনেমনে ভাবছে, আপু নিশ্চয় বাসায় গিয়ে বাবা মাকে বলবে আমি আবারও পৃথার সাথে মিশছি।
ভাবতে ভাবতে বোনকে কল দিয়ে বাবা মাকে না জানানোর জন্য অনুরোধ করলো সায়ান। পৃথার কথা শুনলেই মা তেলেবেগুনে জ্বলে উঠবে। এখনো ওনারা হয়তো পৃথাকে মনে রাখেননি, কিন্তু সেই ফিরিয়ে দেয়ার কারণে এখনো সায়ানকে কথা শোনাতে ভোলেন না।
অনেক্ষণ সারা শব্দ নেই। পৃথা ভাবল সায়ান বোধহয় ঘুমিয়ে গেছে। নিজেও বাসের সিটে হেলান দিয়ে চোখ বন্ধ করে রইলো। ঘুম আসবে বলে মনে হয় না। তবুও চেষ্টা করা যাক।
বাস একবার একদিকে হেলে যাচ্ছে, আরেকবার অন্যদিকে। পাহাড়ি রাস্তা। ভীষণ দূর্গম। ভয়ও হচ্ছে আবার কোনো দূর্ঘটনা না ঘটে। সময়মত ব্রেক করতে না পারলে সোজা খাদে পড়ে যাবে। এতটাই ভয়ংকর রাস্তা। হঠাৎ বাস ব্রেক কষতেই সায়ান হাত বাড়িয়ে পৃথালে ধরে ফেলল। চমকে উঠল পৃথা। সায়ান তাহলে জেগেই আছে? নাকি ঘুমের ঘোরেও ওর মনে আছে পৃথা পাশে। ওকে আগলে রাখতে হবে।
পৃথা বাসের সিটে হেলান দিয়ে সায়ানের দিকে তাকিয়ে বলল, ঘুমাচ্ছেন?
সায়ান পৃথার দিকে তাকালো। আবছা আলো বাস জুরে। স্পষ্ট না হলেও একে অপরকে দেখতে পাচ্ছে। সায়ান ও পৃথা দুজনের খুব কাছাকাছি। মুখোমুখি হয়ে চেয়ে আছে একে অপরের দিকে। দুজনের মুখেই মিষ্টি হাসি। কেউ কিছু বলছে না ঠিকই কিন্তু মনে মনে এক ধরণের ফিলিংস অনুভব করছে।
সায়ান পৃথাকে ওর অতীতের একটা গল্প বলতে শুরু করলো। কয়েক বছর আগে সায়ান পৃথার জীবন থেকে সরে আসার পর অনেকদিন একরোখা হয়ে ছিল। কারো সাথেই তেমন মিশত না। বন্ধুদের সাথে সব ধরণের যোগাযোগ বন্ধ করে দিয়েছিল। অর্পা এরপরেও অনেক চেষ্টা করেছে সায়ানকে কাছে টানার। সায়ান অর্পাকেও পাত্তা দেয় নি। মেয়েটা ক্ষমা চেয়েছিল, তবুও অর্পার উপর সায়ানের রাগ কমেনি। এভাবে চলতে চলতে হঠাৎ একদিন বাসের জন্য দাঁড়িয়ে থাকা একটা মেয়ে দৌড়ে এসে সায়ানকে বলল, আমাকে একটু মেডিকেল মোড়ে পৌঁছে দেবেন?
সায়ান মেয়েটার মুখ দেখে বুঝতে পারেনি তার কোনো বিপদ হয়েছে। ও রসিকতা করে বলেছিল, বাসের ড্রাইভারদের বুঝি পছন্দ হয়নি? বাইকের ড্রাইভারকে পছন্দ হলো?
– আপনার কি মনে হচ্ছে আপনার চেহারা দেখে আমি বাইকে উঠতে চাচ্ছি। ছিহ, এ কেমন মন মানসিকতা। আমার বড় বোনকে হসপিটালে নেয়া হয়েছে। ওর বাচ্চা হবে।
– সরি সরি। প্লিজ উঠুন আমি আপনাকে নামিয়ে দিচ্ছি।
মেয়েটা মুখ কঠিন করে গিয়ে একটা রিকশায় উঠে পড়লো। সায়ান ক্ষমা চাওয়ার জন্য রিকশার পিছু পিছু ছুটছিল। মেয়েটা ধরে নিলো সায়ান বখাটে ছেলে। এরপর একদিন রাস্তায় দেখা। মেয়েটা হন্তদন্ত হয়ে দৌড়ে পালিয়ে যায় সায়ানকে দেখে। তারপর অনেক গুলো দিন কেটে যায়। সায়ান ভুলেই যায় মেয়েটার কথা। আচমকা একদিন ধানমন্ডি লেকের পাশে মেয়েটা এসে এক থোকা পদ্ম ফুল দিয়ে সায়ানকে বললো, আমি আপনাকে ভালোবাসি।
সায়ান বুঝে উঠতে পারছিল না কি বলবে। এই মেয়ে দুদিন আগেও সায়ানকে দেখে ভয় পেয়ে দৌড়ে পালাতো। হুট করে এসে আবার প্রপোজ করে দিলো। আজব মেয়ে মাইরি। মেয়েটা লজ্জা লজ্জা মুখে বলেছিল, আমি কি আপনার সঙ্গী হতে পারি?
সায়ান কোনোকিছু না ভেবেই প্রেম করতে রাজি হয়ে গিয়েছিল। দীর্ঘদিন কারো সাথে বন্ধুত্বও ছিল না। একটা পাগলাটে মেয়ে এসে প্রপোজ করছে আর সায়ান তাকে ফিরিয়ে দিবে এমন সাধ্য ছিলো না। প্রেম করেছে প্রায় মাস সাতেক। হঠাৎ মেয়েটা উধাও হয়ে যায়। ফোন বন্ধ, ফেসবুকে একটিভ নেই। সায়ান কিছুদিন পর জানতে পারে ওর বাবা জোর করে ওকে বিয়ে দিয়ে দিয়েছেন। দেখতে এসেই বিয়ে করে নিয়ে গেছে। সায়ানকে জানানোর সুযোগ পর্যন্ত পায় নি। অবশ্য জানালেও কিছু করার ছিল না। কারণ তখন সায়ান মাত্র বিজনেসে হাত দিয়েছে। এই অবস্থায় বিয়ে করাটা একেবারেই অসম্ভব ছিলো সায়ানের জন্য। এভাবেই একটা প্রেম বিলুপ্ত হয়ে যায়।
গল্পটা শুনে পৃথা হাসবে নাকি কাঁদবে, কি রিয়েকশন দেবে বুঝতে পারলো না। স্যাড রিয়েক্ট দেয়া যায়। কিন্তু হাসি পাচ্ছে কোনো এক কারণে। কৌতুহলী হয়ে পৃথা জিজ্ঞেস করলো, আচ্ছা মেয়েটা কি অনেক সুন্দর ছিলো?
– মোটামুটি ছিলো। একটু অগোছালো টাইপের।
– আমার চেয়েও সুন্দর?
পৃথা অবাক চোখে সায়ানের মুখের দিকে তাকিয়ে রইলো। আবছা অন্ধকারে সায়ানের বুঝতে অসুবিধা হলোনা পৃথার সেই অবাক চাহনি। ও গভীর ভাবে তাকিয়ে বললো, আমার চোখে তোমার চেয়ে সুন্দর জগতে আর একটি মেয়েও দেখিনি।
একটা আনন্দধারা বয়ে গেলো পৃথার শরীর জুরে। সুখে মরে যেতে ইচ্ছে করলো ওর। এমন করে কেউ কখনো বলেনি কেন! কি ভালো লাগছে কথাটা শুনতে। একেই বোধহয় বলে প্রিয়জনের প্রিয়বচন।
পৃথা জিজ্ঞেস করলো, ঘুমাবেন না?
সায়ান হাসতে হাসতে বলল, আমি কখনো বাসে ঘুমাই না।
– তাহলে তখন বললেন কেন?
ছেলে মানুষের মতন পৃথা সায়ানকে মারতে শুরু করলো। সায়ান পৃথার হাত দুটো ধরে দমিয়ে দিল পৃথাকে। পৃথা সায়ানের হাতের মুঠোয় হাত রেখে সমানে হাত কচলাতে লাগলো। তবুও সায়ানের হাত থেকে ছাড়া পেলো না। কি শক্তি মানুষ টার বাবাহ!
বাস হেলেদুলে চলছে বলে একবার পৃথা সায়ানের উপর ঝুঁকে পড়ছে আর একবার সায়ান পৃথার উপর। যথাসাধ্য চেষ্টা করছে নিজেকে কন্ট্রোল করে রাখার, আর গাড়ির পেছনে বসলে যা ঝাঁকুনি খেতে হয়। তবুও পারা যাচ্ছে না। সায়ান বলল, তোমার চুলে কি শ্যাম্পু দাও?
– ডাভ। কেন?
– ভয়ংকর সেন্ট।
– এটা আমার চুলের, শ্যাম্পুর নয়।
– একটু শুঁকে দেখার অনুমতি পাবো?
পৃথা কিছু বলতে পারলো না। মাথাটা এগিয়ে দিলো সায়ানের দিকে। সায়ান নিচু হয়ে পৃথার চুলের গন্ধ শুঁকতে লাগলো। খামচি দিয়ে ধরলো পৃথার খোপার পিছনে। সায়ানের বুকের কাছে মুখ নিয়ে চোখ বন্ধ করে সায়ানের শরীরের অদ্ভুত সৌরভ অনুভব করতে লাগল পৃথা। আহ! কি সুন্দর!
সায়ান পৃথার চুলের গন্ধে পাগল হয়ে যাচ্ছে। কেমন যেন ঘোর লেগে যাচ্ছে। ও পৃথার বাহু ধরে পৃথাকে তুলে ধরে বললো, পরের জন্মে তোমার চুলের গন্ধ যেন এমনই থাকে।
– থাকতো। কিন্তু আমি পরজন্মে বিশ্বাসী নই।
সায়ান হাসল। পৃথার চুলের ফাঁকে ফাঁকে আঙুল ঢুকিয়ে মাথায় বিলি কাটতে লাগল। পৃথা চোখ বন্ধ করে শুধু ফিল করছে। এ কেমন ভালোলাগা!
সায়ান পৃথাকে আচমকা কাছে টেনে নিয়ে চোখের দিকে তাকালো। পৃথার ঠোঁট কাঁপছে। সায়ান বললো, তোমার সেই চুম্বনের কথা মনে আছে?
– হুম। প্রথম ঠোঁটের স্পর্শ। ভুলার কথা নাকি?
– পৃথা, তোমার ঠোঁটে মধু আছে। একবার স্পর্শ করেই আমি পাগল হয়ে গিয়েছিলাম। নিজেকে সংযত করাটা ভীষণ কষ্টকর হয়ে উঠেছিল।
– তাই!
– হ্যাঁ।
অন্ধকারে সায়ান এক হাতে পৃথার গাল স্পর্শ করল। তারপর ঠোঁটে আঙুল ছুঁইয়ে দিলো। শিউরে উঠলো পৃথা। সায়ানের শার্ট খামচি দিয়ে ধরলো ও। সায়ান পৃথার চিবুকে আলতো করে স্পর্শ করলো, তারপর কপালে, নাকে, থুতনিতে, কানে। কানে হাত বুলানোর সময় পৃথা বারবার কেঁপে উঠছিল। অস্থিরতা বাড়ছে ক্রমশ। পৃথা স্থির হয়ে থাকতে পারছে না। এই নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলবে। পাগল পাগল লাগছে। পৃথার কান্না এসে যাচ্ছে। উত্তেজনায় ব্যকুল হয়ে সায়ানকে জড়িয়ে ধরলো পৃথা।
সায়ান বুঝতে পারলো আবেগের বশে বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে। বাড়াবাড়িটা যেন ভুল না হয়ে যায়। আর কিছু না করে পৃথার চুলে হাত বুলিয়ে দিয়ে বললো, সরি পৃথা। পৃথা সায়ানকে খামচি দিয়ে ধরে কেঁদে ফেললো। সায়ান পৃথাকে আর স্পর্শ করলো না। স্তব্ধ হয়ে রইলো। ক্ষণিক পর হাতটা রাখল পৃথার মাথার উপর। পৃথা কাদতে কাঁদতে বললো, আমাকে আর ছেড়ে যাবে না তো?
বুকের ভিতর একটা শিহরণ বয়ে গেলো সায়ানের। চোখ বন্ধ করে পৃথার মাথাটা বুকে চেপে ধরে বললো, না রে। আর কখনো তোকে ছেড়ে যাবো না। তুই থাকবি তো আমার হয়ে?
চলবে..