অপ্রিয় আশালতা পর্ব ৯

0
885

#অপ্রিয়_আশালতা (০৯)
দরজার সামনে লাইজু খানম ও কাব্যকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে কিছুটা অবাক হয় আশালতা।
-আন্টি আপনি? ভেতরে আসুন। (আশালতা)
লাইজু খানম হাসি মুখে ভেতরে প্রবেশ করে ছেলের হাত থেকে ফলের থলেগুলো হাফসা বেগমের হাতে দেন।
-আপা এগুলোর কি দরকার ছিল? (হাফসা বেগম)
-দরকার আছে আপা। এইযে আমার ছেলে কাব্য। (লাইজু খানম)
কাব্য হাফসা বেগমকে সালাম দিয়ে এক পলক আশালতার দিকে তাকায়। কাব্যর চোখে চোখ পড়তেই আশালতা মৃদু কে*পে ওঠে। পুরুষের তুলনায় নারীদের ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় অধিক প্রখর। কে তার দিকে কোন নজরে তাকাচ্ছে,কে কেমন উদ্দেশ্য মনে পোষণ করছে তা অনেক নারীই তার ষষ্ঠ ইন্দ্রিয়র প্রখরতার জোরে উপলব্ধি করতে পারে। আশালতার ক্ষেত্রেও ব্যাপারটি ব্যতিক্রম নয়।
-আপা আমি আশালতাকে আমার কাব্যর বউ করে নিতে চাই।
লাইজু খানমের কথা শুনে আশালতা দাঁড়িয়ে থাকা অবস্থায়ই দুই কদম পেছনে সরে যায়।
-এটা কি বলছেন আপা? আমার মেয়েটাকে তো আপনারা ঠিক মতো চেনেনও না। কিভাবে সম্ভব? (হাফসা বেগম)
-কেন সম্ভব নয় আপা? একটা মানুষকে চিনতে খুব বেশি সময়ও লাগেনা। কিছু মানুষ নিজেদেরকে লুকিয়ে রাখে বিধায় তাদেরকে আমাদের চিনতে সময় লাগে। কিন্তু আশালতার চোখের ওই স্বচ্ছ চাহনিই মানুষের সামনে ওকে পরিপূর্ণভাবে তুলে ধরে। ওর চোখে যে কোনো ছলনার রেশমাত্র নেই আপা। আমার ছেলেটাও জীবনে একবার ঠকে এসেছে আপা। ছেলেটার জীবনে সঠিক মানুষ আমি এনে দিতে পারিনি। যার সাথে বিয়ে দিয়েছিলাম বিয়ের দু’মাস বাদেই প্রেমিকের সাথে পালিয়েছিল। অথচ মেয়েকে যখন শতবার জিজ্ঞাসা করেছিলাম আলাদাভাবে যে তার কোনো প্রেমিক আছে কিনা? সে প্রতিবারই বলেছিল ,”না।“ প্রথমবার ভুল করেছি কিন্তু এবার যে হিরে চিনতে ভুল করিনি এটা আমি শতভাগ নিশ্চিত। আপা প্লিজ আমার কথাটা বিবেচনা করে দেখুন। আপনার মেয়েটাকে দুঃখের মুখোমুখি আমি কোনোদিন হতে দেব না। (লাইজু খানম)
হাফসা বেগম নিশ্চুপ হয়ে যান। এই মুহূর্তে তিনি ঠিক কি জবাব দিবেন কিছুই মাথায় আসছেনা তার।
-আন্টি আইনগত দিক বিবেচনা করতে গেলে আমার ডিভোর্স এখনো কার্যকর হয়নি। কেননা একজন মেয়ে গর্ভবতী থাকাকালীন তার ডিভোর্স সম্ভব নয়। আন্টি আপনারা উচ্চ শ্রেণির মানুষ সমাজ আপনাদের কিছু বলার সাহস পাবেনা। কিন্তু আমাকে সমাজের দোহাই দিয়ে নিচু মানসিকতা বহনকারী মানুষগুলো বাচতে দেবেনা। আজ বাদে কাল আমি একজন মা হতে যাচ্ছি। আমি চাইনা আমার সন্তান আমার সুখের বিনিময়ে মানুষের কাছে দশটা কথা শুনুক। নিচু মানসিকতার মানুষদের বুলিকে ঠে*লে ফেলে দিলেও আমার সন্তানের ভবিষ্যতের অনিশ্চয়তা বহন করে কিছুতেই আমি নিজের সুখের দিক দেখতে পারব না। দুঃ*খিত আন্টি। আমি এই বিয়ে করতে পারব না। আর শত চেষ্টা করলেও সম্ভব হবেনা।
কথাগুলো এক নাগাড়ে বলেই খাওয়ার ঘর থেকে ছুটে শোয়ার ঘরে চলে আসে আশালতা। বু*কে কিঞ্চিত ব্য*থা অনুভব করেন লাইজু খানম।
-আপা মেয়েটাকে আমি জোর করতে পারিনা। মেয়েটা এখনো নিজেকে মানসিকভাবে শক্ত করতে পারেনি। রোজ রাতে অ*স*হ্য য*ন্ত্র*ণায় ছটফট করে । এক দন্ড ঘুমায় না আমার মেয়েটা। তাছাড়া আপা আইনও তো মেনে চলতে হবে আমাদের। (হাফসা বেগম)
-আপা বিয়েটা এখনই হোক তাতো বলছিনা। বাচ্চাটা হোক। ডিভোর্সটা কার্যকর হোক তারপর সামাজিকভাবে আমরা সবকিছু এগোবো। আপনি একটু ওকে ধীরে ধীরে বোঝান। তাড়া নেই একদম। আমি শুধু আজকে এই বিষয়টা বলতেই আপনাদের বাসায় এসেছি।

লাইজু খানমের কথার মাঝেই কাব্য চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে আচমকা বলে ওঠে,
-আমি একটু আশালতার সাথে ব্যক্তিগতভাবে কথা বলতে চাই।
-ভেতরে যাও বাবা। তোমার যা যা কথা বলার আছে বলে আসো কোনো সমস্যা নেই। (হাফসা বেগম)

জানালা হতে বাইরে এক দৃষ্টে তাকিয়ে আছে আশালতা। চোখ হতে অনবরত পানি টুপটুপ করে পড়েই আচ্ছে।
রুমের দরজার ওপাশ হতে কাব্য গলা খাকারি দিয়ে ইতস্থত কন্ঠে বলে ওঠে,
-আসব?
চমকে ওঠে আশালতা। চোখের পানিটুকু মুছে নিয়ে কা*পা স্বরে বলে ওঠে,
-আ…আসুন।!
গটগট পায়ে কাব্য ভেতরে প্রবেশ করতেই আশালতা তাকে বিছানার পাশের চেয়ার বসতে আহ্বান জানায়। চেয়ারে বসতে বসতে কাব্য বলে ওঠে,
-একটু বসবেন আপনি? কিছু কথা ছিল আপনার সাথে।
আশালতা বিছানার একপাশে বসে বলে ওঠে,
-কি বলবেন বলুন?
-আমার মা আপনাকে খুব পছন্দ করেছে। আমি দুদিন ধরেই আপনাকে নিয়ে ভাবছিলাম। আমার মা কেন হঠাৎ আপনাকে পছন্দ করল! কি এমন বিশেষত্ব খুজে পেল! আজকে যখন প্রথম নজরেই আপনার ওই ভ্রমর কালো চোখের দিকে দৃষ্টি স্থাপন করলাম সেই মুহূর্তেই আমার মায়ের পছন্দের প্রতি আমার বিশ্বাসটা আরও দুই গুণ বেড়ে গেল। কেন যেন এবার আমারও মনে হলো, প্রথমবার ঠ*কেছি নিয়তিতে ছিল তাই কিন্তু আপনাকে আমার চোখ বুজে বিশ্বাস করতে মন চাইছে। আমার অতীতের চেয়েও আপনার অতীত অতি ভ*য়া*বহ। কিন্তু দুজনেই প্রথমবারে ঠ*কেছি । আমার মাঝে আন্ডার্স্ট্যান্ডিং টাও সুন্দর হবে যদি আমরা একত্র হই। কিন্তু আপনি ঠিক কি কারণে বিয়েতে রাজি না। একটু বলবেন? (কাব্য)
-একজন সামান্য কর্মচারী কিভাবে মালিকের ছেলের বউ হয় বলুন তো? আপনার মতো এমন সুদর্শন পুরুষের স্ত্রী হবার যোগ্যতা আমার মতো কালো মেয়ের নেই। থাকুক আপনার হাজারো কালো অতীত। আমার সুখের চেয়েও আমার সন্তানের ভবিষ্যৎ বেশি গুরুত্বপূর্ণ আমার কাছে। যার ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করেই আমি বাড়ি ছেড়েছি সেটা না করি যদি আমি নিজের সুখের কথা ভাবি তবে একজন মা হওয়ার সার্থকতা কোথায়? পারব না আমি স্বা*র্থ*প*র হতে। পারবা না নিজের সন্তানের ভার অন্যের ওপর ছেড়ে দিতে।

আশালতার কথায় হোহো করে হেসে ওঠে কাব্য।
-আপনি ধনী-গরিবের মাঝের বৈশিষ্ট্য খুজছেন এখানে? একজন কর্মচারীর কি দো*ষ যে সে একজন ধনী ঘরের বউ হতে পারবেনা? ধনী আর গরিবের মাঝে বৈ*ষম্য কারা তৈরি করে জানেন? একদল নিচু মানসিকতার মানুষেরা। এরা পজেটিভ এংগেলে কিছু ভাবতেই পারেনা। এদের জন্যই সমাজ রসা*তলে যাচ্ছে। জানেন আমার মাধ্যমিক পরীক্ষার সময় না ঘরে বিদ্যুৎ ছিলনা। আব্বু ছিল একটা ফ্যাক্টরির কর্মচারী। ঠিকমতো বিদ্যুৎ বিল দিতে না পারায় লাইন কেটে দেওয়া হয়েছিল। সেবার মায়ের হৃদ*রো*গ ধরা পড়ায় আব্বুর বেতনের সব টাকাই প্রায় আম্মুর চিকিৎসায় চলে গিয়েছিল। মাসের শেষে ঘরে চাল,তরকারিও যায় যায় ছিল। কখনো কখনো নুন ভাত খেয়ে পরীক্ষা দিতে গিয়েছি তো কখনো খালি পেটে। আমার শখ বলতে কিছু ছিল না। আমার বন্ধুরা সাইকেল চালিয়ে যেখানে সারা মহল্লা ঘুরে বেড়াতো আমি তখন চুপচাপ অ*শান্ত মনকে শান্ত করতে ব্যস্ত থাকতাম। আমার আব্বু দুটো শার্ট আর দুটো লুঙ্গি দিয়ে বছর পার করতো। আমার আম্মুর শাড়ি প*চে ছি*ড়ে গেলেও কখনো মুখ খুলে আব্বুর কাছে আবদার করতো না আমার এটা লাগবে ওটা লাগবে। বহুত পরিশ্রম করে আজ আমার আব্বু এখানে এসেছে। আর তাকে সবচেয়ে বেশি অনুপ্রেরণা দিয়ে এই পর্যন্ত টিকে থাকতে সাহায্য করেছে আমার আম্মু। আমি ছোট একটা চাকরি করি এখন। বাইরে থেকে মানুষকে দেখে বিচার করা ঠিক না। আমি খুব কষ্ট করে মানুষ হয়েছি। আমরা আর পাচ দশটা মানুষের মতোই সাধারণভাবে জীবন-যাপন করি। আমার আব্বু টাকা জমিয়ে প্রথমে বাসার আসবাবপত্র না কিনে আগে এই গলির সব বাড়িগুলো করেছিল যেন অসহায় মানুষগুলো আমাদের মতো আর না ভো*গে। আব্বু চেয়েছিল ফ্যাক্টরির কর্মচারীরা বিনা পয়সায় এখানে থাকুক কিন্তু ওইযে সকলেরই যে নিজ নিজ একটা আত্মসম্মান বোধ আছে! তাই আব্বু ভাড়া অর্ধেকে নামিয়ে রেখেছে। ধন-সম্পদ আর রূপ দুটোই স্বল্পকালীন সময়ের জন্য বিরাজ করে। নিজেকে যে কঠিন পরিশ্রম করে প্রতিষ্ঠিত করে সে অন্যকে কখনো নিচু করে দেখেনা মিস আশালতা। সমাজ আপনাকে আমাকে দুঃসময়ে খেতেও দেবেনা আর পরতেও দেবেনা। সেই নিজেরটা নিজেকেই জোগাড় করে নিতে হহবে। তবে কেন ভয়ে কু*ক*ড়িয়ে যাই আমরা? আপনার সন্তান কখনো অবহেলা পাবেনা আমার থেকে। (কাব্য)

নির্বাক হয়ে কাব্যের কথাগুলো শুনে যায় আশালতা। কিছুক্ষণ নিশ্চুপ থেকে কাব্যের উদ্দেশ্যে বলে ওঠে,
-দুঃ*খিত মিঃ কাব্য। আমাকে ক্ষমা করবেন । এই বিয়ে আমি করতে পারব না। আমাকে আর দ্বিতীয়বার এই কথা বলা হলে ফ্যাক্টরিতেও আর কখনো যাওয়া আমার দ্বারা সম্ভব হবেনা। একবার ঠ*কে এসে দ্বিতীয়বার কাউকে বিশ্বাস করা আমার জন্য বড্ড ক*ষ্টের। এই অভা*গী সবার অপ্রিয় আশালতা কারো প্রিয় হওয়ার যোগ্যই না।
কথাগুলো বলেই আশালতা বসা থেকে উঠে গিয়ে পুনরায় জানালার কাছে গিয়ে দাঁড়ায়। কাব্য কিছুক্ষণ আশালতার দিকে এক ধ্যানে তাকিয়ে থেকে চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়ায়।
-কে কার যোগ্য তা সৃষ্টিকর্তা ছাড়া কেউ বলতে পারেনা মিস. আশালতা।
কথাটা বলেই হনহন করে শোয়ার ঘর হতে বেরিয়ে যায় কাব্য। বড় একটা দীর্ঘশ্বাস টেনে নিয়ে পুনরায় জানালার বাইরে দৃষ্টি স্থাপন করে আশালতা।

রাতে মায়ের কোলে মাথা রেখে শান্ত স্বরে হাফসা বেগমের উদ্দেশ্যে আশালতা বলে ওঠে,
-মা আমি কি ভুল কিছু করেছি?
-একদম না মা। তবে কাব্যর পরিবারটা খা*রা*প না মা। (হাফসা বেগম)
-হুম মা। এই সমাজে যেমন অ*মা*নু*ষ সাদের পরিবারের মতো পরিবার আছে তেমনি মিঃ কাব্যর পরিবারের মতোও পরিবার রয়েছে। একজন পুরুষের কর্মের ওপর নির্ভর করে কখনোই অন্য পুরুষকে বিচার করা উচিত না তা কাব্য আজ আমাকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে গেছে মা। তবে কি বলো তো? প্রথমবার ঠ*কে এসে দ্বিতীয়বার আর কাউকে বিশ্বাস করতে ইচ্ছা করেনা। আমার সন্তানের ভবিষ্যত আমি অন্য কারো ওপর ছাড়তে পারিনা মা। আমাকে যে অনেক ল*ড়া*ই করতে হবে। এক্ষেত্রে কারো মায়া-দয়া যে আমার একদম চাইনা মা। একদিন এই সকলের অপ্রিয় আশালতা নিজেকে সমাজের বুকে প্রতিষ্ঠিত ও সম্মানিত একজন নারী হিসেবে তুলে ধরবে। আমাকে দেখে যেন আরও দশটা মেয়ে সং*গ্রাম করার অনুপ্রেরণা পায় আমি নিজেকে এমন ভাবেই গড়ে তুলতে চাই মা। আর তাই তোমাকে একমাত্র আমার পাশে চাই। আর বাকিটা আল্লাহ ভরসা। (আশালতা)

মেয়ের কপালে চুমু এঁকে দিয়ে হাফসা বেগম বলে ওঠেন,
-তোর মা সবসময় তোর পাশেই আছে।


-মা কি ব্যাপার ? আজ কতগুলো মাস হয়ে গেল তুমি এখনো ডিভোর্স পেপার আমাকে দিলে না? এখনো সই করেনি আশা? (সাদ)
-বাবা সই তো করেছে। আশা নাকি ওদের বাড়ি ছেড়ে কোথায় চলে গেছে। তুই চিন্তা করিস না কিছুদিনের মাঝেই ওরা ডিভোর্স পেপার পাঠিয়ে দেবে বলে জানিয়েছে। (সাজেদা বেগম)
-দেখো কোনো তালবা*হানা যেন না জুড়ে বসে ওরা। ডিভোর্স পেপার হাতে পাওয়ার পরে আর ওদের সাথে কন্টাক করবানা। (সাদ)
-আচ্ছা বাবা। (সাজেদা বেগম)
মা ছেলের কথা শুনে লিনার শরীরে আ*গু*ন জ্ব*লে ওঠে। উদ্দেশ্য হাসিল না হওয়া পর্যন্ত সে না পারছে কিছু বলতে আর না পারছে কিছু করতে। হঠাৎ সদর দরজা হতে ড্রইং রুমে কা*ন্না কা*ন্না করতে করতে প্রবেশ করে সাদের ছোট বোন। সকলে চিন্তিত ভঙ্গিতে উঠে এগিয়ে যায় তার দিকে।
-কিরে তুই হঠাৎ চলে এলি? আর কা*ন্না করছিস কেন? (সাজেদা বেগম)
সাজেদা বেগমের আদরের ছোট মেয়ে তার বু*কে ঝা*পি*য়ে পড়ে কা*ন্নামিশ্রিত স্বরে বলে ওঠে,
-মা আমার সব শেষ। আমার সংসার ত*চ*ন*চ হয়ে গেল মা।

চলবে…

আফিয়া অন্ত্রীশা

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here