অপ্রিয় আশালতা পর্ব ১২

0
908

#অপ্রিয়_আশালতা (১২)
-মিস. আশালতা উঠে আসুন। (কাব্য)
আশালতা ঠায় রাস্তার ওপর বসে কাব্যের দিকেই তাকিয়ে আছে। জিন্সের পকেট থেকে টিসু বের করে মুখ মুছে নেয় কাব্য।
-কি হলো উঠুন বলছি! (কাব্য)
ছে*ড়া জুতাটা রেখে উঠে দাঁড়ায় আশালতা। কাব্য পকেট থেকে আরেকটা টিসু বের করে আশালতার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলে ওঠে,
-মুখটা মুছে নিন ধরুন।
আশালতা ফ্যালফ্যাল চোখে কাব্যের দিকে চেয়ে থাকে। কাব্য পুনরায় বলে ওঠে,
-কি হলো নিন!
আশালতা কাঁপা হাতে টিসুটা নিয়ে মুখ মুছে নেয়।
-মিস. আশালতা বা চোখের কাজল লেপ্টে ছড়িয়ে গেছে মুছে নিন। (কাব্য)
আশালতা কাব্যের অনুসরণ করে বা চোখটা টিসু দিয়ে মুছে নেয়। কিন্ত সঠিক জায়গাটায় আর টিসু পৌছায়নি। কাব্য মুচকি হাসে। আশালতার বা চোখের যেখানটায় কাজল লেপ্টে আছে কাব্য নিজের বা চোখের সেই জায়গাটায় হাত দিতে আশালতাকে অনুসরণ করার জন্য নিরব নির্দেশনা দেয়। এবারও যখন আশালতা ব্য*র্থ তখন কাব্য পকেট থেকে এন্ড্রোয়েড ফোনটা বের করে সেলফি ক্যামেরা তাক করে ধরে আশালতার মুখ বরাবর। ল্যাপ্টানো কাজলটুকু মুছে নিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে ফের ছেড়া জুতার দিকে নজর দেয় আশালতা। কিভাবে সে এই ছেড়া জুতা পরে অতটা পথ হেঁটে যাবে। রিকশায় উঠলে ঠিক কতগুলো টাকা অতিরিক্ত খরচ হবে। এমনিতেই মাত্র তিনজনের সংসার চালাতেই তার হিমশিম খেতে হয়। তাছাড়া সেতো টাকার পার্সটা নিয়েও বের হয়নি। কাদো কাদো মুখ করেই জুতার দিকে তাকিয়ে থাকে আশালতা। কাব্য ব্যাপারটা বুঝতে পেরে মৃদু হাসে। আশালতার পাশে গিয়ে নিজের পায়ের স্লিপারটা খুলে আশার দিকে এগিয়ে দেয়। অবাক হয়ে আশালতা বলে ওঠে,
-একি আপনার জুতা কেন আমাকে দিচ্ছেন?
-চুপচাপ এটা পরে নিন। রোদের যে তাপ রাস্তার ওপর পড়ছে পায়ের পাতা পু*ড়ে যাবে। (কাব্য)
-তা আপনার পায়ের পাতা পু*ড়*বে না মিঃ কাব্য? (আশালতা)
-আমার কিছুই হবেনা। মেয়েদের পায়ের পাতা নরম হয় বেশি। আর আমার মায়াবতী ক*ষ্ট পাক আমি চাইনা। (কাব্য)
কাব্যের এহেন কথায় ভ্রু কুচকে আসে আশালতার। ছেলেটা কাকে উদ্দেশ্য করে এই শেষের বুলিটুকু ছুড়*লো!
-ভাবনা শেষ হলে স্লিপারটা পরুন। তা যাচ্ছিলেন কোথায়? (কাব্য)
কাব্যের ইয়া বড় স্লিপার আশালতার তার ছোট্ট পা জোড়ায় এটে নিয়ে বলে ওঠে,
-টিউশন পড়াতে যাচ্ছিলাম। (আশালতা)
-কবে থেকে শুরু করেছেন? আর কোথায়? (কাব্য)
আশালতা সকল কিছু খুলে বলতেই কাব্য বলে ওঠে,
-ওহ তাহলে তো আপনার পৌছাতে দেরি হয়ে যাবে। চলুন আপনাকে রিকশায় উঠিয়ে দেই।
আশালতা আমতা আমতা করে বলতে আরম্ভ করে,
-না না। আমার রিকশা প্রয়োজন নেই। হেঁটেই চলে যাব আমি। আপনি তো আপনার জুতা জোড়া আমাকে দিলেন। তাই আপনি বরং দ্রুত একটা রিকশা করে বাসায় চলে যান।
কাব্য কিছুটা আঁচ করে উঠতে সক্ষম হয়। ফুরফুরে মেজাজ বজায় রেখেই বলে ওঠে,
-আচ্ছা যাব একটু পরে। আমার একটু কাজ আছে সামনে। চলুন একসাথেই হেটে যাই। (কাব্য)
আশালতা জবাবে কিছু না বলেই চুপচাপ কাব্যের সাথে পা মিলিয়ে হাটা শুরু করে দেয়। একটা বিষয় নিজের কাছে বেশ বি*ব্র*তকর লাগছে আশালতার। কাব্যকে এই উত্তপ্ত রাস্তার ওপরে খালি পায়ে হাটতে দেখে প্রচন্ড খারাপ লাগছে নিজের কাছেই। এই লোককে এটা নিয়ে কিছু বলতে গেলেই হয়তো বেশ একটা ধ*ম*ক দিয়ে বসবে তাকে।
-ওহে মায়াবতী তোমাকে কাজল ল্যা*প্টা*নো চোখে অমন চিত্তাকর্ষক না লাগলেও পারতো! এই সৌন্দর্যকে আমি ঠিক কি উপমা দেই বলতে পারো! তুমি কি জানো? একজন পুরুষের কাছে তার প্রিয়তমা পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ সুন্দরী নারী হিসেবে গণ্য হয়। পুরুষের চোখে যদি তার প্রিয়তমার চেয়ে অন্য নারীদের অধিক মোহনীয় মনে হয় তবে সে নারী তার কেমন প্রিয়তমা? “প্রিয়তমা” শব্দটার মধ্যেই তো সহস্রাধিক সৌন্দর্য লুকায়িত থাকে।
ধীর পায়ে হাটতে হাটতে কাব্য আকাশের দিকে চোখ বুজে কথাগুলো বলে ওঠে আনমনে। আশালতা দাঁড়িয়ে যায়। থমকে যায় কাব্যের কথাগুলো শুনে। “কাব্য কি বলছে এসব?” মাথা ঝিম ধরে যায় কাব্যের। কিছু মুহূর্ত পরেই কাব্যের কন্ঠ কর্ণগোচর হতেই হুশ ফেরে আশালতার।
-এই মামা যাবেন? (কাব্য)
কাব্যের ডাকে একটা রিকশা তাদের সামনে এসে দাঁড়ায়।
-এইযে ভাবনা বাদ দিয়ে রিকশায় উঠে পড়ুন জলদি। কথা বাড়াতে আসলে কিন্তু আমার চেয়ে খা*রাপ কেউ হবেনা। বেশ ধ*মকে সুরেই কথাগুলো বলে কাব্য।
আশালতা দ্রুত পায়ে রিকশায় উঠে বসেই খিচে দম বন্ধ করে নেয়। প্রতিজ্ঞা করে রিকশা চলা শুরু করা হওয়া না অব্দি দম সে ফেলবেনা। কোনো মতেই না।
কাব্য রিকশাওয়ালাকে ঠিকানা বলে ভাড়া মিটিয়ে দেয়। রিকশা চলা শুরু হতেই আশালতা দম ফেলে। পেছন থেকে কাব্যের উৎফুল্লতায় ভরা কন্ঠ কানে বাজছে আশালতার। “মামা সাবধানে চালাবেন রিকশা। আমার জ*টিল মূল্যবান জিনিসটা কিন্তু আপনার ভরসায় ছেড়ে দিলাম।“
আশালতা পেছনে কিছুতেই তাকাবেনা তাকাবেনা করে এক প্রকার মনের সাথে যু*দ্ধ করেই রিকশা হতে পেছনে মুখ বাড়িয়ে দেখে কাব্য এখনো রিকশার দিকেই তাকিয়ে আছে। হঠাত মনে পড়ে তার জুতা জোড়া যে সে রাস্তাতেই ফেলে এসেছে। রিকশা ঘুরিয়ে যাওয়ারও তো সুযোগ নেই। অগত্যা ভাবনাকে দূরে ঠে*লে দিয়ে সামনে দৃষ্টি স্থাপন করে মনকে তরতাজা করে নেয় আশা।

ঘড়ির কাটা যখন তিনটা ছুই ছুই তখনই একরাশ ক্লান্তি নিয়ে বাসায় ফেরে আশালতা। জুতা খুলতে নিতেই ফিক করে হেসে ফেলে আশালতা। নিজের পায়ের চেয়েও অধিক বড় স্লিপার পরে সে এত পথ হেটে এসেছে। তাও কিনা পুরুষদের স্লিপার! এর মাঝেই হাফসা বেগম তার ছোট্ট নাতিকে নিয়ে দরজার সামনে এসে দাড়ান,
-কিরে তুই এভাবে একা একা হাসছিস কেন?
এর মাঝেই আশালতা কাব্যর জুতাটা একটা কাপড়ে শপিং ব্যাগে ঢুকিয়ে এক কর্ণারে রেখে দিয়েছে।
-না মা কিছু না। এমনিই হাসছিলাম। দেখি আমার বাবাটাকে দেখি! কতক্ষণ দেখিনা আমার বাবাটাকে। কেদেছে কি? বলতে বলতে আদরের ছেলের দিকে এগিয়ে যায় আশালতা।
-এই একদম আগে ছুবি না। হাত মুখ ভালো করে সাবান পানি দিয়ে ধুয়ে এসে তারপর কোলে নিবি। আর আমার পাখিটা এতো শান্ত আর বুদ্ধিমান! সব বোঝে। বুঝেছে মা বাইরে কাজে গেছে তাকে তো শান্ত থাকতে হবে। একবারও কাদেনি। ঘুম থেকে উঠেই ফ্যালফ্যাল করে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে ছিল। (হাফসা বেগম)
-ওরেহ আমার বাবা এতো বোঝে। দাড়াও বাবা আমি হাত-মুখ ধুয়ে আসি। বলেই বাথরুমের দিকে ছুট লাগায় আশালতা।
বাথরুম থেকে এসেই ছেলেকে কোলে নিয়ে মুখের সবখানে আদর দিয়ে ভরিয়ে দেয় আশালতা। বুকের সাথে মিশিয়ে নিয়ে চোখ বন্ধ করে বসে থাকে। মায়েদের মন বলে কথা! এক মুহূর্তের জন্য সন্তান চোখের আড়াল হলেই মন আনচান করে তাদের।
-ওমনভাবে জড়িয়ে ধরিস না মেয়ে। ব্যথা পাবে তো বাচ্চাটা। (হাফসা বেগম)
-মনে শান্তি প্রবেশ করতে দাও মা। মন তো চাচ্ছে একদম বুকের ভেতরে ঢুকিয়ে ফেলি। এমন কেন মনে হয় মা? এক পলক ছেলেটাকে না দেখলে কেন মন এত আকুপাকু করে? তোমারও কি এমন হয় ভাইজানদের জন্য? (আশালতা)
হাফস বেগমের মনটা হুট করে খা*রাপ হয়ে যায়। কতকাল ছেলেটাকে দেখে না সে! দুটো ছেলেই বাহির থেকে এসে ভাতের থালা নিয়ে তার কাছে চলে আসতো তার হাতে খাওয়ার জন্য। চোখ ছলছল করে ওঠে হাফসা বেগমের। আশালতার জন্য খাবার আনতে যাওয়ার বাহানা দিয়ে শোয়ারঘর হতে বেরিয়ে যায় হাফসা বেগম। আশালতা তার মায়ের মনের অবস্থা বেশ উপলব্ধি করতে পারছে। কিন্তু এই মুহূর্তে যে তার করার মতো কিছুই নেই।

আশালতার এক সময় স্বপ্ন ছিল সে একজন ফ্যাশন ডিজাইনার হবে। কিন্তু পরিস্থিতি যে তার সব স্বপ্নকে মাটি চা*পা দিয়ে দিয়েছে। খোজ খবর নিয়ে একটা হাতের কাজের ট্রেইনিং সেন্টারে ভর্তি হয়ে যায় আশালতা। এই মাস শেষেই একমাসের ট্রেইনিং শুরু হবে। নিলুফাও বেশ জোর করছে এই মাস শেষ হতেই আবার ফ্যাক্টরিতে যাওয়ার জন্য। আশালতা বেশ বুঝতে পারছে সময় নিয়ে খুব তালগোলে পড়ে চলেছে সে।
মাসের আজ একত্রিশ তারিখ। যে বাচ্চাটাকে সে পড়ায় তার মা আজ হুট করেই পড়ানো শেষে বেরিয়ে আসার সময় আশালতার হাতের মাঝে একখানা কাগজের খাম গুজে দেয়। বাইরে এসে খুলে দেখেই চোখ খুশিতে চকচক করে ওঠে আশালতার। প্রথম মাসের বেতন মাস শেষ হওয়ার আগে পেয়েই ছাত্রীর মায়ের প্রতি মনে মনে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে আশালতা। আজ বেশ ফুরুফুরে মেজাজেই বাড়িতে ফিরছে আশালতা। হঠাত চোখ আটকে যায় সেই জায়গায়টাতেই যেখানে কিছুদিন আগেই তার জুতা ছি*ড়ে গিয়েছিল। আজও সেখানে কাব্য হাসি মুখ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আশালতা কাব্যের জুতা জোড়া ফেরত দেওয়ার জন্য কতদিন খুজেছে তাকে। রোজ ভ্যানিটি ব্যাগে জুতা জোড়া নিয়ে বের হয়। যদি একবার কাব্য সামনে বেধে যায়! আশালতা কাব্যের দিকে এগিয়ে যায়।

-এই ভর দুপুরে এখানে দাঁড়িয়ে কি করছেন? (আশালতা)
– এক মায়াবতীর অপেক্ষা করছিলাম। (কাব্য)
কাব্যের কথা তার দিকে তীব্র দৃষ্টি স্থাপন করে আশালতা। ভ্যানিটি ব্যাগ হতে কাব্যের জুতার ব্যাগটা বের করে কাব্যের দিকে বাড়িয়ে দেয়।
-ভালোই হলো আপনাকে আজ পেলাম। অনেক ঘুরছিলাম এটা নিয়ে। আন্টি কেমন আছে? (আশালতা)
-ভালোই আছে। আচ্ছা শুনুন এই শপিং ব্যাগটা নিন। বাসায় গিয়ে খুলে দেখবেন। নিতে অস্বীকার করবেন না। আপনারই একটা জিনিস রয়েছে এতে। আসছি তবে।
কথাটা বলেই আশালতার হাতে শপিং ব্যাগটা ধরিয়ে দেয় কাব্য। তারপর ধীর পায়ে হেলতে দুলতে সোজা রাস্তা ধরে হাটতে শুরু করে।

বাসায় এসেই প্রথমে কাব্যের দেয়া ব্যাগটা খোলে আশালতা। ব্যাগ থেকে এক জোড়া জুতা বের করে আশালতা। আরে এটা তো তারই সেই ছেড়া জুতো জোড়া! কিন্তু এতে যে এতে বেশ পরিবর্তন লক্ষ্য করছে আসালতা। ছেড়া ফিতাটাকে সুন্দর করে সেলাই করে তার ওপর বড় বড় ফুলের স্টোন বসিয়ে দেওয়া হয়েছে। অপর একখানা জুতোটাতেও ঠিক একইভাবেই ফুলের স্টোন বসিয়ে দেওয়া হয়েছে। ক্ষ*য়ে যাওয়া ও ছে*ড়া সেই জুতোতে কিছু পরিবর্তন আনাতে কতটা সুন্দর লাগছে দেখতে? অবাক হয়ে জুতা জোড়ার দিকে তাকিয়ে থাকে আশালতা। পুনরায় ব্যাগের মধ্যে হাত দিতেই একখানা ভাজ করা চিরকুট পায় সে। খুলেই পড়া আরম্ভ করে আশালতা,
“আপনার আত্মসম্মানবোধ প্রখর আমি জানি। তাই কিছু উপহার স্বরূপ দিতেও আমার ভয় হয়। দেখেছেন জুতা জোড়া এখন কত সুন্দর লাগছে? একবার ছিড়ে যাওয়া বা ভেঙ্গে যাওয়া জিনিস আমরা আর পরবর্তীতে ব্যবহার করিনা,ফেলে দেই। কিন্তু আমরা যদি জিনিসটাকে একটু নতুন কিছু ব্যবহার করে মেরামত করি তবে তা পূর্বের চেয়ে অধিক সৌন্দর্যতায় ভরে ওঠে। জীবনটাও ঠিক এমন। ব্যর্থতাকেই আমরা হার হিসেবে মেনে নেই। আর দ্বিতীবার ঘুরে দাড়ানোর চেষ্টা করিনা। কিন্তু একবার যদি নতুন করে নতুন প্রদক্ষেপ গ্রহণ করে আমরা জীবনটাকে সুন্দর করে পুনরায় সাজিয়ে তোলার চেষ্টা করি তবে আমরা সফল হবোই। জীবনে আবার পুনরায় সুখ ফিরে আসবেই।আমাকে কি একটা সুযোগ দেয়া যায়না? এতই কি খা*রাপ মনে আমাকে? মিস. আশালতা আপনি কি জানেন? আপনি ঠিক কতটা প্রিয় আমার?

চলবে…

আফিয়া অন্ত্রীশা

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here