অন্যরকম বসন্ত – ৪(শেষ পর্ব)

0
3918

অন্যরকম বসন্ত – ৪(শেষ পর্ব)
অলিন্দ্রিয়া রুহি

বিকেল বেলা সাদিক ভাই নিজে থেকে বললেন, রিতিকে নিয়ে একটু এদিক ওদিক হেঁটে আসবেন। রিতিদের এলাকায় একটা ঝিল রয়েছে। একসময় সেই ঝিল ভীষণ বড় থাকলেও এখন তা ক্ষুদে..জায়গায় জায়গায় ডোবা-নালা। ময়লার স্তুপ ফেলে ভরাট করা হচ্ছে। তবুও ঝিলের সৌন্দর্য যেন এতটুকু কমেনি। যেটুকু পানি আছে,তাই ঝকঝকে সবুজ..শ্যাওলা পানি লাগলেও আদতে কোনো শ্যাওলা নেই। তবুও পানি এরকম অদ্ভুত সবুজ কী করে হয়,সেটা একটা প্রশ্ন এবং এই প্রশ্নের উত্তর রিতি জানে না।
সাধারণত বিকেলের সময়টা ঘুমিয়েই কাটায় রিতি। বিয়ের আগ অবধি এটাই তার রুটিন ছিল। আজকেও ঘুমানোর প্রস্তুতি নিচ্ছিলো সে,ঠিক তখনি সাদিক ভাই এসে বেড়াতে যাবার কথা বললেন। আসার পথে ফুচকা খাইয়ে নিয়ে আসবেন জানালেন। অবিশ্বাস্য হলেও, রিতির ফুচকা এত একটা পছন্দ না। কিন্তু বেচারা এত আশা নিয়ে গদগদ ভাবে বলল যে রিতির সেই আশা ভঙ্গ করতে ইচ্ছে করল না। আজকাল অনেক কিছুই তার মনের বিপরীতে ঘটছে। অসুখটা আসলে হয়েছে কোথায়! রিতি জানে আবার জানে না… সে হিসেব কষা বন্ধ করে ঝটপট তৈরি হয়ে নিলো। তবে বেরোনোর আগে একটা শর্ত দিলো, রাস্তায় কোনোরকম উল্টোপাল্টা কর্মকাণ্ড করা যাবে না, বলা যাবে না। সাদিক ভাই মাথা পেতে মেনে নিলেন। হাসতে হাসতে জবাবে বললেন, “আমি তো ভেবেছিলাম তুমি আমার সাথে যেতে রাজী হবে না রিতি। কারণ আমি তো পাগল.. আমার মাথা নষ্ট। রাজী যে হয়েছো, এই তো অনেক..”
রিতির এত খারাপ লাগল.. সে মনে মনে তক্ষুনি একটা কঠিন সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলল, যত যাই হয়ে যাক, সাদিক ভাইকে সে ছাড়ছে না.. সাদিক ভাই যেমনই হোক, তাকে গড়ে তুলে নিবে রিতি।

আকাশটা সাদামাটা। নীলের চেয়ে সাদা রংটাই আজ যেন বেশি ফুঁটে আছে। তার ভেতর আরো সাদা জুড়ে দিয়েছে মেঘরাশি গুলো। তারা তুলোর ন্যায় ভেসে বেড়াচ্ছে এদিক থেকে সেদিক। রিতি আর সাদিক ভাই বসে আছে একটা বেঞ্চিতে। রিতি পা দোলাতে দোলাতে ঝিলের সবুজ পানি দেখছে। সাদিক ভাই বাদাম খুঁটে খুঁটে খাচ্ছে। রিতি সবুজ পানি থেকে চোখ সরিয়ে সাদিক ভাইয়ের দিকে তাকাল। একটা ভীষণ ঢিলাঢালা পাঞ্জাবি পরে এসেছেন সাদিক ভাই। পাঞ্জাবির উপরের দুটো বোতাম হাট করে খোলা। তা দিয়ে রোমশ বুকের অনেক খানি দেখা যায়। রিতির মাথা ধরে গেল। সে তৎক্ষনাৎ বলে উঠল, “মেয়েদের আকৃষ্ট করবার ভালো বুদ্ধি সাদিক ভাই। ভালো..ভালো..”
কথাটি সে বলল চিবিয়ে চিবিয়ে। তবুও বেআক্কেল সাদিক ভাইয়ের মাথায় ঢুকল না। তিনি বুঝলেনই না রিতি কেন এই কথাটি বলেছে। তিনি তার মতো বাদাম খাওয়া জারী রাখলেন, এবং বললেন, “আমি কাউকে আকৃষ্ট করি না রিতি। সবাই আমার উপর আকৃষ্ট হয়। আমি হলাম গিয়ে মধু। মৌমাছিরা দেখামাত্র ছুটে আসে। আমি কোনো দিকে না তাকিয়েও বলতে পারি,একদম সামনে দুটো মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তারা একদৃষ্টে আমাকে দেখছে।” সাদিক ভাই মুচকি হাসলেন। রিতি সামনে তাকাল এবং দেখল আসলেই দুটো মেয়ে তাকিয়ে আছে সাদিক ভাইয়ের দিকে। তাদের তাকানোর ধরন বলে দিচ্ছে, একজন অন্যজনের কানে গুজুর গুজুর করে বলছে, সাদিক ভাই সুন্দর লোক। রিতির রাগে পিত্তি জ্বলে গেল। সে ফুঁসে উঠে বলল, “আমি যাচ্ছি। ওদের চোখজোড়া তুলে আনবো।”
সাদিক ভাই খপ করে রিতির এক হাত টেনে ধরলেন। ঘাড়টা নিচু রেখেই বললেন, “তোমাকে তো দেখছে না রিতি… আমাকে দেখছে। আমাকে দেখলে তোমার সমস্যা কী?”
“সমস্যা আছে। অবশ্যই আছে। আমার হাজবেন্ডকে তারা দেখবে কেন? হু দ্যে আর?” বলে রিতি চুপ করে গেল। সাদিক ভাই ঠোঁটের কোণ প্রসারিত করে হাসলেন। রিতির লজ্জা লাগল। সে কেমন বড় মুখ করে সাদিক ভাইকে নিজের হাজবেন্ড বলল! ইশ…
রিতি চুপসে বেঞ্চিতে লেগে বসল। সাদিক ভাই একটা বাদাম ছুঁলে রিতির দিকে বাড়িয়ে ধরলেন।
“বাদাম খাও রিতি। বাদাম খেলে মাথার বুদ্ধি বাড়বে।”
“আমার মাথায় বুদ্ধি কম বলছেন?” মিনমিনিয়ে বলল রিতি।
“বুদ্ধি থাকলে তো কম বলব! তোমার মাথায় বুদ্ধিই নেই।”
“কেন?”
“থাকলে ওই মেয়েদের চোখ তুলতে যেতে না। বরং আমাকে ধরে বসতে। তুমি কী জানো না রিতি, মধুর উপর আস্তরণ দিয়ে না রাখলে যতই চেষ্টা করো, মৌমাছিকে দূরে সরিয়ে রাখতে পারবে না। আমি মধু হলে তুমি আমার পর্দা রিতি।”
হুট করে রিতির মন ভালো হয়ে গেল। সাদিক ভাইটা যে কী…! ইনোসেন্ট ভাবে এত এত কথা বলে…রিতির পুরো ভেতরটাই নাড়িয়ে দেয়।
রিতি সাদিক ভাইয়ের দিকে চেপে বসল। একটা হাত ইতস্তত করে সাদিক ভাইয়ের উরুর উপর রাখল। সাদিক ভাই মুচকি হাসলেন। বাদাম ছুঁলতে ছুঁলতেই বললেন, “আরেকটু কাছে আসো রিতি। আমি তোমার হাজবেন্ড। বাঁধা কীসের?”
রিতি সাহস পেল। এবার আরো এগিয়ে এসে সাদিক ভাইয়ের একটা হাত টেনে নিজের হাতের মুঠোয় ভরে নিলো। সাদিক ভাইয়ের কাঁধে মাথা রাখল। সামনে তাকিয়ে দেখল, মেয়ে দুটো নেই। চলে গিয়েছে। রিতি মনে মনে ভাবল, আসলেই সাদিক ভাই মধু, আর সে তাকে ঘিরে থাকবে। যেন কোনো পোকামাকড় মুখ না দিতে পারে।

সারাটা বিকেল বাদাম খেতে খেতে গুটুর গুটুর করে গল্প করল দু’জনে। যেই রিতির বাদামের গন্ধে মাথা ধরে যেতো, সেই রিতি আজ অনেক আনন্দের সঙ্গে বাদাম খেল। এর কারণ কী? সঙ্গে সাদিক ভাই ছিল বলে? রিতি জানে না, শুধু এইটুকু জানে,সে একটা বসন্তের খোঁজ পাচ্ছে। এই শীত পেরোলেই সেই বসন্তটা আসবে। প্রকৃতি যেভাবে নতুন রূপে সেজে ওঠে, সেভাবে সেও সেজে উঠবে এইবার। এই বসন্ত অন্যরকম, এর সাথে অন্য বসন্তের তুলনা চলে না।

সূর্যটা নিভে যাচ্ছে একটু একটু করে। আলো ফুরিয়ে কুয়াশা মাখানো আঁধারে ডুবে যাবে চারিপাশ। সাদিক ভাই বললেন, “চলো রিতি, ফুচকা খেয়ে আসি।”
রিতি ‘না’ বলল না। তার বেশ লাগছে এই সময়টা উপভোগ করতে।
ঝিলের পাশ ঘেঁষে একটার পর একটা দোকান বসেছে। কোনোটা খাবারের, কোনোটা শরবতের,কোনোটা টুকিটাকি কেনাকাটার। জমজমাট ব্যবসা হয় প্রতিদিন। একটা ফুচকার দোকানে চেয়ার খালি থাকায় সেটায় গিয়ে বসল দু’জনে। ফুচকার অর্ডার দিয়ে রিতিকে বসিয়ে রেখে সাদিক ভাই কই যেন গেলেন। ফুচকা চলে এলো, সাদিক ভাই এলেন না। রিতি অপেক্ষা করল। করতে করতে ঘন্টা পেরিয়ে গেল। আযান দিয়ে দিলো। সূর্য ডুবে গেল। ফর্সা আকাশ কালো হয়ে গেল। টাটকা ফুচকা নেতিয়ে গেল। অথচ সাদিক ভাইয়ের আর দেখা মিললো না। রিতি হাপুস নয়নে কেঁদেকেটে একা একা বাড়ি ফিরলো। ভাগ্যিস শুধু পার্সটা নিয়ে এসেছিল সে। নইলে ফুচকার বিল মেটাতো কেমন করে!

নাকের পাটা ফুলে ঢোল হয়ে গেল রিতির। এই মানুষটার ইনোসেন্ট কর্মকান্ডে বারবার কেন ভুলে যায় এ একটা চূড়ান্ত পাগল! এর কাজ অন্যের মাথাও নষ্ট করে দেওয়া। কেউ কাউকে বসিয়ে রেখে এভাবে উধাও হয়ে যেতে পারে! তাও নিজের স্ত্রী কে? রিতির যতটা রাগ সাদিক ভাইয়ের উপর লাগল, তারচেয়ে বেশি লাগল নিজের উপর। সেও কী সুন্দর সাদিক ভাইয়ের গদগদ কথায় ভুলে গিয়ে “অন্যরকম বসন্তের” সন্ধান করছিল! নাহ.. এই লোক শুধরানোর নয়। এর সঙ্গে কোনোমতেই থাকা যায় না। সাদিক ভাই বাসায়ও আসেননি। তা নিয়ে আর মাথাব্যথা করল না রিতি। সে সোজা তার শ্বশুর মশাইয়ের কাছে গেল। গিয়ে বলল, “আমি আপনাকে কিছু বলতে চাই আংকেল।”
শফিক সাহেব অনুমতি দিলে রিতি কঠিন গলায় বলল, “আমার দ্বারা এসব সহ্য করা সম্ভব হচ্ছে না আংকেল। আপনার ছেলে সহজ-সরল হলে ঠিক ছিল, কিন্তু এরকম মাথা নষ্ট হলে কীভাবে কী! তার কর্মকান্ড কোনোকিছুই স্বাভাবিক মানুষের মতো না। আজকে আমাকে বসিয়ে রেখে সে কোথায় যেন গেল। এখন প্রায় দুই ঘন্টা হয়ে গেছে। তার খবর নেই। এটা কোনো ভালো মানুষের কাজ?”
শফিক সাহেব চিন্তায় পড়ে গেলেন। রিতি রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে নিজের ঘরে চলে এলো। ব্যাগ গোছাতে লাগল। আর একমুহূর্ত এই বাড়িতে নয়। সে আজই নিজের বাসায় চলে যাবে।

সাথী রুমে উঁকি দিলো।
“ভাবী..” রুমে ঢুকতে ঢুকতে সাথী অবাক গলায় বলল, “তুমি ব্যাগ গোছাচ্ছো কেন ভাবী? কোথায় যাবে? ও…ভাইয়া হানিমুনের জন্য অফার করেছে বুঝি?” সাথী ঠোঁট টিপে হাসছে। যা রিতির গায়ে আরও আগুন জ্বালিয়ে দিচ্ছে। রিতি খেঁকিয়ে উঠল, “কীসের হানিমুন? আমি আমার বাসায় চলে যাচ্ছি চিরতরে। আর তোমার ভাইয়ার ব্যাপারে আমার কাছে কিচ্ছু বলবে না। আই হেইট হিম..” বলতে বলতে রিতির চোখ দিয়ে পানি বেরিয়ে এলো। সাথী স্তব্ধ।
তার মুখ থেকে হাসি সরে গেছে।
“ভাবী, সরি। কিন্তু কী হইছে? আমাদের প্ল্যান ছিল আজকে তোমাকে ঘুরতে নিয়ে যাওয়ার নাম করে হানিমুনে যাওয়ার জন্য অফার করবে ভাইয়া। কেন? তোমাকে করেনি?”
“প্ল্যান?”
“হুঁ.. যেদিন তোমাকে বিয়ে করে এই বাড়িতে নিয়ে এলো, সেদিন তুমি ঘুমিয়ে যাওয়ার পর সারারাত ভাইয়া ছাদে আমার সঙ্গে ছিল। তোমার জন্য সে কী ফিল করে সেসব আমাকে বলেছে। অনেক উত্তেজিত ছিল ভাইয়া। কিন্তু তুমি ভাইয়াকে পছন্দ করো না, এই নিয়ে একটু টেনশনে ছিল ভাইয়া। এরপর আমিই তাকে বুদ্ধি দিয়েছিলাম, তোমরা ঘুরে আসো দূর থেকে। একত্রে কয়েকটা দিন কাটাও। একজন অন্যজনকে বুঝতে শিখো। ভাইয়াও তাই আজকেই তোমাকে কোথাও নিয়ে যাওয়ার ব্যাপারে অফার করতো। তোমার একটা অনুমতি নেওয়ার ব্যাপার আছে না? আর.. ”
সাথী চুপ করে গেল। রিতি হতভম্ব গলায় বলল, “আর?”
“ইয়ে মানে… এসব সব সিক্রেট ছিল। ভাইয়া আমাকে বলতে মানা করেছে। তাও তোমাকে বলছি। ভাইয়া একটা আংটি কিনে রেখেছে তোমার জন্য। তোমাকে নাটকীয় ভঙ্গিতে আংটি আর গোলাপের তোড়া দিয়ে প্রপোজ করতো। তোমাদের সম্পর্কটা ভাইয়া অন্যরকম ভাবে শুরু করতে চেয়েছিল। ভাইয়া বলে, মানুষ বিয়ের আগে প্রেম করে। আমি বিয়ের পরে প্রেম করব।”

সাথী চলে গেলে রিতি হতভম্ব হয়ে চুপচাপ বসে রইলো বিছানায়। এবার একে একে দুই মেলাতে শুরু করল। তার মানে সে যখন বাসর রাতে কান্নাকাটি করছিল, তখন সাদিক ভাই ঘুমিয়ে না জেগে… তাই সাদিক ভাই বুঝেছে, রিতির তাকে তেমন বিশেষ পছন্দ না। রিতি বারান্দায় গিয়ে ঘুমোলে সাদিক ভাই সাথীর সঙ্গে আলোচনা করতে গেছে এই নিয়ে… আর আজকে রিতিকে বসিয়ে রেখে নিশ্চয়ই বেচারা গোলাপ কিনতে গিয়েছিল। আর রিতি না জেনেশুনে তাকে ফেলে চলে যাওয়ার কথা ভাবছে! কিন্তু গেল তো গেল আর এলো না কেন! এত দেড়িই বা কেন?
রিতির এবার চিন্তা লাগল। সে বিড়বিড় করে বলল, “আপনি কোথায় সাদিক ভাই?”

সময় গড়ালো। রাত ন’টা। শফিক সাহেব বারংবার ফোন করেছেন সাদিক ভাইয়ের নাম্বারে, কিন্তু ফোন বন্ধ পাওয়া যাচ্ছে। রিতির বাবা-মা খবর শুনে ছুটে এসেছে। রিতি মায়ের বুকে মাথা রেখে নিশব্দে কাঁদছে। তার মনটা কু ডাকছে। আশ্চর্য! যেই মেয়েটা গতকাল এমন সময়েও একটা আধপাগলের সঙ্গে বিয়ে হয়ে গেছে বলে কেঁদেকেটে ভাসিয়েছে, সেই মেয়েটা আজ সেই আধপাগলের জন্যেই কাঁদছে! তার দু’চোখ বারবার সাদিক ভাইকে খুঁজছে।
আপনি কোথায় সাদিক ভাই? কেন কষ্ট দিচ্ছেন বেচারা মেয়েটিকে?

দশটার পরে শফিক সাহেব, রিতির বাবাকে সঙ্গে নিয়ে থানায় গেলেন। সেখান থেকে ফিরে আসলেন ভারাক্রান্ত মন নিয়ে। রিতি উন্মুখ হয়ে অপেক্ষা করছিল তার বাবা,শ্বশুরের। তারা আসতেই রিতির প্রশ্নবাণ শুরু হয়ে গেল। কোথায় সাদিক ভাই, কোনো খবর পেয়েছে কীনা ইত্যাদি ইত্যাদি নানান প্রশ্নে শফিক সাহেব শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন। রিতির বাবা মৃদুশ্বাস ফেললেন। নিয়তির উপর কারো হাত নেই!

____________

রিতি চুপ করে সাদিক ভাইয়ের গালে গাল ঠেকিয়ে সাদিক ভাইয়ের গায়ের উপর শুয়ে আছে। তার হাতে এক তোড়া গোলাপ, একটু আগে একজন নার্স এসে এটা দিয়ে গেছে। জানিয়েছে, মৃত্যুর সময় সাদিক ভাইয়ের হাতে এই গোলাপের তোড়াটা ছিল। ডাক্তারদেরও মন আছে, অনুভূতি আছে। তাই গোলাপের তোড়াটিকে যত্ন করে রেখেছে তারা,যেন এই নিষ্পাপ মানুষটির শেষ ইচ্ছাটা পূরণ করতে পারে। গোলাপের তোড়ার মালিকের হাতে এটি যেন পৌঁছোতে পারে।

গোলাপের তোড়া নিয়ে ফেরার পথে একটি বড় ট্রাকের নিচে পড়ে যায় সাদিক ভাই। ট্রাকের দুই চাকার মাঝে তিনি থাকলেও অতিরিক্ত ভয়ে হার্ট অ্যাটাক করে ঘটনাস্থলেই মারা যান তিনি। যারা তাকে বাঁচাতে ছুটে এসেছিল, তাদের মধ্য থেকেই একজোড়া হাত সাদিক ভাইয়ের ফোন চুরি করে পালিয়েছে। এই হলো মানুষের বিবেকবোধ!থানায় গিয়ে সাদিক ভাইয়ের বিষয়ে বলতেই থানা থেকে জানানো হয় এই দুর্ঘটনার কথা। মৃত ব্যক্তির ছবির জায়গায় নিজের ছেলের ছবি দেখেও শফিক সাহেব কী করে নিজেকে সামলে রেখেছেন, তা এক অবাক বিষ্ময়!

রিতির মা এসে ভেতরে ঢুকলেন। মহিলার চোখ মুখ ফুলে গেছে। গতকালই মেয়ে বিদায় করলেন, আর আজ মেয়ের জামাইকে চিরতরে বিদায় দিতে হলো! নিয়তি মাঝে মাঝে এত নিষ্ঠুর কেন হয়!
রিতির দিকে তাকানো যায় না। সামান্য সময়ের ব্যবধানে মেয়েটার চেহারা কী হয়ে গেছে! রিতির মা কান্না সামলালেন।ধরা গলায় বললেন, “বাইরে আয় মা। ওরা লাশ নিয়ে যাবে।”
রিতি সঙ্গে সঙ্গে উত্তর দিলো, “আর একটা মিনিট দাও মা। এরপর আর কোনোদিন তাকে দেখতে পারব না।”
রিতির মা বেরিয়ে গেলেন। রিতি গাল তুললো। সাদিক ভাই ঘুমিয়ে আছেন। তাকে দেখে মনে হয়, ডাকলেই উঠে যাবে। কিন্তু রিতি জানে, সাদিক ভাই কোনোদিন উঠবে না। সাদিক ভাই রিতির স্মৃতিতেই জীবন্ত হয়ে থাকবে আজীবন।

“সাদিক ভাই.. আপনি জেনে খুশি হবেন যে আপনার গোলাপের তোড়া আমি পেয়েছি। কিন্তু আংটিটা পাইনি। ওটা নিশ্চয়ই কেউ চুরি করে নিয়ে গেছে। আংটি পেলে ভালো হতো। আমি আজীবন আঙুলে পরে থাকতাম। মনে হতো, আপনি আমার সঙ্গেই আছেন।”

রিতি ডুকরে কেঁদে ফেলল।

“আমাকে সারপ্রাইজ দিতে চেয়েছিলেন না? কিন্তু এরকম সারপ্রাইজ যে দিবেন,তা ভাবতেও পারিনি। আপনি নিষ্ঠুর সাদিক ভাই। এভাবে একা ফেলে চলে গেলেন। আমার কথা একটুও চিন্তা করলেন না।”

রিতি দম নিলো। তার ভেতরটা দুমড়েমুচড়ে যাচ্ছে।

“আপনাকে একটা কথা বলতে চাই সাদিক ভাই। আপনি জেগে থাকলে এই কথাটা কখনো বলতে পারতাম না। আমার লজ্জা লাগতো। ঘুমিয়ে ভালোই করেছেন। আমি নির্দ্বিধায় কথাটা বলতে পারব। সাদিক ভাই.. আপনাকে আমি ভালোবাসি সাদিক ভাই। খুব ভালোবাসি। আপনার কথা আমার প্রতিদিন মনে পড়বে সাদিক ভাই। কোনোদিন ভুলব না যে আমি সত্যিকারের একজন পাগল পেয়েছিলাম, যে আমাকে ভালোবাসতে গিয়ে নিজের প্রাণটা দিয়ে দিলো! আপনি আবার আসবেন সাদিক ভাই। আমাকে নিয়ে যাবেন। ওপারে একটা সুযোগ চাইবো… আসবেন তো সাদিক ভাই?”

রিতির দু’চোখ বেয়ে টপটপ করে পানি পড়ছে। সে কাঁদতে চাইছে না তবুও কাঁদছে। ভালোবাসা এমনই, কখন কার জন্য কীভাবে হয়ে যায়, তা আমরা কেউ বলতে পারি না!

(সমাপ্ত)
“অন্যরকম বসন্ত” এতদ্রুত শেষ হওয়ায় সবাই অবাক হবেন, আমি জানি। আসলে এটা ফেসবুকে দেওয়ার কোনো প্ল্যান আমার ছিল না। সরাসরি বই করতে চেয়েছিলাম। কেননা সাদিক ভাই আমার অনেক পছন্দের একটি চরিত্র। কিন্তু অনেকেই এই গল্পটি চেয়েছেন, তাই আমি একটা ছোট গল্প দিলাম। যেন বই আনলে সবার একটা ধারণা থাকে এই গল্পের চরিত্র গুলো কেমন কী, এই সম্পর্কে। আর কোনো লম্বা ধারাবাহিক লেখার আগে আমি বেশ কিছুদিন গ্যাপ নিয়ে লিখি। এটা কিন্তু একদম ফট করে শুরু করেছিলাম, কোনো গ্যাপ নেইনি। কারণ এটা ছোট গল্প তাই। নেক্সট গল্প আনবো ৪-৫ দিন পর। একটু গ্যাপ দিতে চাই। গ্যাপ দিলে লেখার প্রতি আগ্রহ বাড়ে আমার। সাদিক ভাইকে কার কেমন লেগেছে জানাতে ভুলবেন না। সাদিক ভাই বিস্তর গল্পে আবার আসবে, তবে সেটা ফেসবুকে নয়.. বইয়ের পাতায়❣️ আসসালামু আলাইকুম সবাইকে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here