অন্যরকম বসন্ত – ৩

0
3107

অন্যরকম বসন্ত – ৩
অলিন্দ্রিয়া রুহি

দুপুর বেলা রিতির বাসা থেকে ওর বাবা,মা খাবার পাঠালো। রিতির বাসা থেকে শ্বশুর বাড়ির দূরত্ব মাত্র মিনিট পাঁচেকের। অনেকদিনের পুরোনো আকলিমা খালা এসে খাবার দিয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে গোপনে ফিসফিস করে রিতির কানে বলল, “আফাগো, আপনে তো বিয়া হইতে না হইতেই পর হইয়া গেছেন। আফনার রুম খালাম্মায় স্টোর রুম বানাইয়া ফেলছে। আসবাবপত্র সব সরাইয়া ফেলছে। আপনার ফছন্দের একটা ক্যাসেট আছিলো না? সেইটা শ্যাষ। খালাম্মায় সক্কালে কটকটি আলা ব্যাডারে দিয়া দিছে। আমি নিজের চোক্ষে দেখছি গো আফা। আমার বড় কান্দুন আহে। একদিন অইলো না, আর আফনের বাড়ির সবাই আফনেরে পর কইরা দিলো। এহন তো সন্দেহ হয়, আফনেরে সম্পত্তি থেইকাও না বাইর কইরা দেয়। আফনের কপালডা বড়ই পোড়াগো আফা..”
রিতি দুপুরে ভাত খেল না। না, সম্পত্তির জন্য চিন্তিত হয়ে না, এই শোকে যে- তাকে এতদ্রুত পর করে দিলো তার বাবা-মা! কী করে সম্ভব! রিতি গোপনে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে ভাবল, তার আর কেউই রইলো না। এই বিরাট পৃথিবীতে রিতি সম্পূর্ণ একা এবং অসহায়… তখন মনের ভেতর বাস করা কে যেন চুপিচুপি বলে গেল, “কে বলেছে তোমার কেউ নেই? আছে তো.. একটা আধপাগল জামাই আছে।” রিতির দীর্ঘশ্বাস এবার আরও গভীর হলো।

রিতি খেল কী খেল না তা নিয়ে সাদিক ভাইয়ের ভেতর বিশেষ মাথাব্যথা দেখা গেল না। তিনি তার মতো খেয়েদেয়ে তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলতে তুলতে বিছানায় এসে শুয়ে পড়লেন। রিতি শোয়াই ছিল, সে একটু চেপে গেল। তার এবার চোখে পানি চলে আসছে। সবাই তাকে সাধাসাধি করে গেল, অথচ সাদিক ভাই একবারও এসে সেধে গেলেন না! লোকটা ঢিলা ব্রেইনের, সেই সঙ্গে সমান নিষ্ঠুর। রিতি আলগোছে চোখে জমা পানি মুছে ফেলল।
সাদিক ভাই অনেকটা হুকুমের গলায় বললেন, “পা-টা ভীষণ ম্যাজম্যাজ করছে রিতি। একটু টিপে দাও না… তোমার আম্মার রান্নার হাত কিন্তু মাশা-আল্লাহ। আহা…কতদিন বাদে এরকম খানা খেলাম!”
রিতি জবাব না দিয়ে অন্য পাশ ঘুরে শুয়ে পড়ল। সাদিক ভাই ভ্রু কুঁচকে তাকালেন। ফের বললেন, “কী ব্যাপার রিতি? কিছু বললাম তো..” উনার কণ্ঠস্বর কঠিন শোনালো। রিতি চমক খেল। বিয়ে হতে না হতেই কঠিন স্বরে আদেশ করছে! সাহস কত! রিতি তেজ নিয়ে ঘুরে তাকাল, তার চেয়েও বেশি তেজী কণ্ঠস্বরে বলল, “পারব না।”
“আমার বন্ধু রাজন। ওর বউটা এত ভালো! রাজন যা বলে তাই করে। উঠতে বললে উঠবে, বসতে বললে বসবে। আমার মনে হয় বাথরুমেও যায় রাজনের অনুমতি নিয়ে। আর তুমি আমার কথা শোনো না! উপরন্তু চোখ রাঙিয়ে কথা বলো। ছি, ছি রিতি.. আংকেল, আন্টি তোমায় এই শিক্ষা দিয়েছেন?”
“খবরদার, আমার আম্মা-আব্বাকে নিয়ে একটা কথাও বলবেন না।”
“বললে হবে টা কী?”
“খুব খারাপ হবে। আপনার চুল সব টেনে ছিঁড়ে ফেলব।”
“বলছি আংকেল, আন্টিকে, তাতে তোমার এত গায়ে লাগছে কেন?”
“আরে আজব তো! আমার বাবা-মাকে তুলে কথা বলবেন আর আমি চুপ থাকব? আল্লাহ কী আমাকে মুখ দেয় নাই?”
“তাহলে তুমি বলতে চাইছো, তোমার বাবা-মাকে তুমি খুব ভালোবাসো। তাই তাদের তুলে আমি কথা বলেছি দেখে তোমার গায়ে লেগেছে?”
“হ্যাঁ..”
সাদিক ভাই শোয়া থেকে উঠে বসলেন। রিতিও বসলো। সাদিক ভাই রিতির চোখে চোখ রেখে ঠান্ডা গলায় বললেন, “অথচ এই বাবা-মায়ের উপর রাগ করেই দুপুরের খাবার খাওনি! তোমার মায়ের হাতের রান্না বলে খাবে না..আবার বলছো তাকে তুমি ভালোবাসো!”
রিতি চুপ করে গেল। এইবার মুখে আর কোনো কথা নেই।
“কী বলো.. জবাব দাও। এখন চুপ কেন?”
রিতি আমতা আমতা করে বলল, “ভালোবাসি বলে কী অভিমান করতে পারব না?”
“পারবে.. কিন্তু অযাচিত অভিমান কেন? আমার সঙ্গে বিয়ে দিয়েছে এইজন্যে?”
রিতি কিছু না বলে শুয়ে পড়ল। তার ভালো লাগছে না কোনোকিছু। পেট টা মোচড় দিচ্ছে। সত্যি বলতে পেটে ছুঁচো দৌঁড়োচ্ছে… কিন্তু অভিমানের পাল্লা এতই ভারী হয়ে আছে যে, নিজেকে শারীরিক, মানসিক দুই ভাবেই কষ্ট দিতে গায়ে বাঁধছে না…
সাদিক ভাই নিঃশব্দে উঠে চলে গেলেন। রিতি অন্য পাশ ফিরে ঠোঁট কামড়ে শুয়ে রইলো। তার চোখ ভেঙে টপটপ করে পানি গড়িয়ে পড়ছে। কার উপর এত রাগ, এত অভিমান, এত জেদ, সে নিজেও এর উত্তর জানে না।

মিনিটের মাথায় সাদিক ভাই আবার ঘরে এলেন। রিতির পেছন দিকে বসে গম্ভীর গলায় ডাকলেন, “রিতি..”
রিতি অস্ফুটস্বরে জবাব দিলো, “হুঁ..”
“দেখি, চোখ মুছে উঠে পড়ো।”
রিতি অবাক হলো। সাদিক ভাই কী করে টের পেল যে সে কাঁদছে!
রিতি সাদিক ভাইয়ের এক বাক্যে চুপচাপ উঠে বসল। তবে চোখ মুছলী না। কেন যেন তার খুব ইচ্ছে করছে, কেউ আদর করে তার চোখ জোড়া মুছিয়ে দিক। এই কেউটা কে? সাদিক ভাই?
রিতি ছলছল চোখে সাদিক ভাইয়ের দিকে তাকাল। সাদিক ভাই ভাত মাখাচ্ছেন। রিতির জন্য ভাতের থালা নিয়ে এসেছেন। এক লোকমা ভাত রিতির মুখের সামনে তুলে ধরলে বাধ্য মেয়ের ন্যায় চুপচাপ খেয়ে নিলো রিতি। একটু একটু করে এই লোকটা রিতির ভেতরে জায়গা করে নিচ্ছে। সেটা রিতিও টের পাচ্ছে। সেও চায়, এই লোকটা মনের সিংহাসনে শক্ত করে জায়গা করে নিক। এই গাছ বলদের সব বলদামিই সইতে রাজী রিতি। এই যে রিতিকে ভাত খাইয়ে দিতে গিয়ে ভাতে,ঝোলে নিজের পাঞ্জাবির হাতা, হাত, কোলের কাছটা রীতিমতো ভরিয়ে ফেলেছে সাদিক ভাই, তাই বিরক্তমুখে বারংবার ‘ইশ..ইশ’ করছে। এই বিরক্তমুখের সাদিক ভাইকে দেখতেও রিতির কাছে ভালো লাগছে। শুধু মাঝ রাতে যদি ওই নিকৃষ্টতম কাজটা করে, তবে সেটাই হচ্ছে মূল সমস্যা। রিতি মনে মনে বলল, “আজ থেকে তৈলাক্ত জাতীয় সকল খাবার আপনার জন্য নিষিদ্ধ করা হলো সাদু সাহেব। হয় ওই দূষিত বাতাস বায়ুতে নির্গমন করা বন্ধ করুন, নইলে আপনার পাছা আমি টেপ দিয়ে আঁটকে দিতে দুইবার ভাববো না…হুহ!”

(চলবে)
[আগামীকাল থেকে রেগুলার দেওয়ার চেষ্টা করব। প্রতিটি পর্ব এরকম ছোট ছোট হবে। আমি খুব ব্যস্ততায় সময় পার করছি।]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here