অন্তর দহন পর্ব ৪

0
533

#অন্তর_দহন
#লেখনিতে_আরুহি_অহি

পর্ব__৪

সকালে নাস্তার টেবিলে বসে বাঁধল আরেক তুলকালাম কাণ্ড।সবাই মিলে শপিং এ যেতে চায়। কিন্তু স্পন্দন যাবে না।সে গো ধরেই বসে আছে।খেতে খেতে রেহান বললো,

__আমাদর পালা শেষ হয়েছে দাদিমা। তোমার বড় নাতিকে রাজি করানো যায় নি। এবার তুমি বলো দাদিমা।

__আমি বলছি আমার দাদুভাই কে।সে আমার কথা রাখবে বলেই আমার বিশ্বাস।কি দাদুভাই রাখবে না?

__দাদিমা প্লিজ এসবের মধ্যে আমাকে জড়িও না। আমার অন্য অনেক গুরুত্বপূর্ণ কাজ আছে এর থেকে।

__সারা দিন কি কাজ করো শুনি স্পন্দন?দেখি তো শুধু টইটই করে ঘুরতে।

বাবার কথায় খাওয়া থামিয়ে দিয়ে স্পন্দন বললো,

__আমি কি করি আর না করি সেটা আপনার না ভাবলেও চলবে মিস্টার সৈয়দ মির্জা। আমার জীবনের তো আর কিছুই বাকি নেই আপনার হস্তক্ষেপে। এবার যেটুকু বাকি আছে সেটুকু অন্তত আমাকে আমার মতো বুঝতে দেন।

__তোমার স্পর্ধা দিন দিন সীমা ছাড়িয়ে যাচ্ছে স্পন্দন। বাবার সাথে কথা বলার নূন্যতম শালিনতা টুকু নেই তোমার মধ্যে। আমি তোমাকে এমন কি বললাম যে তুমি ঠিক এভাবে রিয়াক্ট করছো?

খাওয়া ছেড়ে এবার উঠে দাঁড়িয়ে পড়ল স্পন্দন। একবার মায়ের দিকে তাকিয়ে বড় বড় পা ফেলে বেড়িয়ে গেলো বাড়ি থেকে।ওর দাদিমা বললো,

__খাওয়ার সময় অন্তত ছেলেটাকে এভাবে বলা তোর উচিত হয়নি মির্জা। নিজের রাগ জেদ নিজের কাছে রাখতে শেখো এখন থেকে।ছেলে মেয়েরা বড় হয়েছে। তাদের সামনে নিজেকে আর ছোট করবে না কখনো। তাদের নিজেদের সিদ্ধান্ত নিজেদের নিতে দাও। আশাকরি আমার কথা তোমার বুঝতে অসুবিধা হয় নি।

__কিন্তু আম্মা?

হাত উঁচিয়ে সৈয়দ মির্জাকে থামিয়ে দিলেন তার মা। বললেন,

__সবাই নিজেদের খাবার শেষ করে যার যার কাজে চলে যাও। আমি এখানে দ্বিতীয় বারের মতো এসব বিষয়ে আর কোনো আলোচনা শুনতে চাই না।

সবকিছু নিরব হয়ে গেলো। শুধু খাবার খাওয়ার টুকটাক শব্দ ছাড়া আর কিছুই শোনা গেলো না।সবাই রেডি হয়ে বসে আছে। চন্দ্র যাবেনা বলে মুখ ফুলিয়ে আছে।সবাই অনুনয় বিনয় করে ক্লান্ত হয়ে ফিরে এসে সোফায় বসে আছে মুখে হাত দিয়ে।মিতু এখনো চন্দ্রের পাশে বসে আছে। শেষ বারের মতো বললো,

__চন্দ্র? ভাইয়া যাবে না বলেই কি তুই যাবি না?

__আপু! তোমার ভাইয়ের সাথে আমার কি?ঐ গোমড়া মুখো কোথায় গেলো আর না গেলো তার ধার এই চন্দ্র ধারে না। তুমি আমাকে দুই মিনিট দাও আমি রেডি হয়ে নিচে আসছি।

মিতুর মুখে এবার হাসি ফুটে উঠলো।ও বুঝে গেছে চন্দ্রের উপর প্রয়োগ করার মক্ষোম ঔষুধ কোনটা।সবাই মিলে হেসে খেলে গাড়িতে উঠে পড়লো। চন্দ্র উঠতেই যাবে তার আগেই ঝড়ের বেগে স্পন্দন কোথা থেকে এসে বললো,

__তুই এই গাড়িতে যাবি চন্দ্র। ওখানে ওতো চাপাচাপি করে যেতে হবে না।যা এই গাড়িতে উঠে বস।

__আমি আপনার সাথে যাবো না। আমি এদের সাথেই এসেছি তাই এদের সাথেই যাবো।আর আপনার তো গুরুত্বপূর্ণ কাজ আছে। আপনি আবার সে সব ফেলে আমাদের সাথে যেতে একপায়ে রাজি হলেন কখন?

স্পন্দন চন্দ্রের কথায় কিছু না বলে ধুপধাপ শব্দ করে এগিয়ে এসে চন্দ্রের হাত ধরে নিয়ে ওর গাড়িতে বসিয়ে লক করে দিলো। চন্দ্র এতোটাই অবাক হয়েছে যে কি হলো বুঝার আগেই ড্রাইভারের সিটে স্পন্দন এসে বসে পড়লো।স্পন্দন চন্দ্রকে এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে বললো,

__এমন হাবার মতো না তাকিয়ে সিট বেল্ট বেঁধে নে চন্দ্র।

__কি? আমি হাবা?এই যে শুনুন?

চন্দ্র কথা শেষ করার আগেই স্পন্দন ঝুঁকে এসে চন্দ্রের সিটবেল্ট বেঁধে দিতে লাগল।আর চন্দ্র এক কোণে গুটিয়ে গেলো।স্পন্দনের নিঃশ্বাস চন্দ্রের উপর পড়তেই চন্দ্র চমকে উঠলো।স্পন্দন চন্দ্রকে না ছুঁয়েই সিট বেল্ট বেঁধে দিয়ে নিজের জায়গায় এসে গাড়ি চালাতে শুরু করলো। চন্দ্র নিজের বুকে একটা ফুঁ দিয়ে মনে মনে শ’খানেক বকবকি করলো স্পন্দনকে।স্পন্দন গাড়ি চালাতে চালাতে বললো,

__বকাবকি গুলো সব এক দিনেই শেষ করে ফেললে ভবিষ্যতে কি বলবি চন্দ্র? তখন তো বলার মতো কোনো কথাই খুঁজে পাবি না।

স্পন্দন মুচকি মুচকি হাসছে দেখে চন্দ্র আরো রেগে গেলো।মুখ ফুলিয়ে লুচির মতো করে বসে আছে চন্দ্র।তা দেখে স্পন্দন আবার বললো,

__এমনিতেই খেয়ে খেয়ে কুমড়া পটাস হয়ে গেছিস। এখন যদি এভাবে আরো মুখ ফুলিয়ে থাকিস তো বিশ্বাস কর চন্দ্র তোকে আর চোখে দেখার মতো থাকবে না।

বলেই শব্দ করে হেসে উঠলো স্পন্দন। চন্দ্র সেদিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে মনে মনে ভাবলো,

__এই বদরাগী,নেশাখোর,গোমড়ামুখো তো হাসতেও পারে।কি সুন্দর লাগছে হাসি মুখে দেখতে।তা না সব সময়ই মুখটা কালি করে চোখ রাঙিয়ে ঘুরে বেড়ায়। অদ্ভুত লোক বটে স্পন্দন মির্জা।এতো দিন ধরে তার এতো এতো কথা শুনে ভয়েই অর্ধেক ম’রে গেছি। এখন তো দেখছি এর রূপের শেষ নেই।সকালে এক রূপ তো বিকালে আরেক রূপ আবার রাতে অন্য রূপ।বেডায় কি যাদু টাদু জানে নাকি না কি?আজব তো?

__চন্দ্র খবর দার বলছি আমার দিকে তাকিয়ে থাকবি না এভাবে? এভাবে তাকিয়ে থেকে থেকে তুই দুই চোখ দিয়ে আমাকে চিবিয়ে চিবিয়ে খাচ্ছিস। আমি কিন্তু সব জানি চন্দ্র। ভালো হবে না বলে দিচ্ছি।

চন্দ্র একটু লজ্জা পেয়ে গেলো।চোখ সরিয়ে বাইরে তাকিয়ে দেখতে লাগলো।সবার কেনাকাটা শেষ হয়েছে। এবার ফেরার পালা। চন্দ্রের মনেই শুধু শান্তি নেই।ও ওর পছন্দের ড্রেস নিতে পারেনি স্পন্দনের জন্য।বাধ্য হয়ে স্পন্দনের পছন্দের ড্রেস ই নিতে হয়েছে।এই নিয়ে মুখ ফুলিয়ে আছে চন্দ্র। সামনে তাকাতেই ঝালমুড়ি বিক্রি করতে দেখে চন্দ্র আর এদিকে ওদিকে না তাকিয়ে ছুটতে শুরু করলো।সবাই ওর নাম ধরে ডাকছে তাতে কি?ওর পছন্দের ঝালমুড়ি দেখেই ওর আর মাথা ঠিক নেই। হঠাৎ করেই মনে হলো কেউ ওকে টেনে সরিয়ে আনলো। সামনে তাকিয়ে দেখতেই দেখলো একটা ট্রাক সাঁই করে বেরিয়ে গেলো ওর গা ঘেঁষ।পাশে তাকিয়ে দেখে স্পন্দন একহাতে ওকে ধরে রেখেছে আর চোখ মুখে স্পষ্ট রাগের ছাপ।কিছু বুঝে ওঠার আগেই স্পন্দন ওকে নিয়ে ঝালমুড়ির দোকানে গিয়ে বললো,

__মামা?যত ঝাল তোমার দোকানে আছে সব দিয়ে একটা ঝালমুড়ি বানিয়ে দাও।

চন্দ্র ফাঁকা ঢোক গিলে সবার দিকে অসহায় হয়ে তাকিয়ে রইল।সবাই এমনিতেই ভয়ে আছে। এবার চন্দ্রের অবস্থা বুঝতে পেরে ওরা আরও ভয়ে সেঁধিয়ে গেলো। ঝালমুড়ি ওয়ালা স্পন্দনের কথায় বেশি ঝাল দিয়ে মুড়ি মাখিয়ে দিলো। চন্দ্র তো ভয়ে কেঁদে ফেললো।চোখ দিয়ে টপটপ করে পানি ঝরছে চন্দ্রর। তবুও স্পন্দনের নির্দেশ মতো সবটুকু খেতে হলো।নাক মুখ লাল হয়ে গেছে চন্দ্রর। অসম্ভব জ্বলছে। তবুও কিছু বলছে না।আর না পানি খেতে চেয়েছে ও। তবুও স্পন্দন পানি এগিয়ে দিলো। সেটাও রাগে অভিমানে না নিয়ে গাড়িতে গিয়ে বসলো। সারাটা পথ চুপচাপ বসে থাকলো।স্পন্দন ও আর কিছু বললো না।বাড়িতে পৌঁছে কাউকে কিছু না বলেই হেঁটে রুমে চলে গেলো।গিয়েই বাথরুমে ট্যাপ ছেড়ে নিচে বসে পড়লো। খুব কান্না পাচ্ছে ওর।বুকটা খা খা করছে। এদিকে স্পন্দন ও উপরে যেতেই সবাই থমথমে মুখে জিজ্ঞেস করলো,

__কি হয়েছে রেহান?নিরা বল কিছু।

__বড় আম্মু ভাইয়া না চন্দ্রকে না মানে ভাবীকে জোর করে অনেক ঝাল দিয়ে বানানো ঝালমুড়ি খাইয়েছে।

__তোমার ছেলে আর মানুষ হলো না।দেখেছো ছেলের অবস্থা?আর একটু আগে খুশিতে আটখানা হয়ে বসেছিলে। না কি ছেলে তার বউকে নিয়ে বৌভাতের শপিং করতে গেছে।দেখো দেখো এই তার নমুনা।

__তুই চুপ কর মির্জা। দাদাভাই কোনো কারণ ছাড়াই এমন করেনি।এই তোরা সত্যি করে বল তো ওখানে কি হয়েছে।

সবকিছু শুনে সবাই চুপচাপ বসে থাকলো। মেয়েটার উপর দিয়ে আজকে বড় বিপদ গেছে। তবুও স্পন্দন এমনটা না করলেও পারতো।ঘরে গিয়ে স্পন্দন সোফায় বসে আছে।ওয়াশরুমের থেকে পানির শব্দ আসছে। কিন্তু চন্দ্র এখনো বাইরে কেনো আসছেনা। এবার স্পন্দন উঠে দাঁড়িয়ে পায়চারি করতে লাগলো। টেনশন লাগছে ওর।হয়তো বেশি রিয়াক্ট করে ফেলেছে। তবুও নিজের মনকে গুরুত্ব না দিয়ে চন্দ্রের অপেক্ষা করতে লাগলো। দীর্ঘ সময় পর চন্দ্র বের হলো।চোখ মুখ লাল হয়ে গেছে।হয়তো কেঁদেছে অনেকক্ষণ।সাথে ঝালের ঝাঁঝ তো আছেই। চন্দ্র স্পন্দনের দিকে না তাকিয়ে বিছানায় শুয়ে পড়লো।স্পন্দন কিছু বলতে গিয়েও বললো না।এসি বাড়িয়ে দিয়ে বাইরে চলে গেলো।রাতের খাবার খেতেও চন্দ্র উঠলো না।উঠবে কি করে পানি খেতে খেতে পেট ভরে আছে। খাবার খাবে কিভাবে?

__মা?

__এসেছিস বাবা।বস খেয়ে নে।

__সবাই খেয়েছে?

__হ্যাঁ খেয়েছে। শুধু চন্দ্র খায়নি।ওর নাকি খিদে পায়নি।

__মা ! তুমি বরং এক কাজ করো। আমার আর চন্দ্রের খাবার দিয়ে দাও। উপরে বসে খেয়ে নিবো।

ওর মা খুশি হয়ে গেলেন। দুজনের খাবার স্পন্দনের হাতে দিয়ে উনি খুশিমনে চলে গেলেন।

__চন্দ্র?উঠে বস। খাবার খেতে হবে।

চন্দ্র কোনো উত্তর দিলো না।স্পন্দন আবার বললো,

__তোকে উঠতে বলেছি চন্দ্র।

__আমি খাবো না।

স্পন্দন টেনে তুলে বসিয়ে দিলো চন্দ্রকে। তারপর মুখে খাবার ঢুকিয়ে দিলো। দুই তিন গাল খেয়ে চন্দ্র আবার পানি খেয়ে বললো,

__প্লিজ আর খেতে পারবো না।

স্পন্দন ও আর কিছু বললো না। খাবার একটু খেয়ে সোফায় গিয়ে শুয়ে পড়লো।মাঝ রাতে মনে হচ্ছে চন্দ্র কাঁদছে। ছটফট করছে।স্পন্দন উঠে এলো সোফা থেকে।দেখলো চন্দ্র এদিকে ওদিকে ছটফট করছে আর কাঁদছে।

#চলবে,,,,,,,

ভুল ত্রুটি মার্জনীয়। লেখিকার লেখা ভালো লাগলে লাইক কমেন্ট করে সাথে থাকবেন। ধন্যবাদ সবাইকে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here