অন্তর দহন পর্ব ২

0
679

#অন্তর_দহন
#লেখনিতে_আরুহি_অহি

পর্ব __২

__স্পন্দন?

মায়ের কন্ঠ শুনে থেমে গেলো স্পন্দন। পেছনে না ফিরে বরং নিরব হয়েই রইলো।

__ঘরে চল স্পন্দন।নিচে চন্দ্র অপেক্ষা করছে তোর জন্য।

__স্পন্দনের জন্য কেউ অপেক্ষা করে না মা।

__এভাবে বলিস না বাবা। বাচ্চা মেয়ে এসব নিতে পারবে না। অন্ততঃ তোর বাবা মায়ের দিকে তাকিয়ে হলেও চন্দ্রকে মেনে নে বাবা।

__তোমাদের মুখের দিকে তাকিয়ে দেখতে গিয়ে স্পন্দন আজ শূণ্য মা। চন্দ্রকে দেওয়ার মতো আমার কাছে আর কিছুই অবশিষ্ট নেই মা।

__স্পন্দন?

__কাঁদছো কেনো মা? আমার জন্য কারো চোখে পানি পড়ে না। তোমার চোখে কেনো পড়ছে তবে?

__আমি তোর মা স্পন্দন। আমার চোখে ছেলের জন্য পানি পড়বেই বাবা।নিচে চল তুই।

__এমনটা কেনো করলে মা?

__তোর ভালোর জন্য করেছি বাবা।

গগন কাঁপিয়ে হেসে উঠলো স্পন্দন। একসময় হাঁটু গেড়ে বসে মায়ের পা দুটো জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কাঁদতে কাঁদতে বললো,

__আমি যে ঝড়ে উপড়ে পরা একটা বৃক্ষ মা। আমার দেহে শ্বাস চলছে তবে আমি অন্তর দহনে মৃতপ্রায়।এই বৃক্ষের বুকে কেনো ফুল ফোটাতে চাইছো তোমরা? আমাকে মুক্তি দাও মা। আমি আর সহ্য করতে পারছি না।

__আমরা তোর ভালো চেয়েছি বাবা।

__তাই বলে নিজের ছেলের ভালো চাইতে গিয়ে ঐ বাচ্চা মেয়েটার জীবন কেনো নরক বানিয়ে দিলে মা?

__কিচ্ছু শেষ হয়নি বাবা। নতুন করে আবার শুরু কর।দেখবি সময়ের সাথে সাথে সব ঠিক হয়ে যাবে।

__তুমিও মা? শেষ পর্যন্ত নিজের স্বার্থে আরেকটা জীবন নষ্ট করে বলছো সব ঠিক হয়ে যাবে। কিভাবে হতে পারলে এতটা স্বার্থপর?

__আজ তোর আমাদের স্বার্থপর মনে হচ্ছে স্পন্দন। কিন্তু একদিন দেখবি তোর বাবা_মায়ের এই স্বার্থপরতার জন্য তুই শুকরিয়া আদায় করবি।

__আমি চাইনা এমন কাজের জন্য কারো শুকরিয়া আদায় করতে।তোমরা ভুল করেছো মা। আমার নষ্ট জীবনের সাথে চন্দ্রের জীবন মিলিয়ে দিয়ে অনেক বড় ভুল করেছো মা। তোমাদের চোখের সামনে আগে একটা জীবন ধুঁকে ধুঁকে ম’রে যাচ্ছিলো। এবার দু’টো জীবন ম’রে যেতে দেখবা।

__বড় মামানি?

মিতুর গলা শুনে স্পন্দন চোখ মুছে উঠে দাঁড়িয়ে পড়লো।

__কি হয়েছে মিতু মা?

__মামু ডাকছে তোমায়। ভাইয়া তোমাকে ও ডাকছে।

স্পন্দন বড় বড় পা ফেলে নিচে নেমে গেলো। পেছনে চোখ মুছতে মুছতে ওর মা ও নেমে গেলো।মিতু সেদিকে তাকিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে নিচে নামার জন্য পা বাড়ালো।

__আমাকে ডেকেছেন?

__ভেতরে এসো স্পন্দন। আমি জানি তোমার এই বিয়েতে কোনো মত ছিল না। আমি তোমাকে বাধ্য করেছি বিয়ে করতে। এখন আমিই চাইছি তুমি চন্দ্রকে মেনে নিয়ে সুখী হও।

__আপনার কথা শেষ হয়েছে?

__আমার সাথে এভাবে কথা বলবে না স্পন্দন।আসতে পারো তুমি এখন।

মায়ের দিকে একবার তাকিয়ে কান্না নিয়ে এলোমেলো বিধ্বস্ত পায়ে বেড়িয়ে এলো স্পন্দন।

ঘরের দরজায় আসতেই দেখে ভাই-বোন গুলো সব কাচুমাচু করে দাঁড়িয়ে আছে।স্পন্দনকে দেখে ভয়ে জড়সড় হয়ে আছে।কেউ কিছু বলার সাহস করতে পারছেনা। এরমধ্যে থেকে সবার বড় রেহানকে সবাই চিমটি কেটে কিছু বলতে বলছে।রেহান ভয় কাটিয়ে বললো,

__ভাইয়া তোমার ভেতরে যাওয়া নিষেধ।

__কে হুকুম জারি করেছে রেহান?

__না মানে ইয়ে মানে ভাইয়া দিপ্ত আর রাতুল বলেছে।

দিপ্ত আর রাতুল নিজেদের নাম শুনেই চেঁচিয়ে উঠলো।বললো,

__রেহান ভাইয়া? তুমি একা আমাদের উপর দোষ দিয়ে দিতে পারো না। আমাদের সাথে তুমি ও ছিলে। সেকথা বলো স্পন্দন ভাইয়াকে।

__কিরে রেহান? খুব সাহস বেড়ে গেছে মনে হয়।কানের নিচে একটা পড়লে সব সাহস জানালা দিয়ে পালিয়ে যাবে।

__দেখো ভাইয়া তুমি ভয় দেখিয়ে আমাদের এভাবে বলতে পারো না।কিরে মিতু নিরা সিঁথি তোরা এমন হাবার মতো দাঁড়িয়ে না থেকে কিছু বল।

__ভাইয়া ঐ তো রেহান ভাইয়া দিপ্ত ভাইয়া আর রাতুল ভাইয়া আমাদের জোর করে এখানে আসতে বাধ্য করেছে।আমরা আসলেই কিছু জানিনা।

__অনেক হয়েছে তোদের একজনের আরেকজনের উপর দোষ দিয়ে পাশ কাটিয়ে যাওয়া। এখন আমার সামনে থেকে সরে দাঁড়ানোর জন্য কি তোদের হাতে কলমে দেখাতে হবে নাকি মুখে বললেই সরে যাবি এখান থেকে।

__আরে ভাইয়া রেগে যাচ্ছো কেনো? তোমার ঘর তোমার বউ।আমরা তো শুধু এখন পাড়া প্রতিবেশী।তাইনা রাতুল।

__ঠিক ঠিক না মানে ঠিকই বলেছিস রেহান ভাই।

__দেখ এমনিতেই মাথা গরম হয়ে আছে।আর তার মধ্যে তোরা এমন করলে কি করতে কি করে বসবো তার ঠিক নেই। ভালো মতো বলছি পথ ছেড়ে দাঁড়া। আমাকে রুমে যেতে দে।

__এতো তাড়া কিসের ভাইয়া। চন্দ্র না মানে ভাবির সাথে তো সারা রাত ধরে কথা বলতে পারবা।তার আগে আমাদের পাওনা মিটিয়ে দেও। আমরাও গিয়ে ঘুমিয়ে পড়ি। সারাদিন এতো ধকল কাটিয়ে এসে আবার তোমার বাসর সাজিয়ে দিলাম। আমাদের তো আর কম কষ্ট করতে হয়নি, তাইনা?

__কিসের পাওনা তোদের? আমার ঘরে আমি যাবো তাতে তোদের টাকা দিয়ে আমাকে যেতে হবে কেনো?

__আরে আমরা কষ্ট করে সাজিয়ে দিলাম। আমাদের পরিশ্রম হয়েছে না?কি যে বলো না তুমি ভাইয়া?

__আমি করতে বলেছি? আমার তো মনে পড়ে না এমন কোনো কথা তোদের বলেছি বলে।

__তুমি বলবে কেনো? নিজের বাসর সাজিয়ে দিতে বলবা একটু লজ্জা করবে না?তাইতো আমরাই সাজিয়ে দিলাম।

__নিজে থেকে সাজিয়ে দিয়েছিস। এখন নিজের থেকে বিদায় হ।না হলে স্পন্দন কি করতে পারে তা তোদের থেকে ভালো কেউ জানে না।

__তুমি আমাদের মতো নিরীহ বাচ্চা বাচ্চা ছেলেমেয়েদের সাথে এমন ব্যবহার করতে পারবা ভাইয়া?

__কে নিরীহ?

__এই যে আমরা!

__তোরা নিরীহ? তোদের মতো একেকটা যদি একটা বাড়িতে থাকে তাহলে সেই বাড়ি আর বাড়ি থাকবে না পাগলা গারদ হয়ে যাবে।আর সেখানে তোরা নিজেদের নিরীহ বলিস? লজ্জা হওয়া দরকার তোদের।

__দেখো ভাইয়া তুমি কিন্তু আমাদের অপমান করছো।

__মান অপমান বোধ আদৌ আছে তোদের?থাকলে এতো সময় নষ্ট না করে আরো আগেই সরে যেতি এখান থেকে।

__তার মানে তুমি টাকা দিবা না?

__না।

__এই চল সবাই বাসর ঘরটা আমরা এমনি এমনি সাজিয়ে দিয়েছি ভাইয়াকে। ভাইয়া এতো গরিব মানুষ জানা ছিলো না।জানলে আরো কিছু টাকা খরচা করে ভাইয়াকে গিফট ও কিনে দিতাম।

__এই দাঁড়া?

সবাই খুশিতে আত্মহারা হয়ে ফিরে দাঁড়াতেই স্পন্দন বললো,

__কোথায় যাচ্ছিস?

__তুমিই তো বললা চলে যেতে।

__হ্যাঁ বলেছি।তবে এখনো নয়। আগে আমার ঘর যেমন ছিল তেমনি করে দিবি তারপর যাবি।

__মানে?

__মানে হলো আমার ঘরে যা যা আছে সব বাইরে রেখে তবেই যাবি।

সবাই অসহায় চোখে একে অপরের দিকে তাকিয়ে দেখে এক পা দু’পা করে দৌড়ে পালিয়ে গেলঝ।স্পন্দন পেছনে পেছনে ডাকলেও কেউ ফিরলো না।একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে রুমের দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকলো স্পন্দন।দেখে বিছানায় গুটিসুটি মেরে বসে আছে চন্দ্র।এক পলক তাকিয়ে চোখ সরিয়ে নিলো স্পন্দন।ড্রয়ারের ওপর থেকে সিগারেট আর দেয়াশলাই নিয়ে বড় বড় পা ফেলে বেলকনিতে চলে গেলো। চন্দ্র এতো সময় দম আটকে বসে ছিলো ভয়ে।স্পন্দন যেতেই ফোঁস করে একটা নিঃশ্বাস ফেলে আড়চোখে বেলকনিতে তাকালো। এরপর আবার আগের মতো করে বসে রইল। এদিকে সারাদিন এতো ধকল গেছে যে ও আর বসে থাকতে পারছে না। ঘুম ঘুম চোখে ঝিমাচ্ছে। হঠাৎ করেই একটা বিকট শব্দে তড়িঘড়ি করে উঠে বসে সামনে তাকিয়ে দেখে স্পন্দন রাগী চোখে তাকিয়ে আছে ওর দিকে।কিছু বুঝে উঠার আগেই স্পন্দন এগিয়ে এসে ওকে বিছানা থেকে নামিয়ে দিলো। এরপর সব ফুল টেনেটুনে ছিঁড়ে ফেলতে লাগলো। চন্দ্র ভয়ে থরথর করে কাঁপছে।গলা শুকিয়ে আসছে ওর।কান্না পাচ্ছে খুব। এমন একটা মানুষের সাথে জেনেশুনে আব্বু আমার বিয়ে কিভাবে দিতে পারলো। আব্বু আমাকে ভালোবাসে না।মনে মনে বলেই চোখ দিয়ে পানি ছেড়ে দিলো চন্দ্র।ফুল সব ছিঁড়ে বিছানার বেডশিট সহ ডাস্টবিন বক্সে ফেলে দিয়ে সোফায় গিয়ে বসলো।মাথার চুল গুলো টেনে পেছনে নিয়ে বললো,

__চন্দ্র?

চন্দ্র কথা বলার অবস্থায় নেই।ভয়ে জড়সড় হয়ে এখনো চোখের পানি ফেলে চলেছে।

__আমি তোকে বউ বলে মানিনা চন্দ্র।তোকে বাবা মা এই বাড়িতে এনেছেন। তাদের কাছে গিয়ে থাকবি । আর ভুলেও আমার আসেপাশে আসার চেষ্টা করবি না তুই।

চন্দ্র এখনো চুপ।এতো সময় যে ঘুম ঘুম পাচ্ছিল তা উবে গেছে অনেক আগেই। এখন শুধু বুকটা ভেঙে কাঁদতে ইচ্ছে করছে চন্দ্রের।

__একদম চোখের পানি ফেলবি না চন্দ্র। আমি মেয়েদের চোখের পানি সহ্য করতে পারিনা তা তুই ভালো করেই জানিস। এখন যা এই ঘর থেকে। আমার চোখের সামনে আর আসবি না।

__কো কোথায় যাবো?

__জাহান্নামে যাবি। কিন্তু আমার চোখের সামনে একটুও নয়। বেড়িয়ে যা চন্দ্র।

__আ আমি যাবো না কোথাও।

স্পন্দন এবার চন্দ্রের দিকে তাকিয়ে বললো,

__তুই বড় বেশি ভুল করেছিস চন্দ্র।এই বিয়েটা করে তুই অনেক বড় ভুল করেছিস।

চন্দ্র ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছে ফ্লোরে। ভুল তো ও করেনি।ওকে বাধ্য করা হয়েছে করতে।সেটা কি স্পন্দন জানে না?

#চলবে,,,,,,,

ভুল ত্রুটি মার্জনীয়। লেখিকার লেখা ভালো লাগলে পাশে থাকবেন। লাইক কমেন্ট করবেন।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here