অন্তর্লীন প্রণয় পর্ব ৩

0
597

#অন্তর্লীন_প্রণয়
#সাদিয়া_মেহরুজ_দোলা
|পর্ব-০৩|

আয়ন্তিকার জ্ঞান আসে বিকেল ৫ টার দিকে। চিনচিন মাথা ব্যাথা নিয়ে সে যখন প্রথম চোখ খুললো ঠিক তখনই তার ডান পাশে দৃশ্যমান হয় অহর্নিশ কে! কেমন উদ্ভ্রান্তের ন্যায় বসে ছিলো তার এক হাত আঁকড়ে ধরে। চোখদুটো ছিলো রক্ত জবার মতো লাল। সকালে ফিটফাট গড়নের মানুষটার এখন বর্তমান অবস্থা নাজেহাল!

আয়ন্তিকা তখন সবকিছু ভুলে গোলগাল চোখে তাকিয়ে ছিলো অহর্নিশের দিকে। অতঃপর বিষ্ময় নিয়ে সে বলল,

-‘ আপনি ঠিক আছেন? ‘

অহর্নিশ নড়েচড়ে উঠলো। এতক্ষণ স্ট্যাচুর ন্যায় মাথা নিচু করে নতজানু হয়ে বসে ছিলো। হাতটা ছেড়ে দেয় আয়ন্তিকার! উঠে দাঁড়িয়ে পড়ে। পরিশেষে গম্ভীর কন্ঠে বলল,

-‘ আমি অলওয়েজ ঠিক থাকি! বাট তোমার কি হয়েছিলো?চিৎকার দিয়ে সেন্সলেস হলে কিভাবে?কি দেখে ভয় পেয়েছিলে? ‘

অহর্নিশের কন্ঠস্বর শক্ত। রেগে আছে কি কোনো কারণে? উঠে দাঁড়ানোর পর আর একবারও ফিরে তাকায়নি সে আয়ন্তিকার দিকে। অন্য দিকে দৃষ্টিপাত স্থাপন করে কথা বলল।

আয়ন্তিকা কিছু সময়ের আগের কথা মনে করার প্রয়াস চালায়। সে যখন ওয়াশরুম থেকে বের হলো তখন তার সামনে ছিলো রক্ত। শুভ্র রঙের ফ্লোরে ছড়িয়ে থাকা রক্ত এক নির্দিষ্ট জায়গা নিয়ে। রক্তে ভয়াবহ ফোবিয়া আছে তার। লাল রাঙা রক্ত দেখলে নিজেকে ঠিক রাখতে পারেনা। হয় বমি করে নাজেহাল অবস্থা বানাবে নতুবা সেন্সলেস হয়ে যাবে। আয়ন্তিকা নিজের চোখজোড়া বন্ধ করে! অস্ফুটস্বরে সে বলল,

-‘ র..রক্ত ও..ওখানে। ফ্লোরে! ‘

অহর্নিশ ঘাড় বাকায় ভীতি কন্ঠফালির আওয়াজ শুনে। আয়ন্তিকার একটুখানি হওয়া মুখ দেখে সে ভড়কে যায়! রক্ত? ফ্লোরে তাকাতে সে হতভম্ব হয়।পরবর্তীতে রাগের বসে নিজেকে শ’খানেক গালি দেয় মন গহ্বরে। আয়ন্তির দিকে দৃষ্টিপাত দিয়ে খানিক এগোয়! নরম কন্ঠে সে বলল,

-‘ আয়ন্তিকা লুক এট মি! ‘

……..
আয়ন্তিকা তাকায় না। চোখ বন্ধ করে শক্ত হয়ে বসে আছে। থরথর করে কাঁপুনি দিচ্ছে! রক্তের কথা মনে পড়লেই তার খিঁচুনি উঠে।

-‘ আয়ন্তিকা আমি কি বলেছি শুনতে পাচ্ছো না তুমি? লুক এট মি ষ্টুপিড! ‘

অহর্নিশ আয়ন্তিকার দুই বাহু স্পর্শ করে। তড়িৎ বেগে বদ্ধ চোখজোড়া খুলে নেয় আয়ন্তিকা। অহর্নিশের ধমক শুনে সে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছে। এই ভয়ংকর মানবের মনে কি একটুও মায়া দয়া নেই? এইতো আয়ন্তি অসুস্থ হলো। ভয় পাচ্ছে, কই একটু শান্ত কন্ঠে কথা বলবে তা না, সে আয়ন্তি কে ধমক দিচ্ছে! অসভ্য লোক! মনে মনে আওড়ায় কথাগুলো আয়ন্তিকা!

ভীতিগ্রস্ত আয়ন্তিকা কে ভাবনার সাগরে ডুবে যেতে দেখে রাগ টগবগে করে বেড়ে যায়। অহর্নিশের এই এক দোষ! কেও তার কথা না শুনলে, বেখেয়ালি হলে তখন সে রেগে যায় বড্ড!

দুই বাহু ছেড়ে আয়ন্তিকার তুলতুলে হাত মুঠো করে ধরে। তাৎক্ষণিকভাবে অহর্নিশ কোলে তুলে নেয় আয়ন্তিকা কে। হতবাক আয়ন্তি! চোখজোড়া গোল গোল করে তাকিয়ে আছে সে। অহর্নিশ তাকে খাট থেকে নামিয়ে সামনে আগাতেই শুরু হয় তার ছটফটানি।গলা কাটা মুরগীর মতো ছটফট করতে করতে সে বলল,

-‘ কোলে নিচ্ছেন কেনো? কই নিয়ে যাচ্ছেন? আপনি কি আমায় মেরে ফেলবেন? ‘

অহর্নিশ বিরক্তিতে ‘চ ‘ শব্দটা উচ্চারিত করে। বারংবার আয়ন্তিকা কেনো মরার কথাটা টেনে তুলে আনে তা সে ভেবে পায়না। অহর্নিশ কঠিন কন্ঠে বলল,

-‘ কথার মাঝে অল টাইম মেরে ফেলার কথা টেনে আনো কেনো আয়ন্তিকা? আমায় কি তোমার সাইলেন্ট কিলার মনে হয়? ‘

-‘ সাইলেন্ট কিলার কিনা জানিনা তবে আপনি যে গুন্ডা, মাস্তান, মাফিয়া টাইপ লোক হবেন তা আমি নিশ্চিত অহর্নিশ ভাই! ‘

বিড়বিড় করে বলল আয়ন্তিকা। অতি নিম্ন কন্ঠে। এতোটা নিম্নস্বর অহর্নিশের কান পর্যন্ত পৌঁছায় নেই। তাই সে প্রশ্ন করলো,

-‘ কি বললে? ‘
-‘ কিছু না। আপনি আমায় নামিয়ে দিন। ‘
-‘ সময় হলে দিবো! ‘
-‘ কোলে তুলেছেন কেনো? ‘
-‘সামনে তাকাও।’

অহর্নিশের বলা কথ্যতে আয়ন্তিকা সামনে দৃষ্টিপাত দেয়। সঙ্গে সঙ্গে আবার সেই উচ্চস্বর! চিৎকার দেয় সে। হিতাহিত জ্ঞান ফেলে, সব ভাবনা ভুলে নিয়ে সে আঁকড়ে ধরে অহর্নিশের কাঁধ। মুখ গুঁজে দেয় তার গলায়। হুঁশে থাকলে হয়তো এই কর্মটি করার সে চিন্তা পর্যন্ত করতো না। অহর্নিশ দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে! সামনে দৃষ্টি দেয়। শুভ্র ফ্লোরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে লাল রঙ! তার রঙের টিউব হতে ভুলবশত পড়ে গিয়েছে। এটাকেই রক্ত ভেবে সেন্সলেস হয়ে বসে আছে আয়ন্তিকা! ভাবতেই অদ্ভুত লাগে।

অহর্নিশ কঠিন কন্ঠে বলল,

-‘ দেখো আয়ন্তিকা, তুমি যেটাকে রক্ত ভাবছো ঐটা রক্ত নয় রঙ! লাল রঙ! পেইন্টিং করার জন্য এ রুম থেকে নেয়ার সময় ভুলবশত রঙের টিউব থেকে পড়ে গিয়েছে একটুখানি লাল রঙ! আর তুমি…ষ্টুপিড গার্ল।রক্ত ভেবে সেন্সলেস হয়ে গিয়েছো।ডিজগাস্টিং! ‘

সঙ্গে সঙ্গে আয়ন্তিকা কে নিজের কোল থেকে নামিয়ে দিয়ে রুম থেকে বের হয়ে চলে যায় অহর্নিশ। আয়ন্তিকার বোকা বোকা চাহনি! লজ্জায় মাথা নুইয়ে নিলো সে। ছিহ্! সামান্য রঙ কে রক্ত ভেবে কতবড় কাহিনি ঘটিয়ে ফেললো। শেষে কিনা সেন্সলেস হলো? তবে এতে তার কি দোষ? লাল রঙটাকে পুরোপুরি রক্তের মতোই লাগছিলো।

__________________________

সন্ধ্যার ঢল শেষ হয়েছে ক্ষনিক আগে। এখন আধার বিরাজমান চারিদিকে। কালো কুচকুচে আঁধারের মাঝে আজ পূর্ণিমার দেখা মিলেছে। পূর্ণ রূপে এর ফলে চারিদিক অন্ধকার নয়। স্বচ্ছ আলোয় পরিপূর্ণ এক মধুর দৃশ্যের আবির্ভাব!

আয়ন্তিকা বেলকনিতে দাঁড়িয়ে চাঁদ দেখছিলো। বাবা মার কথা বড্ড মনে পড়ছে! পুরো সন্ধ্যাটা সে একা কাটিয়েছে। অহর্নিশ বাহিরে ছিলো। একটু আগেই ফিরেছে। এসেই হন্তদন্ত হয়ে ঢুকে পড়েছে ওয়াশরুমে। কেমন অবিন্যস্ত লাগছিলো তাকে দেখে। আয়ন্তিকা কিছু জিজ্ঞেস করতে নিবে সেই সুযোগটা অহর্নিশ দেয়নি!

কাঁচ জাতীয় কিছু ভেঙ্গে যাওয়ার শব্দে আয়ন্তিকা বাহির থেকে নিজের দৃষ্টিপাত সরিয়ে নেয়। কৌতূহলি ভাব নিয়ে পা বাড়ায় সামনের দিকে।শব্দ টা অহর্নিশের রুম থেকে এসেছে। তার এবং অহর্নিশের রুম আলাদা। পাশের রুমটাই অহর্নিশের,
নিজ রুম থেকে বের হয়ে সে অহর্নিশের রুমে উঁকি দেয়। দরজা হালকা চাপানো। ফাঁক দিয়ে ভেতরে দেখতে নিলে ভুলবশত তার একহাত দরজায় লেগে যায়, যার দরুণ দরজা খুলে যায় পুরোপুরি।

আয়ন্তিকার দৃষ্টিপান স্তব্ধতা ধারণ করে। অহর্নিশের দিকে সে প্রশ্নাত্মক চাহনি নিয়ে তাকিয়ে আছে। টি টেবিলে রাখা সেই চির – পরিচিত রিভলবার! অহর্নিশ হাতে তুলো নিয়ে দাঁড়িয়ে নিজের পিঠের আঘাতগুলো ড্রেসিং করার প্রয়াস চালাচ্ছে। কিন্তু পিঠের মধ্যিখানটায় আঘাত হওয়াতে হাত অতো দূর অব্দি পৌঁছাচ্ছে না। ক্ষতগুলো খুব গভীর মনে হলো আয়ন্তিকার, একটু শিউরে উঠলো সে।

-‘ তুমি এখানে?’

আয়ন্তিকা অহর্নিশের পিঠ হতে দৃষ্টি সরিয়ে নিয়ে তার চোখের দিকে তাকায়। ড্রেসিং টেবিলের আয়না দিয়ে অহর্নিশ চেয়ে আছে তার পানে! ব্যাথাতুর ভাব টা তার মুখশ্রীতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। ভ্রু যুগল কুঁচকানো! অহর্নিশের চেহারায় ভড়কানো ভাবটা নেই। কিন্তু এই মূর্হতে তার চেহারাতে এই আভাস টা প্রকাশ পাওয়া দরকার ছিলো।

আয়ন্তিকা লজ্জা ফেলে নতজানু হয়ে রুমে প্রবেশ করে। অহর্নিশ শার্টলেস! গায়ে তার ছিটেফোঁটা পোশাক নেই। তবে সে ট্রাউজার পড়ে আছে।অহর্নিশ ফের বলল,

-‘ এখানে এসেছো কেনো?’

আয়ন্তিকা মাথা উঁচু করে ফিচেল কন্ঠে বলল,

-‘ পিঠে আঘাত পেয়েছেন কিভাবে? আর এসব কি?’
রিভলবার দেখিয়ে আয়ন্তিকা প্রশ্ন করলো।

অহর্নিশ হাতের স্যাভলন মিশ্রিত তুলোটা পাশে রেখে দেয়। তার চোখমুখ নীলচে আকার ধারণ করেছে। এলোমেলো পায়ে এগিয়ে আসে হুট করে সে আষ্টেপৃষ্টে আগলে নেয় আয়ন্তিকা কে। নিজের উষ্ণ আলিঙ্গনে আবদ্ধ করে নেয় অহর্নিশ আয়ন্তি কে। মুখ দিয়ে অস্ফুটস্বরে তার আর্তনাদ ভরা শব্দস্বম বের হচ্ছে।

আয়ন্তিকা স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে। নড়াচড়া করার শক্তিটা বোধহয় লোপ পেয়ে গিয়েছে। এবার সে লজ্জা পাচ্ছে না। বরঞ্চ কষ্ট পাচ্ছে! অহর্নিশের আর্তনাদ তার কানে ভেসে আসতেই তার কেমন দম আটকে আসছে।
আয়ন্তিকা তার ডান হাত আলত করে রাখে অহর্নিশের উন্মুক্তমান পিঠে! ধীর কন্ঠে সে বলল,

-‘ আপনি ঠিক আছেন? ‘
-‘উঁহু ঠিক নেই আমি। একটুও না! আমার মেডিসিন প্রয়োজন। কষ্ট হচ্ছে! ‘
সঙ্গে সঙ্গে প্রতুত্তর করে অহর্নিশ।

অহর্নিশ তার সর্বভর ছেড়ে দিয়েছিলো আয়ন্তিকার ওপর। এই বিশাল দেহের মানুষটার ভর নিতে না পেরে দু – কদম পিছিয়ে যায় আয়ন্তি। জ্বর এসেছে অহর্নিশের। ফর্সা শরীর ছোপ ছোপ রক্তিম দাগে আবর্তিত হয়েছে। অহর্নিশের বর্তমান ব্যাবহারের জন্য আয়ন্তিকা জ্বরকে দায়ী ভাবলো।

আয়ন্তিকা ব্যাকুল কন্ঠে বলল,

-‘ আপনি একটু বেডে বসুন প্লিজ। ‘

অহর্নিশ তার হালকা দাঁড়ির আস্তরণ দিয়ে হালকা ভাবে স্পর্শ করায় আয়ন্তির ঘাড়। ব্যাথায় কুঁকড়ে উঠলেও শক্ত থাকে আয়ন্তিকা। অহর্নিশ বলল,

-‘ উঁহু, তুমি চলে যাবে তাহলে। ‘
-‘ যাবোনা সত্যি বলছি। আপনি একটু বসুন। ‘

অহর্নিশ কে বেডে বসিয়ে দিয়ে আয়ন্তিকা ক্ষ্যান্ত হয়! জ্বরাক্রান্ত শরীর নিয়ে বেশিক্ষণ বসে থাকতে পারেনা অহর্নিশ। কোমল রূপে আস্তেধীরে সে শুয়ে পড়লো। কিন্তু সে আয়ন্তিকা কে ছাড়েনি। আয়ন্তির ওড়নার এক অংশ আঁকড়ে ধরে উপুর হয়ে শুয়ে পড়ে।

আয়ন্তিকার দৃষ্টিপাত এবার অহর্নিশের পিঠের ক্ষত গুলোর দিকে। ক্ষতগুলো আসলেই গভীর। মনে হচ্ছে কেও খুব সজোরে আঘাত করেছে পিঠে! ইশ!কি অবস্থা। লোমকূপ দাঁড়িয়ে যায় তার? কিন্তু অহর্নিশের এই অবস্থা হলো কি করে? আয়ন্তিকা সর্বপ্রথম পাশে রাখা তুলো হাতে নিয়ে তাতে কিছুটা স্যাভলন নিয়ে নেয়। ক্ষততে আস্তেধীরে লাগিয়ে দিতে থাকে। অদ্ভুত হলেও সত্যি তার এখন কোনোরূপ জরতা কাজ করছে না। ওর সমস্ত ধ্যান এখন অহর্নিশের ক্ষতের দিকে। বিন্দু খানেক কষ্ট অনুভূত হচ্ছে।

অহর্নিশ বড্ড অবাক হয় আয়ন্তিকার স্পর্শে। জ্বর হলেও সজাগ সে! এতটুকু সামান্য জ্বর তাকে কাবু করার মতো অধিকার নেয়নি। ভীতু আয়ন্তির স্পর্শ অহর্নিশ ঠিক হজম করতে পারছে না।এমনিতে তো একশো হাত দূরে থাকে। তবে আজ?

আয়ন্তিকা সাহস জুগিয়ে বলল,

-‘ আপনি কি কোনো গুন্ডা, মাস্তান অহর্নিশ ভাই?রিভলবার কেনো আপনার কাছে? এই আঘাত কিভাবে পেলেন?’

অহর্নিশ জাগ্রত ছিলো। এই প্রশ্নটায় সে চমকালো। দৃষ্টি বাকিয়ে সে সোফার দিকে তাকাতেই দেখে রিভলবার। মুখ দিয়ে অস্ফুটস্বরে বলল, ‘উফ..শিট!’
চোখ বন্ধ করে নিলো সে। এতোটা কেয়ারলেস কিভাবে হলো অহর্নিশ?
আয়ন্তিকার চিন্তা ভাবনায় নিজের ভেতরে লুকিয়ে রাখা কথাটা সে বুঝি এবার আর গুপ্ত করতে পারবে না। দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছেড়ে সে বলল,

-‘ আমি কোনো গুন্ডা, মাস্তান না আয়ন্তিকা। আমি পলিটিক্স করি! ‘

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here